Search

Thursday, March 22, 2018

নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি, চরম সঙ্কটে আবাসন খাত



নির্মাণ সামগ্রী -  রড, সিমেন্ট ও পাথরের দাম এবং গৃহ ঋণের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের দাম ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলেন, গৃহ ঋণে ব্যাংক সুদের হার দুই অংকের ঘরে উঠায় ফের সঙ্কটে পড়তে পারে আবাসন খাত। 

মঙ্গলবার, মার্চ ২০, জাতীয় প্রেসক্লাবে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে রিহ্যাব আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা এ কথা বলেন। লিখিত বক্তব্যে রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, দীর্ঘদিনের মন্দা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও অস্থির অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে নির্মাণ শিল্প।

নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, এ খাতের প্রধান উপকরণ ৬০ গ্রেডের রডের বর্তমান প্রতি টনের বাজার মূল্য ৬৫ থেকে ৬৮ হাজার টাকা এবং ৪০ গ্রেডের রডের বাজার মূল্য ৫৩ থেকে ৫৬ হাজার টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবেও এক সপ্তাহ আগে ৬০ গ্রেডের বাজার মূল্য ছিল ৫২ থেকে ৫৩ হাজার আর ৪০ গ্রেডের রড়ের বাজার মূল্য ৪২ থেকে ৪৩ হাজার টাকা।

‘আর এক বছরে রডের বাজার মূল্য প্রতি টনে বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এছাড়া সিমেন্টের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা এবং ইটের দাম বেড়েছে হাজারে এক হাজার টাকা। ৬ মাস আগে প্রতি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হয়েছিল ৩৬০ থেকে ৩৯০ টাকায়। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৪২০ থেকে ৪৬০ টাকায়। একই সময়ে বেড়েছে পাথর আমদানি খরচও।
  • তথ্যসূত্রঃ dailyinqilab.com/মার্চ ২১, ২০১৮। 

দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব, খুন আর রাহাজানিতে রক্তাক্ত বাংলাদেশ

Editor's note - 


বিনাভোটের অনির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশ পুড়ছে  খুন আর রাহাজানির আগুনে। এ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না, নিজ দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকেরাও।  শুধু এমপি-মন্ত্রীরাই নয়, এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছেন বিভিন্ন জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতা, দলীয় চেয়ারম্যান ও মেয়ররাও। এসব নেতা নিজের পদ-পদবি, আধিপত্য ধরে রাখা, ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডার ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অভ্যন্তরীণ খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছেন। ভয়ঙ্করভাবে  ভেঙ্গে পড়েছে দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি। বুধবার, মার্চ ২১, বাংলা দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এ প্রকাশিত রফিকুল ইসলাম রনি’র ‘এত খুন এত মামলা’ শীর্ষক রিপোর্টে উঠে এসেছে দেশের এই ভয়াবহ চিত্র। অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেই অবস্থাটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ভুক্তভোগীরা। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পারে দেশ। জনগণ ভোট দিতে পারলে, সন্ত্রাসীরা রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হবে। 

রিপোর্টটির  তথ্যবহুল অংশ নিচে তুলে ধরা হলো - 


আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ৯ বছরে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দুই হাজার ৭০০-এর বেশি। এই অভিযোগ আর কারও নয়, রূপগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূইয়ার। একইভাবে যশোরের এক উপজেলায় আওয়ামী লীগের শাসনকালে দলের ৪৫ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। শুধু রূপগঞ্জ কিংবা যশোরের একটি উপজেলায় নয়, দেশের এমন চিত্র ৭০টির বেশি নির্বাচনী এলাকায়। শতাধিক আসনে এখন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের হাইকমান্ড যখন ভোট ও জনপ্রিয়তা বাড়াতে গণসম্পৃক্ততামূলক কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দিচ্ছে, তখন বিনাভোটের নির্বাচিত কিছু এমপি অন্য দলের চেয়ে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের শায়েস্তা করতে বেশি ব্যস্ত। সাভারের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে এর আগে দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা স্থানীয় এমপির অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করেই আসছেন । কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতিকে ইয়াবা মামলায় জেলে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে। নোয়াখালীর হাতিয়ায় আয়েশা ফেরদৌস এমপির স্বামী ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর বাহিনীর হাতে গত দুই বছরেই আটজন দলীয় নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামী লীগের। শুধু এমপি-মন্ত্রীরাই নয়, এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছেন বিভিন্ন জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতা, দলীয় চেয়ারম্যান ও মেয়ররাও। এসব নেতা নিজের পদ-পদবি, আধিপত্য ধরে রাখা, ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডার ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অভ্যন্তরীণ খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছেন।

আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দুই মেয়াদে ঢাকার পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জে দলীয় নেতা-কর্মীরাই হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন বেশি। এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৭০০ মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নামে। এ প্রসঙ্গে রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ শাহজাহান ভূইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত ৯ বছরে রূপগঞ্জে সবচেয়ে বেশি মামলা-হামলার শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। স্থানীয় এমপি গোলাম দস্তগীরের অন্যায়ের বিপক্ষে কথা বললেই তাদেরকে মামলায় জড়ানো হয়। এ পর্যন্ত দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে হত্যা, বিস্ফোরক, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ অসংখ্য মামলা করা হয়েছে এমপির নির্দেশে।’

গত ৮ মার্চ রূপগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী সুমন গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তীতে হাসপাতালে মারা যান। এই ঘটনায় স্থানীয় এমপি নিজ দলের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকে ফাঁসাতে মামলায় আসামি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী সুমন মিয়া হত্যা মামলার বাদী কাজলরেখা বলেছেন, রূপগঞ্জের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী আওয়ামী লীগে তার প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদদের ঘায়েল করতেই সুমন মিয়া হত্যা মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছেন। গত ৯ বছরে রূপগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কমপক্ষে ২৫ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। জানা গেছে, গত কয়েক বছরে রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ শাহজাহান ভূইয়া, কায়েতপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম রফিক, মুড়াপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলিমুদ্দিন মিঞা, রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তাবিবুল কাদির তমাল ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাছুম চৌধুরী অপু, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খোকন, মুড়াপাড়া কলেজের সাবেক ভিপি মনির হোসেন ও সাবেক ভিপি শাহরিয়ার পান্না সোহেল, তারাব পৌরসভা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল, গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন, কায়েতপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি লুত্ফর রহমান মুন্নাসহ প্রায় দুইশ নেতা-কর্মীর নামে হত্যা, ছিনতাইসহ বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে স্থানীয় এমপির বিরুদ্ধে কথা বলা এবং নিজ দলের প্রতিপক্ষ শাহীন চেয়ারম্যানের গ্রুপ করায় মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আলতাব হোসেন খোকনকে। একইভাবে শাহীন গ্রুপ করায় হামলা ও মামলা শিকার হয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান রতন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্থানীয় এমপি কামরুল ইসলামের গ্রুপ না করায় আমার ওপর হামলা করা হয়েছে। শুধু হামলাই নয়, মামলা করা হয়েছে আমার নামে। বর্তমানে এমন পরিস্থিতি হয়েছে, দল ক্ষমতায় আর আমরা যেন বিরোধী দলে।’

নোয়াখালীর হাতিয়ায় চলছে সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর শাসন। তার বিরুদ্ধে গেলে এলাকায় ঢুকতে বাধাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের। মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী আয়েশা ফেরদৌস সংসদ সদস্য। মোহাম্মদ আলীর বাহিনীদের তাণ্ডবে গত দুই বছরে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতাসহ অন্তত আওয়ামী লীগের আট নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। তার বাহিনীর সশস্ত্র হামলা থেকে রেহাই পায়নি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও। হাতিয়া পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি ছাইফ উদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাতিয়ায় মোহাম্মদ আলীর শাসন খুলনার খুনি এরশাদ শিকদারকেও হার মানায়। তার অর্ডার ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তার অন্যায়ের বিরোধিতা করলেই হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। দল মনোনীত ছয়জন ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৮-১০টি করে মামলা দায়ের করেছেন তিনি। এ উপজেলায় কমপক্ষে ২০০ দলীয় নেতা-কর্মী হুলিয়া নিয়ে ঘুরছেন।’ তিনি বলেন, আয়েশা ফেরদৌস এমপি হলেও মূলত মোহাম্মদ আলীই শাসন করেন এ এলাকায়। গত চার বছর ধরে কোনো হাটবাজারের টেন্ডার হয় না। নাম মাত্র টোকেন মানি সরকারকে দেওয়া হচ্ছে, যা সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

গত বছরের ৩০ মার্চ চরকিং ইউনিয়নের আফাজিয়া বাজারে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা আশরাফ উদ্দীন আহমেদ খুন হন। সেদিন মোহাম্মদ আলীর সমর্থন নিয়ে রবীন্দ্র বাহিনীর কয়েকজন প্রকাশ্যে তাকে গুলি করে বলে অভিযোগ আছে। পরে ৯ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। গত বছরের ১৩ এপ্রিল উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এমপি আয়েশা ফেরদৌসের কর্মী ও সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। ঘটনাস্থলে গুলিতে নূর আলম নামের এক যুবলীগ কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ১৮ এপ্রিল চরকিং ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা দক্ষিণ শুল্লকিয়া গ্রামের আলী আহাম্মদের ছেলে বাহার ডাকাতের অর্ধগলিত লাশ মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের শত শত নেতা-কর্মীকে জড়ানো হয়েছে। একই বছরের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল হালিম আজাদের মুক্তির দাবিতে মিছিল করলে মোহাম্মদ আলীর সমর্থকরা মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে গুলিবিদ্ধ হন চরঈশ্বর ইউনিয়নের পূর্ব গামছাখালী গ্রামের মো. ইব্রাহীমের ছেলে মো. মুরাদ উদ্দিন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে আনা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি তিনি মারা যান। ৩০ আগস্ট সকালে হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের পূর্ব সোনাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাজী নুরুল ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী রিয়াজ উদ্দীনকে প্রকাশ্যে পায়ের রগ কেটে ও গুলি করে হত্যা করে। এতে ঘটনাস্থলে তিনি নিহত হন।

জানা গেছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ, সাধারণ সম্পাদক ও চরকিং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ মহিউদ্দিন আহাম্মদ, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট ছাইফ উদ্দিন আহমদ, ছাত্রলীগ সভাপতি নাজমুল ইসলাম রাজুসহ প্রতিটি আওয়ামী লীগের নেতার বিরুদ্ধে ২০-২৫টি করে মামলা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্যাতিত হয়ে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মোহাম্মদ আলীর অনুমতি ছাড়া কোনো মামলা নেন না বলে অভিযোগ উপজেলা আওয়ামী লীগের।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময়ে যশোর, কুষ্টিয়া, মাদারীপুর, শরীয়তপুরে সবচেয়ে বেশি খুনের শিকার হয়েছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়াও সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, খুলনা, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পিরোজপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মাগুরা, নাটোর, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গাসহ কমপক্ষে ৪০টি জেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুই শতাধিক নেতা-কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন গত কয়েক বছরে।

গত বছরের ২০ নভেম্বর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কৈখালিতে শোভনালী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সলেমান গাজীকে (৪০) গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০ জানুয়ারি ফেনীর দাগনভূঞা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফখরুলকে নিজ বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। উপজেলার মাতুভূঞা বাজারের পাশের একটি ধানখেত থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ১১ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গত ৭ মার্চ মারা যান ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আশফাক আল রাফী শাওন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি একজন ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদের ছেলের সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হয়। পরে সে গুলিবিদ্ধ হয় বলে জানা গেছে।


Wednesday, March 21, 2018

বেগম জিয়ার মামলায় সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করেছেন লর্ড কারলাইল


মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে




কারারুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চলমান মামলায় ব্রিটেনের অন্যতম শীর্ষসারির আইন বিশেষজ্ঞ লর্ড আলেক্স কারলাইল নিজের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি সরাসরি ই-মেইলে নিশ্চিত করেছেন।

গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় লর্ড কারলাইলকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি প্রথমে বাংলাদেশের মিডিয়াকে জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তিনি বলেন, লর্ড কারলাইল ব্রিটেন থেকে মামলার দেখভাল করবেন এবং প্রয়োজনে বাংলাদেশেও আসতে পারেন। একইসঙ্গে বলেন, ব্রিটিশ এই আইনজীবী ২৮ বছর ধরে আইন পেশায় জড়িত। তিনি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি হিসেবেও কাজ করছেন। লর্ড কারলাইল জানিয়েছেন, তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সম্পৃক্ত হতে পেরে আনন্দিত।

এক্ষেত্রে লর্ড কারলাইল নিজে জানিয়েছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলায় আন্তর্জাতিক আইনের বিধিবিধানসহ সাধারণ ফৌজদারী মামলার আইনগত দিকগুলো মানা হচ্ছে কি না, তা দেখভালের জন্যই আমাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে’। তিনি আরও জানান, ‘সম্প্রতি আমাকে যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ মানবাধিকার উদ্যোগ (ইউকে সিএইচআরআই)-এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে, যার আগ্রহপূর্ণ কাজ হবে বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কীভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে আমার নিজের ব্যক্তিগত আগ্রহও তাতে রয়েছে। এছাড়া আমি প্রমাণাদি দেখে বাংলাদেশে নিয়োজিত আইনি টিমকে প্রমাণাদি গ্রহণের গুণগত উপযুক্ততা জানাব। কেননা আইন পেশায় জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ পর্যবেক্ষণের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে’।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সূত্রে প্রকাশ, লর্ড আলেকজান্ডার চার্লস কারলাইল হাউজ অব লর্ডের ‘ক্রসবেঞ্চ মেম্বার’। পাশাপাশি ‘বার্কস পিরেজ জিনোলজিক্যাল বুক’ অনুসারে পোল্যান্ডের অভিবাসী পরিবারের সন্তান। ১৯৬৯ সালে তিনি লন্ডনের এপসম ও কিংস কলেজ থেকে আইন শিক্ষায় দীক্ষিত। তিনি প্রিন্সেস ডায়ানার বাটলার পল ব্যুরেলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মামলাটি অতি দক্ষতায় পরিচালনা করেন এবং ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটিতে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। রাজনৈতিকভাবে ২০১৭ সালে এমপি মর্যাদায় নিজের লিবারেল ডেমোক্রেট দলটি পরিত্যাগ করেন।

জনসম্পদে ধনী দেশ গরিব থাকতে পারে না

মহিউদ্দিন আহমদ


সপ্তাহজুড়ে নানা ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ ও আলোড়ন জেগেছিল। যেমন মিরপুরে বস্তিতে আগুন লেগে হাজার হাজার মানুষের মুহূর্তের মধ্যেই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, কাঠমান্ডুতে বিমান দুর্ঘটনায় অনেকগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়া, কলম্বোয় ক্রিকেট খেলায় নাটকীয় হার-জিত এবং সেই সঙ্গে ক্রিকেট জাতীয়তাবাদের উৎকট উত্থান। এর মধ্যে আরেকটি খবর আমাদের জন্য সুবাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে নিঃসন্দেহে, তা হলো বাংলাদেশের ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়া।

এত দিন আমরা ছিলাম স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে। অর্থাৎ, পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি হিসেবে আমরা পরিচিত ছিলাম। জাতিসংঘের দেওয়া কিছু সূচকে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের চক্করে পড়েছিলাম এত দিন। ২০১৫ সালেই আমরা ওই সূচকগুলো অতিক্রম করে যাই। এ বছর এল আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। তবে পুরোপুরি আনুষ্ঠানিক নয়। এটা নিশ্চিত হবে ২০২১ সালে এবং এরপর আরও তিন বছর আমরা পর্যবেক্ষণে থাকব।

অর্থাৎ, সবকিছু ঠিকঠাক চললে ২০২৪ সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাফেলায় বুক চিতিয়ে হাঁটতে পারব।

স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি) হিসেবে পরিচিতিতে কোনো মর্যাদা ছিল না। মানুষ হিসেবে বিশ্বসভায় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অপাঙ্ক্তেয়। ভিখারির যতই গুণ থাকুক না কেন, তার সামাজিক মর্যাদা নেই। আমাদের অবস্থা ছিল অনেকটা সে রকমই। আমরা যতই বিশ্বের ‘রোল মডেল’ হিসেবে নিজেদের ঢোল নিজেরা পেটাই না কেন, আমাদের সবুজ পাসপোর্টটা দেখলে অন্য দেশের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ভ্রু কোঁচকায়। এবার যদি চালচিত্রটা একটু বদলায়।

আমাদের কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার কথা ছিল না। ছোট জনসংখ্যার দেশ, দ্বীপরাষ্ট্র, চারদিকে ভূমিবেষ্টিত দেশ কিংবা বৈদেশিক দেনার ভারে জর্জরিত দেশগুলোই এ তালিকায় থাকে। জনসংখ্যা যদি ৭৫ মিলিয়ন বা তার বেশি হয়, তাহলে ওই দেশের এই তালিকায় পড়ার কথা নয়-এ রকমই ছিল নিয়ম। ওই নিয়মে বাংলাদেশ পড়ে না। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আমরা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য হই। তার কয়েক মাসের মাথায় আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত হই। আমরা এটা যেচে হয়েছি, ইচ্ছা করেই। আর্থিক সুবিধা পাওয়ার জন্য অমর্যাদাকর পরিচয়ের এই তিলক পরেছি কপালে। ৪৩ বছর আমাদের এই গ্লানি বয়ে বেড়াতে হলো।

একটি দেশকে জোর করে ভিকারি বানানো যায় না। ঘানা, পাপুয়া নিউগিনি ও জিম্বাবুয়ের আন্তর্জাতিক সূচক অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার কথা। তারা কিন্তু গরিবদের ওই বর্গে যেতে সব সময়ই অপারগতা জানিয়েছে।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ১০ বছর পর স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিয়ে শীর্ষ সম্মেলন হয়। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আমার সুযোগ হয়েছিল গত দুটি শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার-২০০১ সালে ব্রাসেলসে এবং ২০১১ সালে ইস্তাম্বুলে। স্বল্পোন্নত দেশের একজন নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা হতো। চেয়ে চেয়ে দেখতাম, এশিয়া-আফ্রিকায় স্বল্পোন্নত দেশের কর্তাব্যক্তিরা শীর্ষ সম্মেলনের অনেক অনুষ্ঠানে রীতিমতো এতিমের মতো ঘোরাফেরা করেন। কিন্তু নিজ দেশে তাঁরা প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যাঁদের অল্পবিস্তর যাতায়াত আছে, তাঁরা জানেন সেখানে আমাদের নিয়ে কত রকম কথাবার্তা, হাসাহাসি হয়। এবার অন্তত ওই বদনামটা ঘোচানোর সুযোগ এসেছে।

অধিক জনসংখ্যার দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রাখা যায় না-এই যুক্তির পেছনে সারবত্তা আছে। এটা একটা সাধারণ ধারণা যে একটি দেশের বড় সম্পদ হলো তার জনসমষ্টি। জনসম্পদে ধনী একটি দেশ বেশি দিন আর্থিকভাবে গরিব থাকতে পারে না। জনসম্পদের কারণেই চীন আজ বিশ্বের দুই নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি এবং ভারতও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা জনসম্পদের উন্নয়ন ও উৎকর্ষের দিকে ভালোভাবে নজর দিলে অবস্থার আরও ইতিবাচক পরিবর্তন হতো। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে আমরা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে পারতাম। কিন্তু আমরা সেই পথে হাঁটছি না।

আমরা এখনো যেনতেনভাবে গ্রাম থেকে লোকজন ধরে এনে বিদেশে পাঠিয়ে দিই। আবার দেখা যায়, কাজের সংস্থান না থাকায় অনেকেই দালাল ধরে, অনেক টাকা কর্জ করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, নৌকায় চড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে ‘কাজের মানুষ’ পাঠিয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। অথচ খোঁজ রাখি না, এর ফলে কতগুলো পরিবার অমর্যাদার অন্ধকারে হারিয়ে গেল। জনসম্পদ গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকারি যে দুটি জিনিস-শিক্ষা আর স্বাস্থ্যব্যবস্থা-তা আমরা মুনাফাখোরদের হাতে তুলে দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি।

আমাদের কাছের দেশ ভিয়েতনাম। এর একটা বড় অংশ মুক্ত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার পর। যুদ্ধে দেশটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তারপরও তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির সূচকে ওরা এখন আমাদের চেয়ে এগিয়ে। ওরা খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে নিজেদের এশিয়ার চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোর শীর্ষে তিন নম্বরে আনতে পেরেছে। আমাদের কাছে ওরাই তো রোল মডেল হতে পারে। ভিয়েতনাম কিন্তু কখনো স্বল্পোন্নত দেশ হতে চায়নি।

১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় ২৫টি দেশ ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল সিকিম। পরে দেশটি ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়। ২০১১ সালের দিকে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দ্বিগুণ হয়েছিল। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি দিনে দিনে এমন হয়ে উঠেছে যে এখানে অনুন্নয়নের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন। বাংলাদেশের তো লাগল চার দশকেরও বেশি সময়।

এরপরও বাংলাদেশ জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে থাকবে আরও ছয় বছর। গত ৩০ বছরে মাত্র পাঁচটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এরা হলো বতসোয়ানা (১৯৯৪), কেপভার্দি (২০০৭), মালদ্বীপ (২০১১), সামোয়া (২০১৪) ও গিনি (২০১৭)। এই তালিকায় এখনো ৪৭টি দেশ রয়ে গেছে। এর মধ্যে এশিয়ার দেশগুলো হলো (বাংলাদেশ ছাড়া) আফগানিস্তান, ভুটান, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল ও ইয়েমেন।

এখানে একটি কথা না বললেই নয়, একটি দেশ উন্নয়নশীল হওয়া মানে এই নয় যে সবাই উন্নয়নের গাড়িতে সওয়ার হতে পারবে। এটা একধরনের গড় অবস্থান। আমাদের দেশে অনেক পরিবার অনেক আগে থেকেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের মানের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আছে অনেক গৃহহীন মানুষ। জাতিসংঘের একটি প্রত্যয়নপত্র পেলেই যে দেশে দুধ আর মধুর নহর বয়ে যাবে, এমনটি মনে করার কারণ নেই।

আমাদের দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। জাতীয় বাজেটের খুব কম অংশই খরচ হয় সামাজিক উন্নয়ন খাতে। আয়বৈষম্য বাড়ছে সমাজে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রীভবন হচ্ছে রাজধানীতে। এগুলোর কোনোটাই সুখকর সংবাদ নয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর নজর দেওয়া দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার লাভজনক কর্মসংস্থান তৈরি করা। বাগাড়ম্বর নয়, দরকার পরিকল্পনা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। টেস্ট রিলিফ, কাবিখা, ওএমএস-এসব শব্দ মনে করিয়ে দেয় যে দেশে দারিদ্র্য ও সামর্থ্যহীন মানুষের সংখ্যা এখনো যথেষ্ট। বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের যে ‘ভিখারি’ পরিচয় তৈরি হয়েছিল, তা দূর করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

  • প্রথম আলো/21-3-18
  • মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক

খেলাপি ঋণের দায় কার?

ইকতেদার আহমেদ


বাংলাদেশে দুই ধরনের বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এর একটি হলো রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অপরটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলধনের জোগানদাতা সরকার, অপর দিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলধনের জোগানদাতা উদ্যোক্তা পরিচালকগণ। যে পরিমাণ মূলধন নিয়ে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়, পরবর্তীকালে ব্যাংকে আমানতকারীদের আমানতের পরিমাণ ও ঋণগ্রহীতাদের ঋণের পরিমাণ বাড়লে পর্যায়ক্রমে মূলধনেরও পরিমাণ বাড়ে। মূলধন বাড়ানো একটি চলমান প্রক্রিয়া। বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা পরিচালকগণ মূলধনের ১০ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকেন। বর্তমানে প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংকে আমানতকারীদের যে পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে, উদ্যোক্তা পরিচালকদের মূলধনের সাথে তার হিসাব করলে এর অনুপাত দাঁড়ায় ৯৭.৫ : ২.৫।

একজন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধা থাকায় বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের দেখা যায়, সমঝোতার ভিত্তিতে এক ব্যাংকের পরিচালক অপর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিচালক সমন্বয়ে গঠিত। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা সরকারের নিয়োগ পান। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে উদ্যোক্তা পরিচালকদেরই প্রাধান্য। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্য থেকে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য যিনি, তাকে নির্বাচিত করা হয়। অতীতে একজন উদ্যোক্তা পরিচালক তিন বছর ব্যাপ্তিকালের দুই মেয়াদে অর্থাৎ ছয় বছর দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। বর্তমানে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালকদের তিন বছর ব্যাপ্তিকালের পরপর তিন মেয়াদে অর্থাৎ ৯ বছর পদে বহাল থাকার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। অতীতে একই পরিবারের দু’জনের অধিক একসাথে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। সম্প্রতি আইন সংশোধন করে এ সংখ্যাটি ২ থেকে বাড়িয়ে ৪ করা হয়েছে। 
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বড় অঙ্কের ঋণগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে। মাঝারি ও ক্ষুদ্রপর্যায়ের ঋণ অনুমোদনের ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের অনুমোদন দেয়া আছে। ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপকেরা যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করেন, পরিচালনা পর্ষদের ক্ষেত্রে প্রায়ই তার ব্যাঘাত পরিলক্ষিত হয়। 

বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। এ খেলাপি ঋণের একটি অংশ অনাদায়যোগ্য হওয়ার কারণে অবলোপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বা বাণিজ্যিক ব্যাংক একজন ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিতে হলে তাকে নির্ধারিত আইন ও বিধিবিধান মেনে ঋণ দিতে হয়। জামানত ছাড়া কোনো ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। বড় অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে স্থাবর সম্পত্তি অথবা স্থাবর সম্পত্তির ওপর নির্মিত স্থাপনা বন্ধক রেখে ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধকী সম্পত্তির মালিকানা রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে ব্যাংক বরাবর হস্তান্তর করা হয়। ঋণ অনুমোদনের আগে ব্যাংকের কর্মকর্তারা বন্ধকী সম্পত্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে এর ওপর স্থাপনা পরিদর্শন করে এর মূল্য নিরূপণ করেন। বন্ধকী সম্পত্তির মালিকানা বিষয়ে ব্যাংকের আইন শাখা ও আইন উপদেষ্টার মতামত নেয়া হয়। একজন ঋণগ্রহীতাকে ঋণ নেয়ার সময় যেসব কাগজপত্র দাখিল করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো জমি খরিদের দলিল, নামজারি ও জমা ভাগ এবং হালনাগাদ খাজনার দাখিলা। রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক বন্ধকী সম্পত্তির মূল্যমানের এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ অঙ্কের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও প্রায়ই এর ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়। 

উদ্যোক্তা পরিচালক ও বড় ধরনের প্রভাবশালীরা ঋণ নেয়ার সময় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বন্ধকী সম্পদের মূল্যমানের ২-৪ গুণ অধিক পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়ে থাকেন। এ ধরনের ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ না করা হলে অচিরেই দেখা যায় সুদে-আসলে ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এ ধরনের অনেক ঋণগ্রহীতা তাদের গৃহীত ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে সম্পদ কেনায় ব্যয় করছেন। এদের বিদেশী নাগরিকত্ব রয়েছে এবং দেশে ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে এরা বিদেশে পাড়ি জমানোর জন্য সদাপ্রস্তুত। এ ধরনের অনেক ঋণগ্রহীতা ইতোমধ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এবং ব্যাংকের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। 

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশের সাথে যারা সম্পৃক্ত, এদের অনেকেই সমাজের বিশিষ্টজন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। অপর অংশটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ঋণ পেতে সফল হয়েছেন। বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, যেসব ক্ষেত্রে বন্ধকী সম্পদের মূল্যমানের চেয়ে ঋণের পরিমাণ অধিক সেসব ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা উভয়ে, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইন শাখার কর্মকর্তা, আইন উপদেষ্টা প্রভৃতি অবৈধ অর্থ দিয়ে বশীভূত হয়ে অন্যায়ভাবে ঋণ দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ ধরনের ঋণগ্রহীতারা মঞ্জুর করা ঋণের ২০-৩০ শতাংশ উপরোক্তদের উৎকোচ দিয়ে থাকেন। এর একটি অংশ ঋণ মঞ্জুরের আগে এবং অবশিষ্টাংশ ঋণের কিস্তির অর্থ ছাড় করার সময় দেয়া হয়। 

ব্যাংক খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত, বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংক কাগজে-কলমে যে পরিমাণ অর্থ খেলাপি ঋণ হিসেবে প্রদর্শন করছে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এর চেয়ে অধিক। হিসাবে গরমিল ও হেরফের করে তারা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র জনসম্মুখে উপস্থাপনে অনীহ। 

রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে তৎপর দেশের জনমানুষসহ সাধারণ আমানতকারীদের ধারণা দেয়ার জন্য তারা মামলা দায়েরের মাধ্যমে অনাদায়ী অর্থ আদায়ে সচেষ্ট, এমন মনোভাব প্রদর্শন করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় দুর্বলভাবে মামলা পরিচালনা এবং আইনি জটিলতার কারণে মামলা দায়ের করে কাক্সিক্ষত প্রতিকার পাওয়া যায় না। 
এমন অনেক ঋণ রয়েছে, যেগুলো গ্রহণের সাথে জালিয়াতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ ধরনের অনেক জালিয়াতির সাথে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, কিছু পরিচালক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপক সম্পৃক্ত থাকলেও ত্রুটিপূর্ণ তদন্তের মাধ্যমে মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করায় প্রকৃত অপরাধীরা পর্দার আড়ালে থেকে যায়।

রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে যে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা দেয়া হয়, তার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। দুই দশক ধরে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ প্রতি বছর ক্রমে স্ফীত হয়েছে এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা সঠিক হয়ে থাকলে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আর তাই এর দায় থেকে সংশ্লিষ্ট দু’টি প্রতিষ্ঠানও অবমুক্ত নয়। 

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আট হাজার কোটি টাকার অধিক অর্থ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পাচার সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা সংঘটন-পরবর্তী দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এর সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট যারা সম্পৃক্ত তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ সময়ে ব্যাংকটির গভর্নরের দায়িত্বে যিনি ছিলেন; তাকে অপসারণ করা হলে তিনি তার আগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন। এ ধরনের ব্যক্তি যিনি এত বড় অঘটনের সময় ব্যাংকটির শীর্ষ পদে আসীন ছিলেন এবং অঘটন-পরবর্তী এটি যেন জনসম্মুখে প্রচার না পায়, সে বিষয়ে সে সময় তার তৎপরতাকে আমলে নেয়া হলে এরূপ ব্যক্তির প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় পুনঃপ্রত্যাবর্তন নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটুকু সমর্থনযোগ্য তা বিবেচনার দাবি রাখে। এ ধরনের ঘটনা ব্যাংক খাতে জালিয়াতিকে উৎসাহিত করে ঋণখেলাপি হওয়ার পথ যে প্রশস্ত করে তা এ দেশের সচেতন মানুষ অনুধাবনে সক্ষম। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্ণধারসহ আরো কিছু ব্যাংকের শীর্ষ কর্ণধারের অপতৎপরতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে এ দেশে বড় ধরনের ঋণজালিয়াতি ও ঋণখেলাপির ঘটনা সংঘটিত হলেও এদের বিরুদ্ধে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় এরা দায়মুক্ত ভাব নিয়ে মাথা উঁচু করে সমাজে চলাফেরায় উদ্যত। অথচ এদের মধ্যে ন্যূনতম বিবেকবোধ ও দায়িত্বজ্ঞান থাকলে এরা লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষার প্রয়াস নিতেন।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের কারণে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আজ অনাদায়যোগ্য, এ অর্থের মালিক এ দেশের সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ও সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে এর আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা তাদের ন্যায্য লাভ ও মুনাফা থেকে বঞ্চিত হলেও ঋণখেলাপির সাথে যারা সম্পৃক্ত, তারা অনেকটা দায়হীন থেকেই দেশ ও বিদেশে অবৈধভাবে আহরিত সম্পদ সুরক্ষায় নিয়োজিত। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশের ব্যাংক খাতে ধস নেমে তা দেশের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসবে। আর তাই সময় থাকতে ঋণখেলাপির দায় যাদের ওপর বর্তায়, তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তিবিধান প্রত্যাশিত নয় কি?

  • Courtesy: Naya Diganta, Mar 20, 2018
  • লেখক:সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

স্থিতি-অবস্থা বনাম পরিবর্তনের প্রয়োজনীতা

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম


ধারাবাহিকতা আলোচনা কেন 

আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ২০১৮ সালটি বাংলাদেশের জন্য একাধিক আঙ্গিকের দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। এ কথা খেয়াল রেখেই গত তিন বুধবারে তিনটি কলাম লিখেছি এবং পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছি। একই সুতায় গাঁথা কলামগুলোর মধ্যে আজকেরটি হলো চতুর্থ কলাম। বর্তমানে যে মাস চলছে সেটি মার্চ মাস। স্বাধীনতার মাস। অতএব, এই মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব তথা স্বাধীন অস্তিত,¡ স্বাধীন অবয়ব ও স্বাধীন পথচলা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিঞ্চিৎ আলোচনা বিগত তিনটি কলামে (২৮ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ ও ১৪ মার্চ ২০১৮) করা হয়েছে; আজ একটু করব এবং আগামী সপ্তাহে আরেকবার হবে। এই অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যটি এখানে পুনরায় লিখছি : ‘আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ২০১৮ সালটি, বাংলাদেশের জন্য একাধিক আঙ্গিকের দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত।’ ওই দ্বন্দ্বগুলোর সাথে তথা একাধিক দ্বন্দ্বের সাথে, অবশ্যই অনেক কিছু জড়িত বা সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি মাত্র আঙ্গিক উল্লেখ করছি। 

এক. আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর রাজনীতিতে ছোট দেশগুলোর ভূমিকা (ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স) জড়িত। 

দুই. আঞ্চলিক রাজনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নামক ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে আঞ্চলিক সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর (রিজিওনাল পলিটিক্স) জড়িত।

তিন. আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব (কালচারাল কনফ্লিক্ট) জড়িত। এ কথা খেয়াল রেখেই গত সপ্তাহের (১৪ মার্চ ২০১৮) কলামে চারটি অনুচ্ছেদে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমার নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। 

আলোচনার শেষপর্যায়ে পাঠক অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে বা বাংলাদেশের কোন দিকে যাওয়া উচিত বা বাংলাদেশকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এর উত্তর সন্ধানের জন্যই এতগুলো কলাম। যেহেতু ২০১৮ সালের শেষে বা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি নির্বাচন হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে, সেহেতু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে কি হবে না সেটাও আলোচনার সুযোগ আছে। সে জন্যই এ আলোচনা।

পরিবর্তনের চারটি ভিন্ন প্রক্রিয়া

২০১৮ সালের শেষ নাগাদ অথবা ২০১৯ সালের প্রারম্ভে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনেও পরিবর্তন হতে পারে; আবার না-ও হতে পারে। একটি পক্ষ চাচ্ছে পরিবর্তন হোক, একটি পক্ষ চাচ্ছে পরিবর্তন না হোক। বরং স্ট্যাটাসকো মেইনটেইন হোক বা বর্তমান অবস্থায় স্থিত থাকুক। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে কোনোটি স্বাভাবিক ও সুখকর ও কোনোটি অস্বাভাবিক ও বেদনাদায়ক। বয়সের প্রবীণত্বে এসে একান্ত কামনা করি যেন অস্বাভাবিক ও বেদনাদায়ক পরিবর্তন পরিহার করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিশেষত অনুন্নত দেশের বা কোনো-না-কোনো সময় ইউরোপিয়ানদের কলোনি ছিল এমন দেশের, প্রশাসনে বা রাজনীতিতে পরিবর্তনগুলোকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বা রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা অন্তত চারটি শিরোনামের অধীনে ক্যাটাগরাইজ বা পর্যায়ভুক্ত করেন। 

একটি ক্যাটাগরি হলো, ব্যালটের মাধ্যমে তথা মানুষের স্বাভাবিক ভোট দেয়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ক্যাটাগরি হলো, বুলেটের মাধ্যমে তথা ভায়োলেন্সের মাধ্যমে তথা রক্তারক্তির মাধ্যমে। তৃতীয় ক্যাটাগরি হলো, ব্যালটও না বুলেটও না, গণদাবির মুখে তথা গণজাগরণের মুখে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। চতুর্থ ক্যাটাগরি হলো, বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই দুর্বলতাগুলোকে সংস্কার করে, কাঠামোকে শক্তিশালী করে ব্যালট ও হস্তান্তরের যৌথ প্রক্রিয়ায়, যাকে আমরা বলতে পারি ‘সংস্কার’ ক্যাটাগরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস থেকে, প্রত্যেকটি ক্যাটাগরির জন্যই উদাহরণ টেনে এনে আলোচনা করা যায়। বাংলাদেশের গত ৪৬ বছরের ইতিহাস থেকেও প্রত্যেক ক্যাটাগরির জন্যই উদাহরণ বা ঘটনার রেফারেন্স টেনে আনা যায়। আমরা ইতোমধ্যে সেরূপ আলোচনা, অতীতের গত দুই-তিন সপ্তাহের কলামগুলোতে করেছি।

বর্তমান অবস্থায় স্থিত থাকার অর্থ : কয়েকটি উদাহরণ

আমি গত পাঁচ-সাত বছরের শত সহস্র কোটি কোটি টাকার বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর কথা তুলে ধরছি না। যথা ডেসটিনি নামক মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির কেলেঙ্কারি, হলমার্ক গ্রুপের কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। অতি সম্প্রতি ঢাকা মহানগর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম, দু’চার লাইন ব্যাখ্যাসহ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। 

এক নম্বর উদাহরণ ১০ জানুয়ারি ২০১৮; মানবজমিন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘সাড়ে আট হাজার ভুয়া পিএইচডি’র তদন্তে দুদক।’ অর্থাৎ কিনা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী, দশম শ্রেণীর পর মাধ্যমিক পরীক্ষা, দ্বাদশ শ্রেণীর পর উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি এবং মাস্টার্স লেভেল সব কিছুকে ধ্বংস করার পর, শিক্ষাজগতের সম্মানজনক অর্জন পিএইচডিকেও শেষ করা হয়েছে গত ৯-১০ বছরে। পত্রিকার ভাষ্য মতে, প্রায় সাড়ে আট হাজার লোক বাংলাদেশে আছেন, যাদের পিএইচডি অর্জন ছিল ভুয়া বা প্রতারণা। এটা হলো শিক্ষা সেক্টরের তদারকির অমার্জনীয় অদক্ষতার প্রমাণ। 

দুই নম্বর উদাহরণ ৩ মার্চ ২০১৮; ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম ÔCurious case of GMG loan : Rescheduled once, Tk 57cr interest waived; Sonali Bank could not recover Tk 190cr from the airlines despite years of legal battle’ অর্থাৎ জিএমজি এয়ারলাইন্স নামে একটি প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের কাহিনী। কোম্পানিটি ছয় বছর ধরে বন্ধ। তারা ৪০০ শতাংশ প্রিমিয়াম দেখিয়ে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। এসইসি বা সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের সতর্কতায় জনগণের কাছে উন্মুক্ত শেয়ার ক্রয়ের জন্য উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি; হলে বিশালসংখ্যক জনগণ প্রতারিত হতো। বেক্সিমকো লিমিটেডের গ্যারান্টিতে সোনালী ব্যাংক ২৪৭ কোটি টাকা লোন দিয়েছিল। সেই লোন এবং ৩০০ কোটি টাকা পাওয়ার পর কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্য ভাষায় এ রকমও বলা যায়, ব্যাংকের কাছে সোনালি ছবি এঁকে লোন নেয়া হয় এবং মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। তারপর কোম্পানিটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ডেইলি স্টারের ভাষায়, এই কোম্পানটির ঘটনাটি হলো : এ ক্ল্যাসিক একজামপল অব হাউ টু টুইস্ট এ ব্যাঙ্কস আরম উইথ কোর্ট অর্ডারস। 

তিন নম্বর উদাহরণ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮; মানবজমিনের প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘ঋণের টাকায় দানবীর ইউনুস বাদল।’ বাদল জীবন শুরু করেছিলেন বাসচালকের সহকারী হিসেবে। পত্রিকার ভাষায়, ২০১০ সালে তার হাতে আসে আলাদিনের চেরাগ। ২০১০ সাল থেকে পরের ছয় বছরে একক ব্যবসায়ী হিসেবে জনতা ব্যাংক থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন এনন টেক্স গ্রুপ। পত্রিকার ভাষায়, অনিয়ম করেই তার সব লোন সংগ্রহ করা হয়েছে। 

চার নম্বর উদাহরণ ১১ মার্চ ২০১৮; বণিক বার্তার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘আইএফআইসি ব্যাংক : নদী, কবরস্থানের ভূমি বন্ধক রেখে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ।’ আইনানুযায়ী সরকারি খাসজমি, শিকস্তি ও পয়স্তি এবং কবরস্থানের ভূমি জামানত রাখার কোনো সুযোগ নেই। তার পরও এ ধরনের ভূমি বন্ধক রেখে রাজ হাউজিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। 

পাঁচ নম্বর উদাহরণ ১ মার্চ ২০১৮; প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘২৫ শীর্ষ খেলাপির তালিকায় নেই প্রভাবশালীদের নাম।’ বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বহু ঋণখেলাপি আছেন, অর্থাৎ যারা সময়মতো তাদের ঋণ বিভিন্ন কারণে ফেরত দিতে পারেননি। সেখানে দুই লাখ বা পাঁচ লাখ টাকার ঋণখেলাপি আছেন, ৩০-৪০ লাখ টাকার ঋণখেলাপি আছেন, এক-দুই কোটি টাকার ঋণখেলাপি আছেন, ১০০-২০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি আছেন, ৫০০ বা হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি আছেন, তিন-চার বা পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি আছেন। যাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তাদের বলা হচ্ছে শীর্ষ খেলাপি। সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সময় শীর্ষ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করে, এবারো করেছে। কিন্তু এবারের সেই তালিকায় যারা আসলে শীর্ষ বা বাস্তবিকভাবেই সবচেয়ে বড় খেলাপি, তাদের নাম নেই। এমন কৌশল ব্যাংকের মাধ্যমে অবলম্বন করা হয়েছে, যেন তাদের নাম খেলাপিদের তালিকায় জনসমক্ষে প্রকাশ করা না হয়। 

পত্রিকার মন্তব্য : মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের নামে প্রভাবশালীরা ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন। সংবাদের ভাষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক মইনুল ইসলামের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়। 

মন্তব্যটি : ‘খেলাপি গ্রাহকদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুলান করতে হবে। তাদের সম্পত্তি জব্দ করে জেলে পাঠাতে হবে। এসব টাকা সহজে ফেরত আসবে না। এর বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংক খাতকে দিনে দিনে ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কাছে কুক্ষিগত করে ফেলা হচ্ছে। ফলে সামনের দিনে যে নতুন করে বড় খেলাপি সৃষ্টি হবে না; তা বলা যাবে না। 

ছয় নম্বর উদাহরণ ৩ মার্চ ২০১৮, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠার অন্যতম শিরোনাম : ‘কোনোভাবেই থামছে না অর্থপাচার।’ বিভিন্ন পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ডলারের দাম বেশি, তা ক্রমেই বাড়ছে। অপর পক্ষে বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের দাম কমছে। সংবাদের ভাষ্যে অর্থনীতিবিদদের উদ্ধৃত করা হয়েছে। 

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের কারণ মূলত তিনটি। প্রথম কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলে অর্থপাচারও বেড়েছে। দ্বিতীয় কারণ দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা। তৃতীয় কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা।

সাংবিধানিক ঘোষণা লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে

১৯৭১ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখের কথা। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি। গঠনের প্রক্রিয়া প্রায় সমাপ্তির পথে ছিল। তখন যে ক’জন নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন, তারা একত্র হয়েছিলেন কলকাতায়। তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (ইংরেজি পরিভাষায় প্রোক্লামেশন অব ইনডিপেনডেন্স) রচনা, গ্রহণ ও প্রচার করেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে যে তিনটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত ও প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘সাম্য’। 

এই কলামের উপরের অনুচ্ছেদটিতে, ছয়টি উদাহরণ দিয়েছি, যেগুলো অনৈতিকতা ও দুর্নীতির সাক্ষ্য বহন করে। এখন যে উদাহরণটি দিচ্ছি তথা সাত নম্বর উদাহরণ, সেটি হলো সাম্যের লঙ্ঘন ও এর সাথে পরিহাসের উদাহরণ। ১২ মার্চ ২০১৮ বণিক বার্তার প্রথম পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম : ‘ইউএনডিপির পর্যবেক্ষণ : ১০ শতাংশের হাতে সব কিছু কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।’ পত্রিকার মতে, দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী পরিবারের হাতে দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ জমা হচ্ছে বা জমা আছে। আয় বণ্টন ব্যবস্থার এরূপ কেন্দ্রীভবনের জন্য রেন্ট-সিকিং বা লুটপাট ও দুর্নীতির প্রবণতাকে দায়ী করেছে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি। 

ইউএনডিপির মতে, আয়ের এত বড় অংশ কিভাবে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হলো, তা বুঝতে হলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ ফেরত না দেয়ার ঘটনাগুলো জানতে হবে ও বুঝতে হবে। পুঁজিবাজারে কারসাজি করে অবিশ্বাস্য রকমের লাভ সংগ্রহ করার পদ্ধতি এবং সেই লাভের টাকার গন্তব্যস্থল জানতে ও বুঝতে হবে, কর ফাঁকি দেয়ার ঘটনাগুলো জানতে ও বুঝতে হবে, সরকারি কেনাকাটা ও সরকারি ব্যয়ে যে দুর্নীতি করা হয় এবং সেই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার গন্তব্য পথ জানতে ও বুঝতে হবে এবং সর্বোপরি, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে ভূমি দখলের ঘটনা জানতে ও বুঝতে হবে। ইউএনডিপির পর্যবেক্ষণ মতে, গত ছয় বছরে দেশের জনগণের মধ্যে আয়ের বৈষম্য ক্রমান্বয়ে অনেক প্রকট হয়ে উঠেছে।

এ অবস্থার পরিবর্তন চাই

এ অবস্থা বলতে কী বুঝালাম? এ অবস্থা বলতে বোঝাতে চাচ্ছি, শুধু আজকের কলামে উল্লিখিত দুর্নীতির অবস্থা নয়। গত চার বা অন্তত তিনটি কলামে (২১ ফেব্রুয়ারি, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ ও ১৪ মার্চের কলাম) যে রাজনৈতিক অবস্থা এবং আর্থসামাজিক অবস্থা বর্ণনা করেছি; সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী; বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি জন্মদিনেই ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রকাশ এবং প্রচার করেছিল; সেগুলো হালনাগাদ অবস্থায় এখনো মুদ্রিত আছে অথবা কল্যাণ পার্টির ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাবে। আমাদের ঘোষিত লক্ষ্যের সারমর্ম একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ বর্তমান অবস্থা থেকে পরিবর্তন না আনলে, আমরা কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। অতএব আমাদের পরিবর্তন আনতেই হবে। তাই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ঘোষিত নীতিবাক্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি। এই পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই আমি রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছি। 

গত ১০ বছর চার মাস ধরে আল্লাহর দেয়া জীবনের পরিশীলিত মেধা, কনসেনট্রেইটেড অভিজ্ঞতা ও অবসর জীবনের সময় রাজনীতির জন্য ব্যয় করছি। রাজনীতিতে খরচ অবশ্যই আছে এবং সেটিও হালাল উপায়ে করছি। নিজের ও দলের নেতাকর্মীদের পরিবার, দলের নেতাকর্মী এবং শুভাকাক্সক্ষীরা দোয়া ও সহযোগিতা করছেন। অতএব আমি পরিবর্তনের একজন জোরালো প্রবক্তা। আমরা একা এই পরিবর্তন করতে পারব না; তাই বন্ধুবান্ধব প্রয়োজন। কিন্তু দূষিত হওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে, পরিবর্তনে আগ্রহী বন্ধু পাওয়া অসম্ভব না হলেও কঠিন। এরূপ আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে, মহান আল্লাহ তায়ালার একটি বাণী বারবার মনে পড়ে। পবিত্র কুরআনের ৩৯ নম্বর সূরা আয-জুমার। এই সূরার ৫৩ নম্বর আয়াতের মাঝখানে বলা আছে : ‘লা তাকনাতু মির রাহমাতিল্লাহি’। পুরো আয়াতের বাংলা অর্থ এইরূপ : ‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ আমি আশাবাদী এই মর্মে যে, আমরা বাংলাদেশের মানুষ, যারা মহান আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর নির্দেশাবলিতে বিশ্বাস করি ও ওই মর্মে চলতে চাই, আমরা আশাবাদী হবো পরিবর্তনের ব্যাপারে।

জুলুম বন্ধ হবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, নিষ্ঠুরতা বন্ধ হবে, দয়া প্রতিষ্ঠিত হবে। আমি নিরাশ হতে চাই না, আশাবাদী থাকতে চাই। মনে করি, অনেক কষ্ট ও অনেক বঞ্চনার কারণে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষ পরিবর্তন চান। সেই পরিবর্তনের জন্য ভোটারদেরও পরিশ্রম করতে হবে। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমার মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের প্রধান একটি অন্যায় কাজ করেছেন। সেই অন্যায় কাজটি হলো এইরূপ : তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছেন। এই অন্যায় কাজটি করার জন্য তিনি অনেক বুদ্ধি, ধৈর্য ও কৌশল প্রয়োগ করেছেন বা অবলম্বন করেছেন। কাজটি যত বড় অন্যায়ই হোক না কেন (অবশ্যই আমার দৃষ্টিতে বা অনেকের দৃষ্টিতে), কিন্তু করানো হয়েছে নির্বাচিত সংসদ দ্বারা। সে জন্যই আমি একটি কথায় জোর দিচ্ছি। 

দুর্নীতি পরিহার করে সুনীতি যদি আনতে চাই, অনৈতিকতা পরিহার করে নৈতিকতা যদি আনতে চাই, পররাষ্ট্রনীতিতে পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে যদি আত্মনির্ভরশীলতা আনতে চাই, তাহলে এ রকম সাহসী পরিবর্তনে আগ্রহী মানুষের সংসদ বা পার্লামেন্ট প্রয়োজন।

পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

পরিবর্তনের জন্য বা পরিবর্তন আনার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যায় বা যেগুলো মানুষের কাছে সুপরিচিত, সেটিও এই কলামের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। আমি নিশ্চিতভাবেই স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে তথা ব্যালটের মাধ্যমে পরিবর্তন আসুক বা পরিবর্তনের জন্য প্রেক্ষাপট প্রস্তুত হোক বা পরিবর্তনে সহায়তা করবে এমন শক্তি নির্বাচিত হোক, সেই কামনা করি। তার জন্য সংসদের ভেতরে এবং বাইরে যেসব সচেতন রাজনৈতিক দল আছে, তাদের সবার সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। একটি উদাহরণ দেই সংসদের ভেতরে অবস্থিত জাতীয় পার্টির সংসদীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ আজ থেকে ১২-১৪ দিন আগে, সংসদ অধিবেশন চলাকালে একটি করুণ আবেদনময়ী বক্তব্য রেখেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দয়া, সাহায্য, সহযোগিতা কামনা করেছেন তার নিজের দলকে বাঁচানোর জন্য। তার দলের পরিচয় পরিষ্কার করার জন্য এবং তার দলের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য। 

আমি সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এবং সংসদের বিপদগ্রস্ত বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, উভয়ের কাছেও আবেদন রাখব, এখনো সময় আছে আপনাদের ভূমিকা রাখার। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘ইট ইজ নেভার টু লেট টু স্টার্ট সামথিং গুড।’ অর্থাৎ কোনো ভালো কাজ শুরু করার জন্য, দেরি হলেও ওই দেরির কারণে শুরু করা যাবে না এমন ভাববেন না। অপর ভাষায়, দেরি হয়ে গেছে এই অজুহাতে কোনো ভালো কাজ শুরু করতে দেরি করবেন না বা দ্বিধা করবেন না। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ থেকে আজ ২১ মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত পাঁচটি কলাম লিখলাম ধারাবাহিকভাবে; একটি উপসংহারে আসার জন্য। পত্রিকার হার্ড কপি পেতে যদি কষ্ট হয়, তাহলে নয়া দিগন্তের ওয়েবসাইটে, আর্কাইভসে ঢুকে পড়তে পারেন। অথবা আমার ওয়েবসাইটে ঢুকে কলাম যেখানে আছে, সেখানে পড়তে পারেন। আমার ওয়েইসাইট মানে ইংরেজিতে এতটুকু : জেনারেলইবরাহিম.কম.বিডি। যেই উপসংহারটি তুলে ধরব সেটি আগামী ২৮ মার্চ ইনশা আল্লাহ উপস্থাপন করব। তারপর দুই সপ্তাহ কলাম লিখতে পারব না অপরিহার্য ব্যস্ততার ও বিশ্রামের অপরিহার্য প্রয়োজনে; সে জন্য অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী। 

  • নয়া দিগন্ত/২১-৩-১৮ 
  • লেখক : মেজর জেনারেল (অব:)/ বীর প্রতীক/ চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি 

ভুল সবই ভুল, যা জানি তা ভুল

শাহদীন মালিক


ভুলটা বোঝা গেল প্রথম আলোয় র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের সাক্ষাৎকারটা পড়ে (প্রথম আলো, ১৮ মার্চ)। ভুলটা আমাদের শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদের নয়। বিশিষ্ট ব্যক্তি, ভিআইপিদের নাম উচ্চারণ করা বা লেখার আগে, অর্থাৎ নামের আগে বিশেষণ ব্যবহার করা এখন অলিখিত নিয়ম। এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে খবর আছে। নেতা-নেত্রীর নামের আগে যত বেশি বিশেষণ ব্যবহার করা যায়, ততই মঙ্গল। বিশেষণ ব্যবহারকারী ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব মঙ্গলের আশায় বিশেষণগুলো দীর্ঘায়িত করেন।

দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। তখন লন্ডনে থাকতাম। কী যেন একটা রাজনৈতিক ব্যাপারে-ব্যাপারটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, আর সেটা এই কলমের জন্য মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়-একটা পত্রিকায় ওই দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা এক সাংসদের (এমপি) চিঠি ছাপা হয়েছিল। জন মেজর তখন প্রধানমন্ত্রী। এমপি সাহেব চিঠিটা শুরু করেছিলেন ‘ডিয়ার জন’ সম্বোধনে। এই অধমের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। অতিমাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করছে শুধু ‘ডিয়ার জন’ বলে! দল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কেন যে বহিষ্কৃত হলেন না, তা আজও বুঝিনি। কার নামের আগে কয়টা বিশেষণ লাগাতে হয়, তার যথাযথ তালিম নেওয়ার জন্য তাঁর কিছুদিন বাংলাদেশে অবস্থান করা জরুরি।

তিন ভিনদেশে ছাত্র ছিলাম। বহু শিক্ষকের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে। অভদ্র হয়ে গিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে। তখন থেকে অধ্যাপকদের নাম ধরেই ডাকার বা সম্বোধন করার বদভ্যাস গড়ে ওঠে। কাউকে কোনো দিন ‘ছার’ (স্যার) বলিনি। শব্দটা এখনো সহজে মুখ দিয়ে বেরোতে চায় না। সতর্ক থাকা ভালো, পাছে না ‘মাইন্ড’ করে ফেলেন। তাই শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদ।

ভারতের সংবিধানে পইপই করে ‘টাইটেল’ ব্যবহার নিষেধ করে দিয়েছে। ব্যতিক্রম দুটো, যার সাদামাটা অর্থ হলো শিক্ষক আর সেনা কর্মকর্তারা টাইটেল ব্যবহার করতে পারবেন। অধ্যাপক ও মেজর জেনারেল চলে গা! যাহোক, আপাতত শ্রদ্ধেয়ই থাক।

২. শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদের সাক্ষাৎকার পড়ে উপলব্ধি হলো যে এক যুগ ধরে ক্রমান্বয়ে ভুল করে চলেছি। সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল ‘ “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড” একটা ভুল শব্দ’। তাই তো, এত দিন ধরে ভুল শব্দ ব্যবহার করে বিরাট ভুল করে চলেছি।

লিখছি আর ভাবছি, একজন সম্পাদক বছর দুয়েক আগে অকপটে একটা কথা স্বীকার করেছিলেন। তিনি বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা খবর যাচাই-বাছাই না করে ছাপার কথা স্বীকার করে তাকে ভুল হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এরপর এক শ পুরো না হলেও এক শর কাছাকাছি মামলা খেয়েছিলেন!

অকপটে ভুল স্বীকার করার জন্য তো মামলা হওয়ার কথা নয়। সেটাই ভরসা। অবশ্য আরও ভরসা এটুকু যে বছরের পর বছর ধরে এই ভুল অগণিত ব্যক্তি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, এমনকি গণমাধ্যমও করে আসছে। আমাদের চরম সৌভাগ্য যে শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদ আমাদের সবার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন; এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় না। থ্যাংক ইউ!

অবশ্য তিনি প্রশ্নও রেখেছেন-বিচার-অন্তর্ভুক্ত হত্যাকাণ্ড কোনটি।

৩. ভুল বুঝে অনেক ভুল বা খারাপ কাজ করা হয়ে যেতে পারে। আগের বাক্যটা স্বীকারোক্তি নয়, মূল্যায়ন। ভিন্ন মূল্যায়নের জন্য মামলা খাওয়া (!) উচিত নয়। যাহোক, যা বলছিলাম, বছর আড়াই আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের বড় হলরুমে তিরিশের বেশি পরিবার সমবেত হয়েছিল। কারও ছেলে, কারও বাবা, স্বামী, ভাই নিখোঁজ। আমরা তাদের আহাজারি শুনেছিলাম প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে। তাদের প্রায় সবাইকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই অফিস, ওই অফিসে ধরনা দিয়েছে।

ছেলে হারানো বৃদ্ধ মা, বাবা হারানো বালকের কথা শুনতে শুনতে আমাদের অনেকের চোখের জল বাধ মানছিল না।

পরদিন প্রায় সব পত্রিকাতেই স্বজনহারাদের আহাজারির বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছিল।

এখন বুঝতে পারছি-সবই ভুল। তাঁরা হয় আর্থিক-ব্যবসায়িক কারণে সটকে পড়েছেন; পারিবারিক বা বৈধ-অবৈধ প্রেমজনিত কারণে গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এসব করেছেন। কেউই গুম হননি। মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে।

সাক্ষাৎকারে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে-বিচার বিভাগ কি আর স্বাধীন! ধারণা করছি, নারায়ণগঞ্জের সাত ব্যক্তি প্রথমে নিজেদের মেরেছেন। মরার পর নিজের পেট কেটেছেন। তারপর দড়ি দিয়ে পায়ে-পেটে পাথর আর ভারী বস্তু বেঁধে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন। আর শেষে আমজনতা, মিডিয়া আর আইনজীবীদের চাপে পরাধীন বিচারক র‍্যাবের কর্মকর্তা আর তাঁদের সঙ্গী ব্যক্তিদের অকারণে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির আদেশ দিয়েছেন। কারণ, র‍্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম কিছুই করে না। সবই আমাদের ভুল ধারণা।

৪. শুধু ভুলটাই শোধরাতে পারছি, তা নয়। নতুন তথ্যও জেনেছি সাক্ষাৎকার থেকে। প্রথম আলো প্রশ্ন রেখেছিল-‘এভাবে সামরিক বাহিনীকে যুক্ত করে বিশ্বের কোথাও এ রকম বাহিনী আছে কি?’ জবাবে অতি শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ‘না, এ ধরনের বাহিনী অনন্য।’

দুনিয়ায় কেউ বুঝল না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাসদস্যদের সম্পৃক্ত রাখলে সুফল মেলে। বুঝল শুধু আমাদের সরকার আর র‍্যাব। আর র‍্যাব সৃষ্টির জন্য বর্তমানে ডান্ডাবেড়ি লাগানো যে ব্যক্তির ছবি প্রিজন ভ্যান থেকে নামার সময় মাঝেমধ্যে মিডিয়ায় দেখা যায়, অর্থাৎ লুৎফুজ্জামান বাবরের নাম উল্লেখ না করলে নিঃসন্দেহে ইতিহাস বিকৃতির অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

যারা র‍্যাবকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে, র‍্যাবের সঙ্গে এনগেজমেন্টে যাওয়ার দুঃসাহস দেখায়, তারা তো মরতেই পারে এবং মরছেও। এটাই স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে সাক্ষাৎকারের মূল বক্তব্য ছিল এটাই। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সঠিক রাখার জন্য ‘লাইসেন্স টু কিল’ প্রয়োজন।

সবচেয়ে বড় ভুলটা এ জায়গায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে এক দশক ধরে যে কথা বলে চলেছি এবং বলতেই থাকব তা হলো-সফল রাষ্ট্র। দুর্বল রাষ্ট্র আর ব্যর্থ রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য মূলত একটা ব্যাপারে। দুর্বল রাষ্ট্র নিজেকে সফল রাষ্ট্রে পরিণত করতে ক্রমান্বয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বেশি বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর বহিঃপ্রকাশ প্রধানত দুই ধরনের। প্রথমত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাজেট বাড়ে, প্রযুক্তি-অস্ত্রশস্ত্র বাড়ে আর সেই সঙ্গে কমে জবাবদিহি। আস্তে আস্তে ধরো, মারো থেকে ক্রমান্বয়ে অপহরণ, চাঁদাবাজি, জমি দখল ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের বিস্তৃতি ঘটে। সেই সঙ্গে প্রতিবাদীদের সংখ্যা কমতে থাকে। দ্বিতীয় বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্যাংক-বিমা, কনস্ট্রাকশন মেরামত, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ইত্যাদি। ফল হিসেবে রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে ভঙ্গুর হতে থাকে।

আর যার জবাবদিহি নেই, তাকে জবাবদিহি করার চেষ্টা করা অর্থহীন। এটা গণমাধ্যমের ভুল। প্রথম আলো এই ভুলটি করেছে।


  • প্রথম আলো/2০-3-18
  • ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

এতটা চৌকস পেশাদার ভাড়াটে গোষ্ঠী কারা?

সম্পাদকীয়


যেকোনো বিবেচনাতেই হোক, শহীদপুত্র ব্যবসায়ী সজল চৌধুরীর ফিরে আসা একটি স্বস্তির বিষয়। তাঁর প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে যাঁরাই ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা ধন্যবাদার্হ্য। এ ধরনের অপহরণের পর কেউ কেউ ফিরে আসেন, কেউ কেউ ফেরেন না। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে সাধারণ মিলটি রয়েছে তা হচ্ছে এই অপহরণকারী চক্র সম্পর্কে আমরা আর কিছুই জানতে পারি না। এই চক্রকে চিহ্নিত করা যে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তা তারা বিবেচনায় নেয় বলে মনে হয় না।

ব্যবসায়ী সজল চৌধুরী অপহরণের ব্যাপারে ফিরে এসে নির্যাতনের যে বিবরণ দিয়েছেন, তাকে প্রাথমিকভাবে তদন্তযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। সে ক্ষেত্রে শুরুতেই এটা খতিয়ে দেখা দরকার যে নগরীতে ব্যবসায়িক বা পারিবারিক কোনো বিরোধের পরিণতিতে এভাবে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অপহরণ অভিযান এত সফলভাবে পরিচালনা করা কী করে সম্ভব হলো?

এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সে বিষয়ে আমাদের এলিট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তরফে কোনো ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। সজল চৌধুরীর বক্তব্যে র‍্যাবের প্রসঙ্গ এসেছে, সেই সূত্রে র‍্যাবের গণমাধ্যম মুখপাত্রকে আমরা কেবলই আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেখলাম। জনগণের কাছে সত্য প্রকাশের কোনো তাগিদ আমরা দেখলাম না। কারণ, র‍্যাব বা ডিবি বলে কোনো কথা নয়, সজল চৌধুরীকে যেভাবে অপহরণ করে ফেরত দেওয়া হয়েছে, তাতে সমাজে বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা অজানা ভীতি ও আশঙ্কার বিস্তার ঘটতে পারে।

‘ডিবি’ পরিচয় দিয়ে তুলে নেওয়া বা দরজার চাবির রিংয়ে দৃশ্যত র‍্যাব-১–এর লোগো ব্যবহার করার মতো বিষয়গুলো ছদ্মবেশী ভাড়াটে গোষ্ঠীগুলোর পরিকল্পিত কৌশলের অংশ হতেই পারে। কিন্তু যখন যেটা ঘটেছে বা প্রতীয়মান হয়েছে, সেসবের অবিকল বিবরণ দেওয়া ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার এবং সেসবই সরকারি তদন্ত সংস্থাগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু এসবের সত্যতা সম্পর্কে তদন্তের আগে কোনো মন্তব্য করা পেশাদারত্বের পূর্বশর্তগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

যারাই সজল চৌধুরীকে তুলে নিক, এই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্রের কোনো ইঙ্গিত এখনো মেলেনি। যেটা আপাতত পরিষ্কার সেটা হলো সজল চৌধুরী যেকোনোভাবেই হোক, ব্যক্তিগত স্বার্থের টানাপোড়েনের কারণে প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। আরও আশঙ্কা হলো এ ধরনের প্রতিহিংসা মেটানোর জন্য নগরীতে বেসরকারি বাহিনী ভাড়া করা যায় এবং যারা এমনই সাফল্যের সঙ্গে অপারেশন পরিচালনা করতে পারে, যার সঙ্গে কোনো চৌকস বাহিনীর দক্ষতার সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

অন্যদিকে বিষয়টিকে এখন যেভাবে বাহ্যত মূল্যায়ন করা হচ্ছে বা সন্দেহ করা হচ্ছে, তার সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার মিল নাও থাকতে পারে। ফলে এই ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য রহস্যভেদ ও কারা এই কাজটি করেছে তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার বিষয়টি খুবই জরুরি।

অপহরণের শিকার সজল চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের তরফে যেহেতু র‍্যাব ও ডিবির নাম উচ্চারিত হয়েছে, তাই অপহরণকারী চক্রকে ধরে তাদের প্রমাণ করা উচিত যে প্রকৃত অপকর্ম কারা করেছে। তা ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে এ ধরনের অপহরণকারীদের ধরে বিচারের মুখোমুখি করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তা করতে না পারলে সেটা বাহিনীগুলোর ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হবে। সজল চৌধুরীকে অপহরণকারীদের মতো বিপজ্জনক, চৌকস ও প্রশিক্ষিত গোষ্ঠী যদি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, তবে যে কেউ এদের শিকারে পরিণত হতে পারে।

  • প্রথম আলো/2০-3-18

আওয়ামী লীগের ঘাড়ে ‘কোন্দলের’ বোঝা

মিজানুর রহমান খান



র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) হাতে মানিকগঞ্জে ধরা পড়া ১০ জনের একটি সশস্ত্র অপহরণ চক্র সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও সামাজিক অবক্ষয় গভীরতর হওয়ার ইঙ্গিতবহ। আওয়ামী লীগ সমাজের অংশ, তাই সেখানেও বড় সমস্যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জঙ্গি দমলেও সমাজে চরমপন্থা ক্রমে বাড়ছে।

দলীয় কোন্দলের পেছনে আসলে কোনো মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব নেই কিন্তু তথাকথিত কোন্দলে গত এক দশকে দুই শর বেশি আওয়ামী লীগার বা তার সমর্থক খুন হয়েছেন। এর বিচার বিরল, তবে ফেনীর আদালত সম্প্রতি ৩৯ জনকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন। নিহত ব্যক্তি উপজেলা চেয়ারম্যান ও দলীয় সভাপতি ছিলেন। তাঁকে গুলি করে, পেট্রল ঢেলে গাড়িসুদ্ধ জীবন্ত হত্যা করল দলীয় সহযোদ্ধারাই। টাঙ্গাইলেও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যার আসামি সাংসদ আমানুর রহমান। এর বাইরে কোথাও দুষ্কৃতকারীরা দলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা দেখাচ্ছে।

১৯৯০ সালের পর প্রতি পাঁচ বছর পর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণে কোনো দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা দুর্বৃত্তায়নের ধারা স্থায়ী রূপ নেয়নি। মাঝখানে ছেদ পড়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন টানা দুই মেয়াদের শেষ দিকে, তখন স্থানীয় পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের রাশ টেনে ধরা যে কঠিন হয়ে পড়েছে, মানিকগঞ্জের ঘটনাই তার প্রমাণ। একজন চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীকে রাতারাতি ও বেআইনিভাবে দলের উপজেলা সহসভাপতি করা কি প্রমাণ করে যে দলটি ভেতর থেকে ধসে পড়ছে? এই লোকটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ‘ভোট কিনে’ স্কুল কমিটির টানা দুই মেয়াদে সভাপতি হন। এমন ঘটনা বিরল নয়।

আগে সরকারি দল এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলো চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির মতো দুর্নীতি ও মাঝেমধ্যে ছোটখাটো সংঘাতে লিপ্ত হতো। সেই চিত্র ভয়ানকভাবে পাল্টেছে। নামে-বেনামে দলটির একটি অংশ নরহত্যার মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িয়েছে। কিন্তু এই সত্য স্বীকার করতে তারা কুণ্ঠিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের চতুর্থ রিপোর্ট বলেছে, দুই মাসে (গত নভেম্বর-ডিসেম্বর) ২৪ ঘটনায় ২৬৭ ব্যক্তি আহত হন, যার মূলে দলীয় কোন্দল।

রিপোর্টে দলের নাম নেই; কিন্তু তা উল্লেখ করার দরকার হয় না। মারামারির ঘটনায় দল ব্যবস্থা নেয় না-এমন অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহর উক্তি ছিল, ‘ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। তারা সেটা করে। দলের লোক মারামারি করেছে, এটা পত্রপত্রিকা বলে। কিন্তু নিজেরা খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় না। তাহলে কীভাবে ব্যবস্থা নেব?’ দুই বছর আগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজবাহউদ্দিন সিরাজ বলেছিলেন, ‘আমাদের দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, কোন্দল নাই।’ তাঁরা উভয়ে ভ্রান্ত, কিন্তু তাঁদের সাফাই বক্তব্যের সমর্থকেরা যে দলে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতীয়মান হবেন, তাতে আর সন্দেহ কী?

২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে নিহত ১১৬ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকই ছিলেন ৭১ জন। ফেনীর ওই নৃশংস খুনের নেপথ্যের দুটি বড় কারণ, একজন ইউনিয়ন পরিষদে দলের চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে পরেননি, আরেকজন ডায়াবেটিক সমিতির নির্বাচন করতে পারেননি। প্রশ্ন হলো দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেই কি আধিপত্য বিস্তারের যে সর্বনাশা মোহ দলে যাদের পেয়ে বসেছে, তারা ভড়কে যাবে, নাকি দলকে রাজনৈতিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায়ও মনোযোগ দিতে হবে?

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘মারামারি বা অপরাধ করে রাজনৈতিক দলে কারও পদ গেছে, এর নজির কম। পদ যায় রাজনৈতিক কারণে।’ অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পত্রিকান্তরে বলেছিলেন, ‘দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়ে তাঁদের দলীয় ফোরামে আলোচনা হয় না বললেই চলে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেটা প্রকাশিত হচ্ছে, সেটা দেখে অনেক সময় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে সাত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের ঢাকায় অবস্থান এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগে তাঁদের প্রভাব না থাকায় কোন্দল কমছে না।’ 

লক্ষণীয় রূঢ় সত্য বোঝার মতো বিবেকবান ব্যক্তি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগে আছেন, কিন্তু তাঁদের শর্ত অভিন্ন, নাম প্রকাশ করা যাবে না। আশা করব, এই বিবেকবানেরা বিবেচনায় নেবেন যে প্রধান বিরোধী দল খুব বেশি দুর্বল হলে তা ক্ষমতাসীন দলের বৈধ স্বার্থ রক্ষা করে কি না। ফলপ্রসূ ‘একদলীয়’ ব্যবস্থার শক্তি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রায়ণ ও শৃঙ্খলা রক্ষা, বহুদলীয় ব্যবস্থা থেকে যা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং।

নীতিহীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির রাশ না টানলে দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন। এর মধ্যে যাঁরা মামুলি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন আর খুনখারাবি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করেছেন, তাঁরা একাকার হয়েছেন।

মানিকগঞ্জে আওয়ামী লীগের ছদ্মবেশে নিম্নবিত্ত অবস্থান থেকে উঠে আসা পিতা-পুত্র যেভাবে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং বিদ্যাপীঠের সম্পদ লুটের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটা সম্ভবত সমাজে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

মানিকগঞ্জের সেলিম মোল্লার কথিত দলীয় ‘টর্চার সেল’ (জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থে গড়া ডুপ্লেক্স) ইতিমধ্যে দেশের বহু স্থানে একটি অশুভ প্রবণতায় রূপ নিয়েছে। তাঁরা হয়তো দেখছেন, একই সঙ্গে বহু বাহিনী গুম বা ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য নাটকীয়ভাবে তুলে নেয়। বেসরকারি বাহিনী দায়টা তখন বিভ্রান্তিকরভাবে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারে। আইনের শাসন যত দুর্বল হবে, ততই প্রাইভেট বাহিনী বাড়বে। রাশ না টানলে দলের ছত্রচ্ছায়ায়, নামে-বেনামে পদ্ধতিগত প্রাইভেট বাহিনীর বিস্তার ঘটতে পারে। এলিট ফোর্স নয়, দলীয় শুদ্ধি অভিযানই এদের রুখতে পারে।

এ জন্য দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদের জীবনযাপন ও ব্যয়ের অসংগতি যাচাইয়ে একটি বড় ধরনের সাংগঠনিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। বড় উন্নয়নে বড় দুর্নীতি হওয়ার ধারণা আমরা প্রত্যাখ্যান করি। কারণ, এটা স্বীকৃত ও পরীক্ষিত যে দুর্নীতির গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসানো সমাজে উন্নয়ন টেকসই বা সুষম হয় না। দুর্নীতি দলে কোন্দল ও খুনখারাবি বাড়াচ্ছে।

গত বছর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের ‘অভ্যন্তরীণ কোন্দলে’ একটা বন্দুকযুদ্ধ হলো, তাতে সমকাল-এর সাংবাদিক প্রাণ দিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তিনি সাংবাদিকের স্ত্রীকে একটি চাকরি দিয়েছেন। এর একদিকে স্থানীয় সেই সাংসদ (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) হাসিবুর রহমান, ১৯৯৬ সালে বিএনপি ত্যাগ করে নৌকায় চেপে উপমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে ৪২০ ধারায় অভিযুক্ত হওয়ার তথ্য তাঁর গত নির্বাচনী হলফনামায় ছিল না। তাঁর অনুসারী দলের পৌর কমিটির সভাপতির সঙ্গে বর্তমান মেয়রের গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের বন্দুক লড়াই থেকে ওই খুন। সেই হত্যা মামলায় মেয়র দলের পদ থেকে বরখাস্ত ও কারাবন্দী অথচ অন্যজন পৌর কমিটির সভাপতি পদে বহাল।

টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধা খুনের আসামি আওয়ামী সাংসদ বন্দী, কিন্তু তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হননি। দল বলেছে, আদালতে ফয়সালার পর সিদ্ধান্ত। তাহলে শাহজাদপুরের আওয়ামী মেয়র কী দোষ করেছেন? ফেনীতে খুনের পরপরই কমিটি হয়, তাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বাদ পড়েন, দল এখনো কাউকে বহিষ্কার করেনি। দলের কমিটিতে অন্তত খুন ও গুমের মতো ঘটনায় অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত ব্যক্তিদের থাকতে হলে কী নিয়ম, কী নৈতিকতা, তার একটা ফয়সালা দরকার।

আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার বার্তা না দিতে পারলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা নীরবে অশ্রুপাত করবেন। ‘চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নেওয়ার ক্ষমতা কেবল আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের। আসন্ন সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ খুনখারাবি প্রতিরোধে দলটির কার্যনির্বাহী সংসদের উদ্যোগ জরুরি।

  • প্রথম আলো/2০-3-18/ সম্পাদক

Tuesday, March 20, 2018

টাকা নিয়ে উধাও জিএমজি অস্তিত্ব সংকটে ইউনাইটেড

  • শেয়ারবাজারে বিমান কোম্পানি
  • সাধারণ বিনিয়োগকারী ও ব্যাংকের ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা আটকে আছে 
  • সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায়ের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের


মনির হোসেন



চরম দুরবস্থায় পড়েছে শেয়ারবাজারে আসা দুই বিমান কোম্পানি। এর মধ্যে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩শ’ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন জিএমজি এয়ারলাইন্স।

এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। অন্যদিকে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। প্রতিষ্ঠানটি এখন নামেই টিকে আছে। ১০ টাকার শেয়ার ৪ টাকায় নেমে এলেও বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনছে না। আর এই দুই কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংকের ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা আটকে আছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি ঠেকাতে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) ব্যবস্থা নিতে হবে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়। আইনি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তিনি বলেন, সিকিউরিটিজ আইনে অধিগ্রহণের সুযোগ থাকলে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে বিএসইসিকে বিনিয়োগকারীদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। তার মতে, বর্তমান আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে কোম্পানি আইনে তার দেউলিয়াত্ব প্রমাণ হলে বিনিয়োগকারীরা আদালতে যেতে পারে।

সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে জিএমজি। এতে ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ার ৪০ টাকা প্রিমিয়ামসহ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫০ টাকা নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় বাজার থেকে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ১৬৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ প্রতিষ্ঠানটি আইপিওর (প্রাথমিক শেয়ার) মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ আরও ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহের আবেদন করে।

কিন্তু কোম্পানির আর্থিক রিপোর্টে জালিয়াতি ধরা পড়ায় ২০১২ সালে আইপিও আবেদনটি বাতিল করে বিএসইসি। নিয়ম অনুসারে আইপিও আবেদন বাতিল করার পর প্লেসমেন্টের টাকা বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে টাকা আটকে রেখেছে জিএমজি।

কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জিএমজি এয়ারলাইন্স। পরের বছর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা ৭ বছর প্রতিষ্ঠানটি লোকসানি ছিল। এ সময়ে মোট লোকসানের পরিমাণ ৪২ কোটি টাকা।

২০০৬ এবং ২০০৭ সালে ১ কোটি টাকা মুনাফা দেখায়। কিন্তু ২০১০ সালে অলৌকিকভাবে বেড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা। ওই বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রতিষ্ঠানটি ৭৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মুনাফা দেখায়। তিন বছর পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। শেয়ারবাজারে কারসাজি নিয়ে গঠিত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮ সালের স্থিতিপত্রে হঠাৎ করে ৩৩ কোটি টাকার পুনর্মূল্যায়ন উদ্বৃত্ত দেখানো হয়।

এর ব্যাখ্যায় জিএমজি বলেছে, তাদের দুটি বিমানের সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে বিমান দুটি বেশ পুরনো। স্বাভাবিক নিয়মে পুরনো বিমানের সম্পদের দাম আরও কমার কথা। কিন্তু আলাদিনের জাদুর চেরাগের মতো দাম বাড়িয়ে দেখিয়েছে জিএমজি। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে জিএমজির ২৩০ কোটি খেলাপি ঋণ রয়েছে। এই টাকা আদায়ে ২০১৬ সালে সালমান এফ রহমানের বাড়ির নিলাম ডাকা হয়েছিল। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় শেষ পর্যন্ত তা আটকে যায়।

অন্যদিকে ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ইউনাইটেড এয়ার। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ৮২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৭০ দশমিক ৪৩ শতাংশ বা ৫৮৪ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং উদ্যোক্তাদের ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। কিন্তু বিএসইসির নিয়ম অনুসারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া এককভাবে প্রত্যেক পরিচালকের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

গত ৬ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। পুরনো উড়োজাহাজ ব্যবহারের কারণে জ্বালানি খরচ বেশি। বিলম্বিত কর আমলে নেয়ার পর থেকেই মুনাফা কমে গেছে প্রতিষ্ঠানটির। এর আগে শেয়ারবাজার থেকে রাইট শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে উড়োজাহাজ কেনা হলেও প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। বরং বেশি দামে উড়োজাহাজ কেনার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এরপর আর্থিক সংকট কাটাতে নতুন করে রাইট শেয়ার ছাড়তে চেয়েছিল তারা।

কিন্তু উদ্যোক্তাদের ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকায় অনুমতি দেয়নি বিএসইসি। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছেও ইউনাইটেড এয়ারের শত কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। বর্তমানে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার টাকায় ৪ টাকায়ও কেউ কিনছে না। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।

  • যুগান্তর/২০-৩-১৮