শামীম রাহমান
পরস্পরের গা-ঘেঁষে চলা দুই বাসের চাপে ৩ এপ্রিল ডান হাত হারান রাজধানীর তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ এপ্রিল মারা যান তিনি। এর রেশ না কাটতেই ২০ এপ্রিল বনানীতে বাসচাপায় ডান পা বিচ্ছিন্ন হয় গৃহকর্মী রোজিনা আক্তারের। গতকাল মারা গেছেন তিনিও।
২৮ এপ্রিল মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে বাসের চাপায় বাম পা হারান মো. রাসেল নামের এক যুবক। তার এক সপ্তাহ আগে (২২ এপ্রিল) ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের শেরপুরে ট্রাকের নিচে পড়ে বাম হাত বিচ্ছিন্ন হয় শিশু সুমি আক্তারের। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিন বছরে এসব দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছেন ৪ হাজার মানুষ।
জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৩০৫ জন, ২০১৬ সালে ৯২৩ ও ২০১৭ সালে ১ হাজার ৭২২ জন দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছেন। এ তিন বছরে সারা দেশে প্রায় ১৬ হাজার দুর্ঘটনায় ২২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আহতের সংখ্যা প্রায় ৫৪ হাজার। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে আরো ২৯৭ জনকে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব উদ্যোগ প্রয়োজন, তা নেয়া হচ্ছে না। ট্রাফিক আইন বাস্তবায়ন, দক্ষ চালক তৈরি, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল রোধ ও সড়ক নিরাপত্তায় ভঙ্গুর অবস্থার কারণে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ সরকারি তথ্যভাণ্ডার নেই। পুলিশের তথ্য নিয়ে দুর্ঘটনায় হতাহতের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটিএর প্রতিবেদনে হতাহতের সংখ্যা কম দেখানোর প্রবণতা রয়েছে।
এর আগে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) জরিপে বলা হয়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। প্রতি বছর নিহত হন ২৩ হাজার ১৬৬ জন। ‘বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি সার্ভে-২০১৬ (বিএইচআইএস)’ শীর্ষক ওই জরিপের তথ্যমতে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
আর্থিক ক্ষতি আরো বেড়ে যায় পঙ্গুত্ব ও চিকিৎসা ব্যয়ের চাপে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক অধ্যাপক ডা. গণি মোল্লা বণিক বার্তাকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাত-পা ভাঙা, স্পাইন ভাঙা রোগী হাসপাতালে বেশি আসে। তবে আগের তুলনায় ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। একবার কেউ হাত-পা হারালে তারা সমাজের জন্য বোঝা হয়ে যায়। দেশে এখনো কৃত্রিম হাত-পা সংযোজনের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না। আর কৃত্রিম হাত-পা লাগালেও অনেকে তা ঠিকমতো মেইনটেইন করতে পারে না। এ কারণে পঙ্গুত্বের হার কমাতে সড়ক ব্যবস্থায় উন্নতির বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্ঘটনাগুলোর ৯০ ভাগই ঘটেছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত গতি। আর বেপরোয়া চালকের কারণে ঘটে ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা।
১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ মতে, ১৮ বছর বয়স না হলে পাবলিক প্লেসে কেউ মোটরযান চালাতে পারবে না। পেশাদার চালকদের বয়স হতে হবে ন্যূনতম ২২ বছর। পেশাদার চালকদের অবশ্যই মালিকদের কাছ থেকে নিয়োগপত্র নিতে হবে। বেপরোয়া গতি ও মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। তবে যানবাহন-সংক্রান্ত এ আইন থাকলেও তার প্রয়োগ চোখে পড়ে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি সম্পর্কিত আইনের প্রয়োগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। স্বভাবতই এসব দেশের মধ্যে দুর্ঘটনার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশেই।
মোটরযান অধ্যাদেশ প্রয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থার পরিচালক (রোড) সেফটি মাহবুব-ই-রব্বানি বণিক বার্তাকে বলেন, অবৈধ, ফিটনেসবিহীন ও আইন অমান্যকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে বিআরটিএ। অভিযান পরিচালনার প্রয়োজনীয় জনবল আমাদের নেই। তার পরও সীমিত জনবল দিয়ে আমরা গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করে যাচ্ছি।
রাজধানীর সড়কগুলোয় চোখ রাখলেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের সত্যতা মিলবে। ঢাকার যানবাহন চালকদের এক বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। শারীরিকভাবে গাড়ি চালানোয় সক্ষম নন, রয়েছেন এমন চালকও। পেশাদারভাবে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে নিয়োগপত্রের বালাই নেই অনেক ক্ষেত্রেই। নিয়োগপত্র থাকার আইনি বাধ্যবাধকতা সম্পর্কেও জানেন না অনেক চালক। ঢাকায় চলাচলরত হিমাচল, বিকল্প, স্বাধীনসহ কয়েকটি পরিবহনের চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মালিকপক্ষের কাছ থেকে কোনো নিয়োগপত্র পাননি। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে হিমাচল পরিবহনের স্বত্বাধিকারী সাইদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আইন থাকলেও তা অনেক সময় মানা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
সিংহভাগ দুর্ঘটনার জন্য চালকদের দায়ী করা হলেও চালকরা দুষছেন পুরো ব্যবস্থাপনাকে। গ্রিনলাইন পরিবহনের চালক মোফাজ্জল হোসেন বলেন, অনেক দুর্ঘটনা ঘটে রাস্তার কারণে। বাধ্য হয়ে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা হয়। ছোট যানবাহনগুলো আইন না মেনে রাস্তায় এলোমেলো চলাচল করে। তাদের বেপরোয়া চলাচলে দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তার ওপর হাটবাজার, রাস্তায় গাড়ি আছে কিনা— তা না দেখেই পারাপারের প্রবণতার কারণেও দুর্ঘটনা হয়। অথচ অ্যাক্সিডেন্ট হলে সব দায় চাপানো হয় আমাদের ওপর।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. শামছুল হক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিক্ষিপ্ত কিছু উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। বছরের কয়েক দিন অভিযান চালিয়ে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সেসব পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন।
- Courtesy: Banikbarta/ Apr 30, 2018
No comments:
Post a Comment