গণপরিবহনে যৌন নিগ্রহ
শনিবারের ঘটনা। বাড্ডা লিংক রোড থেকে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে উঠছিলেন উত্তরা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রী। গন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়টির উত্তরা ৬নং সেক্টরের ক্যাম্পাস।
বেলা ১টার দিকে বাসটি যখন নতুন বাজারে পৌঁছায় তখন যাত্রীদের বড় অংশ নেমে যায়। বাইরে অনেক যাত্রী থাকলেও বাসটিতে কোনো যাত্রী উঠাচ্ছিল না। এতে ওই ছাত্রীর মনে সন্দেহ হয়। তিনি বাস থেকে নামতে চাইলে বাস চালকের সহকারীরা তার পথ আগলে দাঁড়ায়।
বাসের কন্ডাক্টর তার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মেয়েটি চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। পরে ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে ঘটনাটি জানালে ছাত্ররা তুরাগ পরিবহনের বেশ কিছু বাস আটক করে। ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে ওই বাসের চালকসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
রাজধানীতে তুরাগ বাসে তরুণীকে যৌন হয়রানির প্রতিবাদে যখন উত্তরা ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা প্রতিবাদে মুখর ঠিক ওই সময়ই আরেকটি বাসে এক তরুণী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত চালকের সহকারী ও চালককে পুলিশ আটক করলেও অভিযোগকারী ছাত্রী মামলা না করায় পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তারা অবশ্য ওই ছাত্রীর কাছে ক্ষমা চায়। তবে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওই শ্রমিক দেশের আর কোনো বাসে কাজ করতে পারবে না। হয়রানির শিকার ওই তরুণী ফেসবুকে পুরো ঘটনা প্রকাশ করেছে। গত সোমবার ময়মনসিংহের শ্যামগঞ্জ থেকে জেলা সদরে ময়মনসিংহ কলেজে যাওয়ার পথে পিএইচ পরিবহনের একটি বাসে এই ঘটনা ঘটে। শুধু এ দুটিই নয়, গণপরিবহনে যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের একাধিক ঘটনা ঘটছে। আর এসব ঘটনায় বাড়ছে আতঙ্ক।
মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, রূপা হত্যা এবং ধর্ষণের বিচার হয়েছে। এটা হয়তো আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। কিন্তু তাতে গণপরিবহনে যৌন হয়রানি কমবে বলে মনে হয় না। আমরা এই ধরনের যৌন হয়রানির প্রচুর অভিযোগ পাই। আসলে অভিযোগ জানানোর বিষয়টি সহজ করতে হবে। কারণ, চলন্ত বাসের ঘটনা কোন থানা এলাকায় তা নিয়ে পুলিশের আইনি দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত অনেক ঘটনারই আর অভিযোগ হয় না। তাই এইসব ব্যাপারে তাৎক্ষণিক অভিযোগ নেয়ার কোনো একক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ ধর্ষণ
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পর্যালোচনা করে তৈরি করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গণপরিবহনের চালক-হেলপারসহ সহযোগীরা মিলে ৯টি গণধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় মোট ৫৫ আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। প্রতিটি ঘটনায় মামলা হলেও গত ৯ই এপ্রিল মানিকগঞ্জে সংগঠিত গণধর্ষণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। ২০১৭ সালের ২১শে জানুয়ারি রাজধানীর দারুসসালামে চলন্ত বাসে যৌন হয়রানির অভিযোগে গাবতলী-নবীনগর রুটের বাস চালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ওই ঘটনায় পুলিশ গাড়ির চালক ও তার সহকারীকে গ্রেপ্তার করে। ওই বছরের ১০ই ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় বাসে আটকে রেখে ১৩ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে চালকের সহকারীর বিরুদ্ধে। পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৩ই মার্চ ইজিবাইকে করে চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে আলমডাঙ্গায় ফিরছিল এক স্কুলছাত্রী। ভাড়া মেটাতে না পারার কারণে চালক তাকে ফাঁদে ফেলে আরো তিনজনসহ ধর্ষণ করে।
২০১৭ সালের ২৫শে এপ্রিল খিলগাঁওয়ে এক গৃহবধূকে মাইক্রোবাসে যৌন নির্যাতনের পর ওই মাইক্রোবাসে চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯শে এপ্রিল ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ট্রেনে বখাটেদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন এক নারী। ওই বছরের ২৭শে অক্টোবর চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে নগরীর বহদ্ধারহাটে যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে চালক ও তার সহকারীর বিরুদ্ধে। পরে তরুণী থানায় মামলা করলে পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। গত ২২শে জানুয়ারি কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে নদীয়ার রেল স্টেশনে বাংলাদেশি এক নারীযাত্রী শ্লীলতাহানির শিকার হন। এই বিষয়ে ওই নারীর স্বামী জিআরপির সংশ্লিষ্ট শাখায় অভিযোগ করেন। ওই বছরের ১০ই ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় বাসে আটকে রেখে ১৩ বছরের এক কিশোরী পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে বাসের হেলপার হাফিজুল ইসলাম। পরে পুলিশ অভিযুক্ত হেলপারকে আটক করে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করেছি। আর এইসব ঘটনায় পুলিশ সক্রিয় হয়েছে। অভিযোগ বা মামলাও করা হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, এটা প্রকৃত ঘটনা যা ঘটে তার চেয়ে অনেক কম। কারণ, সব ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয় না। আবার সবাই নানা কারণে পুলিশের কাছে অভিযোগও করে না। সমস্যা হচ্ছে, পরিবহনে কোনো নারী যৌন হয়রানির শিকার হলে তিনি কোথায় অভিযোগ করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। এজন্য মোবাইলকোর্টকে আরো সক্রিয় করা উচিত।
রূপা ধর্ষণ-হত্যার দ্রুত বিচার: গত বছর ২৫শে আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে ছোঁয়া পরিবহনের একটি বাসে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় গত ১২ই জানুয়ারি টাঙ্গাইলের একটি আদালত চার জনের মৃত্যুদণ্ড এবং এক জনের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। ময়মনসিংহের একটি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতেন রূপা, পাশাপাশি পড়তেন একটি ল’ কলেজে। বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে গত বছরের ২৫শে আগস্ট বাসে ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন তিনি। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় মধুপুর এলাকার জঙ্গলে। পরিচয় না পেয়ে প্রথমে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবেই দাফন করা হলেও খবরটি ছড়িয়ে পড়ে গণমাধ্যমে। দু’দিন পর মধুপুর থানায় গিয়ে ছবি দেখে নিজের বোনকে শনাক্ত করেছিলেন রূপার ভাই হাফিজুল ইসলাম প্রামানিক। রূপা ধর্ষণ এবং হত্যা মামলায় মাত্র ছয় মাসের মধ্যে যেভাবে আসামিদের বিচার শেষ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশে খুব বিরল। যে চলন্ত বাসে এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সেটি নৃশংসতার শিকার তরুণীর পরিবারকে দিতে বলেছেন বিচারক। ঘটনার পরপরই বাসটির চালক হেলপারসহ ৫ জনকে আটক করে মামলা করে পুলিশ। এরপর গত ২৯শে নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আদালতে। ঘটনার ১৭৩ দিনের মধ্যে এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করেন আদালত।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নিপীড়নের বিবরণনিজের সঙ্গে
ঘটে যাওয়া বর্বর ঘটনার বর্ণনা দিতে অনেক নারীই আশ্রয় নিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। ময়মনসিংহের ওই মেয়েটি যেমন ফেসবুকে লিখেছেন, আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি যেখানে একটা মেয়েকে সেক্সুয়ালি হ্যারেজ করছে সেটা দেখেও মানুষ চুপ থাকে, জাস্ট চুপ। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের মা, বোন, মেয়ের সঙ্গে এইসব না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এরা চুপ থাকবে। মানুষ কতটা অমানুষ হলে এমনটা হয় যেখানে চলন্ত বাসে বাসের হেল্পার একটা মেয়েকে মলেস্ট করে, মেয়েটা চিৎকার করে বাস ভর্তি সবাইকে বলছে এই লোকটা আমার গায়ে হাত দিছে, অথচ কেউ কিচ্ছু বললো না। কেউ কোনো প্রতিবাদও করলো না। উল্টো মেয়েটাকেই থেমে থাকতে বলে। হ্যাঁ এই মেয়েটা আমি, আজ সকালে শ্যামগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে বাসে এই ঘটনাকে আমার সঙ্গেই ঘটেছে। এই ঘটনাই আমি হতবম্ব হয়ে গেছিলাম। এতটা অবাক আমি খুব কমই হয়েছি। আমার নিজেকে এত ছোট, এত অসহায় আর কখনো লাগেনি। মনে হচ্ছিল প্রতিবাদ করে আমি অন্যায় করছি, পাপ করছি।
গত ১৬ই এপ্রিল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেন, আব্দুল্লাহপুর থেকে রামপুরা আসার জন্য বাসে উঠেছিলাম ৬.৩০ এ। বাসে দুজন কন্ডাক্টরের একজন মনে হয় ড্রিংক করেছিল। অনেক ভিড় ছিল, তবে রামপুরা আসতে আসতে প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। পিছনের দিকে কয়েকজন ছেলে বসেছিল আর সামনের দিকে আমি আর আম্মু। বাসের লাইটগুলো বনশ্রীতে এসে বন্ধ করে দেয় ড্রাইভার। কারণ হিসেবে বলেন, হেডলাইট নষ্ট এজন্য বন্ধ করেছে লাইট। আগামীকাল সকালে পরীক্ষা, হাতে একদম সময় নেই বলে কেউ এটা নিয়ে ঝামেলা করিনি।
রামপুরায় পৌঁছে গেলে বাস জ্যামে পড়ে আর আমরা নামার জন্য দরজার দিকে যেতে থাকি। আম্মু প্রথমে নামে। আমি দরজা পর্যন্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন আমার হাত চেপে ধরে, আম্মু ততক্ষণে নেমে গিয়েছে। আমি নামার চেষ্টা করি। কিন্তু বাস সামনের দিকে যেতে থাকে আর পিছনে কয়েকজন বলছিল, ‘মাইয়াটারে ধর’।
কী করব বোঝার মতো সময় ছিল না। অন্য হাতে একটা স্টিলের টিফিন বক্স ছিল ঐটা দিয়ে লোকটাকে বারি মারলাম। কতটা লেগেছিল জানি না। কিন্তু আমাকে ধরে রাখা হাতটার শক্তি কমে গেল। ধাক্কা দিলাম লোকটাকে, বাস থেকে লাফ দিলাম। আমার ভাগ্য ভালো ছিল যে, বাস আস্তে যাচ্ছিল আর মধুবনের সামনে জ্যাম ছিল। নেমে পিছনে দৌড় দিলাম। দূর থেকে আম্মুকে দেখতে পেলাম, আমাকেই খুঁজছে। জানতাম যে, রাস্তায় একা বের হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তবে আজকে জানলাম মায়ের সঙ্গে বের হয়েও আমি নিরাপদ না। কালকের খবরের কাগজে আমিও হয়তো একটা কলাম হয়ে যেতাম। আমার রক্ত মাংসের শরীরটার জন্য। কিছু জানোয়ারের জন্য। যে দেশে একটা মেয়ে তার মায়ের সঙ্গেও সুরক্ষিত নয়, সেই দেশ আর যাই হোক স্বাধীন নয়।
- কার্টেসি — মানবজমিন/ শনিবার, এপ্রিল ২৮।
No comments:
Post a Comment