Search

Tuesday, April 3, 2018

সত্যে হতাশা, অসত্যে আশাবাদ!

গোলাম মোর্তোজা 


বাংলাদেশ প্রায় সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ, ২ লাখ নারীর সম্মানহানি, স্বাধীনতা অর্জন। একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কত মূল্যই না দিতে হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনও দেশকে এত মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়নি।

বর্তমানে ‘উন্নয়ন’ এই শব্দটি নিয়ে বাংলাদেশে যত কথা, তর্ক-বিতর্ক দুনিয়ার আর কোথাও এমন নজির নেই। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ। বিশাল উদযাপন উৎসব পালিত হয়েছে শুধুমাত্র বাংলাদেশে। তাও আবার প্রকৃত তথ্য সামনে না এনে। প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে, আগামী অর্ধযুগ সেই ধারায় চলতে সক্ষম হলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ এখনও নিম্ন-মধ্যম আয়ের স্বল্পোন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ নয়। আগামী ৬ বছরের বাংলাদেশের পরিচিতিও এটাই থাকবে।

তার পরের তিন বছর অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত একটি কর্মকৌশল প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তারপর বাংলাদেশের প্রকৃত পরিচয় হবে ‘উন্নয়নশীল’। উৎসবের জন্যে ৬ বা ৯ বছর অপেক্ষা করার সময় আমাদের নেই। উৎসব আগেই করে রাখতে হবে। উন্নয়ন উৎসবের ডামাডোলের মাঝে নতুন-পুরনো কিছু পরিসংখ্যান সামনে আসছে, যা ‘উন্নয়ন’ গল্পের সঙ্গে ঠিক মানানসই নয়। একদিকে সরকারের এত ‘উন্নয়ন’ বিষয়ক কথামালা, আরেক দিকে দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ আর্থিক খাতের বিপরীতমুখী তথ্য। জনমনে নানা সন্দেহ-কৌতূহল-প্রশ্ন। সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।

১. বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৬-২০১৭ বছরের শ্রম জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। বিবিএস’র জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমান কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১১ কোটি মানুষ কর্মক্ষম। গত কয়েক বছর দেশে-বিদেশে আলোচনা হচ্ছে, জনসংখ্যাগত সুবিধার বিবেচনায় বাংলাদেশ বর্তমানে সুবর্ণ সময় অতিক্রম করছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম। ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ যারা কাজ করছেন বা কাজ করতে সক্ষম, তারাই কর্মক্ষম মানুষ।

এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যাবে। যদি এই জনসংখ্যাকে কাজে লাগানো না যায়, ২০ থেকে ৩০ বছর পরে জনসংখ্যার এই অংশ কর্মক্ষম থাকবে না। আজকের সম্পদ, ভবিষ্যতের বোঝায় পরিণত হতে পারে। বিবিএসের পরিসংখ্যানে কর্মক্ষম জনসংখ্যার চিত্রের পাশাপাশি, উদ্বেগের চিত্রও উঠে এসেছে। যদিও তা সাহসের সঙ্গে প্রকাশ না করে এক ধরনের চতুরতার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে।

২. বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী ১০ কোটি ৯১ লাখ কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ কর্মে নিযুক্ত আছে। ৪ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ কর্মে নিযুক্ত নেই। অর্থাৎ এদের কাজ নেই বা কাজ করছে না। আইএলও’র সংজ্ঞা সামনে এনে বলা হচ্ছে, এরা শ্রমশক্তির বাইরে,এদের যে কাজ নেই,কাজ নেই মানে এরা যে বেকার, তা স্বীকার করা হচ্ছে না। আইএলও’র সংজ্ঞায় ফেলে বেকারের সংখ্যা দেখানো হচ্ছে মাত্র ২৬ লাখ। এই চিত্র দেখিয়ে কাগজে কলমে কর্মসংস্থান এবং বেকারের একটা ভারসাম্যমূলক বা স্বস্তিদায়ক অবস্থা হয়তো দেখানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেশের কী উপকার হবে?

৩. উন্নয়ন হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। সবই বোঝা গেলো। কিন্তু আর্থিক খাতের চিত্র এত ভয়ঙ্কর কেন? ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। ৩ মাস পরে ডিসেম্বর মাসে এসে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। মাত্র ৩ মাসে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যা ছিল ১৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা।

ঘাটতির পরিমাণ শুধু বাড়ছেই। এই ঘাটতি মোকাবিলার জন্যে নানা নামে ইতিমধ্যে ৬টি ব্যাংককে ১৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন আরও ২ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

বহুল আলোচিত ফার্মার্স ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৮৩ কোটি টাকা। ৪০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে শুরু হওয়া ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭২৩ কোটি টাকা।

৪. ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির প্রকৃত কারণ চুরি-ঋণ জালিয়াতি এবং ঋণখেলাপি। আরও সরাসরি বললে, কিছু মানুষ জনগণের টাকা নানা উপায়ে জালিয়াতি করে নিয়ে যাচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে ভর্তুকি দিয়ে ব্যাংকগুলো বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে, সেই অর্থও লোপাট হয়ে মূলধন ঘাটতিতে পরিণত হচ্ছে।

৫. কাগজের হিসাব বলছে, গত ১০ বছরে,খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ২ বছরে বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত এক বছরে বেড়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের অধিকাংশই ফেরত পাওয়া যাবে না। একপর্যায়ে গিয়ে মূল টাকা ও সুদসহ ‘আর পাওয়া যাবে না’ দেখিয়ে মাফ করে দেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে মাফ করে দেওয়া হয়েছে। জনগণের টাকা ব্যাংক থেকে, ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষ ঋণের নামে এভাবে নিয়ে নিচ্ছে। গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা দিয়ে ১১টি পদ্মা সেতু বানানো যেত অথবা ঢাকা শহরের প্রতিটি রুটে মেট্রোরেল নির্মাণ করা যেত।

মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয়েও বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। চেন্নাইয়ের ৪৪ কিলোমিটার মেট্রোরেলের ২৪ কিলোমিটার নির্মিত হয়েছে মাটির নিচে দিয়ে। ৩৪টি স্টেশনের ২০টি মাটির নিচে। মাটির উপরের চেয়ে নিচে দিয়ে নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। মাটির উপরে-নিচে মিলিয়ে ৪৪ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে চেন্নাইয়ের ব্যয় হয়েছে ২৪৫ কোটি ডলার, কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ মাটির উপর দিয়ে ২০.১ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় করছে ২৭০ কোটি ডলার, কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। জাপানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ করছে বাংলাদেশ। চেন্নাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ ব্যয়ে হলেও, পাচার হওয়া টাকা দিয়ে বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ৪৫০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করতে পারত!

৬. দেশে কর্মক্ষম মানুষ আছে, কাজ নেই। আবার কাজ আছে, দেশে দক্ষ মানুষ নেই। দেশে আবার মেধার মূল্যায়নও নেই। ১০০টি পদের মধ্যে ৫৬টি পদে চাকরি হয় কোটায়। বাকি ৪৪টি পদের জন্যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকে।

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নেই। আর্থিক খাতে চরম নৈরাজ্য। বেসরকারি সেক্টরে চাকরির ক্ষেত্র বাড়ছে না।

বাংলাদেশে ৫ লক্ষের ওপরে ভারতীয়, কয়েক হাজার শ্রীলঙ্কান,চাইনিজ কাজ করছেন উচ্চ বেতনে, উচ্চ পদে। প্রতি বছর শুধু ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যায় কমপক্ষে ৩২ হাজার কোটি টাকা। ‘সিলিকন ইন্ডিয়া নিউজ’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আয় করেছে ৪ বিলিয়ন ডলার।

এই চিত্র দেখে ভারতের ওপর রাগ করে লাভ নেই। যে মানের ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কানরা বাংলাদেশে কাজ করছেন, সেই মানের কর্মী বাংলাদেশের নিজের নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের তৈরি করতে পারেনি। আগে তাও মোটামুটি একটা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। গত আট দশ বছরে তা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আগামীতে বেকারের সংখ্যা বাড়বে, দক্ষ লোকের সংখ্যা শুধু কমবে। বিদেশ থেকে দক্ষ লোক এনে কাজ করাতে হবে। চিন্তা করে দেখেন, আমাদের প্রবাসী কর্মীরা রক্ত পানি করে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। সেই অর্থ আবার বিদেশি কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছেন। ভারত সারা পৃথিবী থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে,বাংলাদেশ তার মধ্যে পঞ্চম।

৭. বাংলাদেশে সংখ্যায় কম,সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত দুটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে। একটি শ্রেণি রাজনীতি-ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। লুটপাটের অংশীজন হয়ে বিত্তবান হয়ে উঠছে, উঠেছে। আরেকটি করপোরেট জগতে কর্মরত শ্রেণি। এই দুটি শ্রেণির বক্তব্য প্রায় একরকম। ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’ জাতীয় গানে তাদের সঙ্গে মুখ মেলাতে হবে। জনগণের টাকা লুট- জালিয়াতি- পাচার হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলা যাবে না। তাদের ভাষায় এগুলো হতাশার কথা। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখে, হইচই করাটাও তারা পছন্দ করেন না। তারা এর দ্বারা ক্ষতির মুখে পড়ছেন না। নিজেদের সন্তানদের পড়াচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যমে। সেখানে প্রশ্ন ফাঁস বা মান নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। একটি ফ্লাইওভার বা ব্রিজ দেখিয়ে দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে ‘এই দেখো উন্নয়ন’! তাদের বক্তব্য, ‘এত ভর্তুকি দিয়েও ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সামর্থ্য দেখাতে পারছে বাংলাদেশ’।

৩ বছরের কাজ ৯ বছরে কেন? ৩০০ কোটি টাকার কাজে ১২০০ কোটি টাকা খরচ করা হলো কেন? এসব প্রশ্নে তাদের ভেতরে ক্ষিপ্ততা তৈরি হয়। ‘তবুও ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে তো—এত খুঁত ধরলে দেশকে তো এগিয়ে নেওয়া যাবে না। অন্য সরকার এলে দেশ কি এর চেয়ে ভালো চলবে?’– পাল্টা প্রশ্ন করেন।

না, ভালো চলার সম্ভাবনা খুই কম। এ কারণে সব অন্যায়-অনিয়ম-লুটপাট মেনে নিতে হবে?

‘বিকল্প তো কিছু নেই। অপেক্ষা করতে হবে। দেখছেন না, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে,দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’

শিক্ষাব্যবস্থা অকেজো করে দিয়ে,আর্থিক খাতে এমন নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি করে,দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে, কোনও দেশের সমৃদ্ধ হওয়ার নজির নেই। ব্যতিক্রমী বাংলাদেশ সেই নজিরও তৈরি করবে?

  • Bangla Tribune/ March 29, 2018 

No comments:

Post a Comment