গোলাম মোর্তোজা
চারিদিকে ‘উন্নয়ন’র নানা গল্প! দৃশ্যমান প্রমাণ পদ্মা সেতু, দু’তিনটি চার লেনের রাস্তা, কয়েকটি ফ্লাইওভার। মানুষ ভালো আছে, আয় বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও কিনতে মানুষের সমস্যা হচ্ছে না! বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার হয়েছে, বিচার হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! বেশকিছু উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা বেড়েছে।
ক্ষমতাসীনদের মুখ থেকে একথা প্রতিদিন কয়েকবার শোনা যায়। তারা টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, বলেন রাজনৈতিক সমাবেশে। টেলিভিশনের টকশোতেও শোনা যায় প্রতিরাতে।
এই কথাগুলো যে পুরোপুরি অসত্য, তা তো নয়। আবার বাস্তবতা যদি এমন হয়, তাহলে দেশের মানুষের তো খুশি থাকার কথা। যদি বলি যে দেশের মানুষ খুশি বা ভালো নেই, তীব্র প্রতিবাদ হবে এ কথার। যুক্তি দেওয়া হবে পাল্টা যুক্তিও দেওয়া যাবে। সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। সাধারণ মানুষের কথা যদি একটু কান পেতে শোনা যায়, তবে ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এর কারণ কী? মানুষ কী যত পায়, তত চায়? না কি ‘ভালো আছে’ বলতে যা বোঝানো হয়, তার ভেতরে ত্রুটি বা দুর্বলতা আছে? সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে দেখি।
১. আলোচনার শুরুতেই সরকারি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের ‘খানা আয় ব্যয় জরিপ’র প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় গড়ে বেড়েছে ৩২ হাজার ৪৪১ টাকা। আর সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় গড়ে কমেছে ১০৫৮ টাকা।
এই গরিব মানুষ মানে দিনমজুর শ্রেণি। ক্ষমতাসীনরা সর্বত্র বলেন, শ্রমের মজুরি বেড়েছে, ১৫০ টাকার মজুরি ৪০০ টাকা হয়েছে। মানুষ ভালো আছে, গরিব মানুষ বেশি ভালো আছে। তাই যদি হয় তাহলে সরকারি হিসাবে ৫ শতাংশ গরিব মানুষের আয় কমে গেল কেন? এই জরিপ তো বেসামরিক কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান করেনি। তার মানে মানুষের ভালো থাকার যে গল্প করা হচ্ছে, তা আসলে পুরোপুরি সত্যি নয়। গল্পের ভেতরে বড় রকমের সমস্যা আছে।
২. ঢাকা শহরের রাস্তায় নামেন। যে কোনো একজন মানুষের কাছে জানতে চান, কেমন আছেন? প্রায় ৯৯ ভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যায় বলবেন, ভালো নেই?
বলতেই পারেন এটা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ মানুষ অধিকাংশ ‘ভালো নেই’ বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু ‘ভালো থেকে’ও ভালো নেই বলবে, এতটা সরলিকরণ নয় বিষয়টি।
৪৭ বছরের বাংলাদেশে রাজধানীর মানুষের জন্যেও গণপরিবহন নেই। মানুষ কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবে, কোনো সরকার তা ভাবল না। একদিকে সাধারণ মানুষের পরিবহন নেই, অন্যদিকে যানজট এমন একটা অবস্থায় পৌঁছালো যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকতে হয় সব মানুষকে।
একথার সঙ্গে সঙ্গেই বলা হবে, যানজট একদিনে তৈরি হয়নি। সমাধানও একদিনে হবে না। কাজ চলছে, সমাধান হবে।
৩. কাজ বলতে, নগর ঢাকায় ফ্লাইওভার তৈরি হলেই, যানজট সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ফ্লাইওভার বেশ কয়েকটি তৈরি হলো। ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার সমাধান হলো না।
ফ্লাইওভারের ফলে এক জায়গার যানজট আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হলো।
তারপর বলা হলো, মেট্রোরেল তৈরি হলেই যানজট, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মেট্রোরেল তৈরি হচ্ছে। নিশ্চয় মেট্রোরেলের কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। যানজট সমস্যার কী সমাধান হবে? মেট্রোরেল চালু হলে, উত্তরা থেকে খুব সহজে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত চলে আসা যাবে। কিন্তু যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। নিচে দিয়ে গাড়ি-রিকশা-বাসের যানজট থাকবেই। মেট্রোরেল সারা শহরে বিস্তৃত করার সুযোগ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে।
আর ফ্লাইওভার নির্মাণের সঙ্গে মানুষের ভালো থাকার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
ফ্লাইওভার দেখে আনন্দিত হন যাদের গাড়ি আছে তারা। ঢাকা শহরে এমন মানুষের সংখ্যা ৯ শতাংশের বেশি নয়।
৪. গ্রামের কৃষকের কাছে গিয়ে জানতে চান, কেমন আছেন?
উত্তর পাবেন, ভালো নেই। না, এত সরাসরি তিনি উত্তর দেবেন না। আলুচাষি বলবেন, উৎপাদন তো খুব ভালো হয়েছে। দাম তো পেলাম না। লোকসান দিতে হলো। টমেটো চাষি বলবেন, গতবার তো ভালোই দাম পেয়েছিলাম। এবার তো পুরাই লোকসান। ব্যাংকের ঋণ শোধ করব কীভাবে? ধান চাষি কৃষক হাহাকার করছেন, খরচের সমান দাম না পেয়ে। ভালো আছেন মূলত দেশের কিছু অঞ্চলের সবজি ও ফল চাষিরা। কিন্তু এটা তো সমগ্র বাংলাদেশের খুব কমসংখ্যক চাষি। বৃহত্তর অংশই তো ভালো নেই।
গ্রামের দিনমজুরদের মজুরি বেড়েছে, তাও সত্য। শুভঙ্করের ফাঁকি হলো, গ্রামে সারাবছর কাজ থাকে না। বছরের তিন চার মাস কাজ ছাড়া থাকতে হয়। ফসলের মৌসুমে কাজের লোক পাওয়া যায় না। মৌসুম শেষে লোক থাকে, কাজ থাকে না।
গ্রামে কাজ না পেয়ে, শহরে বা ঢাকায় আসার প্রবণতা শুধু বাড়ছেই, কমছে না। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে যিনি রিকশা চালান, তার আয় বেড়েছে- ব্যয় বেড়েছে তার চেয়েও বেশি।
৫. গ্রামের যে কৃষক অনেক কষ্ট করে সন্তানকে পড়াশোনা করিয়েছেন। চাকরির জন্যে তাকে ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। জমি বিক্রি করে তিনি ঘুষ দেন।
ইয়াবাসহ মাদক গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে। দেখার বা ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই। যারা দেখবেন বা ব্যবস্থা নেবেন তারাই মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। সাধারণ মানুষের ভালো না থাকার এটা খুব বড় একটা কারণ। যারা ইয়াবার হাজার হাজার কোটি টাকার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ‘মাদকবিরোধী সপ্তাহ’ পালন করার দৃশ্য টেলিভিশনে দেখেন সাধারণ মানুষ।
৬. তাহলে কেউ কি ভালো নেই? না, কেউ কেউ ভালো আছেন। যারা ফ্লাইওভার তৈরি করছেন, তারা ভালো আছেন। ৩০০ কোটি টাকার বাজেটে কাজ শুরু করে, তা ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় শেষ করছেন। যারা ৪ লেনের রাস্তা নির্মাণের কাজ পেয়েছেন, তারা ভালো আছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে সবচেয়ে নিম্ন মানের রাস্তা নির্মাণ করছেন। রাজধানীর ভালো ফুটপাত, ভালো রোড ডিভাইডার ভেঙে নতুন করে গড়ার কাজ যারা পেয়েছেন, তারা ভালো আছেন।
আর ভালো আছেন ব্যাংক থেকে যারা লোন নিয়েছেন এবং যারা দিয়েছেন। শেখ আবদুল হাই বাচ্চুরা ভালো আছেন, তারা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যাংক থেকে জনগণের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিয়েছেন। সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা যারা নিয়েছেন, তারা ভালো আছেন। একজন তানভীর জেলে থাকলেও, সুবিধাভোগী সবাই নিরাপদেই আছেন। একদা গাড়ি চোর ইউনুছ বাদল সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ভালো আছেন। ১০০ কোটি টাকা মসজিদ নির্মাণের জন্যে দিয়ে পরকালেও ভালো থাকা নিশ্চিত করছেন।
তারা ভালো আছেন যারা প্রতি বছর নিয়ম করে লক্ষাধিক কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন। যারা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা বা মালয়েশিয়া চলে যাওয়া নিশ্চিত করে রেখেছেন।
তারা ভালো আছেন যারা তৃতীয় বিশ্বের টাকায়, প্রথম বিশ্বে থেকে প্রথম শ্রেণির জীবনযাপন করেন।
৭. কাগজের হিসাবে বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হয়েছে। এখন উন্নয়নশীল দেশ হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিজন মানুষের ঋণ ৪৬ হাজার টাকা। বিদেশ থেকে আনা ঋণে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। ‘উন্নয়ন’র জন্যে অবকাঠামো নির্মাণ খুব জরুরি। এসব অবকাঠামো যদি একটা বড় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সঠিক ব্যয়ে নির্মিত হতো, নিশ্চয় তা ভালো ব্যাপার হতো। প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৫ বা ১০ গুণ বেশি ব্যয়ে নির্মিত এসব অবকাঠামো শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের ভাগ্য বদলে কতটা ভূমিকা রাখবে, বড় প্রশ্ন সেটা নিয়ে। মনে রাখতে হবে, অবকাঠামো নিজে উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের সহায়ক। নির্মিত হচ্ছে ঋণের টাকায়। সে ঋণ সুদসহ শোধ করতে হবে। এখন যে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তা শোধ করা শুরু হবে ১০ বা ১৫ বছর পর থেকে। অবকাঠামো যদি পরিকল্পিত না হয়, কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হবে না। কিন্তু ঋণ শোধ করতে হবে। সমস্যাটা তৈরি হবে তখন। এখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ, জনগণের নামে ঋণের অর্থ আছে, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। একই ফর্মুলায় বিপদে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ কাগজে ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হলেও, তা ধরে রাখার জন্যে, টেকসই করার জন্যে যে পরিকল্পনা তার খুব বড় রকমের অনুপস্থিতি দৃশ্যমান।
বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি। যা ছিল তাও ধ্বংসের পথে। শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও, টেকসই পথে এগোয়নি বিদ্যুৎ খাত। চুরির উৎসব চলছে। কৃষক ঠিকমতো ঋণ পায় না, ক্ষমতার কাছের ঋণখেলাপি ধনীর তালিকায় নাম লেখায়। কৃষকের ঋণ মাফ হয় না, এসব খেলাপিদের হাজার হাজার কোটি টাকা মাফ করে দেয়া হয়। ফলে মানুষের ভালো থাকার গল্পের পাশাপাশি, খুব বড় রকমের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।
- SHAPTAHIK/Editor : Golam Mortoza