বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক বলে পরিচিত ইসলামী ব্যাংকের পরিস্থিতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। নগদ টাকার সংকটে পড়ে ব্যাংকটি গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
কর্মকর্তারা বলেছেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, কোনও শাখাই আগের মতো নিজেদের পছন্দের গ্রাহককে ঋণ (বিনিয়োগ) দিতে পারছে না। শুধু তাই নয়, অর্থ ছাড়ের (ডিসবাসমেন্ট) ক্ষেত্রে শাখার কর্মকর্তাদের অথরাইজ করার ক্ষমতাও বাতিল করা হয়েছে। ফলে দেশের কোনও জায়গা থেকে কোনও ধরনের ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকের শাখাগুলো।
এপ্রসঙ্গে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অর্থ ছাড় করার ক্ষেত্রে আগে শাখার ম্যানেজারে বা তার নিচের কর্মকর্তারা অথরাইজ করতো। এখন আর তারা অথরাইজ করতে পারছেন না। অর্থ ছাড় বা ডিসবাসমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাংকের সার্ভারে থাকা শাখার কর্মকর্তাদের নাম ব্লক করে দেওয়া হয়েছে।প্রধান কার্যালয় থেকে এই সার্ভার এখন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘সার্ভারে শাখার অথরাইজ কর্মকর্তার ক্ষমতা এখন প্রধান কার্যালয়ের হাতে রেখে দেওয়া হয়েছে।’
জানা গেছে, গত বছর ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকে যে পরিবর্তন শুরু হয়, তা এখনও অব্যাহত থাকায় ব্যাংকটি নানান সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি চেয়ারম্যান পদে আবারও পরিবর্তনের ফলে আস্থার সংকটে পড়েছে এই ব্যাংক। ইতোমধ্যে ব্যাংকটিতে নগদ টাকার সংকট সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে এতদিন শাখাগুলোকে মৌখিকভাবে ঋণ বিতরণ বন্ধ রাখতে নির্দেশনা থাকলেও, সম্প্রতি শাখার কর্মকর্তাদের অথরাইজ করার ক্ষমতাও বাতিল করা হয়েছে।
ব্যাংকটির শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংক বেশ কিছুদিন ধরে নতুন কোনও প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে না। আর আগের যেসব গ্রাহক ও প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগ অনুমোদিত হয়েছিল, সেগুলোতেও অর্থ ছাড় করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতো প্রধান কার্যালয়। রবিবার (২২ এপ্রিল) থেকে শাখার ক্ষমতা একেবারেই তুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ব্যাংকের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত বিনিয়োগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তবে মতিঝিল শাখার এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত আমানত ও বিনিয়োগ হার (আইডিআর) সমন্বয় করার জন্য বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ রাখা হয়েছে।’
এপ্রসঙ্গে ব্যাংকটির রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকে এককোটির বেশি গ্রাহকের আমানত রয়েছে। নির্বাচনের বছরে সেই আমানত যাতে কোনোভাবে খেয়ানত না হয়, সেজন্য বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বড় ঋণ ছাড় করা হচ্ছে যাচাই-বাছাই করে। নির্বাচনের বছরে ইসলামী ব্যাংকের কোনও টাকা যাতে জঙ্গি অর্থায়ন বা সন্ত্রাসী কাজে বা সরকারবিরোধী কোনও কাজে ব্যবহৃত হতে না পারে, সেজন্য শাখার কর্মকর্তাদের অথরাইজ করার ক্ষমতাও বাতিল করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ইসলামী ব্যাংক এর আগে কখনও তহবিল সংকটে (নগদ টাকা) পড়েনি। গত বছর প্রায় আট হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ হয়েছে। একসময় এই ব্যাংকটি দেশের বিপদে পড়া ১০ থেকে ১৫টি ব্যাংককে আর্থিকভাবে সহায়তা করতো, এখন সেই ব্যাংক নিজেই নগদ টাকার সংকটে পড়েছে। এমন অবস্থায় বেশ কিছু গ্রাহক ব্যাংকটি থেকে আমানত তুলে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ হার (আইডিআর) ৯২ শতাংশ, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত হারের চেয়ে দুই শতাংশ বেশি। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের মোট আমানতের পরিমাণ ৭৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে মুদারাবা আমানত ৬৭ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। আর বাকিটা খরচ ছাড়া (কস্ট ফ্রি) আমানত। ব্যাংকটির বিনিয়োগ রয়েছে ৭৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। এ বিনিয়োগের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগ ৭৪ হাজার ৮৭ কোটি এবং বাকিটা শেয়ার বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের সংগৃহীত আমানতের ৮৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। তবে সার্বিক আর্থিক সূচক ভালো থাকলে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা যায়। যদিও সর্বোচ্চ এই হার এক শতাংশ কমিয়ে ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ব্যাংকের ঋণ ৮৯ শতাংশের বেশি রয়েছে, তাদেরকে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে এই সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে।
ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান হঠাৎ করেই পদত্যাগ করার পর ব্যাংকটিতে নতুন করে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই চাকরি হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন। এদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে ভেরিফিকেশন (তদন্ত) করানোর খবরে কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে।এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের টপ ম্যানেজমেন্টে যারা রয়েছেন, তাদের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদার তিন শতাধিক কর্মকর্তার বিষয়ে নতুন করে তদন্ত করা হবে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের বিষয়ে ভেরিফিকেশন (তদন্ত) করবে। ওই পরিচালক আরও বলেন, নতুন করে ভেরিফিকেশন হওয়ার খবরে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড চাপ সৃষ্টি করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।
গত ৫ এপ্রিল ইসলামী ব্যাংকের (ম্যানেজমেন্ট) ব্যবস্থাপনা থেকে তিন ডিএমডিসহ শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তা বিদায় নেন। অপসারণ করা হয় অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো. শামসুজ্জামান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া এফসিএ, ডিএমডি আবদুস সাদেক ভূঁইয়া, ডিএমডি মোহাম্মদ মোহন মিয়া ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) আমিরুল ইসলামকে। তাদের মধ্যে এসইভিপি (সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট) ছাড়া বাকি সবার চুক্তির মেয়াদ ছিল এক বছরের।
এদিকে শাখার কর্মকর্তাদের অথরাইজ করার ক্ষমতা বাতিল করার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের বেশ কয়েকটি এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেট কার্যক্রমও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেট পরিচালনা করতো সরকারবিরোধীরা, সেসব আউটলেটগুলোর কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ব্যাংকটির এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ১০৫টি আউটলেটের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৯৫টি আউটলেট চালু হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ারকে সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভাতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হকও সেদিন পদত্যাগ করেছিলেন। এছাড়া, একইদিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
Bangla Tribune/ Apr 24,2018
No comments:
Post a Comment