Search

Saturday, April 28, 2018

সিটি নির্বাচন নিয়ে নাগরিক ভাবনা

বদিউল আলম মজুমদার

বাংলাদেশ এখন নির্বাচনের মহাসড়কে। জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও এ বছর আরও সাতটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ইতিমধ্যে আদালতের আদেশে স্থগিত হয়ে গেছে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে, যেখানে ১৫ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল শুধু দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের-আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্যই নয়, পুরো জাতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বলা যাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে।

গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত আটটি সভায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের দেড় সহস্রাধিক নির্দলীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়। এসব অনুষ্ঠানে আমি একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম: বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে কি তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে? এ প্রশ্নের জবাবে প্রায় সবাই দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, উত্তর দিয়েছেন যে বিদ্যমান অবস্থায় তাঁরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখেন না। এর বাইরেও অন্য দুটি অনুষ্ঠানে উপজেলা পর্যায়ের ৪০ জনের অধিক রাজনৈতিক নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিকে আমার একই প্রশ্ন করার সুযোগ হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এ দুটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় সবাই, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও আগামী নির্বাচন নিয়ে একই মনোভাব ব্যক্ত করেন।

সমাজের একদল সচেতন ও জনমত সৃষ্টিকারী নাগরিকের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের হতাশাব্যঞ্জক মনোভাব জাতির সামনে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বিশেষত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের জন্য, যাঁরা যেকোনো নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। এসব অংশীজনের যথার্থ ভূমিকাই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকা অপরিহার্য, যদিও যথেষ্ট নয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, সবচেয়ে শক্তিশালী, কার্যকর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনও সঠিক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে না, যদি না সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারি দল সদাচরণ না করে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে,২০১৩ সালের ১৫ জুলাই অন্য আরও তিনটি-রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সঙ্গে খুলনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ চারটি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিদায়ী মেয়ররা, যাঁদের প্রায় সবাই মেয়র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত সফল, বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এরপর ৬ জুলাই ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দল লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিএনপির কাছে পরাজিত হয়, যদিও গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য এবং মোটামুটিভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল। এসব নির্বাচনে জেতার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও তারা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা চালায়নি। কারণ, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার প্রেক্ষাপটে, আওয়ামী লীগ তখন প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে তাদের বিশ্বাস করা যায় এবং তাদের তথা দলীয় সরকারের অধীনে সঠিক নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু পরপর পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বড় ব্যবধানে ক্ষমতাসীনদের পরাজয়ের পর পরবর্তীকালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল দুর্ভাগ্যবশত পূর্বনির্ধারিত হয়ে যায়। ফলে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন মোটামুটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হয়নি।

আসন্ন গাজীপুর ও খুলনার সিটি করপোরেশন নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গাজীপুর ও খুলনার নির্বাচনে হারলে তাদের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট বার্তা সবাই পাবে। আর কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে তারা জিতলে, তা আগামী নির্বাচনগুলোর যথার্থতা নিয়ে জনমনে আরও আশঙ্কা বাড়বে। গাজীপুর ও খুলনার নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আয়োজন করার মধ্য দিয়ে কমিশন সুনাম অর্জন করলেও, পরবর্তীকালে দুই দফা-২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ এবং ২৯ মার্চ ২০১৮ অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তা বহুলাংশে ম্লান হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ৩১ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘সংঘর্ষ, অস্ত্রের মহড়া, জাল ভোট, প্রাণহানি, ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টাসহ নানা অঘটনের মধ্য দিয়ে...অনুষ্ঠিত হলো বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বলতে যা বোঝায় তার উল্টোটা দেখা গেছে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে। এখন বাংলাদেশে নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে পেশিশক্তির লড়াই।’

আরেকটি কারণেও এই দুটি নির্বাচন বিশেষ চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ২০১৪ সালের একতরফা জাতীয় নির্বাচনের পর অনেকেই দাবি করেছিলেন যে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হলে, গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে এবং নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষকেরা উপস্থিত থাকলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু ২০১৪ সালের পরের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা, বিশেষত গত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এটিকে ভ্রান্ত ধারণা বলে প্রমাণিত করেছে; বরং এসব অভিজ্ঞতা থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে সরকার এবং সরকারি দল চাইলেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। তবে নির্বাচন কমিশন চাইলে কারচুপি ও কারসাজির নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ না থাকলে তারা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তও নিতে পারে। জাল-জালিয়াতির অভিযোগ উঠলে তদন্তসাপেক্ষে কমিশন নির্বাচনী ফলাফলও বাতিল করতে পারে। আমাদের উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে। তাই কমিশনের দায়িত্ব তাদের ক্ষমতা সঠিক ও নির্মোহভাবে ব্যবহার করা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত রাখা, যাতে এর বিশ্বাসযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত রাখতে হলে অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, মামলার বিবরণী, পেশা, আয়ের উৎস এবং নিজেদের ও নির্ভরশীলদের সম্পদ এবং দায়-দেনার তথ্য হলফনামা আকারে প্রদানের বিধান গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে বা তথ্য গোপন করলে প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার কথা এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা তথ্য গোপন করে নির্বাচিত হলে নির্বাচন বাতিল হওয়ার কথা। এ ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। (দেখুন, বর্তমান লেখকের সম্পাদিত নবম জাতীয় সংসদ ২০০৮: অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি প্রথমা প্রকাশন, ২০১২)।

এ ছাড়া হলফ করে মিথ্যা তথ্য দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। হলফনামায় প্রদত্ত ও আয়কর বিবরণীর তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখলেই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বহুলাংশে কলুষমুক্ত রাখা যাবে। আমরা বহুদিন থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করার দাবি করে আসছি। আশা করি, খুলনা ও গাজীপুরের প্রধান রাজনৈতিক দলের কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে হলফনামায় তথ্য গোপন করার যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন জনস্বার্থে এবং আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলুষমুক্ত রাখার লক্ষ্যে হলফনামা চুলচেরাভাবে যাচাই-বাছাই করার গুরুত্ব অনুধাবন করবে।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার : সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক
  • প্রথমআলো/এপ্রিল ২৭,২০১৮

No comments:

Post a Comment