Search

Wednesday, April 25, 2018

ব্যাংক-ব্যবসায়ী নিলাম নিলাম খেলা

চট্টগ্রামে খেলাপি ঋণ আদায়


ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে চট্টগ্রামে একের পর এক ব্যবসায়ীর বন্ধকি সম্পদ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জায়গা-জমি, বসতঘর ইত্যাদি জব্দ করা হচ্ছে। মাত্র এক বছরে চট্টগ্রামে ৬০ ব্যবসায়ীর এমন ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সম্পদ নিলামে তোলা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক প্রকার যোগসাজশের ফলেই এসব সম্পদ নিলামে তুলে বিক্রি করা সম্ভব হয় না। খেলাপি ঋণ আদায় নিয়ে ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর মধ্যে চলে 'নিলাম নিলাম খেলা'।

ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিলেও এখন অনেক ব্যবসায়ীকে খুঁজে পাচ্ছে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কারখানায় তালা ঝুলিয়ে মোবাইল ফোনও বন্ধ রাখছেন অনেকে। আত্মগোপনে থেকে কেউ কেউ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন প্রতিনিধি পাঠিয়ে। নোটিশ দিয়েও যাদের দেখা মিলছে না সেসব ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীর বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তুলতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হচ্ছে। এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলেও বহু ব্যবসায়ীর সম্পদ নিলামে ওঠে না। নিলাম ঠেকাতে ব্যাংক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে তাদের কেউ কেউ কিছু টাকা ব্যাংকে দিয়ে বসেন আপসরফায়। আবার কেউ উচ্চ আদালতে গিয়ে নিয়ে আসছেন স্থগিতাদেশ। কারও কারও সম্পদ নিলামে উঠলেও সেটি বিক্রি হয় না। সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, নিলাম নিয়ে ব্যাংক-ব্যবসায়ীর এমন খেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো ব্যাংক খাত।

এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংক চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার এম এ কাইয়ুম বলেন, 'গণমাধ্যমে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পালিয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের ওপর একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করা হয়। কিন্তু তাদের সম্পত্তি নিলামে তুলতে গেলে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন তারা। আবার কেউ ওপর মহলে তদবির করে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে আনেন। এসব কারণে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেও অনেক সময় বড় ব্যবসায়ীদের সম্পদ নিলামে তোলা সম্ভব হয় না।' মাঝপথে নিলাম প্রক্রিয়া স্থগিত করা প্রসঙ্গে পূবালী ব্যাংক চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ও ডিএমডি মোক্তার আহমেদ বলেন, 'নিলাম বিজ্ঞপ্তি একবার প্রকাশ হলে তা আর স্থগিত করা যায় না। তবে কেউ কেউ কিছু টাকা ব্যাংককে দিয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ নেন। বড় আইনজীবী নিয়োগ করে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন।' 

দেড় হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পেরে নূরজাহান গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, এমইবি গ্রুপ, সিদ্দিক ট্রেডার্স, হারুন ট্রেডিং, এস এস ইন্টারন্যাশনাল, রুমানা এন্টারপ্রাইজ, মনোয়ারা ট্রেডিং, আইমান এন্টারপ্রাইজ, মইনুদ্দিন করপোরেশনসহ বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নিলামে তোলার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেও প্রকৃত অর্থে নিলাম হয়নি কারও সম্পত্তিই। ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা সর্বোচ্চ ৫৯৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকার সম্পত্তি নিলামে তোলে নূরজাহান গ্রুপের। কিন্তু নামমাত্র টাকা দিয়ে আপসরফা করে নিলাম ঠেকিয়েছেন তারা। চট্টগ্রামে সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ করপোরেট শাখায় ১১৩ কোটি টাকার ঋণ গত বছর খেলাপি হয় ওয়েস্টার্ন মেরিনের। এজন্য তাদের সম্পত্তি নিলামে ওঠার কথা আরও ৬ মাস আগে। কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে সময়ক্ষেপণ করার কৌশল নেন তারা। এর ফাঁকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নতুন করে সময় বাড়ানোর আবেদন করে তার অনুমোদন নিয়ে আসে ওয়েস্টার্ন মেরিন। 

একইভাবে ৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা ঋণখেলাপি হওয়ায় মেসার্স গ্রিনফিনিটি এনার্জি, মেসার্স এক্সিস ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স মেডী ট্রেড করপোরেশনের সম্পত্তি নিলামে তোলার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছর ১০ আগস্ট। কিন্তু পূবালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় মাত্র ১৫ লাখ টাকা দিয়ে এ নিলাম ঠেকিয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা। একই ব্যাংক প্রায় দুই কোটি টাকা ঋণখেলাপি হওয়া আফসানা বিল্ডার্সের বন্ধকি সম্পত্তিও নিলামে তোলে গত ২২ নভেম্বর। কিন্তু চার লাখ টাকা জমা দিয়ে এ নিলামও ঠেকিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নিলাম নিয়ে এমন 'কানামাছি খেলা' চলছে। আবার প্রক্রিয়া বারবার স্থগিত হওয়ায় নিলাম বিজ্ঞপ্তির প্রতিও আস্থা হারাচ্ছেন আগ্রহীরা। এ জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অনেক নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হচ্ছে একাধিকবার।

২০১৫ সালে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু পুনর্গঠন সুবিধা নিয়েও ব্যবসায়ীদের বড় অংশ কিস্তি পরিশোধ করছে না। বরং বিশেষ সুবিধা পাওয়া এই বড় ব্যবসায়ীরা নতুন করে আবার খেলাপি হচ্ছেন। মাত্র এক শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯২৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন সুবিধা নেওয়ার পরও খেলাপি হওয়া এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। 

ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, অব্যাহত লোকসান, ব্যবসায়িক প্রতারণা ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দর ব্যাপক ওঠানামা করার কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারছেন না তারা। নিলাম থেকে সম্পত্তি বাঁচাতে আরও সময় চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, দফায় দফায় সময় বাড়িয়েও কোনো সুরাহা না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছেন তারা।

২০১৮ সালের গত দুই মাসেই অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নিলামে তোলার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন অর্থঋণ আদালত। আর ২০১৭ সালে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সংখ্যা অন্তত ৭০।
  • Courtesy: Dainik Samakal /Apr 25, 2018

No comments:

Post a Comment