গোলাম মোর্তোজা
ব্যাংক বা আর্থিকখাতের অনিয়ম-জালিয়াতি-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে একই কথা বারবার বলতে হয়। পুনরাবৃত্তি পাঠক হয়তো বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু যুক্তিকে যখন কূ-যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করার অপচেষ্টা করা হয়, তখন আরও কিছু কথা বলতেই হয়।
১.
একটি দেশের আর্থিক কাঠামো বা সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার নিয়ম। নিয়মের ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একের পর এক বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। অনুমোদন দেয়ার আগে অর্থমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ ব্যাংকের অনুমোদন দিতে হচ্ছে।
‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ মানে দলীয় লোকদের সুযোগ দেয়া। সুযোগ দেয়া মানে দলীয় লোকদের টাকা বানানোর বা বড়লোক বানানোর ব্যবস্থা করা। গত কয়েক বছরে সেই কাজটি দৃশ্যমানভাবে হয়েছে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে, ঋণের নামে জাল-জালিয়াতি করে জনগণের টাকা ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন নিয়ে গেছে।
২.
ব্যাংকের মালিক বা পরিচালকদের বড়লোক বানানোর সুবিধার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে দিয়েছে সরকার। একজন পরিচালক তিন বছর করে মোট ছয় বছর পরিচালক থাকতে পারতেন। এখন একজন টানা নয় বছর পরিচালক থাকতে পারবেন। আগে এক পরিবারের দুইজন সদস্য পরিচালক থাকতে পারতেন। এখন এক পরিবারের চারজন পরিচালক থাকতে পারবেন। শুধু দলীয় লোকদের নয়, পারিবারিকীকরণও সম্পন্ন করা হয়েছে । যদি একটি ব্যাংকের নয় জন পরিচালক থাকেন, তাহলে পরিবারের সদস্যরাই সংখ্যগরিষ্ঠ। চেয়ারম্যান তাদেরই লোক হয়, অর্থাৎ চেয়ারম্যানসহ পাঁচ জন এক হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন। নামে বেনামে ঋণ দিতে বা নিতে পরিচালকদের এখন আর কোনো সমস্যা নেই।
৩.
আগে সরকারি আমানতের ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যেত। এখন নিয়ম করে দেয়া হচ্ছে ৫০ শতাংশ রাখা যাবে। কারণ ব্যাংকে টাকা নেই। তারল্য সংকট প্রকোট হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের বছরে ব্যাংকগুলো সংকটে পড়লে সরকারের বিপদ বাড়বে। ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটানোর জন্যে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার নিয়ম করা হলো। ব্যাংকগুলো চাপ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার পরিমান এক শতাংশ কমিয়ে নিল। উল্টো যাত্রা বা নজীরবিহীন বললেও কম বলা হয়। এগুলো এখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের স্বাভাবিক চিত্র। সব জোরাতালি বা টোটকা সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা। সামগ্রিক কোনো পরিকল্পনা নেই।
৪.
প্রশ্ন হলো, ব্যাংকের টাকা গেল কোথায়, তারল্য সংকট কেন দেখা দিল? রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা কোনো সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে বড়লোক হয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। নামে বেনামে ঋণ দিয়েছেন। একটু ঘুরিয়ে বলা যায় নিজেরা নিয়ে নিয়েছেন। শুধু নতুন ব্যাংক নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুরনো ব্যাংকে বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে চেয়ারম্যান, এমডি, পরিচালক নিয়োগ পাওয়াওয়ালারা ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার করে, ঋণের নামে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
৫.
সরকারের খরচ বেড়েছে, অপব্যয় বেড়েছে, দুর্নীতি বেড়েছে। আয় বাড়েনি। সঞ্চয় পত্রের বিনিময়ে বিপুল পরিমান টাকা সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। অন্য দিকে ঋণ জালিয়াতি, খেলাপি ঋণ বেড়েছে।দুর্নীতি- জালিয়াতির মাধ্যমে বেহাত হয়ে যাওয়া টাকা পাচার হয়ে গেছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক ‘গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি(জিএফআই)’র গবেষণার তথ্য ২০০৫-২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি। দেশের অর্থনীতির গতি- প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ২০১৫-২০১৮’র বর্তমান সময় পর্যন্ত টাকা পাচার অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এই তিন বছরে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে।
৬.
সরকার ও সরকার সংশ্লিষ্ঠরা বলেন, জিএফআই’র রিপোটে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা ধারণা থেকে বলা হয়েছে, ফলে এই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য নয়।
জিএফআই’র রিপোর্টে দুর্নীতির তথ্য সুনির্দিষ্ট নয়, তা সত্য। টাকা পাচার তো আর রিসিট দিয়ে হয় না, ফলে সুনির্দিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায় না।তবে জিএফআই’র রিপোর্ট অনুমানভিত্তিকও নয়। একটি দেশের আমদানি- রপ্তানির কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে, টাকা পাচারের পরিমান নির্ধারণ করে জিএফআই।তারা অনেক কিছু বাদ দিয়ে পরিমান নির্ধারণ করে। বাস্তবে তাদের উল্লেখিত পরিমানের চেয়ে টাকার পাচার আরও বেশি হয়ে থাকে।
টাকা পাচারের তথ্য যে একেবারে সুনির্দিষ্ট করে পাওয়া যায় না, তাও নয়।২০১৭ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৬০০ জন মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে টাকা নিয়ে গেছেন।এই তথ্য মালয়েশিয়ান সরকারের দেয়া।
ধারণা করা হয়,নিয়ে যাওয়া মোট টাকার পরিমান কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি।
২০১৫-১৭ সাল, এই দুই বছরে দের থেকে দুই হাজার জন বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে টাকা নিয়ে গেছেন।
মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি যারা সেকেন্ড হোমে নাম লিখিয়েছেন, যারা এ সংক্রান্ত খোঁজ রাখেন, তাদের ধারণা ২০১৭ সালের জুনের মাঝামাঝি থেকে ২০১৮ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কমপক্ষে দের হাজার বাংলাদেশি সেকেন্ড হোমে টাকা নিয়ে গেছেন।প্রক্রিয়াধীন আছেন আরও হাজারখানেক।
কত হাজার বা লক্ষ কোটি টাকা শুধু মালয়েশিয়ায় পাচার হয়ে যাচ্ছে,আমরা অংক ছাড়া আর কিছু করতে পারি না।
৭.
আর্থিকখাতের অনিয়ম বা জালিয়াতি একটা প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যাচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করছে।
ফলে অনিয়ম দুর্নীতি আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। তা যদি বাড়ে, পাল্লা দিয়ে বাড়বে টাকা পাচারও। সরকার টাকা পাচারের কোনো তথ্যই স্বীকার করতে চায় না । প্রকাশিত কোনো তথ্য, তদন্ত করেও দেখে না। সমস্যা স্বীকার না করে, অস্বীকার করার নীতিতে যে পরিত্রাণ মেলে না, তা সরকার বুঝতে চায় না। নির্বাচনের বছরে আর্থিকখাতের আরও কত ভয়ঙ্কর সংবাদ যে শুনতে হবে!
- গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।