Search

Thursday, April 19, 2018

ইউনেস্কোর উদ্বেগ সত্ত্বেও ফিটনেসবিহীন নৌযান চলছে সুন্দরবনে

এম এম ফিরোজ


সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অনিয়ন্ত্রিত নৌযান চলাচল নিয়ে একাধিকবার উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। তার পরও বাধাহীনভাবে চলছে ফিটনেসবিহীন বিভিন্ন ধরনের নৌযান। গত শনিবার সুন্দরবনের পশুর চ্যানেলে জাহাজডুবির ঘটনা তদন্তেও উঠে এসেছে— কয়লাবাহী কার্গো জাহাজটি ছিল ফিটনেসবিহীন। জাহাজটিতে কয়লাও ছিল ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বা বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অবাধে ফিটনেসবিহীন নৌযান চলছে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তা আরো একবার প্রমাণ হলো।

গত শনিবার সুন্দরবনের ভেতরে পশুর চ্যানেলে কয়লাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি বিলাস ডুবে যাওয়ার ঘটনায় এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ। তদন্ত প্রতিবেদনটি গতকাল জমা দিয়েছে কমিটি। তাতে বলা হয়েছে, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কয়লা পরিবহন ও ফিটনেস না থাকার কারণেই ডুবেছে জাহাজটি।

তদন্তটি করেছেন সুন্দরবন চাঁদপাই রেঞ্জের কর্মকর্তা শাহিন কবির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আরো আগে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া যেত। কিন্তু কার্গোর মালিক ও মাস্টারের গাফিলতির কারণে বিলম্ব হয়েছে। তাদের কাছে ডুবন্ত জাহাজের ফিটনেস ও মাস্টারের লাইসেন্স চাওয়া হলে তা দিতে গড়িমসি করে তারা।

এদিকে কার্গো জাহাজটি ডুবে যাওয়ার গতকাল চতুর্থ দিনেও উদ্ধারকাজ শুরু হয়নি। উদ্ধার তত্পরতায় মালিকপক্ষের এমন উদাসীনতায় বন্দর কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেয়া ১৫ দিনের মধ্যেও জাহাজটি উদ্ধার করা যাবে কিনা সে ব্যাপারে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার মো. ওয়ালিউল্লাহ বলেন, কয়লা আমদানিকারক উদ্ধারকারী নৌযান আনতে না পারায় ডুবে যাওয়া কার্গো জাহাজটির উদ্ধারকাজ শুরু করা যায়নি। ১৫ দিনের মধ্যে আমদানিকারক উদ্ধারকাজ শুরু করতে ব্যর্থ হলে বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।

এদিকে উদ্ধারকাজে বিলম্বের কারণে বাড়ছে পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কাও। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার বলেন, কয়লায় থাকা সালফার পানিতে মিশলে পানির পিএইচ মাত্রা কমে যেতে পারে। এ ধরনের ঘটনা বেশি বেশি ঘটতে থাকলে সুন্দরবনের বড় ধরনের ক্ষতিই হবে। কয়েক বছর ধরে তো এমন দুর্ঘটনা বারবারই ঘটছে। ফলে এ বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়া দরকার।

জানা যায়, ২০১১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেয়। শুরুতে প্রতিদিন ২০-২৫টি জাহাজ চললেও এখন তা ২০০ ছাড়িয়েছে। এসব জাহাজের বেশিরভাগই চলছে পশুর নদী হয়ে।

খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব অহিদুজ্জামান পল্টু বণিক বার্তাকে বলেন, মোংলা-সুন্দরবন নৌ-রুটের অন্যান্য চ্যানেল ক্ষীণ হওয়ায় বেশির ভাগ নৌযান পশুর নদী হয়ে চলাচল করে। মোংলা-সুন্দরবনে বেশির ভাগ নৌ-দুর্ঘটনা হয় বড় জাহাজ থেকে লাইটারেজে পণ্য খালাসের সময়।

নৌযানের ফিটনেস প্রসঙ্গে মালিক গ্রুপের এ প্রতিনিধি বলেন, সব নৌযানকেই সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর (ডিজি শিপিং) থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়ে চলাচল করতে হয়। প্রতি বছর ডিজি শিপিংয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করতে হয়।

যদিও সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলে আসছে ইউনেস্কো। গত বছরের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত কমিটির অধিবেশনেও এ আহ্বান জানানো হয়। তারপরও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নৌযান চলাচল করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনকেন্দ্রিক শিল্প-কারখানার আশপাশের নদীগুলোতে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটছে নিয়মিতই। রামপাল কয়লা বিদ্যুেকন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এমন কয়লাবাহী জাহাজের যাতায়াত আরো বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে এ ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকিও।

সুন্দরবনের নৌযানের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর। সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ডুবে যায় তেলবাহী ট্যাঙ্কার এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন। ২০১৫ সালের ৩ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবে যায় সারবোঝাই কার্গো জাহাজ এমবি জাবালে নূর। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে ডুবতে ডুবতে অন্য কার্গোর সহায়তায় মোংলায় পৌঁছতে সক্ষম হয় আরেকটি কয়লাবোঝাই কার্গো। ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবরেই সুন্দরবনের পশুর নদীতে ৫১০ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় এমভি জিয়া রাজ। পরের বছরের ১৯ মার্চ বিকালে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীর ‘হরিণটানা’ বন টহল ফাঁড়ির কাছে ১ হাজার ২৩৫ টন কয়লা নিয়ে এমভি সি হর্স-১ ডুবে যায়। ২০১৭ সালের ৪ জুন রাতে হারবারিয়া চ্যানেলে ৮২৫ টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল নিয়ে এমভি সেবা নামে আরেকটি কার্গো জাহাজ তলা ফেটে ডুবে যায়।

২০১৪ সালে শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার ঘটনার পর ইউনেস্কো এক বিবৃতিতে জানায়, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল করলে তা জীববৈচিত্র্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। সুন্দরবন ইউনেস্কো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। এ বনে অনেক বিপন্ন এবং বিশ্বের দুর্লভ জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। তাই দ্রুত সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।
  • Courtesy: Banikbarta/ Apr 19,2018

No comments:

Post a Comment