Search

Friday, April 13, 2018

সেই রাতের ঘটনা কারা ঘটিয়েছিল?



সোহরাব হাসান


গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আরেকটি ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ তৈরি হয়েছিল। সকাল ১০টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের দিকে আসছিলেন। শাহবাগ মোড়ে দাঁড়াতেই দেখি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাফেলা। যেকোনো ছাত্রসংগঠনের মিছিলে সামনে কয়েকজন ছাত্রী থাকেন, বাকি সবাই ছাত্র। কিন্তু এই মিছিলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সমান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব পাশের সড়ক দিয়ে আসা মিছিলটি শাহবাগ মোড় ঘুরে দক্ষিণ দিকে রাজু ভাস্কর্য অভিমুখে যাচ্ছে। মিছিলকারীদের কারও হাতে ফেস্টুন, কারও মুখে স্লোগান, ‘কোটা প্রথার সংস্কার চাই’। কোনো হট্টগোল নেই।

ওদিকে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর হেলমেটধারী সদস্যরাও ছিলেন শান্ত, ধীরস্থির। কেউ মিছিলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। মিছিলের পুরোভাগে যাঁরা, সজাগ ছিলেন কোনো অঘটন যেন না ঘটে। এরই মধ্যে মিছিল থেকে একজন পানির একটি খালি বোতল ছুড়ে মারলেন পুলিশের দিকে। নেতারা সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিলেন।

নব্বইয়ের পর এত বড় মিছিল ঢাকা শহরে আর দেখা যায়নি।

সঙ্গে থাকা একজন সাংবাদিক বন্ধু, যিনি নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন কভার করেছেন, বললেন, নব্বইয়ের পর এত বড় মিছিল ঢাকা শহরে আর দেখা যায়নি। তখনো মিছিল আসছিল। সবার গন্তব্য রাজু ভাস্কর্য। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী একজনকে জিজ্ঞেস করি, শহরের আর কোথায় কোথায় সমাবেশ হচ্ছে? তিনি বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এখানে এসেছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আলাদা সমাবেশ করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নিজ নিজ ক্যাম্পাসে ও পাশের সড়কে মিছিল-সমাবেশ করছেন। আমরা যখন কারওয়ান বাজার পার হচ্ছিলাম, দেখি পান্থপথে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল করছিলেন। আসলে গতকাল সত্যিকারভাবেই ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কষ্টেরও।

রাজু ভাস্কর্যের চারদিকে ঘিরে বলতে গেলে মহাসমাবেশ। সাংবাদিকদের ব্যস্ততা, টিভি ক্যামেরার ছোটাছুটি। অস্থায়ী মঞ্চ থেকে নেতারা কী বলছেন, শোরগোলে সবটা বোঝা গেল না। তবে যেটুকু শুনলাম, কোটা সংস্কারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। তখনো শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে মুহুর্মুহু স্লোগান, ‘সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। তাঁরা একজন মন্ত্রীর নাম ধরেও স্লোগান দিচ্ছিলেন।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-রোষ
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জ ছিল অনেকটা সরগরম। সবার মুখে কোটা আন্দোলনের প্রসঙ্গ। কেউ কেউ আবার সরকারের লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন। নীল দলের সমর্থক একজন শিক্ষক বললেন, ‘বুঝতে পারছি না সরকার কেন ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানছে না। তারা তো সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলন করছে না।’ অপর একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, যিনি একসময় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, খেদের সঙ্গে বলেন, ‘এই যে বাইরে বিপুল জনস্রোত দেখছেন, শত শত শিক্ষার্থী হল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, এটি শুধু কোটা সংস্কারের জন্য নয়; দীর্ঘদিন ধরে তাদের ভেতরে যে চাপা ক্ষোভ ছিল, এই আন্দোলনে তারই বিস্ফোরণ ঘটেছে।’ তিনি আরও বলেন, প্রতিটি হলে প্রায় প্রতিদিন ছাত্রলীগের মিছিল হয়। আর সেই মিছিলে বাধ্যতামূলকভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যোগ দিতে হয়। মিছিলে না গেলে কেউ হলে থাকতে পারে না।


তাঁর কথায় আগের রাতে কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা মনে পড়ল। সেখানে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ‘অপরাধে’ তিন শিক্ষার্থীকে মারধর করেন হল ছাত্রলীগের নেত্রী ইফফাত জাহান। এতে আরেক শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে জানালার কাচে তাঁর পা কেটে যায়। এতে হলের শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হন। পরে ইফফাতকে হল ও ছাত্রলীগের পদ থেকে বহিষ্কার করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। হলের সাধারণ ছাত্রীদের দাবি, তাঁকে শুধু বহিষ্কার করলে চলবে না, বিচারও করতে হবে।

সেই রাতের ঘটনা কারা ঘটিয়েছিল?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্দোলনের পাশাপাশি গতকাল সরগরম আলোচনা ছিল উপাচার্যের বাসভবনে হামলার বিষয়টি। আগের দিন শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল টেলিফোনে সাংবাদিকদের ঘটনাস্থল সরেজমিন দেখার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমরা সেখানে গিয়ে দেখি, উপাচার্যের বাসভবনের কয়েকজন কর্মী ছাড়া কেউ নেই। শিক্ষকেরা এসে চলে গেছেন। তাঁদের জরুরি বৈঠক ছিল। টিভির খবরে দেখলাম, শিক্ষক সমিতি কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়েছে, সংহতি জানিয়েছেন উপাচার্য আখতারুজ্জামানও। কিন্তু তাঁরা কাজটি আগে করলে অনেক অঘটনই এড়ানো যেত।

সেদিন রাতে উপাচার্যের বাসায় কারা হামলা করেছে, এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আন্দোলনকারীদের ব্যবহার করে থাকতে পারে। বিএনপি বলেছে, আন্দোলন ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য ‘সরকারের এজেন্টরা’ এই কাজ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, উপাচার্যের ভবনে যারা হামলা করেছে, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ফেসবুকে যারা ওই রাতে একজন ছাত্র নিহত হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেছেন, সেদিন রাতে পুলিশ বিনা উসকানিতে নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে শতাধিক শিক্ষার্থীকে আহত ও রক্তাক্ত করলে তাঁরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। এরই মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে একজন শিক্ষার্থী মারা গেছেন। এরপর শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্ষোভের কথা জানাতে উপাচার্যের বাসভবনে গিয়েছিলেন, এ কথা ঠিক। কিন্তু সেখানে মুখে কাপড় পরে যারা তাণ্ডব চালিয়েছে, তাদের তাঁরা চেনেন না। আন্দোলনেও তারা ছিল না। উপাচার্যের বাসভবনে দায়িত্ব পালনকারী একজন কর্মী জানান, হামলার সময় ভেতরে দুজন কর্মী, তিনজন প্রহরী ও বাইরে পাঁচজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল হাজারের বেশি। এই ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ঘটনার পরপর আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এগিয়ে এলেও কেন পুলিশকে খবর দেওয়া হলো না?

আন্দোলনকারীরা বলেছেন, উপাচার্যের বাসভবনে যারা হামলা করেছে, সরকার তাদের ধরুক। কিন্তু নিরীহ ও নিরপরাধ শিক্ষার্থীরা যেন নিগৃহীত না হন। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে গেলেও আন্দোলনকারীদের মনে ভয় আছে। কয়েকজন আমাকে বললেন, ‘ভাই, আমাদের কথা লিখুন, তবে নাম প্রকাশ করবেন না। বিপদ হবে।’

নীল ও সাদা দলের বাইরের একজন শিক্ষক বললেন, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে যতবার সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিগৃহীত হয়েছেন, প্রশাসনের কাছে প্রতিকার চেয়েও তাঁরা পাননি। ফলে প্রশাসনের প্রতি তাঁদের ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতি
এ কলাম লেখা পর্যন্ত কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘তারা চায় না, তাহলে দরকার কী? কোটা পদ্ধতিরই দরকার নাই।’ তাঁর এ বক্তব্যের পর আজ সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে ধারণা করি।

আন্দোলনকারীরাও বলেছেন, আজ সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমরা চাই অবিলম্বে বিষয়টির সুরাহা হোক।


  • সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি  (sohrabhassan55@gmail.com)


  • কার্টেসি — প্রথম আলো/ এপ্রিল ১২, ২০১৮। 


No comments:

Post a Comment