Search

Tuesday, April 24, 2018

হালদা’র আর্তনাদ: বাঁচবে তো মাছ?

তানজিনা আকতারী


সাপের মত এঁকেবেঁকে চলেছে নদী। ভাসছে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা, ইঞ্জিন চালিত ট্রলার। বিকট শব্দ করে চলছে বালু উত্তোলনের ড্রেজার। আকাশে চক্রাকারে উড়ছে বক, মাছরাঙ্গা, শঙ্খচিল, পানকৌড়িসহ নানান প্রজাতির পাখি।  অতিথি পাখির আনাগোনা তো আছেই। মাঝে মাঝে সবাইকে অবাক করে পানি থেকে লাফিয়ে উঠছে ডলফিন। এটা যেকোনো নদীর পরিচয় মনে হলেও, বলছিলাম হালদা নদীর কথা।

নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে ছোট বড় যত নদী আছে, তার মধ্যে গুণে অনন্য নদীটির নাম হালদা। হালদা অপার এক সম্ভাবনার, ভালোবাসার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ খুলে দেওয়া প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়ের নাম। হালদা পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী ও এশিয়ার প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে এবং সেই নিষিক্ত ডিম সরাসরি সংগ্রহ করা হয়। এই নদী কেবল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের জন্যই ঐতিহ্যের অধিকারী নয়, ইউনেস্কোর শর্ত অনুসারে এটি বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের যোগ্যতা রাখে।

মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার বিশেষ সময়ে বা তিথিতে অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। স্থানীয়ভাবে এই বিশেষ সময়কে বলে-জো। হাটহাজারী ও রাউজান সীমান্তের প্রায় ১৪ কিলোমিটার এলাকা থেকে এবছর ২২ হাজার ৬৮০ কেজির বেশি রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ মাছের তাজা ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। ডিম থেকে রেণু সংগ্রহ করা হয়। প্রতি কেজি রেণু থেকে চার থেকে পাঁচ লাখ পোনা জন্মায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ড. মনজুরুল কিবরীয়া আশা করেন, এই ডিম থেকে আনুমানিক ৩৭৮ কেজি রেণু তৈরি হবে। গত বছর পরিমাণমত পানিসহ এক কেজি রেণু সর্বোচ্চ এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। সেই হিসাবে এবার আমরা রেণু পোনা থেকে প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা উপার্জন করতে পারি। তারপর সেই পোনা কিছুটা বড় হলে সংখ্যা হিসাবে বিক্রি করে এদেশের অর্থনীতিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার জোগান হবে বলে আশা করা যায়। আরও আশার কথা, এবছর হালদায় বিগত ১০ বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।

এছাড়াও মিঠা পানির অতি বিপন্ন প্রজাতির ডলফিনের সংখ্যা সারা বিশ্বে ১১০০-১২০০টি। এর মধ্যে শুধুমাত্র হালদা নদীতেই আছে ২০০-২৫০টির মত।

এত সুখবরের পরও হালদার পেছনে বিপদ ওত পেতে আছে। ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায় নদীর ওপর ও নদীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হারুয়ালছড়ি খালে দুটি রাবার ড্যাম বসানোর কারণে চা বাগান ও বোরো চাষের জমিতে পানির জোগান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু উজানে বাঁধের কারণে ভাটিতে পর্যাপ্ত পানি না যেতে পারায় শুকনা মৌসুমে নদীর অন্তত ৫-৬ কিলোমিটার এলাকা শুকিয়ে যায়। এছাড়া প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রুই ও কালবাউশের খাদ্য বেনথোস এবং মৃগেল ও কাতলা মাছের খাদ্য প্ল্যাঙ্কটন এই দুই ধরনের খাদ্যের উপস্থিতি প্রায় শূন্যের কোঠায়। সঙ্গত কারণেই মাছ স্থান ও খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে। ডলফিনও তার চিরপরিচিত আশ্রয় হারাতে বসেছে।


এছাড়াও হালদাকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেওয়ার আরও একটি কারণ নদীর দুই পাড়ে শত শত একর জমিতে তামাকের চাষ। তামাকের নির্যাস, চাষে ব্যবহার করা সার ও কীটনাশক মেশানো পানি সরাসরি মিশে যাচ্ছে হালদায়। বিশেষ করে বর্ষায় মাছের প্রজনন মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের ও বৃষ্টির সঙ্গে তামাকের পচা পাতা, মূল ও নদী তীরে চুল্লিতে তামাক পাতা পোড়ানোর ফলে উচ্ছিষ্ট গিয়ে পড়ে নদীতে। ফলে দূষণ বাড়ছে, তামাকের বিষ নদীতে মিশছে, মাছের ও জলজ প্রাণীর জীবন হচ্ছে বিপদাপন্ন।

হালদা পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি নেই। যেগুলোর আছে, সেগুলো ঠিকমতো চালু করা হয় না। একের পর এক ইটভাটা নদীর পানি ও মাটি ব্যবহার করেই চলেছে। খালের মাধ্যমে সব বর্জ্য হালদায় এসে মিশছে, পানির স্বাভাবিক রঙ হারিয়ে কালো রঙ ধারণ করেছে দূষণে। কর্ণফুলী পেপার মিলের গ্যাস নদীতে অপসারণ করা হচ্ছে। এছাড়াও প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, গৃহস্থালির বর্জ্যর কথা নাই বা বলি! নদীর পরিবেশ জলজ প্রাণীর জন্য স্বাস্থ্যকর হচ্ছে না, ফলে মা মাছের মৃত্যু ঘটছে।


বালু উত্তোলন হালদার জন্য আরও এক হুমকি। প্রতিদিন এই অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় লাখ বর্গফুট বালু তোলা হয়। বালু তোলার কারণে নদীর তলদেশের মাটির গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শব্দ দূষণ বাড়ছে, পানি ঘোলা হয়ে যাচ্ছে, সূর্যের আলো ঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না, বালুর সঙ্গে সঙ্গে জলজ প্রাণীও উঠে আসছে। এতে জলজ জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব তো পড়ছেই, সেই সঙ্গে বালু তোলার ড্রেজারের আঘাতে প্রায়ই মারা যাচ্ছে ডলফিন। 

শুধু কি তাই? ক্ষতির মাত্রাকে ভয়ঙ্করভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে নদীর বাঁকগুলো কেটে সোজা করায়। গত ১০০ বছরে হালদা নদীর ১১টি বড় বাঁক কেটে সোজা করে ফেলা হয়েছে, তাতে নদীর দৈর্ঘ্য ১২৩ কিলোমিটার থেকে কমে ৮৮ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। বাঁকের স্রোতস্বিনী অংশ মাছের প্রিয় আবাস ও এই পানিতেই মাছ ডিম ছাড়ে। বাঁক কমে যাওয়ায় মাছের বিচরণক্ষেত্রও কমে গেছে।

এখন প্রশ্ন জাগে, হালদাকে বাঁচাতে আমরা কী করতে পারি? নদী বাঁচানোর প্রধান শর্তই হচ্ছে পানির প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখা। কিন্তু বাঁধের কারণে সেটি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সম্ভব হলে বাঁধ দুটোকে সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। যদি তা নিতান্ত সম্ভব নাই হয় তাহলে যতটা সম্ভব বাঁধের উচ্চতা কমিয়ে দেওয়া দরকার। ইটভাটাগুলো নদীর কাছ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। এছাড়াও ভাটাগুলো যাতে কোনভাবেই নদীর মাটি ও পানি ব্যবহার না করে সেজন্য নজরদারি বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দূষণ কমানোর জন্য ভারী শিল্প-কারখানাগুলোতে তরল বর্জ্য শোধনাগার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এবং পরিবেশ আইন মেনে চলতে সম্পূর্ণরূপে বাধ্য করতে হবে। তামাক চাষ অতি দ্রুত বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মা মাছ ধরা বন্ধে পাহারা জোরদার করতে হবে। 

সরকার যদিও নদীর উল্লেখযোগ্য অংশকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে তবুও সেটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠু তদারকির মারাত্মক ঘাটতি রয়ে গেছে। তাই জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের জন্য আরও বেশি এলাকা মৎস্য অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় মৎস্য চাষিদের মা মাছ ধরা বন্ধে সচেতনতা ও প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে।

যেহেতু কর্ণফুলী হয়ে মা মাছ হালদায় প্রবেশ করে, তাই কর্ণফুলী না বাঁচাতে পারলে হালদাও বাঁচবে না। সেজন্য কর্ণফুলীর দূষণ রোধ করা জরুরি। হালদা নদীকে বাঁচাতে হলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, সিডিএ, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একত্রে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে যেমন অর্থের অপচয় হবে, ঠিক তেমনি প্রকল্পের প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হওয়াটাও বিচিত্র নয়।

এত কিছু বলার পরও মূল প্রশ্ন রয়েই যায়। মৎস্য অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকার কী ভাবছেন হালদা নিয়ে? সরকারের কাছে আমরা যেমন হালদা নদীর মাছের হারানো বাসস্থান ও বংশবৃদ্ধির পরিবেশ ফেরত চাই, ঠিক তেমনি বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন রক্ষার জন্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করার জোর দাবি জানাই। হালদা নদী রক্ষার তাগিদই এখন মাছ ও জলজ প্রাণীর টিকে থাকার প্রধান চাওয়া। মাছে ভাতে বাঙালি কথাটা চিরকাল ধরে রাখার জন্য হালদা আমাদের প্রধান অবলম্বন। একে বাঁচানো মানেই অনেকাংশে বাঙালি অস্তিত্বকেই বাঁচানো। আমরা শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারবো তো?

  • Courtresy: The Daily Star/ Apr 23, 2018

No comments:

Post a Comment