Search

Sunday, March 25, 2018

ময়নাতদন্তের ভুলে হত্যা হয়ে যায় আত্মহত্যা

আহমেদ জায়িফ



কোনো কোনো লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে স্পষ্ট আঘাতের কথা উল্লেখ ছিল। কোথাও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেই ছিল খুনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা এসব কিছুই আমলে নেননি। শুধু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। অথচ পরে জানা যায়, লাশের ময়নাতদন্তই ভুল ছিল। আগে যে ঘটনাগুলোকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হয়েছিল, আদতে তা ছিল খুন। 

খুনের এ রকম ১০টি ঘটনার কথা উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই। প্রতিবেদনটি ধরে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খুনের মতো নৃশংস একটি অপরাধে পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো তদন্তই করেননি। হত্যার এই ঘটনাগুলোকে আত্মহত্যা বলে পুলিশের প্রতিবেদন দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থের লেনদেন, তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি ও পক্ষপাতিত্ব ছিল। 

তদন্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যার স্পষ্ট আলামত থাকা সত্ত্বেও ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দেওয়াটা তদন্তপ্রক্রিয়ারই ব্যর্থতা। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা দুটি উদাহরণ শুনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও চিকিৎসক প্রভাবিত হয়েছিলেন। এখানে লেনদেনের ঘটনাও ঘটতে পারে। এটা পুরো ব্যবস্থার (সিস্টেম) গলদ। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ 

ছিল খুনের ইঙ্গিত, তদন্তে আত্মহত্যা

রাজধানীর চকবাজারের একটি বাসা থেকে ২০১০ সালের ২৩ জুন আনিসুর রহমান নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক মতামত দেন, আনিস আত্মহত্যা করেছেন। একাধারে থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ তদন্ত শেষে একই মতামত দেয়। 

কিন্তু মামলার বাদী আনিসের ভাই জাহাঙ্গীর মিয়া তৃতীয়বারের মতো নারাজি দিলে আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। পাঁচ বছর পর তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রেমের সম্পর্কের জেরে আনিসুর রহমান খুন হয়েছিলেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুই আসামি গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। 

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, আনিসের মাথার পেছনের অংশে কাটা দাগ ও রক্তক্ষরণ, বাঁ ঊরুতে তিন থেকে চারটি কাটা চিহ্ন, বুকের বাঁ পাশে খামচির দাগ ছিল। সুরতহাল প্রতিবেদনেও এসব চিহ্নের কথা উল্লেখ ছিল। ঘটনাস্থলেই রক্তমাখা একটি বাটালি ফেলে রাখা ছিল। কিন্তু ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বা তদন্ত কর্মকর্তারা এর কিছুই আমলে নেননি। চিকিৎসক সঠিকভাবে ময়নাতদন্ত না করেই আত্মহত্যা বলে মত দিয়েছিলেন। 

গাজীপুরের শ্রীপুরে সুমাইয়া আক্তার ফারহানা নামের এক গৃহকর্মীর মরদেহের সুরতহালে শরীরে বিভিন্ন আঘাতের কথা উল্লেখ ছিল। অথচ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মতামত দেওয়া হয়, সুমাইয়া আত্মহত্যা করেছিলেন। থানা-পুলিশও সে অনুযায়ীই ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে আদালতে প্রতিবেদন দেয়।

রাসায়নিক ও ডিএনএ পরীক্ষার পরও ময়নাতদন্তে ভুল

২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে শ্বশুরবাড়িতে তিন সন্তানের জননী নিলুফা আখতার বাখারাকে (২৫) শ্বাসরোধে হত্যা করেন তাঁর দেবর। নিলুফারের ময়নাতদন্ত এবং ভিসেরা ও হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসক মতামত দেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ ও সিআইডিও তাদের তদন্তে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করে। পরে পিবিআইর তদন্তে আসে ধর্ষণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নিলুফারের দেবর তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। 

গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমানকে। আর তাঁর বান্ধবী সুমাইয়া নাসরিনকে হত্যা করা হয়েছিল ধর্ষণের পর বালিশচাপা দিয়ে। অথচ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মিজান আত্মহত্যা করেছেন। আর সুমাইয়াকে যে ধর্ষণ করা হয়েছিল, সে বিষয়টিও উঠে আসেনি ডিএনএ টেস্টে।

ময়নাতদন্ত-প্রক্রিয়ার পরিবর্তন চায় পিবিআই 

পিবিআই বলছে, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা ডোমদের ওপর ‘অতিমাত্রায়’ নির্ভরশীল। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রভাবকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেদন দেওয়া, সাক্ষী হওয়ার ভয়ে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের ময়নাতদন্তের কাজে অংশ না নেওয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকাও ময়নাতদন্ত ভুল হওয়ার কারণ বলে মনে করে সংস্থাটি। 

পিবিআইর অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মাইনুল ইসলাম বলেন, ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়ায় ভালো যন্ত্রপাতি যুক্ত করতে হবে। এ কাজে যুক্ত চিকিৎসকদের জন্য যথাযথ আর্থিক বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকা উচিত। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ও মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি সেলিম রেজাও রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের চাপে চিকিৎসকেরা প্রভাবিত হন বলে মনে করেন। 

ময়নাতদন্ত করে কেউ আত্মহত্যা করেছে, না হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে ফরেনসিক চিকিৎসকের মতামত দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন সিআইডির ডিআইজি ভানু লাল দাস। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক শুধু মৃত্যুর কারণ বলবেন। এটি হত্যা না আত্মহত্যা, সেটা বের করার দায়িত্ব পুলিশের।’

  • প্রথম আলো / মার্চ ২৪, ২০১৮ 


সম্পাদকীয় - ব্যাংকে তারল্যসংকট



কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংক সমস্যায় পড়লেও সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাত ভালো অবস্থায় আছে এবং ব্যাংকে কোনো তারল্যসংকট নেই। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের মিল আছে বলে মনে হয় না। 

গত বুধবার প্রথম আলোতে ‘বাড়ছে ডলারের দাম ও সুদহার: ব্যাংকে অর্থসংকট’ শিরোনামে যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসা–বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবারই উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। কেননা, ব্যাংকের তারল্যঘাটতি তো শুধু ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি বাড়াবে না। শিল্প–ব্যবসা-বাণিজ্য তথা জনজীবনেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। 

পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে একদিকে আমানত কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে ডলারের দাম ও সুদহার বাড়ছে। দুই দিক থেকেই দুঃসংবাদ। কম সুদে আমানত পাওয়া না গেলে ব্যাংক বেশি সুদে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করবে। শেষ পর্যন্ত চাপটা পড়বে ঋণগ্রহীতার ওপরই। 

প্রথম আলোর প্রতিবেদনমতে, তারল্যসংকটের কারণে বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক শাখাগুলোতে ঋণ দেওয়ার সীমা কমিয়ে দিয়েছে। আগে কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া শাখা ব্যবস্থাপকেরা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারতেন। এখন সেই ঋণ দিতে কেন্দ্রের অনুমোদন লাগবে। শুধু ইসলামী ব্যাংকে নয়, অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকেও আমানত ঘাটতি আছে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক এই ঘাটতি পূরণে কর্মীদের বেশি বেশি আমানত সংগ্রহের জন্য চাপ দিচ্ছে। কখনো কখনো চাকরির শর্ত হিসেবেও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকলে এর প্রয়োজন হতো না। 

মাস কয়েক আগে বেসরকারি ব্যাংক ফারমার্স আমানতসংকটে পড়লে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা দেখা দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেয়। এর আগে আর্থিক অনিয়মের কারণে ব্যাংকটিকে জরিমানা করা হয়েছিল, পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আবার সংশ্লিষ্টদের চাপে পিছিয়ে আসে। 

এই প্রেক্ষাপটে তারল্যসংকট যে নতুন করে ঝুঁকি তৈরি করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। নির্বাচনের বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার কী পদক্ষেপ নেয় এবং সেই পদক্ষেপের প্রতি ব্যবসায়ী ও গ্রাহকেরা কতটা আস্থা রাখতে পারেন, তার ওপরই নির্ভর করবে সেই অনিশ্চয়তা কাটবে কি কাটবে না। 

প্রথম আলোর খবরে আরও বলা হয়, কোনো কোনো ব্যাংক ১৩ শতাংশ সুদহারে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত নিচ্ছে, যা কিছুদিন আগেও ছিল এক অঙ্কের ঘরে। সুদের হার নিয়েও একধরনের বিশৃঙ্খলা রয়েছে, যা সুস্থ ব্যাংকিংয়ের সহায়ক নয়। ব্যাংকগুলোতে আমানত সংগ্রহের বিষয়ে প্রতিযোগিতা থাকবে। কিন্তু সেটি হতে হবে নিয়মনীতি মেনে। কোনো ব্যাংক যদি ১৩ শতাংশ সুদে আমানত গ্রহণ করে, গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সেই সুদ ১৭–১৮ শতাংশে পৌঁছাবে। সে ক্ষেত্রে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।

ব্যাংকিং খাতের এই সংকটের মুখে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আরও চাপ বাড়িয়েছে। এর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে ও রপ্তানি আয় কমবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। এখানেও ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে অনুৎপাদনশীল খাতে আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। 

নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো রকম অনিশ্চয়তা তৈরি না হয়, সে বিষয়েও সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। বিভিন্নমুখী সমালোচনার মুখে ঋণ আদায়ে যে কিছুটা গতি এসেছে, সেটি অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই।

  • প্রথম আলো / মার্চ ২৪, ২০১৮

অসম্ভবকে ‘সম্ভব’ করে তাঁর সুপারিশ

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানও সরকারের আর্থিক বরাদ্দ পেয়েছে বাঁশখালীর সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সুপারিশে।


বাস্তবে যে শ্মশানের অস্তিত্ব নেই, সেই শ্মশান সংস্কারের জন্য কি টাকা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব? যাঁরা ভাবছেন ‘অসম্ভব’, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের ভুল ভাঙবে। যে সংগঠনের চিহ্ন দুনিয়াতে নেই, সে সংগঠন কি কখনো সরকারি টাকা বরাদ্দ পাবে? সহজ উত্তর হচ্ছে বাঁশখালীর সাংসদ সুপারিশ করলে টাকা পাবে।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সুপারিশে এমন কিছু সংগঠন সরকারি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে, যেসব সংগঠনের নাম শুধু কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। অবশ্য শুধু অস্তিত্বহীন সংগঠনের জন্যই তিনি সুপারিশ করেন বিষয়টি এমন নয়। বাস্তবে আছে এমন সংগঠনকে বরাদ্দ দিতেও সুপারিশ করেছেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, ওই সংগঠনের লোকেরা বিষয়টি জানেন না। ফলে বরাদ্দ হওয়া টাকা সংগঠনগুলো পায়নি।

কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) এবং গ্রামীণ রক্ষণাবেক্ষণ (টেস্ট রিলিফ বা টিআর) প্রকল্পের আওতায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাঁশখালীর ৩৬৫টি প্রকল্পের জন্য সুপারিশ করেন সাংসদ। এতে বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম আলো উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ডের আটটি প্রকল্পের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়। এর মধ্যে ছয়টি প্রকল্পের জন্য জমা দেওয়া স্থাপনা বা সংগঠনের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সাংসদ হন মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তবে তিনি আলোচনায় আসেন ২০১৬ সালে। ওই বছরের ২ জুন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে পিটিয়ে খবরের শিরোনাম হন তিনি।

অস্তিত্ব নেই, অস্তিত্ব আছে
সাংসদের সুপারিশে বাঁশখালী পৌরসভার উত্তর জলদীর ‘কেবল মহাজনপাড়া শ্মশান’-এর উন্নয়নের জন্য গত অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে পাড়াটি। স্থানীয় বাসিন্দারা এই নামের কোনো শ্মশানের সন্ধান দিতে পারেননি। পরে ওয়ার্ড কাউন্সিলর দিলীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওয়ার্ডে তিনটি শ্মশান রয়েছে। ‘কেবল মহাজনপাড়া শ্মশান’ বলে কিছু নেই।

একই ওয়ার্ডে সর্বজনীন সহমরণী শিবধাম সংস্কারের জন্য সাংসদের সুপারিশে ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই স্থাপনাটি থাকলেও বরাদ্দ করা টাকা পায়নি শ্রীধাম (মন্দির) কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিশ্চিত করেন মন্দির পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কাউন্সিলর দিলীপ চক্রবর্তী।

উপজেলার বৈলছড়ি ইউনিয়নের মির্জাকাটা কবরস্থান সংস্কারের জন্য গত অর্থবছরে গ্রামীণ রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের আওতায় সাংসদের সুপারিশে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। মির্জাকাটা জামে মসজিদের পাশে একই নামের কবরস্থান। মির্জাকাটা মসজিদের ইমাম আবুল বশর জানান, কয়েক বছর আগে একটি বরাদ্দ পেয়েছিল মসজিদের পরিচালনা কমিটি। কবরস্থান সংস্কার হতে দেখেননি।

এ বিষয়ে মির্জাকাটা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আমিরুজ্জামান বলেন, কবরস্থান সংস্কারের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ পাননি তাঁরা।

ভুয়া প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংসদ মোস্তাফিজুর মোস্তাফিজুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। আপনারা একজন এমপির বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা লিখবেন?’

অবশ্য বাঁশখালী পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সেলিমুল হক চৌধুরী বলেন, টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বাঁশখালীর সাংসদ এবং তাঁর লোকজন দায় এড়াতে পারেন না।

পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ‘দক্ষিণ জলদি যুব উন্নয়ন পরিষদ’-এর জন্য গত অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ওয়ার্ডের গুরা পুকুরপাড় এলাকায় ‘একতা সংঘ’ এবং মহাজনপাড়ায় ‘জাগরণ যুব সংগঠন’ নামের দুটি সংগঠন রয়েছে। জাগরণ যুব সংগঠনের সভাপতি খোকন দাশ বলেন, ‘যুব উন্নয়ন পরিষদের’ নাম কখনো শোনেননি তিনি।

ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাবলা কুমার দাশ বলেন, কয়েক বছর আগে ‘যুব উন্নয়ন পরিষদ’-এর একটা ব্যানার রাস্তায় টাঙানো ছিল।

উপজেলার সরল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাইরাং চৌধুরীপাড়ার ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’-এর ঘর নির্মাণের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু ওয়ার্ডে এই সংগঠন নেই। তবে চৌধুরীপাড়া থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বঙ্গবন্ধু পরিষদের একটি কার্যালয় আছে। সংগঠনের সভাপতি শহীদুল ইসলাম বলেন, কখনো সরকারি বরাদ্দ পাননি তাঁরা।

চাম্বল ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব চাম্বল শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদকে ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ওয়ার্ডে না থাকলেও পাশের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের কার্যালয় রয়েছে। সংগঠনের সভাপতি শেফাইতুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের শেষের দিকে সংগঠনের যাত্রা শুরু। এখন পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দ পাননি।

কাথারিয়া ইউনিয়নে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদকে ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, ২০১৪ সালে নয় হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলেন। এরপর আর কোনো বরাদ্দ পাননি।

পুঁইছড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তরপাড়ার ‘সুফিয়া ফাউন্ডেশন’-কে ৩৭ হাজার ১০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওয়ার্ডের বিভিন্ন পাড়া ঘুরে এর কার্যালয় পাওয়া যায়নি। পরে পুঁইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোলতানুল গণি চৌধুরী এবং উত্তর পাড়া এলাকার দায়িত্বে থাকা ইউপি সদস্য মো. কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁরাও এই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম এবং কার্যালয় কোথায় তা বলতে পারেননি।

ভুয়া প্রকল্পের বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম মিয়াজীর দাবি, প্রকল্প যাচাই করেই বরাদ্দের অর্থ ছাড় দেওয়া হয়।

হলফনামায় গরমিল
২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী উল্লেখ করেছিলন, তাঁর কৃষিজমি আছে চার একর, তিন কাঠার প্লট রয়েছে, ব্যাংকে আছে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং নগদ ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে ব্যাংকে জমা ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং নগদ ৩৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। হলফনামায় বাড়ি থাকার তথ্য দেননি তিনি। অথচ চট্টগ্রামের ষোলশহরের রহমান নগরে তাঁর পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে।

বাড়ির তথ্য গোপন রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘শহরের বাড়িটি আমার স্ত্রীর নামে। তাঁর বাড়ির তথ্য আমি কেন হলফনামায় দেব?’ কিন্তু স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব এবং নগদ টাকার তথ্য হলফনামায় দিয়েছিলেন-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনি কি আয়কর বিভাগের কেউ? আপনাকে কেন প্রশ্নের জবাব দিতে হবে? আমার স্ত্রী আয়কর দেন।’

সাংসদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন
সাংসদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সস্মেলন করেছিল বাঁশখালী আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ। এতে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান এবং ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে টিআর ও কাবিটা প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়। এই দুর্নীতির জন্য সাংসদ ও তাঁর লোকজনকে দায়ী করেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আবদুল্লাহ কবির। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাঁশখালী আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রথমে মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। পরে মনোনয়ন দেওয়া হয় মোস্তাফিজুর রহমানকে।

সত্য বলতে হবে 
সাংসদের সুপারিশে ভুয়া প্রকল্পে টাকা বরাদ্দের বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রোজিয়া সুলতানা বলেন, ‘বরাদ্দের খুব সামান্য অংশই বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে। অনেক প্রকল্পের অস্তিত্বই নেই। এই সত্য কথাগুলো আমাদের বলতে হবে।’ 

রোজিয়া বাঁশখালী পৌরসভার সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।

দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানায়, বাঁশখালীতে টিআর এবং কাবিটা প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা অনুসন্ধান শুরু করেছেন।

  • প্রথম আলো/মার্চ ২৪,২০১৮

River blocked at Sirajdikhan to facilitate brick kiln

Munshiganj 


A Baluchar Union Parishad member has initiated a move to construct an approach road splitting a distributary of the river Dhaleshwari at Siranjdikhan upazila under the district to facilitate supplies to a brick field.

During a visit to the spot, it was found that the road was being constructed across the river to facilitate supply of raw materials to the UP member-owned brick kiln National Bricks on the bank of the river. 

The UP member Amzad Hossen said the river became dead four years ago.

Justifying the construction of the approach road, Amzad said the road was being developed on demand of the local people. Local people, however, remained silent against the river grabbing fearing harsh consequences. 

They told this correspondent that the river was lifeline to their economic activities and a water-source for household activities. They also raised concerns over the unauthorised brick kiln owned by Amzad. 

Sirajdikhan upazila nirbahi officer Tanbir Mohammad Tanbir said they would take necessary actions if any violation of law was found. Baluchar UP chairman Abu Bakkar Siddique said the UP member was asked to halt construction of the road. 

Senior chemist of the district’s Department of Environment Abdullah Al Mamun said Amzad’s brick kiln had no clearance certificate. He said in no way the approach road splitting the river would be allowed.

  •  Courtesy: The New Age Mar 25, 2018

Saturday, March 24, 2018

স্বৈরশাসন তালিকায় বাংলাদেশ বিতর্ক: কীভাবে দেখছে বিএনপি?


বিবিসি বাংলা/ মার্চ ২৪, ২০১৮ 

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি (ফাইল ফটো।)

বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না বলে একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মন্তব্যের পক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বিরোধীদল বিএনপি।

ঢাকার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন: "আমরা এত দিন ধরে যে কথাগুলো বলছিলাম আজকে তা বিশ্বে স্বীকৃত হয়েছে। এই গবেষণার মধ্য দিয়ে আমাদের বক্তব্যের প্রতিফলন হয়েছে।"

বিশ্বের ১২৯টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান 'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং' মন্তব্য করে, "বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না।"
রিপোর্টটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয় যা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন: "এই গবেষণায় আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে যারা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম তারা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করছি। এবং আমরা এর নিন্দা জানাচ্ছি"।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দায়ী করে তিনি বলেন, "সরকার স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে বাংলাদেশকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে গেছে।"

অন্যদিকে আরেক প্রতিক্রিয়ায় লন্ডন থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা আবু সায়েম বলছেন, "গত নয়টি বছর বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছে কেবল এক ব্যক্তির তুঘলকি খেয়ালখুশিতে। ভিন্নমত দমনে প্রয়োগ করা হয়েছে গুম, খুন, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার মতো পৈশাচিক সব পদ্ধতি।"

ঢাকায় বিএনপি সমর্থকদের বিক্সোভ মিছিল।

দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার সমালোচনা করে তিনি উল্লেখ করেন, "বিদ্যমান আইন ও কার্যবিধির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে শত বছরের পুরানো ও পরিত্যক্ত কারাগারে।"

"অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সরকারের স্বৈরাচারী মানসিকতার শিকার। বেআইনি পন্থায় আদালতকে প্রভাবিত করে তার বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। গত প্রায় দশ বছর লন্ডনে নির্বাসনে থাকা সত্ত্বেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে সত্তরটির ওপরে মামলা।"

'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং'-এর সমীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন তিনি।

মি. সায়েম অভিযোগ করেন, সরকার "বরাবরের মতো এবারো বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে কলঙ্কের বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে।"

এসময় তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে "অবাধ, সুস্ঠু ও নিরপেক্ষ" নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হেফাজতে মৃত্যু, কিছু প্রশ্ন ও বাহিনীর দায়বদ্ধতা


ফারহানা পারভীন/বিবিসি বাংলা, ঢাকা/মার্চ ২৩, ২০১৮ 

 
বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর অভিযোগ প্রায়ই করে থাকেন মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা

মার্চের ১২ তারিখ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের চিত্র। স্ট্রেচারে পরে আছে জাকির হোসেন মিলন নামের এক ব্যক্তির মরদেহ। পাশেই তার স্বজনদের আহাজারি আর অভিযোগ।

জাকির হোসেন মিলন ছিলেন তেজগাঁও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানব-বন্ধনে অংশ নিতে প্রেসক্লাবে সামনে গিয়েছিলেন মার্চের ৬ তারিখে।

সেখান থেকেই পুলিশ গ্রেফতার করে তাকে। এর পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের রিমান্ডে ছিলেন তিন দিন। জাকির হোসেনের চাচা মো: ওয়ালিউল্লাহ বলছিলেন, রিমান্ডে নেয়ার পর ১১ই মার্চ প্রথম যেদিন তিনি জাকির হোসেনকে দেখেন সেদিনের কথা।

তিনি বলছিলেন " প্রিজন ভ্যানে যখন উঠালো তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম 'বাবা মিলন তুমি কেমন আছো? সে বললো চাচা আমার শরীরটা ভালো না, আমি মনে হয় বাঁচবো না-সে কাঁদলো এই কথা বলে। আমার চোখেও পানি কিন্তু আমি বাসায় যেয়ে কাউকে বলিনি কারণ সবাই ভেঙ্গে পরবে তাই।"

পরদিন সকালে জাকির হোসেনের মৃত্যুর খবর পান মি: ওয়ালিউল্লাহ । তিনি বলছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে যেয়ে তিনি দেখেন মি: হোসেনের মরদেহ পড়ে আছে।

শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন। তিনি জোর দিয়ে অভিযোগ করছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রিমান্ডে থাকার সময় মৃত্যু হয়েছে মি: হোসেনের। মো: ওয়ালিউল্লাহ বলছিলেন মরদেহের কোন ময়নাতদন্ত করা হয় নি।

তিনি বলছিলেন "আমাদের পিছনে ডিবির লোক, পুলিশের লোক, আমরা তো ময়না তদন্ত করতে পারিনি। কোন রকম লাশ বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের, আমি চাচা হিসেবে সাইন করেছি। এরপর যখন মিলনের জানাজা হয় সেখানে অনেক পুলিশ এবং সাদা পোশাকে ডিবির লোক ছিল। তাই ভয়ে অনেকেই জানাজায় আসেনি"

বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর অভিযোগ প্রায়ই করে থাকেন মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা


জাকির হোসেনকে আটক করা হয়েছিল শাহবাগ থানায়।

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: হাসানের কাছে জাকির হোসেনের আটক, হেফাজতে মৃত্যু এবং পরিবারের অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এই একই বিষয় নিয়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কথা বললে তারাও মন্তব্য করতে চাননি।

জাকির হোসেনের মত আরো দুইটি পরিবারের সাথে আমার কথা হয়েছে যাদের পরিবারের সদস্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছে বলে পরিবারগুলো দাবি করেছিল একসময়।

কিন্তু এখন তারা 'অন-রেকর্ড' সে বিষয়ে আর কথা বলতে চাননা। তারা বলছিলেন তাদের নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য এখন আর ঐ বিষয়ে কথা বলতে চান না।

এদিকে বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হেফাজতে মারা গেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা গেছেন ৭৮ জন।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ

সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে যদি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অন্যায় কাজ।

তিনি বলছিলেন "পুলিশ যখন হেফাজতে নেয় তার মানে তাকে সুরক্ষার জন্য নেয়। একজন দোষী সাব্যস্ত হয় নি শুধুমাত্র তার উপর একটা অভিযোগ এসেছে। সেই হেফাজতে নিয়ে পুলিশই যখন তাদের উপর নির্যাতন করে তার মানে পুলিশ রক্ষকের ভূমিকা থেকে ভক্ষক হয়ে যায়। এবং এটা একটা জঘন্যতম অপরাধ। পুলিশ রাষ্ট্রের অঙ্গ, তাই এটা রাষ্ট্রের মাধ্যমে সংগঠিত হচ্ছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অন্যায়"।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ কি পরিমাণে রয়েছে এবং তাঁর কতগুলো বিচার করা হয়েছে - এই তথ্য জানতে আমি একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেছি।

একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এই ধরণের অপরাধের প্রমাণ পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শাস্তি হয় কিন্তু সেগুলোর তালিকা বা তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না।

তবে দুটি ঘটনা গণমাধ্যমের খবর হয়েছিল, একটি ১৯৯৮ সালে- শিক্ষার্থী রুবেল হোসেন ডিবি পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় মৃত্যু বরণ করে।

এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় ২০০২ সালের ১৭ জুন রায় দেন বিচারিক আদালত। তখন ডিবি পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার মো: আকরাম হোসেনসহ ১৩ জনকে যাবজ্জীবন দেয় আদালত।

এই রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই আপিল করে আসামিপক্ষ। এরপর হাইকোর্ট ১৩ আসামিকে খালাস দেন।

আরেকটি ঘটনা ২০০৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পুলিশের হাতে খুন হয়েছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক মো: মোমিন।

মোমিন হত্যা-মামলায় কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে ২০১১ সালের ২০ জুলাই মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। তবে রফিকুল ইসলাম কারাগারে থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা

হেফাজতে মৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা বলছিলেন এই ধরণের মৃত্যুর ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য প্রচলিত আইনি সাহায্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চেষ্টা থাকা উচিত।

তিনি বলছিলেন "তারা প্রাথমিক পর্যায়ে সাহায্যের জন্য মানবাধিকার কমিশনে যেতে পারে, সেখানে তদন্তে কী আসলো সেটা দেখতে পারে। পরে নিম্ন আদালত ,উচ্চ আদালত রয়েছে। যেকোন ফৌজদারি কেস থানায় না নিলে আপনি আদালতে যেতে পারেন। এছাড়া এ ধরণের কাজের সাথে যারা জড়িত (পুলিশ) তাদের দ্বারা এই ঘটনা ঘটবে না এটা একেবারে বলা যায় না। তবে এটা কমিয়ে আনা উচিত। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চেষ্টা থাকতে হবে যাতে করে এধরনের পেশাদার বাহিনীকে তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন"।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন এ বলা হয়েছে "কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে যদি নির্যাতন করেন এবং উক্ত নির্যাতনের ফলে উক্ত ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহা হইলে নির্যাতনকারী এই আইনের ধারা ১৩ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তজ্জন্য তিনি অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং উহার অতিরিক্ত দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন"।

কিন্তু এই আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিজেদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এর কিছু ধারা পরিবর্তন করার জন্য বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশও করা হয়েছে।

বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম এই আইন হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে কতখানি সুরক্ষা দিচ্ছে? আর আইন পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী?

তিনি বলছিলেন "এই আইনের কিছু ত্রুটিতো আছেই। এই আইনটাকে রিফাইন করতে হবে। যারা হেফাজতে মৃত্যুবরণ করবে তাদের পরিবার যাতে করে সুরক্ষা পায় এবং এই দৃষ্টান্ত যাতে স্থাপন হয় যে হেফাজতে মৃত্যু হলে সেটা আমরা সাধারণভাবে গ্রহণ করবো না। এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিবো"।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে প্রত্যেক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেটা ব্যাপক উদ্বেগজনক।

মি. হকের কাছে প্রশ্ন করা হয় প্রত্যেক বছর অন্তত ৪০/৫০ টা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা দিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো, কেন এটা কমিয়ে আনা যাচ্ছে না বা কেন এমনটা হচ্ছে?

তিনি বলেন "যদি ৫ জনেরও মৃত্যু হয় সেটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া একটা সমষ্টিগতভাবে কোন বাহিনী করছে এমন নয় কারণ আমরা তদন্ত করতে যেয়ে দেখেছি এটা একটা ব্যক্তি বিশেষের কাছে। তবে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে আইনটি হচ্ছে সেটাতে যেখানে হেফাজতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার সঠিক বিচার হবে, একই সাথে অযথা যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হয় সেটাও দেখা হবে"।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে প্রত্যেক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেটা ব্যাপক উদ্বেগজনক।

এদিকে এই সংক্রান্ত যে আইন আছে সেটা পরিবর্তনে সুপারিশ করেছে কয়েকটি বাহিনী।

অন্যদিকে পরিবারগুলো বিচার চাওয়ার পরিবর্তে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এখন আতঙ্কে দিন পার করছেন।

এই অবস্থায় আইনমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী বিদ্যমান আইনটি পরিবর্তন হয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের উপকারে কতখানি আসবে সেটার উপর নজর থাকবে।

'রিজার্ভ চুরির হোতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে আছে'


আকবর হোসেন/ বিবিসি বাংলা, ঢাকা/মার্চ ২৩, ২০১৭

ফিলিপিনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাক্সিম লুকাস। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ফাঁস করেছিলেন।

 

আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক তহবিল লোপাটের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা।

চুরি হওয়া আট কোটি দশ লাখ ডলার চলে গিয়েছিল ফিলিপিনের ব্যাংক ও জুয়ার বাজারে । সে অর্থ ফেরত আনার জন্য তদ্বিরও করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বিষয়টি এখন সে দেশে অনেকটাই স্থবির আছে।

এর দুটো কারণ আছে বলে জানালেন ফিলিপিনের ইনকোয়ারার পত্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাক্সিম লুকাস, যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রথমে বিস্তারিত ফাঁস করে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন।

প্রথমত, ফিলিপিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। দ্বিতীয়ত: সে দেশের অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, ব্যাংক তহবিল লোপাটের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ-কেউ জড়িত।

বিষয়টি নিয়ে ফিলিপিন সংসদের উচ্চ-কক্ষ সেনেটে বেশ কয়েকবার শুনানিও হয়। টেলিফোনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মি: লুকাস বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ফিলিপিনের আইন-প্রণেতারা গত কয়েকমাসে বিষয়টিকে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

গত বছরের মাঝামাঝি ফিলিপিনে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। সে দেশে নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাসীন হয়েছেন। দেশটির সংসদের উচ্চ-কক্ষ সেনেটে এখন নতুন নেতৃত্ব। ফলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে গেছে।

মি: লুকাস বলেন, " গত বছর শুনানি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যেসব সেনেটর ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের অনেকেই সর্বশেষ নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেন নি। বিশেষ করে যে সেনেটর সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন, তিনিও নির্বাচনে জয়লাভে ব্যর্থ হয়েছেন। ফিলিপিনের আইন প্রণেতারা এখন দেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের চুরি যাওয়া টাকার নিয়ে শুনানির বিষয়টি এখন চাপা পড়ে আছে।"
 
বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘ্টনায় ফিলিপিনের সেনেটের শুনানির একটি দৃশ্য

এ শুনানি সহসা শুরু হবে কি-না সে বিষয়ে কোন ধারণা করতে পারছেন না ফিলিপিনের এ সাংবাদিক। সে দেশের আইন প্রণেতারা বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের অর্থ ফিলিপিনে কোথাও আছে। কিন্তু এটি খুঁজে বের করার বিষয়ে কেউ কোন আগ্রহ পাচ্ছে না।

এ টাকা চুরির ঘটনায় কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফিলিপিন কর্তৃপক্ষ সে দেশে মামলা দায়ের করেছে। এদের মধ্যে আরসিবিসি ব্যাংকের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছে।

এখন এ মামলাটি আদালতে বিচারাধীন আছে। ফিলিপিনে যাওয়া টাকার মধ্যে কিছু টাকা বাংলাদেশ ফেরতও পেয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ টাকা এখনো পায়নি। 

গত বছরের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল চুরির টাকা উদ্বার করতে ফিলিপিনের সহায়তা পাবার আশায় সে দেশ সফর করেছিলেন। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি বলে মনে হচ্ছে।

সাংবাদিক মি: লুকাস জানালেন, " বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে ফিলিপিনের তরফ থেকে বলা হয়েছে, রিজার্ভ চুরির হোতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে আছে বলে তাদের ধারণা। বাংলাদেশ তদন্তে কী ধরনের তথ্য পাচ্ছে সেটিও ফিলিপিনকে দেখানোর জন্য বলেন সে দেশের কর্মকর্তারা।"
বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল ফিলিপিন সফর করার পর সেখানে আর কোন অগ্রগতি নেই বলে উল্লেখ করেন এ অনুসন্ধানী সাংবাদিক।

মি: লুকাস জানালেন, তার সাথে ফিলিপিনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলাপ হয়েছে। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের যে প্রতিনিধি দলটি ফিলিপিন সফর করেছিল, তাদের সাথে তখন বৈঠক করেছিলেন সাবেক এ মন্ত্রী। ফিলিপিনের কিছু কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন, যারা এ অপরাধের সূচনা করেছিল তারা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরের লোক।

" সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশ অযথাই ফিলিপিনের ঘাড়ে বেশি দোষ চাপাচ্ছে। অপরাধীরা হয়তো ঢাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে তিনি মনে করেন," বলছিলেন সাংবাদিক মি: লুকাস।
বাংলাদেশের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত জন গোমেজকে ফিলিপিনের নতুন প্রেসিডেন্ট মৌখিক আশ্বাস দিয়েছিলেন যে অর্থ উদ্ধারে ফিলিপিন সরকার সহায়তা করবে।

তবে ফিলিপিন্সের নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে তার উপরই নির্ভর করছে বিষয়টি কোন দিকে এগুবে।

তাছাড়া আদালতে যে মামলা এখন থমকে আছে সেটি কবে নাগাদ নিষ্পত্তি হবে সে বিষয়ে কিছু বলা মুশকিল বলে উল্লেখ করেন ফিলিপিনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাক্সিম লুকাস।

Friday, March 23, 2018

বিশ্বের নতুন পাঁচ 'স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায়' বাংলাদেশ


বিশ্বের নতুন পাঁচ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ

(বিবিসি বাংলা)   — বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছে একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

বিশ্বের ১২৯ টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান 'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং' তাদের রিপোর্টে এই মন্তব্য করে। রিপোর্টটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয়েছে।

রিপোর্টে ১২৯ টি দেশের মধ্যে ৫৮ টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং ৭১ টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে তাদের আগের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ৭৪টি দেশে গণতান্ত্রিক এবং ৫৫টি দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে।

গণতন্ত্রের মানদন্ডে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ

(১০- এর মধ্যে স্কোর)
  • বাংলাদেশ
  • ভারত
  • পাকিস্তান

বেরটেলসম্যান স্টিফটুং-এর রির্পোট

একশো উনত্রিশটি দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে যে সূচক এই সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ নম্বরে। একই অবস্থানে আছে রাশিয়া।

উরুগুয়ে, এস্তোনিয়া এবং তাইওয়ান আছে এই সূচকের শীর্ষে। আর একেবারে তলায় রয়েছে সোমালিয়া, ইয়েমেন এবং সিরিয়া।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান অবশ্য বাংলাদেশের নীচে - ৯৮ নম্বরে। মিয়ানমারের অবস্থান ১০৪ নম্বরে। অন্যদিকে ভারত আছে বেশ উপরের দিকে - ২৪ নম্বরে। শ্রীলংকার অবস্থান ৪১ নম্বরে।

'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং' ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিতভাবে এ ধরণের রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে।

তবে তাদের এই সমীক্ষায় উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া সহ পরিণত গণতন্ত্রের দেশগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, "বিশ্বে গত ১২ বছরের মধ্যে গণতন্ত্র এবং সুশাসনের অবস্থা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এক সময় বিশ্বের যেসব দেশকে মুক্ত বলে ভাবা হতো, সেসব দেশের সরকারও ক্রমশ কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠছে।"

বাংলাদেশে ২০১৪ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি


রিপোর্টে বলা হয়, "বিশ্বে যে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা সামান্য বেড়েছে, সেটার চাইতে বেশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে গণতান্ত্রিক দেশুগুলিতেও এখন নাগরিক অধিকার ক্রমশ খর্ব করা হচ্ছে এবং আইনের শাসন ভুলুন্ঠিত হচ্ছে। ব্রাজিল, পোল্যান্ড এবং তুরস্কের মতো দেশ, যাদেরকে গণতন্ত্রায়নের আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, তাদেরই সবচেয়ে বেশি অবনতি ঘটেছে।"

এই রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তুরস্কের কথা। এতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে তাদের সর্বশেষ রিপোর্টের পর তুরস্কেই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বেশি অধোগতি দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান সেখানে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর মত প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করেছেন বলে মন্তব্য করা হয়।

'বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক নয়'

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এই সমীক্ষা চালানো হয় যেসব দেশের ওপর, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচটি দেশের কথা—বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া এবং উগান্ডা।

রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এই পাঁচটি দেশ এখন আর গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানছে না। এসব দেশে বহু বছর ধরেই গণতন্ত্রকে ক্ষুন্ন করা হচ্ছিল। এসব দেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয় রিপোর্টে।

ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই বাংলাদেশকে 'স্বৈরতন্ত্র' বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে।

"এই পাঁচটি নতুন স্বৈরতান্ত্রিক দেশ এমন একটা পর্যায় অতিক্রম করেছে, যেদিকে যাচ্ছে আরও কিছু ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশ - হন্ডুরাস, হাঙ্গেরি, মলডোভা, নিজার, ফিলিপাইন এবং তুরস্ক।"
তবে রিপোর্টে কিছু কিছু দেশে গণতান্ত্রিক অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, মরিশাস এবং উরুগুয়ে।

২০১৬ সালের রিপোর্টে বার্কিনা ফাসো এবং শ্রীলংকাকে মধ্যম মাত্রার স্বৈরতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এই দুটি দেশকে এবারের রিপোর্টে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বলা হয়েছে।

  • শুক্রবার, মার্চ ২৩, ২০১৮

ঢাকা ডুববে, অচল হবে-দেখবে সবাই


এ কে এম জাকারিয়া


                    স্বাভাবিক বর্ষার ধকল নেওয়ার ক্ষমতা ঢাকার নেই
বর্ষা শুরু হলো বলে। স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়মে এপ্রিলে কালবৈশাখী দিয়ে যে ঝড়-বাদলের শুরু, মে মাসে তা রূপ নেয় বর্ষায়। বর্ষাকে বরণ করতে হলে কিছু প্রস্তুতি লাগে, এবার ঢাকায় নাকি সেই প্রস্তুতি নেই। ফলে স্বাভাবিক বর্ষা মানেই ঢাকা ডুববে। প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, ‘ডুববে ঢাকা, দেখবে ওয়াসা। কারণ, প্রতিবছর বর্ষার আগে ওয়াসা নর্দমা পরিষ্কারের কাজটি শুরু করে জানুয়ারি মাস থেকে, এবার অর্থের অভাবে সেই কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। জলাবদ্ধতা সামাল দিতে এ বছর ওয়াসার দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। সেই দুটিও বাদ গেছে। এই যখন অবস্থা, তখন ঢাকা ডুবলে শুধু ওয়াসা কেন, আমাদের সবাইকেই তা দেখতে হবে। ডুবে যাওয়া ঢাকায় দুর্ভোগের সবটাই আমাদের পোহাতে হবে।

ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তাই এবারের বর্ষায় ঢাকাবাসীকে প্রকৃতির ওপর ভরসা রাখতে বলেছেন। বৃষ্টি বেশি হলে এবার নাকি রক্ষা নেই, ভয়াবহ হতে পারে জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতা দূর করার উদ্যোগ ও উদ্যমে সরকারের ঘাটতিতে হতাশ নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘এখন দোয়া করতে হবে যাতে গত বছরের মতো একসঙ্গে এত বৃষ্টি না হয়।সৃষ্টিকর্তা ঢাকাবাসীর ডাকে সাড়া দিয়ে বৃষ্টিপাত কমিয়ে দিলে তবেই রক্ষা! দুর্ভোগ থেকে মুক্তির আর তো কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না।

তবে স্রষ্টার কাছে ঢাকায় কতটুকু বৃষ্টি আমরা চাইব বা চাইব না, তার একটি হিসাব-নিকাশ জরুরি। তা না হলে আমাদের চাওয়ায় ভুল হয়ে যেতে পারে। আসুন গত বছরের বর্ষায় আমাদের কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা মনে করার চেষ্টা করি। আর তখন বৃষ্টিপাত কেমন হয়েছিল, তারও খোঁজখবর নিই। গত বছর বর্ষা মৌসুমে ঢাকায় এক দফা অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছিল এবং সেটা হয়েছিল নিম্নচাপের প্রভাবে। তবে বর্ষা মৌসুমে এক বা দুই দফা এ ধরনের অতি ভারী বৃষ্টি অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিভিন্ন মাত্রার বৃষ্টিপাত নির্ধারণ করা হয় কিছু হিসাব মেনে। আবহাওয়া বিভাগ ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে বৃষ্টির ধরন নির্ধারণ করে। এ সময়ে ১০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টি হলে তাকে হালকা, ১০ থেকে ১৯ মিলিমিটার পর্যন্ত মাঝারি, ২০ থেকে ৪৩ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিকে মাঝারি মাত্রার ভারী, ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিকে ভারী এবং এর চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতকে অতি ভারী বৃষ্টি হিসেবে ধরা হয়। গত বছর আগস্টের ২২ তারিখ সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ঢাকার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। এর ঠিক দুই মাস পর নিম্নচাপের প্রভাবে ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত একই অবস্থা তৈরি করেছিল। এই দুটির বাইরে গত বছর মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিতেই বেশ কয়েক দফা ঢাকা ডুবে গিয়ে অচল হয়ে পড়েছিল।

আমাদের বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক মেয়াদ মে থেকে আগস্ট-এই চার মাস। এই সময়ের মধ্যে হালকা, মাঝারি, মাঝারি থেকে ভারী আবার কখনো ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিও হতে পারে। মৌসুম জুড়ে সব মাত্রার বৃষ্টি মিলিয়েই একটি স্বাভাবিক বর্ষা মৌসুম। আবার একটি বা দুটি নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ও বাংলাদেশে স্বাভাবিক। অক্টোবর, নভেম্বরেও সে কারণে কখনো টানা ও ভারী বর্ষণ হয়। এবারের বর্ষায় ডুবে যাওয়া থেকে ঢাকা নগরীকে রক্ষা করতে হলে বা জনগণ যদি সেই দুর্ভোগ পোহাতে না চায়, তবে অনেকটা বৃষ্টিহীন বর্ষার জন্যই স্রষ্টার কাছে হাত তুলতে হবে। স্বাভাবিক বর্ষার ধকল নেওয়ার ক্ষমতা ঢাকার নেই।

এখন দয়াময় স্রষ্টা যদি আমাদের ডাকে সারা দিয়ে সত্যিই বৃষ্টি কমিয়ে দেন, তাহলে ঢাকা না হয় ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচল এবং আমাদের দুর্ভোগও না হয় কমল, কিন্তু ঢাকাবাসী বাঁচবে তো? বৃষ্টি গ্রীষ্মের টানা গরম থেকে আমাদের স্বস্তি দেয়। শীত মৌসুম শেষ হতে হতে ঢাকা যে মাত্রায় ধূলিধূসর হয়ে ওঠে, বাতাস যে পরিমাণ দূষিত হয়ে পড়ে, তখন বৃষ্টি আসে আশীর্বাদ হয়ে। বৃষ্টি ঢাকার বায়ুদূষণ কমায়। ঢাকার গাছগুলো সবুজ হওয়ার জন্য বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। ঢাকার বৃষ্টি শহরটির চারপাশের দূষণে কালো হয়ে যাওয়া নদীগুলোকে প্রাণ দেয়। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় বৃষ্টিতে বিরতি মানেই এসির ব্যবহার বেড়ে যাওয়া ও বিদ্যুতে ঘাটতি এবং ঢাকার পানির স্তর নেমে যাওয়া, লোডশেডিংয়ের কারণে ওয়াসার পাম্প বন্ধ থাকা ও পানিসংকট। বৃষ্টিহীন একটি বর্ষা কি আমরা ঢাকাবাসী আসলেই চাই?

আমরা স্বাভাবিক বর্ষা চাই। যে বর্ষায় হালকা, মাঝারি, ভারী ও অতি ভারী সব ধরনের বৃষ্টিপাতই হবে। কিন্তু আমরা চাই, স্বাভাবিক বর্ষায় ঢাকা ডুববে না, আমরা দুর্ভোগে পড়ব না। এমন হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, ঢাকা হচ্ছে চারদিকে নদী ও শাখা-প্রশাখার মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খালের এক দুর্লভ শহর। সমস্যা হচ্ছে, শহরের এই অনন্য বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখা যায়নি। বছরের পর বছর ধরে তা ধ্বংস করা হয়েছে। যাদের এসব দেখভাল ও রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল এবং আছে, তারা ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার প্রমাণ রেখে চলেছে। সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানের যুক্ততা রয়েছে এর সঙ্গে। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কারোরই আসলে কোনো দায় নেই।

১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন আইন অনুযায়ী, ঢাকা শহরের পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ফলে নর্দমাগুলো সচল রাখা ও পরিষ্কার করার দায়িত্ব ওয়াসার। এই নর্দমাগুলো বানানোর দায়িত্ব অবশ্য সিটি করপোরেশনের। ২০০০ সালের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন অনুযায়ী, ঢাকার নদী, খাল ও জলাভূমি সংরক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবোর। অন্যদিকে ঢাকার সব খালের মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসন। এই অবস্থায় নর্দমা-খালও পরিষ্কার থাকছে না, খাল-জলাভূমিকে দখলমুক্তও রাখা যাচ্ছে না। যেকোনো সমস্যার জন্য এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করলেই তো হলো। ঢাকা ওয়াসা আর দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগই শোনা গেল দুই-তিন বছর ধরে। কাজের কাজ কি কিছু হলো!

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী গত বছর বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এসব (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না।আমরা জেনে গেছি যে এই প্রমিজ’-এর কোনো ফল এ বছর আমরা দেখব না। নর্দমা পরিষ্কার করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বরাদ্দ বাড়ায়নি। এ বছর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কারণ, অর্থের অভাবে ওয়াসা আপাতত নর্দমা পরিষ্কারের কাজে হাত গুটিয়ে রেখেছে। কবে অর্থ মিলবে আর কবে কাজ শুরু হবে! কথা ছিল, ঢাকা ওয়াসা এ বছর জমি অধিগ্রহণসহ পাঁচটি খাল পুনঃখনন ও কল্যাণপুর পাম্প স্টেশনে একটি রেগুলেটরি পুকুর তৈরি করবে। মন্ত্রণালয় সেই প্রকল্প একনেক থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর পেছনে নাকি রয়েছে ওয়াসা ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মান-অভিমান। বুঝলাম ঢাকার নাগরিকেরা আসলে কত অসহায়, কয়েকজন কর্মকর্তার মান-অভিমানের কাছে তাদের ভালো-মন্দের বিষয়টি কতটা তুচ্ছ!

নাগরিকদের দুর্ভোগ না হয় আমলারা বিবেচনায় নিলেন না। কিন্তু জলাবদ্ধতার আর্থিক ক্ষতির দিকটি? বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের নভেম্বরে এক সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সাল থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষতি হবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এটা স্বাভাবিক বর্ষার হিসাব। আর আবহাওয়া উল্টাপাল্টা আচরণ করলে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যা ঘটা অস্বাভাবিক নয়, এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। জলাবদ্ধতা দূর করতে অর্থ খরচ, সেদিক থেকে দেখলে লাভজনক বিনিয়োগ। কারণ, এই বিনিয়োগ দেশের অর্থের ক্ষতি কমাবে।

ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার দিকে নজর দিতে হলে কী কী করতে হবে বা করা উচিত, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের তরফে পরামর্শেরও অভাব নেই। সমস্যা হলো এ নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি করা, ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মেয়াদে তা বাস্তবায়ন করা এবং এ জন্য বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করা অথবা একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা। এখানেও সেই পুরোনো প্রশ্ন-ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে দায়িত্ব নিয়ে এই কাজ করবে কে? দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, পাউবো, জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়-জলাবদ্ধতা নিয়ে সবারই যখন নানা দায়িত্ব, তখন কাজটি করার আসলে কেউ নেই। জলাবদ্ধতা ঢাকার অগুনতি সমস্যার একটি। এগুলোর কোনোটির দিকেই নজর দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ঢাকাকে দেখভাল করার একক দায় কারও নেই। ৭ মন্ত্রণালয় ও ৫৪ সেবা সংস্থার জগাখিচুড়ি দিয়ে যে ঢাকার সেবা-শুশ্রূষা নিশ্চিত করা যাবে না, এই বাস্তবতা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কি আদৌ কোনো দিন বুঝবেন? ফলে ঢাকা ডুববে, অচল হবে, এটাই তো আমাদের নিয়তি।

  • সৌজন্যে - প্রথম আলো/ মার্চ ২৩, ২০১৮।