আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি
গত ৭ মার্চ রাজধানীর দারুস সালাম থানার বসুপাড়ার খাল থেকে এক নারীর বস্তাবন্দি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার বয়স আনুমানিক ২২ বছর। দেড় মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ওই নারীর পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
দারুস সালাম থানার ওসি সেলিমুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘ওই নারীকে হত্যার পর লাশ বস্তাবন্দি করে খালে ফেলে দেয়া হয়। লাশ গুম করতেই খুনিরা এই পথ বেছে নেয়। লাশ অর্ধগলিত হওয়ায় চেহারা দেখে তাকে চেনা যায়নি। তার পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এই খুন সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারছি না।’
রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার তুরাগ নদী থেকে পুলিশ ২০ মার্চ ভাসমান অবস্থায় অর্ধগলিত অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে। যুবকের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। তার বয়স আনুমানিক ২৫ বছর।
আশুলিয়া থানার ওসি আবদুল আউয়াল যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিচয় না পাওয়ায় যুবক হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারিনি। পরিচয় শনাক্ত করতে বিভিন্ন থানায় ছবি পাঠিয়েছি। তার আঙুলের ছাপ নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছি। এখনো প্রতিবেদন পাইনি।’
গত ১৫ এপ্রিল কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বস্তাবন্দি এক যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার বয়স আনুমানিক ৩২ বছর। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত করছেন এসআই বিজন কুমার দাস। তিনি জানান, লাশটি ছিল অর্ধগলিত। চেহারা চেনা যায় না। আশপাশের থানাগুলোতে ছবি পাঠানো হয়েছে। ম্যানুয়ালি তদন্ত করা হচ্ছে। পরিচয় না পাওয়ায় হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
শুধু এই তিনটি ঘটনাই নয়, রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকা থেকে প্রায়ই অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে অধিকাংশই খুনের শিকার। হত্যার পর লাশ গুম করতে খুনিরা লাশ নদী ও জলাশয়ে ফেলে দেয়। কখনো আবার মহাসড়কের পাশে নির্জন স্থানে লাশ ফেলে রাখে।
চার বছরের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, প্রতি মাসে গড়ে তারা ১০৩ ব্যক্তির বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে। বছরে গড়ে সংস্থাটি এক হাজার ২৩৪ লাশ দাফন করে। চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রথম আট মাসে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ৭৮০ বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে সংস্থাটি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে (১২ মাসে) এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৩০০। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৩৫৭ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক হাজার ৩৩৩ বেওয়ারিশ লাশ সংস্থাটি দাফন করে। এসব লাশের অধিকাংশের বয়সই ১৬ থেকে ৪৭ এর মধ্যে।
এ বিষয়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের নির্বাহী পরিচালক ইলিয়াস আহমেদ বলেন, ‘যেসব লাশের কোনো ওয়ারিশ থাকে না আমরা সেসব লাশ দাফন করি। প্রতি বছরই বিপুলসংখ্যক বেওয়ারিশ লাশ এই সংস্থার মাধ্যমে দাফন করা হয়।’
পুলিশ বলছে, অপরাধীরা রাজধানীর উপকণ্ঠের জলাশয়, মহাসড়কের পাশে নির্জন স্থানকে লাশ গুমের ‘ডাম্পিং জোন’ মনে করে। অন্য কোথাও খুন করে তারা এই জোনে লাশ ফেলে যায়। কয়েক দিনের মধ্যে লাশ পচে গলে যায়। এতে করে লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে খুনের রহস্য উন্মোচন হয় না। পরিচয় না থাকায় তদন্তে অনেক বেগ পেতে হয়। এ কারণে এসব ঘটনা তদন্তে পুলিশের তেমন আগ্রহ নেই। অজ্ঞাত লাশের অনেকেই আবার দুর্ঘটনার শিকার। লাশগুলো বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীর কোলঘেঁষা বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, তুরাগ, বালু নদী, শীতলক্ষ্যা নদীসহ বিভিন্ন জলাশয়। এর বাইরে রূপগঞ্জের পূর্বাচল উপশহর, ডেমরা, মিরপুর বেড়িবাঁধ, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর রেললাইনের দু’পাশ, শ্যামপুরের ওয়াসা পুকুর পাড়, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ, কাঞ্চন-কুড়িল ৩০০ ফুট সড়কের পাশ থেকে প্রায়ই অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। পচে গন্ধ বের না হলে এসব লাশ কারও নজরে আসে না। এসব লাশের মধ্যে কোনোটি গুলিবিদ্ধ. কোনোটিতে ধারালো অস্ত্রের চিহ্ন, কোনোটি বস্তাবন্দি, কোনোটির হাত-পা বাঁধা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শরীরের জখমের চিহ্ন থাকে। হত্যার পর লাশ গুম করতে এবং আলামত নষ্ট করতে এ কৌশল নেয় খুনিরা।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা নিজেরা নিরাপদ থাকতে খুন করে নির্জন এলাকায় লাশ ফেলে দেয়। আবার কখনও নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আগে রাজধানীর আশপাশে অনেক অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যেত। এখন সেটা কমে গেছে। এখন অধিকাংশ ঘটনার রহস্য আমরা উদ্ঘাটন করতে পারছি।’
তদন্তে আগ্রহ নেই পুলিশের : পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো ব্যক্তি খুনের শিকার হলে তার পরিচয় জানাটা জরুরি। পরিচয় জানা না গেলে খুনের রহস্য উন্মোচন করা প্রায় অসম্ভব। এসব লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তার পরও রহস্য উদঘাটনের নিশ্চয়তা থাকে না। এ কারণে কয়েক দিন যাওয়ার পর এসব মামলার তদন্তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
পাঁচ বছর আগে ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টলা ট্রেন থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সন্দেহ হলে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য লাশ পাঠায় পুলিশ। ভিসেরা রিপোর্টে দেখা যায়, শ্বাসরোধে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করে। এর আগে এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছিল। পাঁচ বছর আগের এই হত্যা মামলার রহস্য এখনও উদ্ঘাটন হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াসিন ফারুক তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিচয় না থাকার কারণে অনেক সময় ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না। এই ঘটনাটি আমি থানায় যোগদান করার অনেক আগের। এ বিষয়ে আগের কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’
- কার্টেসি — যুগান্তর/ বুধবার, এপ্রিল ২৫, ২০১৮।
No comments:
Post a Comment