Search

Saturday, April 28, 2018

‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’- সংযোগ পেতে টাকাই সব


  • বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি
  • কোনো রকম টাকাপয়সা ছাড়াই বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়ার কথা।
  • ঘুষ ছাড়া সংযোগ পেয়েছেন কম গ্রাহকই, এঁরা সবাই সরকারি দলেরই লোক।

সরকারের পরিকল্পনা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’। অর্থাৎ সবার জন্য বিদ্যুৎ। বাস্তবে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক রেষারেষিতে এই কর্মসূচি কলুষিত হয়ে পড়েছে। এলাকাভেদে কলুষিত করেছেন সরকারি দলের নেতা-কর্মী, বিদ্যুৎ কর্মী ও ঠিকাদারেরা।


কোনো রকম টাকাপয়সা ছাড়াই যে সরকার বিদ্যুৎ-সংযোগ দিচ্ছে, গ্রাহকেরা তা বুঝতেই পারছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার পোস্টার, লিফলেট, স্টিকার ছাপিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে। মাইকিং করে গ্রাহকদের বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ লাইন কিংবা সংযোগের জন্য কাউকে টাকা না দিতে। কিন্তু টাকা ছাড়া সংযোগ পেয়েছেন কম গ্রাহকই।

মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে গ্রাহকের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানা গেছে। কোনো এলাকা বিদ্যুতায়নের প্রকল্পভুক্ত হলেই ওই এলাকায় সরকারি দলের নানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ‘বিদ্যুৎ আসবে, টাকা দিতে হবে’ বলে নেমে পড়েন। এরপর টাকা আদায় চলে দফায় দফায়। কোনো গ্রাহক টাকা না দিলে তাঁর সংযোগ স্থগিত রাখা হয়। আবার কোনো এলাকা সরকারি দলের প্রভাবাধীন না হলে সেখানে সংযোগ দিতে গড়িমসি করা হয়। সরকারি দলের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণেও সংযোগ পেতে সমস্যা হয়। এমনকি বিদ্যুতের লাইন নির্মাণ, গ্রাহকের ঘরে ঘরে মিটার স্থাপন হওয়ার পরও চাহিদা অনুযায়ী সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ না করায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘটনাও ঘটছে।

ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ কর্মসূচির প্রধান বাস্তবায়নকারী হচ্ছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। জানতে চাইলে বিআরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মইন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, যেসব অভিযোগের সঙ্গে তাঁদের সংস্থার লোক জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে চাকরি থেকে বরখাস্তসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিষয়ে সময়-সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়।

সংযোগ পেতে টাকাই সব

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিয়ে বিদ্যুৎ-সংযোগ পেয়েছেন কম গ্রাহকই। পাটধারী, জগজীবনপুর, চৌবিলা, দহপাড়া, মধুখোলা, শরিফ সলঙ্গা, কৃষ্ণপুর, কালীগঞ্জ, হাটদেলুয়াসহ প্রায় ২০টি গ্রাম বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে না। কারণ এসব গ্রামের গ্রাহকেরা এখনো সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করেননি।


ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি সংযোগের জন্য তাঁদের ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রাম হিসেবে চুক্তি হয়েছে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। বিদ্যুৎ সরবরাহ উদ্বোধনের আগে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ না করলে কোনো গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়নি।

সলপ ইউনিয়নের বেতকান্দি গ্রামে গত কোরবানির ঈদের সময় বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। এই গ্রামে সংযোগ দেওয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। দর-কষাকষির একপর্যায়ে ১৭ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। কিছু টাকা অগ্রিম দেওয়ার পর লাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার পর বাকি টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। কিন্তু তা করা না হলে বেতকান্দি গ্রাম বাদ রেখে উল্লাপাড়ার রাজমান এলাকার ১৫টি গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হয়।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সংযোগ বন্ধ

চাঁদপুরের কচুয়ায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে প্রায় ৪০০ গ্রাহক বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। তাঁদের লাইন নির্মাণ হয়েছে অনেক আগে। ঘরে ঘরে মিটারও লাগানো হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হচ্ছে না।

চাঁদপুর জেলা পরিষদের সদস্য বলেন, তাঁর বাড়ি কচুয়া উত্তর ইউনিয়নের তুলপাই গ্রামে। গ্রামের মানুষকে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য ছয় মাস আগে দেড় কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ১২০ জন গ্রাহকের মিটার লাগানো হয়েছে। কিন্তু তিনিসহ গ্রামের লোকজন গোলাম হোসেনের সমর্থক হওয়ায় তাঁদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে না।

জানতে চাইলে, চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর অধীন কচুয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তাঁরা পর্যায়ক্রমে সব লাইন চালু করার চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক কারণে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার প্রসঙ্গটি তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান।

বরগুনা জেলার পাথরঘাটার একটি গ্রাম থেকে ভুক্তভোগীরা জানান, তাঁরা অনেক দিন চেষ্টা করেছেন টাকা না দিয়ে বিদ্যুৎ-সংযোগ পাওয়ার। কিন্তু একপর্যায়ে ঠিকাদারের লোকেরা কিছু টাকা আদায় করেই ছাড়েন। এরপর লাইন নির্মাণ ও গ্রাহকের বাড়িতে ওয়্যারিং সম্পন্ন হয়ে আছে। কিন্তু মিটার দেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যুৎ সরবরাহ তো আরও অনেক পরের কথা।

বিআরইবির সূত্র জানায়, দেশের সর্বত্রই প্রায় একই অবস্থা। অনেক স্থানে গ্রাহকেরা টাকা দিয়েও ভয়ে প্রকাশ করেন না, পাছে বিদ্যুৎ না পান। অনেক এলাকার গ্রাহক রাজনীতিকদের কাছে ধরনা দেন বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করার জন্য। কয়েকটি এলাকার গ্রাহকেরা বলেছেন, দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য যে প্রশংসা সরকারের প্রাপ্য, তা চাঁদাবাজি-দুর্নীতির কারণে পাচ্ছে না। অথচ চাঁদাবাজেরা সরকারি দলেরই লোক।

  • প্রথম আলো /এপ্রিল ২৮,২০১৮

No comments:

Post a Comment