Search

Sunday, April 22, 2018

মাঝরাত, সময়জ্ঞান এবং ‘গুজব’

গোলাম মোর্তোজা


‘বর্তমান’ অন্ধকার। ভবিষ্যৎ ‘দেখিস একদিন আমাদেরও...’। আছে শুধু ‘অতীত’। বর্তমানের যত বিচ্যুতি, দীনতা-নীচতা, অতীতের গৌরবের গল্প দিয়ে ঢেকে রাখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলার চেষ্টা করি।

এদেশে সবকিছুরই পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও হয়েছে। ৫৬ শতাংশ সরকারি চাকরি কোটায়, সভ্য বা অর্ধ- সভ্য কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো নিয়ম নেই। যদিও কোটা পৃথিবীর বহু দেশে আছে।

শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। আন্দোলনটা কী?

তারা এই ৫৬ শতাংশ কোটা কমিয়ে আনার জন্যে প্রথমে অনুরোধ করেছেন। অনুরোধ এক পর্যায়ে দাবিতে পরিণত হয়েছে। মনে রাখা দরকার, তারা কোটা বাতিলের দাবি করছেন না, সংস্কারের দাবি করছেন। সরকারের গঠন করা তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও যা কাগজে-কলমে বলেছেন।


এই দাবির এক পর্যায়ে গত ৮ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের উপর যে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তা সবারই জানা। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধতার সঙ্গে বলেছেন ‘কোটাই থাকার দরকার নেই’। ছাত্রীরা রাত একটার সময় হল থেকে বের হয়ে এসেছেন, এতে প্রধানমন্ত্রী এতটাই বিচলিত হয়েছেন যে রাতে ঘুমাতে পারেননি। জাতীয় সংসদে সে কথা বলেছেনও। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর আন্দোলন স্থগিত হয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ‘লোক দেখানো-কাঁদানো’ কর্মকাণ্ড বন্ধ তো হয়ইনি, ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে।

১. রাত ১০টা থেকে শুরু করে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত, কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে তিন জন মেয়েকে বের করে দিয়েছেন হল কর্তৃপক্ষ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ধমকেছেন- ভয় দেখিয়েছেন অনেককে। রাত একটার সময় মেয়েরা বের হয়ে আসায় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বুঝলাম, মেয়েরা নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় না নিয়ে হল থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু হল কর্তৃপক্ষ-হলের প্রাধ্যক্ষ, হলের আবাসিক শিক্ষক, যারা মেয়েদের অভিভাবক, তাদের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের রাত সাড়ে ১২টায় হল থেকে বের করে দিলেন। বিস্মিত-মর্মাহত-ক্ষুব্ধ যে শব্দেই বলেন, তা দিয়ে আসলে কী কিছু বোঝানো যায়! কোনো মানুষ, কোনো অভিভাবক, পুরো সুস্থ নন অর্ধ সুস্থ চিন্তার কোনো অভিভাবক এমন কাজ করতে পারেন? আপনার উত্তর ‘না’ হতে পারে বা হবেই, যদিও তাতে কিছু যায় আসে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের।

২. কথাটা আসবে, এভাবে সব শিক্ষককে বলছি কেন? সব শিক্ষক তো আর এ কাজ করেননি। হ্যাঁ, সব শিক্ষক এমন কাজ  করেননি। করেছেন একজন হল প্রাধ্যক্ষ, তাকে সরাসরি সমর্থন যুগিয়েছেন উপাচার্য। তার আগে ১৯ জন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চেয়ে উপাচার্যের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। হয়তো এমন আরও কিছু শিক্ষক আছেন যারা ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হচ্ছেন শিক্ষার্থীদের প্রতি অনাচার দেখে।কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার দাবিতে মানববন্ধন করছেন, কয়েকজন লিখেছেনও। বিবেকহীনতার এই কালে যা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
তারপরও বলতে হয় সেই সংখ্যা কতজন, মোট শিক্ষকের মধ্যে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষক প্রায় ১৮’শ। প্রায় সবাই চুপচাপ দেখছেন, তাদের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের নিপীড়িত-নির্যাতিত হতে দেখছেন। বোধ-বুদ্ধি- বিবেক, কোনো কিছুই যেন কাজ করছে না।

৩. হলের মহামান্য প্রাধ্যক্ষ মেয়েদের রাত সাড়ে ১২টায় একা ছেড়ে দেননি, কর্মটির পেছনে যুক্তি দিতে গিয়ে প্রাধ্যক্ষ বা উপাচার্য যা বলছেন, অনেকেই তা বলবেন ‘বের করে দেওয়া হয়নি, অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে’।
সন্ধ্যায় একজন মেয়ের অভিভাবককে ফোন করে হলে আসতে বলা হয়েছে।

তিনি থাকেন ধামরাই। বলেছেন রাতে নয়, সকালে আসব। হল থেকে বলা হয়েছে, রাতে মানে এখনই আসতে হবে। বাবা ধামরাই থেকে মেয়ের হলে ছুটে এসেছেন। এভাবে কেউ রাত ১০টায়, কেউ রাত সাড়ে ১২টায় মেয়েকে নিয়ে হল থেকে বেরিয়েছেন। এই মাঝরাতে মেয়েকে নিয়ে অভিভাবকরা কোথায় যাবেন? যাকে রাত সাড়ে ১২টায় হল থেকে বের করে দেওয়া হলো, তার হয়তো ঢাকা শহরে থাকার কোনো জায়গা নেই। মেয়েকে নিয়ে বাবা বা অভিভাবক কী করবেন? তিনি রিকশা বা সিএনজিতে করে গাবতলী-সায়েদাবাদ বা মহাখালী বাস টার্মিনালে যাবেন বা গেছেন। হয়তো কোনো বাহ্যিক বা শারীরিক দুর্ঘটনা ঘটেনি। মানসিক? তা জানার সময় মহান উপাচার্য-প্রাধ্যক্ষ-শিক্ষকদের থাকার কথা নয়। এত ছোট বিষয় নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই।উপাচার্য বলেছেন ‘এমন না যে সংখ্যা অনেক, মাত্র তিন জন!’
বিষয়টি এমন যে, মাত্র তিন জনের জন্যে আবার এত চিন্তা কেন!

৪. একটা প্রশ্ন মাথায় আসছে। করব কিনা ভাবছি। আমরা এখন এমন এক দেশের বাসিন্দা, যে দেশে প্রশ্ন করা প্রায় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। প্রশ্ন করলেই ‘রাজাকার’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবুও প্রশ্ন করি-
রাত একটায় হল থেকে বের হয়ে এসে ক্যাম্পাসের ভেতরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ, না রাত সাড়ে ১২টায় অভিভাবকের সঙ্গে রিকশা বা সিএনজিতে বাস টার্মিনালে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ? কোনটা বড় অপরাধ, রাত একটায় হল থেকে বের হয়ে নিপীড়নের প্রতিবাদে আন্দোলনে যোগ দেওয়া, না রাত সাড়ে ১২টায় হল থেকে বের করে দেওয়া? মহামান্য প্রাধ্যক্ষ মেয়েদের ফোন চেক করে ‘গুজব’ ছড়ানোর পোস্টের সন্ধান পেয়েছেন। শাস্তিস্বরূপ হল থেকে বের করে দিয়েছেন। মেয়েদের হল থেকে বের করে দেওয়ার শতভাগ সত্য সংবাদকে উপাচার্য বলেছেন ‘গুজব’। সত্যকে ‘গুজব’ বলা যায়? বললে, তা ঠিক কোন পর্যায়ের ‘গুজব’র তালিকায় পড়ে? মেয়েদের নিরাপত্তা বিবেচনায় যে বিশ্ববিদ্যালয় এখনও আইন (যা থাকার দরকার নেই) বহাল রেখেছে সন্ধ্যার মধ্যে হলে ফিরতে হবে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় মাঝ রাতে মেয়েদের হল থেকে বের করে দিয়েছে। হল প্রাধ্যক্ষ বলেছেন ‘ছেলেমেয়ে আলাদা করে দেখছি না’। উপাচার্য বলেছেন ‘রাত আর দিন আবার কি? অভিভাবকদের আসতে দেরি হওয়ায় রাত হয়েছে’।
শিক্ষক বা উপাচার্যের বক্তব্য যখন স্ববিরোধী হয়ে যায়, তখন লজ্জা পাওয়া ছাড়া সাধারণের আর কিছু করার থাকে না।

৫. ‘গুজব’ প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা। কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ নেত্রী কর্তৃক ‘রগ কাটা’র গুজবকে কেন্দ্র করে অনেক কিছু ঘটেছে।তার আগে একজন আন্দোলনকারীর মৃত্যুর ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাক্রম বা ‘গুজব’র বিষয়গুলো কে কিভাবে দেখেছেন, বলেছেন?

আরও সুনির্দিষ্ট করে যদি বলি, ‘গুজব’ ছড়াল কেন বা ‘গুজব’ কেন ছড়ায়।

ক. অকারণে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে ‘গুজব’র প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে।যা শিক্ষার্থীরা করেননি।

খ. যে শিক্ষার্থী মারা গেছেন বলে ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়েছে, তিনি রাবার বুলেটবিদ্ধ হয়ে আহত- রক্তাক্ত হয়েছেন। আহতদের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুরুতেই খোঁজ-খবর নিলে, গুজব এতটা ডালপালা মেলত না।

গ. বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলনের ইতিহাস দেখেন নিপীড়ন বা নির্যাতন করে আন্দোলন দমন করতে চাইলে, বুলেট বা রাবার বুলেটে আন্দোলনকারীরা আহত হলে, মারা যাওয়ার গুজব ছড়ায়, এটা খুব অস্বাভাবিক বিষয় নয়। ক্ষমতাসীনরা সব সময় বলেন ‘গুজব’ পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয়, বাস্তবে তা নয়। ‘গুজব’ ছড়ানোর জন্যে সবক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের পরিকল্পনা করার দরকার হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভয়ঙ্কর দমন প্রক্রিয়ায়ই ‘গুজব’ ছড়ানোর উপাদান থাকে।

ঘ. কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ নেত্রী আন্দোলনকারী একজনের ‘পায়ের রগ’ কেটে দিয়েছেন, এই গুজব বিষয়ে আসি। আসুন ধরে নিই আন্দোলনকারীরা এই ‘গুজব’ পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়েছেন। তাহলে প্রক্টর আর ভিসি কি করেছেন? হল প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকরা কি করেছেন?
প্রক্টর বলেছেন ‘অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। মেয়েটি নিজ মুখে আমার কাছে স্বীকার করেছে।’

পরে যখন জানা গেল অপরাধ সংগঠিত হয়নি, তার মানে ‘গুজব’ প্রক্টর নিজেও ছড়িয়েছিলেন। তিনি ভিসিকেও এই তথ্য সরবরাহ করেছেন। ভিসি হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকদের কাছে জানতে চেয়েছেন। তারাও ভিসিকে বলেছেন ‘অপরাধ সংগঠিত হয়েছে’। ভিসি সে কথা গণমাধ্যমের সামনে বলেছেন। তাহলে ‘গুজব’ ছড়ানোর দায় তো উপাচার্যেরও। শুধু গুজব নয়, প্রক্টর-ভিসি ছড়িয়ে পড়া ‘গুজব’কে সত্য ভিত্তি দিয়েছেন।

ঙ. ‘রগ কাটা’ হয়েছে কি, হয়নি- দেশের কোনো গণমাধ্যম অনুসন্ধান করে, দায়িত্ব নিয়ে প্রকৃত সত্য তথ্য প্রচার বা প্রকাশ করতে পারেনি। অধিকাংশ গণমাধ্যম ‘রগকাটা’ তথ্যের পেছনে ছুটেছেন। প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান করে বের করা অসম্ভব ছিল না। ছাত্রলীগ নেত্রী রগ না কাটলেও, শিক্ষার্থীদের যে নিয়মিত নিপীড়ন করেন সেই তথ্য গণমাধ্যম জানিয়েছে। ভিসি- প্রক্টর সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি।

চ. ৮ এপ্রিল রাতে হলগুলোতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ হতে পারে, এমন প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। লাঠি-রড-চাপাতি হাতে দল বেঁধে তরুণরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বলা হয় এসব যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে এবং তারা হলের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আক্রমণ করবে।

এই ভিডিও চিত্র আগের, না সেদিনের- দেশের কোনো গণমাধ্যম তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি। সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও।

তাহলে এই ‘আতঙ্ক’ বা ‘গুজব’ ছড়ানোর দায় কি যারা আতঙ্কিত হয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তাদের, না সরকারেরও? এখানে গণমাধ্যমের কি কোনো দায় নেই?

ছ. ‘মুখ গামছা দিয়ে ঢেকেছে কেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা? যেহেতু মুখ ঢেকে মিছিলে এসেছে, সুতরাং তাদের খারাপ উদ্দেশ্য আছে’- এই প্রচারণা চালানো হলো কলকাতার একটি জনসভার ছবি ব্যবহার করে। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এই প্রচারণা কারা চালালেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা গণমাধ্যম তা অনুসন্ধান করে রহস্য উন্মোচন করেনি।

জ. ‘গুজব’ ছড়ানো হয়েছে বলে জিকির করার কিছু নেই। যা ঘটেছে, তা ঘটতে দেওয়ার বা থামাতে না পারার ব্যর্থতা সম্মিলিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সরকারের। সরকারি ছাত্র সংগঠন এবং দলীয় কিছু শিক্ষক- উপাচার্যের কর্মকাণ্ডে বিষয়টি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

৬. কথায় কথায় বলা হয় ‘সব কিছুর একটা সীমা’ থাকা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপর চালানো নির্যাতনের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকছে না। এতদিন শিক্ষকদের প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগ নির্যাতন করত। এখন শিক্ষকরা সরাসরি নির্যাতন শুরু করেছেন। ‘দাবি মানা হলো, হলে ফিরে যাও’- বলে নিপীড়ন-নির্যাতন, ছাত্র রাজনীতি বা নিপীড়নের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে নিশ্চয়ই থেকে যাবে। মাঝ রাতে মেয়েদের হল থেকে বের করে দিয়ে যে, অপরাধ করা হয়েছে- তা বুঝেই হয়ত মেয়েদের আবার হলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তাতে বিষয়টি সমাধান হচ্ছে না।

যে যুক্তিতে মেয়েদের ভয় দেখানো হয়েছে, হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে- সেটা খুব বড় রকমের কু- যুক্তি।

ক. বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোনো মেয়ের মোবাইল ফোন, হল প্রাধ্যক্ষ চেক করতে পারেন না। এক্ষেত্রে ‘প্রাইভেসি’ লঙ্ঘিত হয়েছে।

খ. ভুয়া আইডি বা ‘অপতথ্য’ প্রচার করেছেন কিনা, তা প্রমাণিত হয়নি। প্রমাণ করার কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। প্রমাণের আগেই ‘অভিযুক্ত’ করে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে দিয়েছেন প্রাধ্যক্ষ-উপাচার্য। মেয়েদের ‘প্রাইভেসি’র বিষয়টি এক্ষেত্রেও লঙ্ঘিত হয়েছে।

গ. হল প্রাধ্যক্ষ, হলের আবাসিক শিক্ষক বা উপাচার্য কেউ- ই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ নন। মোবাইল বা ভুয়া আইডির বিষয়টি কোনো ল্যাবে পরীক্ষা ছাড়া, রায় দিয়ে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনেও যা করা যায় না।

ঘ. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে প্রাধ্যক্ষের যেমন দলীয় পদ ধারণ করে রাজনীতি করার অধিকার আছে (নৈতিকতার বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে বলছি), রাষ্ট্রীয় আইনে নিষিদ্ধ নয় এমন যে কোনো দলের রাজনীতি করার অধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আছে। সরকারের বা দলের সমালোচনা করে পোস্ট যে কোনো শিক্ষার্থী দিতে পারেন। ‘সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড’ -এই যুক্তিতে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা উপাচার্য- প্রাধ্যক্ষ- প্রক্টর, কারও নেই।

ঙ. যেখানে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে, সেই আইনের দোহাই দিয়ে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেওয়াকে উৎসাহিত করতে পারেন না। ‘অভিভাবকের দায়িত্ব’ বলে উপাচার্য যে নিপীড়নকে সমর্থন করছেন, ‘উপাচার্য পদ’টির জন্যে তা অত্যন্ত অসম্মানজনক। কোনো অভিভাবক খুশি মনে মাঝরাতে মেয়েদের হল থেকে নিয়ে যাননি। ‘অভিভাবকরা খুশি হয়েছেন, খুশিতে কেঁদে দিয়েছেন, বোনের ফেসবুক পোস্টের কারণে পুলিশ অফিসার ভাইয়ের চাকরি চলে যাবে’, সেই পুলিশ অফিসার একথা বলেছেন বলে উপাচার্য দাবি করছেন, এগুলো সৃজনশীল গল্প হিসেবেও উঁচু মানের নয়, সত্য কাহিনী তো নয়-ই।

চ. নিম্নবিত্তের সন্তান রাশেদদের নেতৃত্বে গড়ে উঠা ন্যায্য দাবির প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। ‘শিবির ট্যাগ’ বা দিনমজুর রাশেদের বাবাকে নাজেহাল করার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে।
ছ. ‘দুই হাজার ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল করে দেব’- এমন হুমকি দিতে পারেন না একজন প্রাধ্যক্ষ। গণমাধ্যমের সামনে ভিসির বক্তব্য এবং প্রাধ্যক্ষের  অডিও’র হুমকি, কোনো অর্থেই উপাচার্য বা শিক্ষকসুলভ নয়।

জ. প্রাধ্যক্ষ এবং উপাচার্য বলেছেন ‘কাউন্সিলিংয়ের জন্যে মেয়েদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে’।
মাঝরাতে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, হুমকি দেওয়া হয়েছে অভিভাবক বা মেয়েরা গণমাধ্যমকে কিছু বলতে পারবেন না। বললে, বিপদে পড়তে হবে।এমন অভিনব কাউন্সিলিং পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে জানিনা। জানেন কেউ?

৭. সারা পৃথিবীতে শিক্ষার্থীরা হলে থাকলে, অভিভাবকরা সবচেয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। হলে থাকা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকদের ঘুমহীন সময় কাটাতে হয়।

শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া দরকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, সরকারেরও। দাবি মানার কথা বলে ঘরে ফিরিয়ে নিপীড়ন- ভালো কাজ নয়। শিক্ষার্থীরা ভাবতে পারেন, তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। নিপীড়ন না করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের। কোটা সংস্কার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে হবে সরকারকে। সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কিছু করণীয় নেই। তাদের করণীয় নিপীড়ন বন্ধ করার দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে। কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষের প্রকাশিত হয়ে পড়া ‘অডিও হুমকি’তে যার উপাদান আছে। ‘এখন থেকে হলে সিট হল কর্তৃপক্ষ দিবে’- এই বক্তব্য দিয়ে যা বোঝায়, সেই অনুযায়ী উদ্যোগ নিতে হবে। ছাত্রলীগের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন- হল ছেড়ে দেওয়ার নীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। তা না হলে, সমস্যার সমাধান হবে না।

  • DailyStar/Apr 22, 2018

No comments:

Post a Comment