Search

Tuesday, March 27, 2018

ঢাকা এখন গডফাদারদের শহর


সম্পাদকের নোট -


লাগামহীন দুর্নীতি-অনিয়মের ফলে ঢাকায় মানুষের জীবনযাত্রা বিশ্বের অধিকাংশ শহর থেকে কষ্টকর ও নিম্নমানের। ঢাকার বাতাসে দূষিত পদার্থের পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য শহর থেকে বেশি। বাসা বাড়া, পরিবারের খাবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র, গ্যাস, পানি ও পরিবহন ব্যয়সহ  দৈনন্দিন সবখরচ মিটাতে পারছে না অধিকাংশ নগরবাসী। এরমধ্যে দিনে দিনে পরিবহণ খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি রয়েছে ভালো পরিবহনের অভাব। ঢাকা শহরের রাস্তায় প্রতিদিনই দূর্ঘটনায় নিহত-আহত হচ্ছে নাগরিকেরা। এমন পরিস্থিতিতে  ঢাকা শহরে পরিবহণ খাতের চরম নৈরাজ্যের চিত্র উঠে এসেছে এক গোলটেবিল আলোচনায়।  এক ডজন মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিক সরাসরি ঢাকা শহরের পরিবহণ খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। এরা বাস, মিনিবাসসহ বিভিন্ন পরিবহণ ও ফুটপাথের হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা আদায় করে এবং নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। চাঁদাবাজির ফলে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে এবং বেশি টাকা আয়ের জন্য ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালানো হয়, যার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা দূর্ঘটনা। পরিবহণ খাতে শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।


দৈনিক প্রথম আলোয় এই সংক্রান্ত রিপোর্টের পূর্ণপাঠ নিচে দেয়া হলো - 

ঢাকার অন্যতম পরিচয় এটি মসজিদের শহর। কেউ কেউ বলেন রিকশার শহর। এবার নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি গডফাদারদেরও শহর। এই শহরের রিকশা থেকে গণপরিবহন, ফুটপাত থেকে টার্মিনাল—কোনো কিছুই চাঁদা ছাড়া চলে না। এসব চাঁদার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি রাজনীতিক, সরকার-সমর্থক সংগঠন ও ব্যক্তিদের হাতে। অবশ্য সরকার বদল হলে নিয়ন্ত্রকও বদলায়।

শনিবার, মার্চ ২৪, ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজক ছিল বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।

এই বৈঠকে একাধিক আলোচক বলেন, ঢাকা বর্তমানে নাগরিকদের শহর নয়, ‘গডফাদারদের’ শহর। ঢাকার কয়েক লাখ অনিবন্ধিত রিকশা এবং ফুটপাতের কয়েক হাজার অবৈধ হকারের কাছ থেকে চাঁদা আদায়কারীদের গডফাদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আলোচকেরা বলেন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালগুলোতেও গডফাদারদের দৌরাত্ম্য। তাই যাত্রীসেবার বদলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ঢাকা ও এর আশপাশে বাস-মিনিবাস চলাচল করে প্রায় সাত হাজার। অন্তত এক ডজন মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিক সরাসরি এই পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এঁদের অনেকে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা হয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন। আবার কেউ কেউ সরাসরি নিজেই বাস নামিয়ে ব্যবসা করছেন।

পরিবহন সূত্রগুলো বলছে, ওয়েবিল (যাতায়াতের হিসাব), জিপি (গেট পাস), পার্কিং চার্জ, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা—এসব নামে প্রতিদিন প্রতিটি বাস-মিনিবাস থেকে ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। এই চাঁদার টাকা পরিবহননেতা, মালিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পকেটেও যায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আসছে না। এই খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে যাত্রীভাড়া আরও কমে যেত। ভোগান্তিও থাকত না।

হকার সমিতিগুলোর হিসাবে, ঢাকার ফুটপাতে ৫০-৬০ হাজার হকার আছেন। রাস্তায় থাকা হকারদের ধরলে সংখ্যাটা ১ লাখে দাঁড়ায়। প্রত্যেক হকারের কাছ থেকে গড়ে দিনে ১৫০ টাকা আদায় করা হয়। সে হিসাবে হকারদের কাছ থেকেই দৈনিক চাঁদা আদায় হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা।

গত বছরের প্রথম ভাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কিছু কিছু এলাকার হকারদের সংখ্যা নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়। সেই হিসাবে, গুলিস্তান এলাকায় শুধু ফুটপাতে হকার আছে আড়াই হাজার। নিউমার্কেট এলাকায় পৌনে নয় শ।

অভিযোগ রয়েছে, চাঁদার এই টাকা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পুলিশ ও চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত লাইনম্যান এবং তাঁদের সহযোগীরা ভাগ করে নেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাসেম প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজেরা হকারদের কাছ থেকে যে পরিমাণ চাঁদা আদায় করে, এটা সরকার নিজে তুললে হকারদের পুনর্বাসন হয়ে যেত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও হকারদের পুনর্বাসন হচ্ছে না। চাঁদাবাজেরা পকেট ভারী করছেন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় নিবন্ধিত বৈধ রিকশা আছে ৮০ হাজার ৪৭৩টি। ১৯৮৬ সালের পর আর কোনো রিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। তবে রাজধানীতে চলে প্রায় পৌনে ৭ লাখ রিকশা। উৎসব-পার্বণে রিকশার সংখ্যা বেড়ে ১০ লাখে দাঁড়ায়। সরকার-সমর্থক বিভিন্ন সংগঠন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রিকশার নিবন্ধন দিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে পুলিশ ও সিটি করপোরেশন অভিযান চালিয়ে কিছু কিছু রিকশা জব্দ করে। এরপর সেগুলো সাংসদ, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের নামে পুনরায় নিজ দলের লোকদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করা হয়।

গতকাল গোলটেবিল বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এ শহরকে নাগরিকদের বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। সরকারি সংস্থাগুলোকে এ ক্ষেত্রে নাগরিক সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নিবন্ধিত নির্দিষ্ট সংখ্যক রিকশা, ফুটপাত হকারমুক্ত করা, বাস, লঞ্চ টার্মিনালগুলো সরকারি সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হবে।


  • তথ্যসূত্র - দৈনিক প্রথম আলো, লিঙ্ক - https://bit.ly/2G5y6wj

ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে লোকসানে ফারমার্স

• টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা 
• আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি
• সিদ্ধান্ত হলেও তিন মাসেও মূলধন জোগান হয়নি 
• সংকটের প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে


সংকটে পড়া ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি হওয়ায় ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ব্যাংকটির শাখাগুলোতে প্রতিদিন ভিড় করেও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। অন্যদিকে নানা অনিয়ম করে দেওয়া ঋণও আদায় করতে পারছে না তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া ফারমার্স ব্যাংকের অনিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এসব গুরুতর আর্থিক তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে নতুন করে ব্যাংকটির আরও যেসব আর্থিক অনিয়ম বেরিয়ে আসছে, তা হিসাবে নিলে লোকসান বাড়বে কয়েক গুণ। বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি ফেরত না আসার আশঙ্কা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা বের করা হয়েছে মূলত মতিঝিল ও গুলশান শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে মতিঝিল শাখার ঋণ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ও গুলশান শাখার ঋণ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

এসব অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর সময়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ‘ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের ভাগ নিয়েছেন তাঁরা। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।’ মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি।

এদিকে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারার বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে। আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অন্য ব্যাংক থেকে আমানত তোলার প্রবণতা বাড়ায় ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট দেখা দিয়েছে। বেড়ে গেছে সুদের হার। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ঋণ কার্যক্রমেও একধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতে পড়েছে। এত বড় দুরবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে ভালো প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। এ থেকে যে টাকা আসবে, তা গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া যেতে পারে। এ প্রক্রিয়া সফল না হলে ব্যাংকটি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

যোগাযোগ করা হলে ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসান খসরু প্রথম আলোকে বলেন, ঋণের মান খারাপ হওয়ায় লোকসান হয়েছে। ব্যাংকটি যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এ জন্য কাজ চলছে। চলতি মাসের মধ্যে নতুন মূলধন জোগানের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এরপর ব্যাংকটিতে বিভিন্ন পরিবর্তন এনে নতুন করে যাত্রা করবে।

এহসান খসরু আরও জানান, সংকটে পড়ার পর গ্রাহকদের ২৬০ কোটি টাকা আমানত ফেরত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন আমানত এসেছে ৬০ কোটি ও ঋণ আদায় হয়েছে ২১০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, তারল্যসংকটে পড়ায় এখন নতুন করে মূলধন জোগান দিয়ে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সরকার। এ জন্য সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) উদ্যোগে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক থেকে মূলধন সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের শেষ সময়ে ব্যাংকগুলোর কেউ বাড়তি ঝুঁকি নিতে চাইছে না। এ জন্য ব্যাংকগুলো মূলধন জোগান দেওয়ার পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদে বসতে চাইছে। তবে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ তা মানতে কিছুটা দোটানায় রয়েছে। এ কারণে গত জানুয়ারিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।

৮ মার্চ প্রাক্-বাজেট আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফারমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের নামে লিখে দিতে হবে। ওই পরিমাণ শেয়ার লিখে দিলেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে টাকা দেওয়া হবে। এ সময় তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আলোচনায় পরামর্শ এসেছিল যে লেট দেম ডাই। ফারমার্স ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংককে কলাপস হতে দেব না। যেকোনোভাবেই একে রক্ষা করতে হবে।’

যোগাযোগ করা হলে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। কী প্রক্রিয়ায় ফারমার্স ব্যাংককে সহায়তা করা হবে, তার সিদ্ধান্ত এলেই মূলধন দেওয়া হবে।’

ফারমার্স ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে যাত্রার পর ব্যাংকটি নিট মুনাফা করেছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে মুনাফা হয় ৩ কোটি, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ও ২০১৬ সালে ২৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭ সালে এসে লোকসান হয় ৫৩ কোটি টাকা। বিতরণ করা ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭২৩ কোটি টাকাই খেলাপি। এটি ব্যাংকের নিজস্ব তথ্য।

রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে অনুমোদন পাওয়া নতুন নয়টি ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। অনুমোদন পাওয়ার আগেই সাইনবোর্ড লাগিয়ে দপ্তর খুলে নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছিল ব্যাংকটি। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর বছর না ঘুরতেই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে, যার ভুক্তভোগী এখন সাধারণ আমানতকারীরা।

ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ২০১৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে বিস্তারিত তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই। সাধারণ আমানতকারী ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে আমানত নেওয়া এবং ধার করে বর্তমানে টিকে আছে ফারমার্স ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটি পুরো ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি (সিস্টেমেটিক রিস্ক) তৈরি করেছে, যা আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে।

এরপরই মূলত ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নেওয়া শুরু হয়। এর ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে গেলে গত বছরের ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক মাহাবুবুল হক চিশতীকেও পদ ছাড়তে হয়। এরপর ১৯ ডিসেম্বর দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থতার দায়ে ব্যাংকের এমডি এ কে এম শামীমকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপরই বেরিয়ে আসে যে সরকারি খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের আমানত আটকে গেছে ব্যাংকটিতে। এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা আছে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায়। সুদসহ যা ৫১০ কোটিতে পৌঁছেছে। এ ছাড়া জীবন বীমা করপোরেশনের আটকা পড়েছে শতকোটি টাকার বেশি।

ব্যাংক সূত্র জানায়, মূলধন সংকট কাটাতে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমতি পায় ফারমার্স ব্যাংক। বন্ডটির নাম দেওয়া হয়েছে দি ফারমার্স ব্যাংক প্রসপারেটি বন্ড-২০১৭। বন্ডটির বিপণনের দায়িত্ব পায় রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট। তবে এখন পর্যন্ত সেই বন্ড বিক্রি করতে পারেনি ব্যাংকটি।

গত জানুয়ারিতে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা চৌধুরী নাফিজ সারাফাত। ফোনে যোগাযোগ করে গতকাল তাঁকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া মহীউদ্দীন খান আলমগীরকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

সব মিলিয়ে বড় ধরনের সংকটে আছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দেওয়া এই ফারমার্স ব্যাংক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটাও জরুরি। যেমন সাবেক ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের যথাযথ শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। তাহলে সবাই শিক্ষা নেবে। নইলে অনেকে উৎসাহ পাবেন।

  • প্রথম আলো/মার্চ ২৭,২০১৮

ভুয়া উন্নয়ন প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ?

অরূপ রায়


ঢাকার সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) ও অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) আওতায় ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে অন্তত আটটি প্রকল্প সরেজমিনে দেখা হয়। দেখা যায়, ছয়টি প্রকল্পে কোনো কাজ হয়নি। দুটি প্রকল্পে আংশিক কাজ হয়েছে।

সাংবাদিকতার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তথ্য না পেয়ে কাবিটা ও ইজিপিপি প্রকল্পের তথ্য জানতে গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৫ মার্চ, ১৫ মে ও ১৭ ডিসেম্বর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে সাভার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে পৃথক চারটি আবেদন করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ে তথ্য না পেয়ে তিনটি আবেদনের জন্য একই বছরের ৮ মে, ১০ জুলাই ও ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কাছে আপিল করা হয়। এরপর একটি আবেদনের তথ্য পাওয়া গেলে ৪ জুন ও ২১ আগস্ট তথ্য কমিশনে অভিযোগ করা হয়।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পিআইওর কার্যালয় থেকে ধাপে ধাপে প্রায় সব তথ্য সরবরাহ করা হয়। এসব তথ্য বিশ্লেষণের পর সরেজমিনে জানা গেল, কংক্রিট ও ইট বিছানো সড়কেও মাটির কাজ দেখিয়ে টাকা তোলা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভাকুর্তা ইউনিয়নে কাগজ-কলমে ৪৪টি প্রকল্প দেখিয়েছে সাভার পিআইওর কার্যালয়। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার ২৬৮ টাকা। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইজিপিপি প্রকল্পে দুই দফায় ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ রয়েছে।

ইজিপিপির আওতায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শ্যামলাশী জয়নালের বাড়ি থেকে হাসিমের বাড়ি, স্কুল থেকে বাবুর বাড়ি ও সিরাজের বাড়ি থেকে আলীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দিয়ে উন্নয়ন বাবদ বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ওই প্রকল্পে শ্রমিক দেখানো হয়েছে ৮০ জন। একই রাস্তায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাবুর ঘাট থেকে শ্যামলাপুর উচ্চবিদ্যালয় ও হাসেমের বাড়ি থেকে জালাল সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় মাটির কাজ দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। প্রকল্পটিতে শ্রমিক দেখানো হয়েছে ৪১ জন। অথচ এ দুই প্রকল্পের সিংহভাগ রাস্তাই কংক্রিট ও ইটের তৈরি।

শ্যামলাশী মোস্তফার বাড়ি থেকে দুদু মার্কেটের রোড পর্যন্ত রাস্তা মাটি দিয়ে উন্নয়নের জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকার বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। প্রকল্পটিতে শ্রমিক দেখানো হয়েছে ৩০ জন। কিন্তু এ বছর ওই রাস্তায় কোনো মাটি ফেলা হয়নি বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ লাখ ২৪ হাজার টাকায় মোগড়াকান্দা সড়ক থেকে মজিবর রহমানের পোলট্রি ফার্ম পর্যন্ত রাস্তা মাটি দিয়ে উন্নয়ন দেখানো হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, পোলট্রি ফার্মের কাছে ১০০ ফুট জায়গায় দুই ফুট প্রশস্ত করে মাটি ফেলা হয়েছে। একই অর্থবছরে চুনারচর সামনহাটি রাস্তা হতে চুনারচর খাল পর্যন্ত রাস্তা মাটি দিয়ে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রকল্পটিতে শ্রমিক দেখানো হয়েছে ৩৫ জন। কিন্তু রাস্তার দুই প্রান্তে ১০০ ফুট করে মাটি ফেলেই কাজ শেষ করা হয়েছে।

কাবিটার আওতায় ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে মোগড়াকান্দা হাজি ইব্রাহীমের বাড়ি থেকে মিয়াচান্দের বাড়ির কাছে কালভার্ট পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ওই টাকায় রাস্তা পুনর্নির্মাণের পরিবর্তে পুরোনো রাস্তার ওপর কয়েক ট্রাক ভাঙা ইট ফেলা হয়। একই রাস্তায় সরকারের অন্য একটি প্রকল্প থেকে মিয়াচান্দের বাড়ির কাছে ইট বিছাতে দেখা যায়। কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি মোগড়াকান্দা-হিন্দুভাকুর্তা-সাভার সড়কের জসিমের বাড়ি থেকে কান্দিভাকুর্তা মোসলেমের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার। রাস্তাটি পুনর্নির্মাণের জন্য ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৫৮ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে।

কোনো কাজ হয়নি ডোমড়াকান্দা রমজানের বাড়ি থেকে নলাগারিয়া আলী মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে। স্থানীয় মুদি দোকানি ইস্কান্দার বলেন, তিন মাস ধরে তিনি সেখানে দোকান দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ওই রাস্তায় কোনো কাজ হয়নি।

ভাকুর্তা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে যে বরাদ্দ দেওয়া হয় স্বচ্ছতার সঙ্গে তা খরচ করা হয়। ভুয়া প্রকল্প দিয়ে বা কাজ না করে অর্থ তছরুপ করা হয় না।’

অবশ্য ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোহাম্মদ আলী ইজিপিপি প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ ও নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে। তিনি এসব বিষয়ে গত বছর মে মাসে ঢাকা জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।

  • প্রথম আলো / ২৭ মার্চ ২০১৮ 


জনগণের আমানত ঋণের নামে লুটপাট

আবুল কাশেম


নথি নেই, ঋণের আবেদন নেই, নেই কোনো স্বাক্ষরও; জামানত তো দূরের কথা। তবু হলমার্ককে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। আর এতেই ঘটে গেছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারি। বেসিক ব্যাংক গত কয়েক বছরে কোন প্রতিষ্ঠানকে কত টাকা দিয়েছে, তার হিসাব নেই খোদ ব্যাংকের কাছেই এবং যথারীতি ঘটে গেছে সেই টাকা লুটপাটের ‘উৎসব’। এভাবে ভুয়া প্রতিষ্ঠান, ভুয়া নথিপত্র দেখিয়ে অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণের নামে জনগণের আমানত লুটেপুটে নিচ্ছে ব্যাংক থেকে। কারখানা নেই, অফিস নেই, বন্ধকি জমিও নিজের নয়, এমন অনেক গ্রাহকের ঋণ আবেদনও মঞ্জুর করছে ব্যাংক। সরকারি সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণের নামে টাকা নিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; এমনকি কবরস্থানের জমি বন্ধক রেখেও ব্যাংক থেকে অর্থ নিতে পারছে তারা। পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই প্রাপ্য টাকার দ্বিগুণ-তিন গুণ ঋণ দিয়ে দিচ্ছে ব্যাংক। আবার শুধু নিজে ঋণ দিয়ে খেলাপি হওয়াই নয়, গ্রাহক বানানোর জন্য অন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পর্যন্ত কিনে নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। প্রভাবশালী লুটেরাচক্র একটু বেকায়দা দেখলেই আইন-আদালতের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসে বহাল তবিয়তে, কখনো কখনো দ্বিগুণ উৎসাহে লুটপাটে লিপ্ত হয়। এভাবে ব্যাংকঋণ লেনদেনের নামে টাকা লুটপাটকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশ।

অন্যদিকে জালিয়াত গ্রাহকদের প্রতি ব্যাংকগুলোর বিশেষ প্রীতি থাকলেও নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণের জন্য ঘুরতে হয় দ্বারে দ্বারে। উপযুক্ত জামানতের নথি নিয়ে ঘুরলেও প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান নিশ্চিত হয় না তাদের। দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি শিল্প গ্রুপকে দেশে বৃহত্তম জ্বালানি তেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা করতে ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে হচ্ছে ২৪টি ব্যাংক থেকে। এই রিফাইনারিতে উৎপাদিত পণ্য কিনবে সরকার, ফলে ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা রয়েছে; তা সত্ত্বেও ঋণ পেতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে ওই কম্পানিকে।

অথচ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে ব্যাংক। ব্যাংক খাত বিপর্যস্ত হলে দেশের সমৃদ্ধি-উন্নয়নও মুখ থুবড়ে পড়বে। এ দেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ—স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণের চূড়ান্ত স্বীকৃতি অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতেও ব্যাংক খাতকে মজবুত রাখা অতি জরুরি। অথচ বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বাস্তবে ব্যাংক সুরক্ষার শক্ত ব্যবস্থা দেশে নেই—না আইনে, না ব্যবস্থাপনা-পরিচালনায়। উল্টো পাকাপোক্তভাবে আছে ব্যাংক থেকে জনগণের আমানতের টাকা লুটপাট করে ব্যাংক ফাঁকা করে দেওয়ার ‘সুব্যবস্থা’।  

গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঋণের জামানতের কাগজপত্র ভুয়া জেনেও রাজনৈতিক চাপে কিংবা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে দিচ্ছে, ঋণের এসব টাকা কোনো দিন ফেরত পাওয়া যাবে না জানার পরও। মাত্র ছয় বছরে এ্যাননটেক্স নামের একটি গ্রুপকে জনতা ব্যাংক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে পাঁচ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা দিয়েছে নির্বিঘ্নে। সোনালী ব্যাংক হলমার্ককে যে দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা দিয়েছে, তার বেশির ভাগ ঋণের কোনো আবেদনপত্রও ছিল না। কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে আবেদনপত্র থাকলেও তাতে হলমার্কের এমডি তানভীর আহমেদের কোনো সই-স্বাক্ষরও ছিল না। তবু প্রতি রাতে মাইক্রোবাস ভরে সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে টাকার বস্তা চলে যেত হলমার্কের অফিসে। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময় কাকে, কত টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে তার কোনো হিসাব এখন পর্যন্ত নেই ব্যাংকটির কাছে।

কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই নয়, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে ব্যাংক ফাঁকা করে ফেলছে। এসব ঋণ জালিয়াতিতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ছেন ব্যাংকের পরিচালক ও মালিকরা। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটির মালিকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাঁরা কমিশন নিয়ে, ঘুষ নিয়ে জনগণের আমানতের টাকা ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছেন, নিজেরাও তুলে নিয়েছেন। এমনকি ব্যাংক রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারের নীতিনির্ধারকরাও ব্যাংকের ভক্ষক হয়ে উঠেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নীলফামারী-৪ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি শওকত চৌধুরী একই জমি বন্ধক রেখে দুটি ব্যাংক—বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। নিজের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে কমার্স ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে নিয়েছেন ৯৩ কোটি টাকারও বেশি। ঋণ জালিয়াতির দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে।  

শিল্প মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন ঢাকার হাজারীবাগের নর্থ ইস্ট ট্যানারির ৪৫ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে অগ্রণী ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রোমভেজ ট্যানারি লিমিটেড। কিন্তু ঋণের একটি টাকাও পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংক বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলার বিজ্ঞাপন দিয়েছে সংবাদপত্রে। ওই বিজ্ঞাপন দেখার পর বিস্মিত শিল্প মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখে বলেছে সরকারি সম্পত্তি বন্ধক রেখে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে দুই দফা চিঠি দেওয়ার পরও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আইন-আদালতের ফাঁক গলে... : ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা বেশির ভাগ ঋণই আর আদায় হয় না। আবার কোনো কোনো খেলাপি গ্রাহক উল্টো ব্যাংকের বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে দেন, যাতে তাঁকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে ব্যাংক। বড় আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খেলাপিমুক্ত থাকার আদেশ বের করে আনেন আদালত থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) কর্মকর্তারা জানান, কোনো কোনো খেলাপি গ্রাহককে নিয়ে দুদক যাতে তদন্ত না করে এমন বিষয় উল্লেখ করেও আদালত থেকে রায় নিয়ে আসে কোনো কোনো ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান। ফলে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নতুন করে আরো ঋণ নেওয়ার সুযোগ পায়, ঋণের টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপির তকমা থেকে রেহাই পায়। এ ধরনের অনেক খেলাপি গ্রাহক বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকও থাকেন।

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন আবদুল আউয়াল পাটোয়ারি। তাঁর প্রতিষ্ঠান পাটোয়ারি পটেটো ফ্লেক্স লিমিটেডের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা ছিল প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক পেত ৩০ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধ না করায় এসব ব্যাংকে খেলাপি হন তিনি। খেলাপি চিহ্নিত হলে ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না। তাই উচ্চ আদালতে রিট করে গত বছরের শেষ দিকে নিজের পক্ষে রায় নিয়ে আসেন তিনি। বর্তমানে তাঁর পরিচালক পদ নেই।

একজন-দুজন নয়, উচ্চ আদালতে এভাবে রিট করে ৬০০ খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ ধরনের রায় নিয়ে এসেছে বলে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির। তিনি বলেছেন, ‘ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ঋণখেলাপি প্রদর্শনের পরও কোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। এ রকম প্রায় ৬০০টি মামলা আছে, যেখানে ঋণখেলাপি স্ট্যাটাস প্রদর্শন বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।’

গভর্নর বলেন, আদালতের রায়ের ফলে খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সিআইবিতে খেলাপি হিসেবে দেখানো যায় না। আর খেলাপি না দেখানো হলে ওই গ্রাহকের একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয় না। ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করে একাধিক ব্যাংক থেকে যখন আরো বেশি ঋণ নিচ্ছে, তখন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঋণের জন্য ঘুরছেন ব্যাংকের দরজায় দরজায়। উচ্চ আদালতের এসব রিট বছরের পর বছর ধরে চলে, নিষ্পত্তি হয় না। ঋণখেলাপিরাই প্রভাব খাটিয়ে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে দেয় না। আর যত দিন মামলা নিষ্পত্তি না হয়, তত দিন অর্থ পরিশোধের কোনো ঝামেলাও নেই। বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলোর তরফ থেকে উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠনের দাবি উঠলেও, তা হচ্ছে না। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিকবার আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেও পৃথক বেঞ্চ গঠন করাতে পারেননি।

অর্থঋণ আদালতে মামলায় দীর্ঘসূত্রতা : বাংলাদেশে অর্থঋণ আদালত আইনের আওতায় মামলা করে আদালতের নির্দেশে তার বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংক অর্থ আদায় করে। তবে অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি দীর্ঘতর প্রক্রিয়া। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে মামলা রয়েছে প্রায় দুই লাখ। এসব মামলায় জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। তবে অবলোপন করা ঋণ, গত ডিসেম্বরে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা ঋণের হিসাব আমলে নিলে এর পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও অনেক বেশি হবে।

ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অনেক ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালত থেকে মামলার ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে থাকে।  আবার অর্থঋণ আদালতের রায়ে বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংক নিলামে তুললে তার ওপরও স্থগিতাদেশ পাওয়া যায় উচ্চ আদালত থেকে। সোনালী ব্যাংক হলমার্কের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর বাকিগুলোর নিলাম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলা হলেও তাতে কেউ অংশগ্রহণ করে না। হলমার্কের কয়েকটি কারখানা নিলামে তুলেও কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি। ফেনীর সোনা ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন রূপালী ব্যাংক থেকে ৯৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছেন না। ব্যাংক টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করে আনোয়ার হোসেনের একটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান নিলামে তোলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া বিজ্ঞপ্তির মেয়াদ ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, কিন্তু কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি।

লুটেরা রক্ষার ‘সুব্যবস্থা’... : বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পরিশোধ না করে পার পাওয়া যায় সহজে। আদালত থেকে রায় নিয়ে খেলাপিরা আবারও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঋণ নিতে পারে। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা ও পর্ষদের সদস্যরা যত সহজে ঋণের নামে আমানতের টাকা অসৎ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেন, তা আদায়ে তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ চেষ্টাও থাকে না। খেলাপি ও ব্যাংক লুটপাটকারীদের জন্য এত উদার ব্যবস্থা আর কোনো দেশে নেই। ভারতে কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের আয়ত্ত নেওয়ার চেষ্টা করে। সে ক্ষেত্রে ভারতে ব্যালান্সশিট বেসড ব্যবসা বিদ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশের কম্পানিগুলোতে এ ধরনের করপোরেট সংস্কৃতি নেই। যখন বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের আর কোনো ঋণসীমা থাকে না, সব ক্ষেত্রেই যখন তারা খেলাপি হয়, তখন মালিকানায় থাকা ব্যক্তিরা আর অর্থ পায় না। কিন্তু ওই সব খেলাপি লোকের ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে। নেপালে কোনো ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হওয়ার ভয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার প্রবণতা দেশটিতে কম। সেখানে খেলাপি ঋণের হার ২ শতাংশেরও কম।

নিলামে দরদাতা না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথমত যে সম্পত্তি নিলামে তোলা হয়, তার গুরুত্বের ওপর এটি নির্ভর করে। আবার অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে নিলামে তোলা হয় বেশির ভাগ সম্পত্তি। সে ক্ষেত্রে মানুষ মনে করে, আদালতের মাধ্যমে টাকা দিয়ে জমি বা সম্পদ কিনলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা বুঝে পাওয়া যাবে না। আবার আদালতের মাধ্যমে জমি কিনলে প্রকৃত দর মেনে তাকে কোর্ট ফি, রেজিস্ট্রেশন খরচসহ সব ধরনের খরচ বহন করতে হয়। তখন টাকার উৎস দেখানো নিয়েও চিন্তায় পড়তে হয়। সাধারণভাবে জমি কিনলে এসব খরচ অনেক কম দেখানো যায়। তবে ব্যাংক আদালতের মাধ্যম ছাড়া সরাসরিও নিলামে তুলতে পারে। তাতে সময় লাগে না। কিন্তু বাড়তি খরচ ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতার রোষানলে পড়ার ভয়েও অনেকে তাতে আগ্রহী হন না।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আদায় পরিস্থিতিতে হতাশ অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “বিভিন্ন ফোরামে খেলাপি ঋণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ বিদেশে খেলাপি হলে ওই প্রতিষ্ঠানের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন অন্যরা সতর্ক হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো ‘বেল আউট’ দিয়েও টাকা আদায় করছে। আমাদের দেশে কোনো টাকা আদায় হচ্ছে না।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে। না হলে খেলাপির সংস্কৃতি কমবে না। এ জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। খেলাপি ঋণ বাড়লে ভালো গ্রাহকদের ভোগান্তি বাড়ে। খেলাপি যত বাড়ে ব্যাংক ভালো গ্রাহকদের ওপরে সুদহার তত বাড়ায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ডিউ ডিলিজেন্স না করার কারণে খেলাপি বাড়ছে। উদ্যোক্তারা কেমন, এদের ট্র্যাক রেকর্ড কী, সেসব তথ্য সঠিকভাবে খতিয়ে দেখছে না ব্যাংকগুলো। এদের অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সে কারণে খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েই চলেছে। ব্যাংকগুলোর উচিত ভালো আইনজীবী দিয়ে এদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা পরিচালনা করা।’

  • কালেরকণ্ঠ/মার্চ ২৭,২০১৮

ফেসবুক বিতর্কে বাংলাদেশের নির্বাচন

কামাল আহমেদ


দিন দশেক আগে লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান-এর সহযোগী সাপ্তাহিক অবজারভার-এ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক অপব্যবহারের বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ওই খবরের মূল কথা হচ্ছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিদের কাছ থেকে ফেসবুকের পাঁচ কোটি ব্যবহারকারীর মনস্তাত্ত্বিক গঠন প্রকৃতির তথ্য-উপাত্ত কিনে তা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে কাজে লাগিয়েছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা (সিএ) অন্যান্য দেশেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় একই ধরনের কাজে যুক্ত ছিল এবং আছে বলে খবরটিতে বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তো বটেই, বিতর্কে আমাদের প্রতিবেশী ভারতও পিছিয়ে নেই। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কাসহ যেসব দেশে সিএর কার্যক্রমের কথা উঠেছে, সেসব দেশে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। তবে বাংলাদেশ হচ্ছে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম-আগামী নির্বাচনে তাদের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার খবর নিয়ে কোথাও কোনো কথা নেই।

অবজারভার-এর প্রথম খবরটি প্রকাশের এক দিন পর ১৯ মার্চ ভারতীয় পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমস দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সিএর তৎপরতা নিয়ে খবর প্রকাশ করলে ভারতের প্রধান দলগুলো এ বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র ও আইনমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সিএকে কাজে লাগানোর অভিযোগ করেন। যদিও পরে জানা যায় যে কংগ্রেস নয়, সিএকে কাজে লাগাতে চেয়েছে বিজেপি। এর আগে রাজ্যপর্যায়ের নির্বাচনে বিহারে ক্ষমতাসীন জনতা দল ইউনাইটেড সিএর সাহায্য নিয়েছিল।

হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, সিএ ও তার ভারতীয় শরিক ওভেলানো বিজনেস ইন্টেলিজেন্স (ওবিআই) প্রাইভেট লিমিটেড ২০১৯ সালের নির্বাচনের বিষয়ে বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের সঙ্গেই কথা বলেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে ওয়াকিবহাল একজনকে উদ্ধৃত করে তারা জানায়, প্রতিষ্ঠানটি শ্রীলঙ্কার ২০২০ সালের নির্বাচন নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের সঙ্গে এবং বাংলাদেশের ২০১৯ সালের নির্বাচন (নির্বাচনটি চলতি বছরের শেষেও হতে পারে) নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে। ওই ব্যক্তি আরও জানিয়েছেন যে কোনো কিছু এখনো চূড়ান্ত হয়নি, এগুলো ছিল প্রাথমিক আলোচনা।

সিএ তার ওয়েবসাইটে বলেছে যে ভারতের বিহার রাজ্যের নির্বাচনে তারা যতগুলো আসন বাছাই করেছিল, তার ৯০ শতাংশে সফল হয়েছে এবং তাদের গ্রাহক ভূমিধস বিজয় পেয়েছে। সিএ বলেছে, তাদের কাজ ছিল মত বদলাতে পারে এমন ভোটারদের চিহ্নিত করা। তা ছাড়া গ্রাম পর্যায়ে দল সংগঠিত করায় প্রচারকৌশল ঠিক করার দায়িত্বও ছিল তাদের। সিএর ভারতীয় শরিক ওবিআইয়ের প্রধান নির্বাহী অমরিশ ত্যাগি ভারতীয় জনতা দল ইউনাইটেডের জ্যেষ্ঠ নেতা ও রাজ্যসভার সাবেক সদস্য কেসি ত্যাগির ছেলে। অমরিশ ত্যাগি এরপর ২০১২ সালে উত্তর প্রদেশে কাজ করেছেন বিজেপির নিতিন গড়কড়ির জন্য। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের পক্ষেও প্রচারকাজ চালিয়েছেন। তবে অমরিশ ত্যাগি ভারতে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কাজ করার কথা অস্বীকার করেছেন। প্রযুক্তিবিষয়ক ভারতীয় পোর্টাল বিবকম ডটকম জানিয়েছে, সিএ ও তার ভারতীয় অংশীদার নিশ্চিত করেছেন যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা আইন ভাঙার জন্য দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে নির্বাচনগুলোতে তাদের সহযোগিতামূলক কাজ চালিয়ে যাবে। ওবিআইয়ের অমরিশ ত্যাগি বিবকমকে বলেছেন যে সামাজিক মাধ্যমের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের আইনে ভিন্নতা আছে।

ওবিআই কিংবা সিএ ছাড়াও এ ধরনের কৌশলগত সেবা আরও অনেক কোম্পানিই দিয়ে থাকে। সিএর অভিভাবক কোম্পানি হচ্ছে স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস ল্যাবরেটরি (এসসিএল)। এর বিশেষত্ব হচ্ছে ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর আচরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (বিহেভিয়ারিওল সায়েন্স) কাজে লাগিয়ে জনমত প্রভাবিত করা। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এর তথ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বা উইপোনাইজেশন অব ইনফরমেশন বলে অভিহিত করে থাকেন। এসসিএলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, তারা শতাধিক দেশে নানা ধরনের বিষয়ে জনমত সমীক্ষা, প্রচারকৌশল ঠিক করা এবং সরাসরি প্রচারকাজ পরিচালনার মতো কাজ করেছে। তারা পাশ্চাত্যের সামরিক জোট ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা দপ্তরের হয়েও বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে থাকে। এসসিএলের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধপীড়িত এলাকায় জনমত সংগঠিত করার অভিজ্ঞতা। নেপালে মাওবাদী বিদ্রোহীদের আচরণ বদলানোর ক্ষেত্রেও তারা কাজ করেছে বলে তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে।

নির্বাচন প্রভাবিত করার কাজটি তারা যেসব দেশে করেছে, সেসব জায়গায় তারা যে শুধু তাদের নিয়োগকারী দল বা প্রার্থীর বার্তা প্রচার করেছে তা নয়, তারা জাতিগত বিরোধ কাজে লাগিয়ে বিরোধ তীব্রতর করা, প্রতিপক্ষের ভোটারদের মনে ভীতি ছড়ানোর মতো অপকর্মও করেছে। নাইজেরিয়ায় তারা প্রেসিডেন্ট জনাথন গুডলাকের পক্ষে নির্বাচনী সমাবেশের আয়োজন করে। প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে আসা নিরুৎসাহিত করতে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানোর পরোক্ষ স্বীকারোক্তি রয়েছে তাদের। লাটভিয়ায় তারা জাতিগত উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়েছে। এখন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে এসব কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর খোদ ব্রিটিশ সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে ব্রিটিশ সরকার ওই সব দেশে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী করায় অর্থ ব্যয় করেছে, আর অন্যদিকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও তারা সেসব দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বেআইনি প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতসহ বিশ্বের অন্তত বারোটি দেশে তাদের অফিস রয়েছে। তবে নির্বাচনবিষয়ক কার্যক্রম আলাদাভাবে পরিচালনার লক্ষ্যেই তারা সিএর রাজনৈতিক শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো ভূমিকা কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিতে পারে কি না। নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা কী হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো নীতি অথবা বিধিমালা তৈরি হয়নি এবং বিষয়টিতে জাতীয় পর্যায়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও লক্ষণীয় নয়। নির্বাচনী আইনে বিদেশি প্রচার বিশেষজ্ঞ নিয়োগে বাধা না থাকলে অতীতে সে রকম কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না, সেই প্রশ্নও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনো বক্তব্য আসেনি। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা গত চার দিনেও প্রথম আলোর ই-মেইলের কোনো জবাব দেয়নি। বলে রাখা ভালো, চ্যানেল ফোরে প্রচারিত গোপনে ধারণকৃত এক আলোচনায় সিএর প্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন যে তাঁরা প্রোটনমেইল নামের এমন ই-মেইল ব্যবহার করেন, যা নির্দিষ্ট সময়ের পর আপনা-আপনি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তাঁদের কার্যক্রমের ডিজিটাল ছাপ তদন্তকারীরা কতটা ধরতে পারবেন বলা মুশকিল। ট্রাম্পের নির্বাচন এবং ব্রেক্সিটের গণভোটে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে যেসব বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো প্রথমে তাঁরা অস্বীকার করলেও পরে স্বাধীন তদন্ত অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। এ নিয়ে আলাদা একাধিক তদন্ত শুরুও হয়েছে। ফেসবুকও কাঠগড়ায় এবং দুঃখ প্রকাশের পর জাকারবার্গকেও এসব তদন্তে হাজির হতে হবে।

বাংলাদেশে ফেসবুক, টুইটার এবং নতুন নতুন অনলাইন পোর্টালে রাজনীতিকদের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণা যে নতুন মাত্রা পেয়েছে, তা আর নতুন কোনো খবর নয়। সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইনের প্রচারযুদ্ধে সরকারবিরোধীরা যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তার একাধিক দৃষ্টান্তের কথা আগেও আলোচনা করেছি (ভুয়া খবর, ফেসবুক, টুইটার ও নির্বাচন, প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮)। বিদ্যমান ৫৭ ধারা অথবা প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে দলনিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এমন আলামত একেবারেই অনুপস্থিত। সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমালোচনার ক্ষেত্রে ৫৭ ধারার যথেচ্ছ ব্যবহার এবং কথিত মানহানি মামলার নজির ভূরি ভূরি। বিপরীতে বিরোধী নেতা-নেত্রীদের চরিত্র হননকারী ভুয়া তথ্য বা অভিযোগের প্রতিবাদ গণমাধ্যমে যেমন যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না, ঠিক তেমনি আদালত থেকে তাঁদের আইনগত প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

আমাদের নাজুক গণতন্ত্রে সরকারি দল ও তার সহযোগীরা এক মাসে চার-পাঁচটি জনসমাবেশের সুযোগ পেলেও বিরোধীদের অনুরোধ-আবেদন দিনের পর দিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার নজির সবারই জানা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দলগুলোর সবাই কি সোশ্যাল মিডিয়ায় সমান সুযোগ পাবে? আলামতগুলো অবশ্য ভিন্ন বার্তা দেয়। একইভাবে নির্বাচনী প্রচারকাজে সহায়তার জন্য বিদেশি পরামর্শক কিংবা স্ট্র্যাটেজিস্ট নিয়োগের ভালো-মন্দ ও প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের বিষয়েও দ্রুতই বাস্তবসম্মত নীতিমালা দরকার। সেই নীতিমালা হতে হবে ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যহীন।

  • প্রথম আলো/ মার্চ ২৭, ২০১৮ 

অর্থনীতিতে অগ্রগতি সাম্য মেলেনি


মহান স্বাধীনতার ৪৭তম বার্ষিকী পালন করছে দেশ। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শোষণ-বঞ্চনার নাগপাশ ছিন্ন করে সদ্য ভূমিষ্ঠ রাষ্ট্রটি নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ প্রস্ফুটিত আলোর মধ্যগগনে। ৪৭ বছরের এই পথচলায় বহু অর্জনে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে বিশ্বের বুকে দেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে এদেশের কর্মপাগল মানুষ। স্বাধীনতার ৪৭তম বার্ষিকীর ঠিক আগে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার যোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।

নানা সূচকে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের সামনে এখনো অর্থনৈতিক সমতা, সুশাসন ও কার্যকর গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি বৈষম্য বেড়ে চলেছে সমানতালে যা স্বাধীনতার মূল চেতনার পরিপন্থি। একইসঙ্গে সুশাসন ও জবাবদিহিতা পুরো নিশ্চিত না হলে মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করাটাও কঠিন। কার্যকর গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও সামনে নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের জন্য জরুরি বলে মনে করেন তারা। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন স্বাধীনতার এতো বছরে আমাদের অর্জন ও সম্ভাবনা অনেক। তবে স্বাধীনতার পর থেকে যে ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছিল তা এক সময় ধীর হয়ে যায়। বাংলাদেশের গত ৪৭ বছরের ইতিহাসে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বহুদূর এগিয়েছে দেশ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এগুলো বড় প্রাপ্তি। তবে সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। 

তিনি বলেন, সব থেকে বড় দুচিন্তার বিষয় হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা জিইয়ে আছে। দেশের বড় দলগুলো আলোচনায় বসছে না। আর আলোচনায় বসবে- এমন সম্ভাবনাও খুব বেশি নেই। ফলে আগামীর দিনগুলো সুখকর নাও হতে পারে। অর্থনীতির উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একটি দেশের উন্নয়নের জন্য প্রথমে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। যা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। অন্য চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে আছি। এখন দরকার দারিদ্র্যবিমোচনে বেশি মনোযোগ দেয়া। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ গত কয়েক বছর ধরে একই জায়গায় স্থির রয়েছে। এই ধারা থেকে বের হতে হবে। এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। তিনি বলেন, আমাদের সুশাসনের অভাব রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে। সহজেই ব্যবসা করা যায় এমন তালিকায় বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৭৭ নম্বরে। এতে বোঝাই যাচ্ছে দেশের ব্যবসার পরিবেশ কোথায়? এই জায়গা থেকে উত্তরণে আমাদের কাজ করতে হবে। এসব বিষয় আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি। ৪৭ বছর পর সেই বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নেই। অনেকে এগিয়েছে। ইতিমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে। এগুলো ভালো অর্জন। এটাকে ধরে রাখতে হবে। টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, এখন দরকার সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন। প্রয়োজন সমতাভিত্তিক উন্নয়ন। যেন সবাই সমান সুযোগ পায়। তিনি বলেন, দিন দিন বৈষম্য বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ লোকের অভাব। এগুলোকে দক্ষ করতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। প্রশাসনকে রাজনীতি মুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষমতার কাছাকাছি যারা আছে তারাই বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এ কারণে টেকসই উন্নয়নের জন্য দরকার সমতাভিত্তিক কার্যকর উদ্যোগ। 

  • মানবজমিন/মার্চ ২৭,২০১৮

Monday, March 26, 2018

Digital Security Act - EU and 10 countries express grave concern


The European Union and 10 countries including the US and the UK have expressed concern over several sections of the proposed Digital Security Act-2018 at a meeting with Law Minister Anisul Huq at his secretariat office in Dhaka Sunday, March 26.

After the meeting for over an hour, German Ambassador Thomas Prinz said, “We came here today [Sunday] as representatives of 11 embassies and high commissions [in Dhaka] to express our concern over the new draft of Digital Security Act as we know at this moment.

“The new act would suppress freedom of expression in multiple ways. We are particularly alarmed about the threat of severe punishment for merely expressing a belief or opinion, about the imprecise terminology which could lead to misinterpretation of law, non-availability of bail for certain offences and the empowerment of the security agency to detain a citizen without warrant by court.

The minister later said he assured them of considering their concern, and if necessary, changes or clarification would be made in the proposed act.

Already, local rights activists and journalists have raised voice against the draft act, saying they were frightened by the proposed law.

The cabinet on January 29 approved the draft act, which has to be passed in parliament.

The diplomats came up with concerns specifically over section 21, 25 and 28 of the draft law, which will deal with defamation, hurting religious sentiments or negative propaganda against the Liberation War or the Father of the Nation, using digital devices, respectively.

The 10 counties are - Germany, Sweden, the US, Denmark, France, Canada, the UK, Spain, Norway and Switzerland. 

SECTIONS IN QUESTION

Section 21  
Section 21 says anyone who spreads negative propaganda against the Liberation War or the Father of the Nation, using digital devices, or instigates such acts will risk being sentenced up to 14 years' jail or a fine of up to Tk 1 crore or both.

He or she will face up to life imprisonment or Tk 3 crore fine or both for committing the offence for the second time, it said.

Section 25
Section 25 of the proposed law says a person may face up to three years in jail or Tk 3 lakh fine or both if he or she is found to have deliberately published or broadcast in a website or electronic form -- something which is attacking or intimidating or which can make someone dishonest or disgruntled; if he or she knowingly publishes or broadcasts false and distorted (full or partial) information to annoy or humiliate someone, or to tarnish the image of the state or to spread rumour.

A person will face up to five years in jail or Tk 10 Lakh or both for committing the offence for second time, it said.

Section 28 
Section 28 says a person may face up to seven years in jail or Tk 10 lakh fine or both if he or she is found to have deliberately published or broadcast something in a website or in electronic form or get it done to hurt one's religious sentiment and values.

A person will face up to ten years in jail or Tk 20 lakh or both for committing the offence for the second time, it said.

Section 32
Section 32 says a person may face up to 14 years in jail or Tk 20 lakh fine or both on the charge of spying if he or she illegally enters the offices of government, semi-government and autonomous bodies to gather information and uses electronic device to record something secretly.

If that person commits the crime again, he or she will face life imprisonment or a maximum fine of Tk 1 crore or both.

The Ghost of ICT ACT 

The draft Digital Security Act came at a time when rights activists and journalists have been demanding repeal of section 57 of Information and Communication Technology Act for its “widespread misuse”.

Demand for repealing section 57 got momentum after around two dozen journalists were sued under the controversial provision last year. Some 701 cases filed under section 57 are pending with the lone cyber tribunal of the country till January.

Although it was said that section 57 of the ICT act would be revoked once the draft is passed in parliament, journalists and right activists felt duped by the government as the provision was kept in the proposed law with some changes.

Section 57 deals with defamation, hurting religious sentiments, causing deterioration of law and order and instigating against any person or organisation through publishing or transmitting any material in websites or in electronic form.

It stipulates maximum 14 years in prison for the offences.

The draft of Digital Security Act-2018 splits these offences into four separate sections (21, 25, 28 and 29) with punishment ranging from three to 10 years' jail term.

The proposed law describes some crimes as “non-bailable” and allows a police official to search or arrest anyone without a warrant in special circumstances.


  • Resource - The Daily Star/March 25, 2018

Sunday, March 25, 2018

আবার বিতর্কিত নির্বাচন হলে পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর - সুজন


আগামী সংসদ নির্বাচন যদি বিতর্কিত হয় তাহলে দেশ ভয়াবহ পরিণতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সুজন সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, বিতর্কিত নির্বাচন যাতে না হয় সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে ভূমিকা রাখতে হবে। 

রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে। তিনি দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষায় সকল অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করতে সবাইকে সর্বশক্তি নিয়োগ করার আহ্বান জানান। 

গতকাল শনিবার সিলেটে সুজনের বিভাগীয় পরিকল্পনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। 

নগরীর একটি হোটেল আয়োজিত বিভাগীয় পরিকল্পনা সভায় সুজন সম্পাদক বলেন, এক সময় সুজন দুর্বল ছিল। আমরা ভয় পেতাম। এখন আমরা শক্তিশালী। আমাদের দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতা দখলকারীরা ভয় পায়। আর সকলেই সহযোগিতা করে। সুজন সম্পাদক বলেন, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সকলের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজ যদি সোচ্চার হয়, তাহলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তিনি দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ রোখার আহ্বান জানান। 

সুজন সিলেট কমিটির সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকারের পরিচালনায় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট হোসেন তৌফিক চৌধুরী, মৌলভীবাজার সভাপতি ছাদিক আহমদ, সিলেটের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইরফানুজ্জামান চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ সম্পাদক একেএম শিবলী, সুনামগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহিনা আক্তার, সিলেট সদরের সভাপতি মিছবাউল বারী লিটন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের সভাপতি রাধিকা রঞ্জন তালুকদার, সুনামগঞ্জ সদরের নুরুজ আলী, বিশম্ভরপুরের শেখ এটিএম আজরফ, তাহিরপুরের সাইফুল কিবরিয়া, জামালগঞ্জের মিছবাহ উদ্দিন, বিশ্বনাথের মধু মিয়া, ফেঞ্চুগঞ্জের খন্দকার মমতাজ বেগম, আব্দুল হালিম প্রমুখ। 

পরিকল্পনা সভায় প্রত্যেক জেলা কমিটির নেতারা ২০১৮ সালের কার্যক্রমের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। সভার শুরুতে নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত এবং সুজনের প্রয়াত সদস্যদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।
  • দিনকাল/ মার্চ ২৫,২০১৮  

উন্নয়নশীল না নিম্ন-মধ্যম আয়ের এলডিসি, তা নিয়ে বিভ্রান্তি

ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ কি না, তা নিয়ে সাধারণ্যে বিভ্রান্তি আছে। শিক্ষিত সমাজও বিভ্রান্ত।



নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে তিন বছর আগেই। ২০১৫ সালের ১ জুলাই এ ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। আর চলতি মাসে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা। এই ঘোষণা জাতিসংঘের।

কিন্তু নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ কী, আর উন্নয়নশীল দেশইবা আসলে কী? বাংলাদেশ যে নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, তা শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ এখনই হয়ে যায়নি। ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ’—এ ঘোষণা আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। ঘোষণাটি দেবে জাতিসংঘ। তার পরের তিন বছর, অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে একটি কৌশলপত্র তৈরি করে বাংলাদেশ তা বাস্তবায়ন করবে।

বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি আছে এমনকি শিক্ষিত সমাজেও। তাও আবার কয়েক ধরনের বিভ্রান্তি। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ কি এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেছে, না হতে যাচ্ছে? নাকি বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ? মধ্যম আয়ের দেশেরও যেহেতু ভাগ রয়েছে দুটি, বাংলাদেশ তাহলে কোনটি-নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ, না উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ?

এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-আমলারাও প্যাঁচে রয়েছেন। মন্ত্রীরা প্রায়ই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বলে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কিন্তু খোলাসা করে বলছেন না যে তা নিম্ন-মধ্যম, না উচ্চ-মধ্যম আয়ের? আরেকটা প্রশ্নও উঠছে নতুন করে। ১৯৮০ বা ১৯৯০ দশকেই যে স্কুল-কলেজে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলা হতো, সেটা তাহলে ভুল ছিল? আসলে তখন আমরা জাতিসংঘের হিসাবে এলডিসি এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন আয়ের দেশ ছিলাম। একটু আগ বাড়িয়ে তখন কেউ কেউ উন্নয়নশীল বলে ফেলতেন।

‘এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের অভিযাত্রায় বাংলাদেশ’ নামে গত বৃহস্পতিবার থেকে দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠান চলছে। তা আরও চলবে। গত বৃহস্পতিবার অন্যদের মতো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রায় সব কর অঞ্চলই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে। দেখা যায়, ব্যানারগুলোতে প্রায় একই লেখা, ‘নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনে সাফল্য উদ্‌যাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা’।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অবশ্য মনে করেন, কেউ কেউ গুলিয়ে ফেললেও অনেকে ইচ্ছা করেও বাড়িয়ে বলছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের এলডিসি, আরও ছয় বছর তা-ই থাকবে। ২০২৪ সালে জাতিসংঘ যদি ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ তখন হবে নিম্ন-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ।

জাতিসংঘের হিসাব

জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে তিন ধরনের দেশ রয়েছে-উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত (এলিডিসি)। জাতিসংঘ হিসাবটি করে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা বা সংকট সূচক অনুযায়ী। জাতিসংঘের ১৯৭১ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে এলিডিসি ছিল ২৩ টি, বর্তমানে ৪৭। বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে।

মাত্র পাঁচটি দেশ গত ৪০ বছরে এলডিসি থেকে বের হতে পেরেছে। এর মধ্যে বতসোয়ানা ১৯৯৪, কেপ ভার্দে ২০০৭, মালদ্বীপ ২০১১, সামোয়া ২০১৪ এবং ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ২০১৪ সালে বের হয়। ২০১১ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এলডিসিবিষয়ক চতুর্থ জাতিসংঘ সম্মেলনে ২০২০ সালের মধ্যে এলডিসির সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। সামনেই ২০২০। অর্থনীতিবিদেরা আপাতত এ লক্ষ্য পূরণের সম্ভাবনা দেখছেন না।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব

কোন দেশ কতটা ধনী বা গরিব, সেটাকে বিশ্বব্যাংক নিজের মতো বিবেচনা করে। মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় দিয়ে বিবেচনা করা বিশ্বব্যাংকের ভাগগুলো এক হিসাবে তিনটি, আরেক হিসাবে চারটি। তিনটি ভাগ এ রকম—নিম্ন আয়, মধ্যম আয় এবং উচ্চ আয়ের দেশ। মধ্যম আয় আবার দুই রকম—নিম্ন-মধ্যম আয় এবং উচ্চ-মধ্যম আয়। সে হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের মধ্যে আছে।

বাংলাদেশ যে নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, সে ঘোষণা বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ২০১৫ সালের ১ জুলাই। যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় সেগুলোই হচ্ছে নিম্ন আয়ের দেশ। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫ সালের ১ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ ছিল। নিম্ন আয়ের দেশকে সহজ বাংলায় বাঙালিরা গরিব দেশ বা দরিদ্র দেশ বলে আসছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত সবাই মধ্যম আয়ের দেশ। এর মধ্যে আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ পর্যন্ত হলে তা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ, আর ৪ হাজার ১২৬ থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত হলে সেটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ। মাথাপিছু জাতীয় আয় এর চেয়ে বেশি হলেই হবে উচ্চ আয়ের দেশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার।

বিশ্বব্যাংকের ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে নিম্ন আয়ের দেশ ৩১টি, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ ৫২টি, উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ ৫৬টি এবং উচ্চ আয়ের দেশ ৮০টি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মাথাপিছু আয় ২০২৮ সালে দ্বিগুণ হলেও আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশই থাকব। কারণ, ১০ বছরেই তো মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ১২৬ ডলারে নিয়ে যেতে পারব না।’

  • প্রথম আলো/মার্চ ২৫, ২০১৮

যানজটে বছরে ক্ষতি ৩৭ হাজার কোটি টাকা


যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে ৫ কিলোমিটার। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপ আবার কাজ করছে অন্যান্য রোগের উৎস হিসেবে।

পাশাপাশি যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজটের পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে খারাপ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও যে বাড়বে, তা বলা বাহুল্য।

গতকাল শনিবার রাজধানীতে আয়োজিত ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বৈঠকের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় বুয়েটের এআরআই-আইটিএন ভবনের সেমিনার হলে।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তাতে যানজটের আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যানজটের কারণ, যানজট থেকে উত্তরণের উপায়সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়।

আর্থিক বিষয়

২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ যাত্রা (ট্রিপ) হয়। একজন মানুষ কোনো একটি বাহনে উঠে নির্ধারিত গন্তব্যে নামলে একটি যাত্রা বা ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে যানজটে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একাধিক গবেষণায় ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে বলা যায়, গড়ে বছরে যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতির অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত।

স্বাস্থ্যগত সমস্যা: যানজটের ফলে মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব পড়ছে বলে গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, যানজট ৯ ধরনের মানবিক আচরণকে প্রভাবিত করছে। দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব থেকে শুরু করে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো বিষয়গুলো যানজটে প্রভাবিত হচ্ছে।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (নিটোর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মুহম্মদ সিরাজ-উল-ইসলাম বলেন, যানজটে বসে থাকলে মানসিক চাপ তৈরি হয়। নানান রকম দুশ্চিন্তা ভর করে। এই মানসিক চাপ সব ধরনের রোগের উৎস। চাপের ফলে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, যুদ্ধংদেহী মনোভাব চলে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ্‌ দীবা বলেন, যানজটের কারণে মানসিক অশান্তি তৈরি হয়, যার প্রভাব পড়ে পরিবারসহ বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কে। ব্যক্তির কর্মদক্ষতা, কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়। যে চালকেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালান, তাঁদের দুর্ঘটনা ঘটানোর আশঙ্কা বেশি থাকে। আর উচ্চমাত্রার শব্দদূষণের ফলে দীর্ঘস্থায়ী বধিরতা তৈরি হতে পারে।

হেঁটেই পৌঁছানো যাবে আগে: এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ।

২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।

বুয়েটের এআরআই-আইটিএন ভবনের সেমিনার হলে গতকাল ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বক্তব্য দেন এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। 

যানজটের পেছনের কারণ: মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ঢাকায় বড় সড়কের সংখ্যা হাতে গোনা। ট্রাফিক মোড়গুলো শহরের বিষফোড়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাতের অবৈধ দখল, ভাসমান বিক্রেতাদের সড়ক দখল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়া অন্যতম। তা ছাড়া দুই শতাধিক কোম্পানির অধীনে শহরের বাস সেবা পরিচালিত হওয়ার ফলে যাত্রী ওঠানো নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতাও যানজটের অন্যতম কারণ।

আবার বৈঠকে একাধিক আলোচক বলেন, ঢাকা বর্তমানে নাগরিকদের শহর নয়, ‘গডফাদারদের’ শহর। ঢাকার কয়েক লাখ অনিবন্ধিত রিকশা এবং ফুটপাতের কয়েক হাজার অবৈধ হকারের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন গডফাদাররা। বাস, লঞ্চ টার্মিনালগুলো গডফাদারদের দখলে থাকায় যাত্রীসেবার বদলে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।

সমন্বয়হীনতা: বৈঠকে আলোচকেরা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে, সরকারি সংস্থাগুলো শহরকে বসবাস উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিবর্তে শহরকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাঁরা অভিযোগ করেন, সরকারি এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার কাজে সমন্বয় নেই।

এআরআইয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সব পেশার, সব বয়সী মানুষ যানজটের ফলে ভুক্তভোগী। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যানজট নিরসনে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। যানজট নিরসন একক কোনো সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, বিভিন্ন সংস্থা সমন্বয়হীনভাবে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করায় যানজট বাড়ছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা একটি সড়ক দিনের বেলায় ভালো দেখে এসেছেন, রাতের বেলায় সে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, শহরে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও অনেককেই যানজটের কারণে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। যানজট কমানো গেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও কমানো যেত।

সমাধানের পথ: বৈঠকে আলোচকেরা ঢাকার যানজট কমাতে বাস সেবা আরও বিস্তৃত ও উন্নত করা, রেলে যাত্রী পরিবহন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি কমানো, ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেন।

বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সরওয়ার জাহান বলেন, ২০১৫ সালে করা আরএসটিপি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। যাঁরা এ পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরা ঢাকার সমস্যা কতটা মাথায় রেখে করেছেন তা ভাবনার বিষয়। ঢাকার যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, তাতে বাস সেবা মূল সমাধান। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিষিদ্ধ না করলে এ শহর অকার্যকর হয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, যানজট সমস্যাটি বহুমাত্রিক। ঢাকায় যদি জনসংখ্যা বাড়তেই থাকে, তাহলে পরিকল্পনা করে সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা গড়তে হবে।

যানজট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এআরআইয়ের পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, পৃথক বাস লেন তৈরি, ট্রাফিক মোড়গুলোর বিষয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।

  • প্রথম আলো/মার্চ ২৫, ২০১৮