আলী ইমাম মজুমদার
দৈনিক প্রথম আলোয় মুনির হাসান তারুণ্যের ইশতেহারে একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘প্রথম আলোর “তরুণেরা কী ভাবছে” শীর্ষক জরিপ জানাচ্ছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ৮২ শতাংশ তরুণ। আর ৬৩ শতাংশ জানেই না জীবনের লক্ষ্য কী। নিরুত্তাপ, হতাশার আবর্তে মনে হয় ঘুরপাক খাচ্ছে। জানতে চাইলে বলে, আমাদের কথা কেউ ভাবে না। আমরা কোথায় যাব?’ জরিপটি অতি সত্যি কথা সহজভাবে নিয়ে এসেছে। মুনির হাসান তরুণদের পথ ঘোরাতে বলেছেন নিজের পথে। অত্যন্ত যৌক্তিক। তবে এই সমাজে তারুণ্য অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত এবং এর প্রমাণও রয়েছে ভূরি ভূরি। এমনকি সেই তরুণদের মধ্যে বড় ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যাঁরা সাফল্যের শীর্ষে রয়েছেন, তাঁরাও অনেক সময় উপেক্ষিত।
৩৬তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হয় ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট। ২ লাখের অধিক তরুণ আবেদন করেছিলেন। টানা ২৬ মাস সময় নিয়ে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ২ হাজার ৩২৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সেই সুপারিশ পাঠানো হয় ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর। সুপারিশপ্রাপ্তদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বভাবচরিত্র যাচাই করতে হবে। এগুলো সম্ভব দুই মাসে। তবে প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে চললেও শেষ হয়নি অদ্যাবধি। ধারণা করা হয়, মাস দুয়েকের মধ্যে তাঁরা কাজে যোগ দিতে পারলেও কপাল ভালো। এমনিতে হাল ঠিকানায় নথিটির অবস্থান প্রায় ছয় মাস। আরও দুই মাস পর যদি নিয়োগও হয়, তবে বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে চাকরি পেতে তাঁদের সময় যাবে ৩৪ মাস। অথচ চাকরিপ্রার্থীরা ইতিমধ্যেই তারুণ্যের একটি মূল্যবান সময় হারিয়ে ফেলেছেন। আর এর কোনোটার দায় তাঁদের নয়। তাহলে তাঁদের নিয়ে কেউ ভাবে না-এ অভিমানী উক্তিকে কি বাড়াবাড়ি বলা যাবে?
বিসিএসে আবেদন করার বয়সসীমা ২১ থেকে ৩০। প্রাধিকার কোটাধারীদের জন্য দুই বছর বেশি। আর সে বয়সসীমা ধার্য করা হয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি যে মাসে প্রকাশিত হয়, তার প্রথম দিনটি ধরে। এ ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট। সেদিন যাঁদের বয়স ৩০ ছিল, চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় তা হবে ৩৩। তাহলে চাকরি করবেন ২৬ বছর। সাধারণত ৩২ থেকে ৩৫ বছর করার কথা। এমনকি ২৩ বছর বয়সেও যদি কেউ থাকেন (এখন যা বিরল), তাহলে নিয়োগ পাবেন ২৬ পাড়ি দিয়ে। চাকরি করবেন ৩৩ বছর। আর নিয়োগপ্রক্রিয়াটাও যদি ভারত ও পাকিস্তানের মতো বছরেরটি সে বছরেই শেষ হতো, তাহলে আরও দুই বছর চাকরি করতেন। তারুণ্যের সময়টা আমরা নস্যাৎ করে দিচ্ছি অনেক অনেক প্রক্রিয়ায়। সর্বত্র না থাকলেও সেশনজটের অভিযোগ আছে কিছু উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাই কারও কারও পড়ালেখার পর্ব শেষ হয় না ২৫-২৬ বছরের আগে। অথচ একসময় তা ২১ থেকে ২৩ বছরে শেষ হয়ে যেত। চাকরিতে, বিশেষত উচ্চতর সিভিল সার্ভিসে আসতেন ২৩ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তারুণ্যের সেরা সময় রাষ্ট্রকে তাঁরা দিতেন। আর এখন আসেন কার্যত সে সময়ের অনেকটা পাড়ি দিয়ে।
সহজ কাজগুলো সহজে হয় না কেন, এটা অনেকে বুঝতে অক্ষম। আমরা রীতি ও পদ্ধতিকে ক্রমান্বয়ে জটিল থেকে জটিলতর করছি। ব্রিটিশ ভারতে আইসিএসে নিয়োগ হতো স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। সে ধারাই গত কয়েক বছরের আগপর্যন্ত চলছিল। এরপর যুক্ত করা হয় অন্যান্য সংস্থা। এখন পুলিশ ও জেলা প্রশাসকেরা এগুলো যাচাই করছেন। দুটোই যুগপৎ চলতে পারে। আর প্রার্থীরা বিভিন্ন জেলা বা মহানগরীর বলে সময় খুব একটা লাগার কথা নয়। তা ছাড়া এই অনুসন্ধান-প্রক্রিয়ায় প্রার্থীদের কিছু করণীয় নেই বিধায় দ্রুতই হতে পারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা। অনুসন্ধান প্রতিবেদনগুলো যাচাই করে নিয়োগ প্রদানের জন্য নথি তৈরিতেও দীর্ঘ সময় নেওয়ার কথা নয়।
অন্যদিকে জানা যাচ্ছে, প্রার্থীদের স্বভাবচরিত্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিচয়ও বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের বিবেচনায় পিএসসির সুপারিশ পেয়ে গত কয়েকটি বিসিএসে কিছু প্রার্থী চাকরি পাননি। অথচ সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম বা ফৌজদারি অপরাধের সংশ্লিষ্টতা থাকলেই তাঁকে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা যায়। তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন কোন দল-মতের লোক, এ দায় প্রার্থীর ওপর বর্তায় না। সরকারবিরোধী ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকেও প্রার্থীরা পাকিস্তান সময়কালে উচ্চতর সিভিল সার্ভিসে চাকরি পেয়েছেন। বাংলাদেশে পেয়েছেন সিকি শতাব্দী আগেও। এ বিষয়টি কর্তৃপক্ষ সহৃদয়তার সঙ্গে দেখবে, এরূপ প্রত্যাশা রইল। এখানে উল্লেখ্য, সময়ক্ষেপণ যাতে না হয়, তার জন্য ভারত পুলিশি তদন্ত অপেক্ষমাণ রেখেই উচ্চতর সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ দিচ্ছে। বিরূপ কোনো প্রতিবেদন এলে তাঁকে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তা আসে কালেভদ্রে।
তারুণ্যকে কাজে লাগানোর আবশ্যকতা সবারই জানা। মানুষের জীবনের প্রতিটি দিন দ্রুত সামনের দিকে এগোতে থাকে। একপর্যায়ে তারুণ্যের ছোঁয়ায় সে টগবগ করে। আর সেই তারুণ্য পেছনে যেতে খুব সময় নেয়, এমনও নয়। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকৃতির এ নিয়মকে উপেক্ষা করা যায় না। বিসিএসে গোটা দুই ক্যাডারে (পুলিশ ও আনসার) দৈহিক সামর্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শুরুর দিনগুলোতে এ গুরুত্ব অধিক। তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমিতে ২৩ আর ৩৩ বছরের তরুণের পারদর্শিতা এক রকম হওয়ার কথা নয়। এ নিয়ে আমরা কিছুটা বয়সী তরুণদের দোষ দিতে পারি না। যে ব্যবস্থা তাঁকে এর আগে চাকরি দিল না, সেই দায়ভার যাবে যাঁরা এ ব্যবস্থা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের ওপর।
এ ছাড়া মানুষের শেখারও একটা বয়স আছে। বিসিএসে যাঁরা চাকরি পান, তাঁদের মধ্যে কম বয়সীরা দ্রুত ধরে নিতে পারেন নিয়মনীতি। বয়স কিছুটা কাছাকাছি হলে নিজেদের একই পরিবারের সদস্য বলে বিবেচনায় নেন। থাকে সহমর্মিতা, প্রেরণা, উদ্দীপনা ও পেশার প্রতি সম্মানবোধ। আমরা বহু ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এনেছি। তাহলে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এটা পারছি না কেন-তা দুর্বোধ্যই ঠেকছে। কেন একটি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা এত সময় নেবে আর কেনই-বা সেই পরীক্ষায় সফলঘোষিত ব্যক্তিরা মাসের পর মাস নিয়োগপত্রের অপেক্ষায় থাকবেন?
তারুণ্যের ইশতেহারেই মুনির হাসান লিখেছেন, ‘দেশের ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট চাকরি পাচ্ছে না।’ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যানুসারে দেশে বেকার ২৭ লাখের মতো। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত বিভিন্ন স্থানে বহু পদ শূন্য রয়েছে বলে জানা যায়। সরকার আমাদের দেশে এখনো একক বৃহত্তম চাকরিদাতা। এই সরকারি চাকরিগুলোর শূন্যপদ পূরণ একটি দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান প্রণীত হয়েছে নয় মাসে। আর আমরা বিসিএস পরীক্ষাকে একটি সময়াবদ্ধ সীমায় আনতে পারছি না স্বাধীনতার পর থেকে। কয়েকটি বিশেষ বিসিএস ব্যতীত সব কটিতেই বড় রকম সময় চলে যায়। একটি তো পাঁচটি বছর নিয়েছে। দেশের যে ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট চাকরি পাচ্ছেন না বলে দাবি করা হয়, ৩৬তম বিসিএসে পিএসসির সুপারিশকৃত ২ হাজার ৩২৩ জন তাঁদেরই অংশ। আইএলওর ২৭ লাখের হিসাবেও তাঁদের থাকার কথা। ২৬ মাসে হলেও তাঁরা তাঁদের উপযুক্ততা প্রমাণ করেছেন। আরও কিছু পদ্ধতিগত কার্যক্রমের অপেক্ষায় কেটে গেছে ছয় মাস। তাঁদের তারুণ্যের মূল্যবান সময় যেটা গেল, সেটা দেশ আর পাবে না। তবে আগামী দিন থেকে এমন ব্যবস্থাটি পরিবর্তনের একটি প্রত্যয়ী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। সময়ের প্রেক্ষাপটে এটা খুবই যৌক্তিক প্রত্যাশা।
- আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
- Courtesy: Prothom Alo/ Apr 09, 2018
No comments:
Post a Comment