Search

Sunday, April 15, 2018

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় জাল সনদে ৪৪৩ পুলিশ!

এ পর্যন্ত করা সব প্রত্যয়নের পুনঃতদন্ত চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় * নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট


উবায়দুল্লাহ বাদল

জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে চাকরি করছেন ৪৪৩ জন। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট একাধিক ভুয়া স্মারকের মাধ্যমে এসব ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে প্রত্যয়ন করেছে বলে অভিযোগ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিষয়টি জানার পর স্মারক জালিয়াতি ও পুলিশ নিয়োগ সংক্রান্ত এ পর্যন্ত করা সব প্রত্যয়নের পুনঃতদন্ত চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্ত করতে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) দায়িত্ব দিয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পাওয়া প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, একটি চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের প্রত্যয়ন করছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মামলা ও গ্রেফতার হয়েছেন। জালিয়াত চক্রকে ধরতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করার অনুরোধ জানিয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি। আশা করি তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে।

জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে পুলিশে প্রায় ৫০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ করা হয়েছে। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, ৪৪৩ জন ভুয়া সনদ ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন। 

এছাড়া জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে পুলিশে চাকরি নেয়ার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় গত বছরের আগস্টে পুলিশ কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলম ও নাসিমা খাতুনকে কারাগারে পাঠায় চুয়াডাঙ্গার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এর আগে একই অপরাধে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দাঙ্গা বিভাগের কনস্টেবল শাহিদুজ্জামান ও কবিরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে জয়পুরহাট থানা পুলিশ। এ ধরনের ঘটনায় আরও অনেকে চাকরি হারিয়ে কারাগারের ঘানি টানছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

নিয়ামনুসারে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেতে হলে আগে সনদ যাচাই করে নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই শর্ত শিথিল করা হয়। নিয়োগের পর সনদ ভুয়া প্রমাণিত হলে চাকরিচ্যুত এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের শর্তে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। চাকরি পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্টদের নথি পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধার সনদ প্রত্যয়ন করে চিঠি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যয়ন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো স্মারক জাল করেই জালিয়াত চক্র ওই ৪৪৩ জন কনস্টেবলকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগে ইস্যুকৃত প্রত্যয়নপত্র জালিয়াতির প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর ১২৮৪নং স্মারকে ১৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়নের বিষয়ে পত্র জারি করা হয়। এতে ১-৪৭ পর্যন্ত ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রত্যয়ন করা হয়। ৪৮-৮৪ পর্যন্ত ৩৭ জনকে পরামর্শসহ প্রত্যয়ন করা হয়। ৮৫-৮৯ পর্যন্ত ৫ জনকে পরামর্শসহ সাময়িক প্রত্যয়ন করা হয়। ৯০-১১০ পর্যন্ত ২১ জনকে জামুকার শর্তে সাময়িক প্রত্যয়ন করা হয়। ১১০-১৫০ পর্যন্ত ৪০ জনকে কাগজপত্রাদির অভাবে প্রত্যয়ন করা হয়নি। আর ১৫০-১৬০ পর্যন্ত ১০ জনকে মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া প্রমাণপত্র দাখিল করা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পর তা অবহিত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। কিন্তু জালিয়াত চক্র এ প্রত্যয়নপত্রটি জাল করে।

জালিয়াতির বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, পরিবর্তনকৃত জালপত্রটিতে ১ থেকে ৪৭ জন প্রত্যয়নের স্থলে ১ থেকে ৫৬ জনকে প্রত্যয়ন দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ৯ জনকে বেশি দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ৭ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, যাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছিল। একজনের সাময়িক সনদ ছাড়া কিছু নেই। অন্য একজন যার জন্ম প্রমাণপত্র নেই।

উভয় মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পত্রের ফটোকপি সংযুক্ত করে গরমিল পাওয়ার বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশ নিয়োগ সংক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত ইস্যুকৃত সব প্রত্যয়নপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মাধ্যমে পুনঃতদন্ত চাওয়া হয় চিঠিতে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ওই চিঠি দেয়ার দেড় মাস পরও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়টি উল্লেখ করে ২৮ জানুয়ারি একই বিষয়ে আবারও চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাতে আগের ১০ জনের বিষয় ছাড়া আরও চারটি স্মারকের মাধ্যমে ৪৩৩ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির বিষয় উল্লেখ করা হয়। ২৮ জানুয়ারির এই চিঠিতে বলা হয়, জননিরাপত্তা বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত প্রত্যয়নের সঠিকতা যাচাইয়ে ৯টি পত্র প্রেরণ করা হয়। এসব পত্র যাচাইকালে স্মারক নং যথাক্রমে ১৩৩০, ১৩৩১, ১৩৯১ এবং ১৪০৪ জাল ও ভুয়া মর্মে প্রতীয়মান হয়। ১৩৩০নং স্মারকে ১৯৩ জন, ১৩৩১ স্মারকে ১০০ জন, ১৩৯১নং স্মারকে ৯৫ জন এবং ১৪০৪নং স্মারকে ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার (মোট ৪৩৩ জন) প্রত্যয়নের সিদ্ধান্ত রয়েছে, যাদের প্রত্যয়ন করা হয়নি। এসব প্রত্যয়নপ্রত্র জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া উল্লিখিত ৪টি স্মারকের জালিয়াতির বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব অপরূপ চৌধুরী সোমবার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি এ জাতীয় বেশ কিছু জালিয়াতির ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের দেয়া সনদ যাচাই-বাছাই শেষে বেশ কিছু ব্যক্তির সনদ ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। আমরা প্রত্যয়ন না করলেও একটি চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের প্রত্যয়ন করেছে বলে জানা গেছে। এমনকি প্রত্যয়ন সংক্রান্ত পত্রের স্মারক নম্বরটিও জাল; যা আমাদের স্মারক নম্বরের সঙ্গে মিল নেই। বিষয়টি তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা আমাদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট নথিপত্রও নিয়ে গেছে।

এ চিঠি পাওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের বিষয়। আর এই মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যারা জালিয়াতি করেছে তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। ইতিমধ্যে বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এনটিএমসি) নুরুল ইসলাম সোমবার নিজ দফতরে এ বিষয়ে বলেন, ‘এ ধরনের একটি বিষয় তদন্তের জন্য ডিবি পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর জানা যাবে কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তার দাবি, বিষয়টির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জননিরাপত্তা বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। পাশাপাশি এর সঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত থাকতে পারে। যারা সিন্ডিকেট করে বিপুল অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এতবড় ঘটনা একজনের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। এ কারণে চিঠি পাওয়ার পরও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টির তদন্ত হচ্ছে না। পুরো বিষয়টি ডিবি পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।


  • যুগান্তর/ এপ্রিল ১৪,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment