গোলাম মোর্তোজা
সেই বহু পুরনো কথা ‘গ্লাস অর্ধেক ভরা না অর্ধেক খালি’। যেভাবেই দেখেন কোনোটাই অসত্য নয়। দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় অবশ্যই।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতি সরলিকরণ করা হয়ে থাকে। ধারণা দেয়ার চেষ্টা হয় ‘অর্ধেক গ্লাস খালি’ বলা মানে আপনি একটি বিষয় নেতিবাচকভাবে দেখছেন।’অর্ধক গ্লাস ভরা’ বললেই আপনি ইতিবাচক বা আশাবাদী মানুষ। এই গ্লাস ‘খালি’ এবং ‘ভরা’র সঙ্গে সত্য এবং অসত্যের যে সম্পর্ক আছে, সরলিকরণ ব্যাখ্যা তা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের সমাজ- রাজনীতির প্রেক্ষিতে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করা যাক।
১. বাংলাদেশ জনসংখ্যাগতভাবে একটি সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। মোট জনসংখযার ৬৬ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক হিসেবে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি। বিষয়টি ভেবে দেখেন, ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১১ কোটি মানুষ কাজ করতে সক্ষম। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ উন্নত হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই জনসংখ্যার এই সুবিধাজনক সময়টা অতিক্রম করেছে। ইউরোপের প্রায় সব দেশ, এশিয়ার জাপান,দক্ষিন কোরিয়াসহ অনেক দেশের নাম বলা যায়।বর্তমানে বাংলাদেশ এমন সুবিধাজনক একটি অবস্থায় আছে। একটি দেশের এমন সুবিধাজনক অবস্থা থাকে সাধারণত তিন দশক।আজকের যে জনসংখ্যা সম্পদ, তিন দশক পরে গিয়ে তা দায়ে পরিণত হতে শুরু করে। যেমন জাপানে এখন বয়স্ক মানুষ অর্থাৎ কাজ করার সক্ষমতা নেই, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।কিন্তু তারা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। ফলে অর্থনীতির আগের সেই গতি না থাকলেও টিকে আছে।
৬৬ শতাংশ বা প্রায় ১১ কোটি মানুষ কর্মক্ষম, রিজার্ভ- অর্থনীতি- প্রবৃদ্ধির অংকও সবল। কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষের কাজ নেই। যদিও তাদের কাজ করার সক্ষমতা আছে। এই পরিসংখ্যান সামনে আনলেই বলবেন,সাড়ে ৬ কোটি মানুষের তো কাজ আছে । গ্লাস অর্ধেক ভরা, সেভাবে দেখেন। হ্যাঁ,সেভাবে দেখা যায়। এই তথ্য তো অসত্য নয়। সাড়ে ৪ কোটি মানুষের কাজ নেই, এই তথ্যও তো অসত্য নয়। প্রত্যাশাটা কী, সব মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশের সব মানুষের ভাগ্যের বদল হবে। ‘দিন বদল’র শ্লোগাণে তো তেমনটাই বলা হয়েছিল। এখন শুধু অর্ধেক গ্লাস ভরা দেখতে বলছেন কেন! আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি বিনিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিয়ম- নৈরাজ্য বিনিয়োগের একমাত্র কারণ না হলেও, অন্যতম কারণ। এর বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেয়াটা দৃশ্যমান নয়। বিনিয়োগ না হওয়ায় প্রত্যাশিত কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে বিক্ষুদ্ধতা।
২. সরকারের দৃষ্টিভঙ্গেতেও ভিন্ন চিত্র দেখা যায়।’একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে ফেরত নিয়েছে মিয়ানমার’- মিয়ানমার সরকার সংবাদটি ফলাও করে প্রচার করছে। একটি পরবারকে ফেরত নেয়ার বিষয়টিকে বাংলাদেশ বলছে ‘হাস্যকর’। বাংলাদেশ বলছে না যে, অন্তত একটি পরবারকে তো ফেরত নিয়েছে। পরাবারটি নো ম্যানস ল্যান্ডে ছিল। বাংলাদেশ বলছে না যে, পরিবারটিকে বাংলাদেশের ভেতরে না পাঠিয়ে, মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়েছে।এভাবে বললে মনে হতো যে, পরিবারটিকে বাংলাদেশেই পাঠানোর কথা ছিল। বিষয়টি তো তা নয়। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা সরকারি হিসেবে ১১ লাখ, অন্যান্য হিসেবে এই সংখ্যা ১৪ লাখও হতে পারে। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের কথা বলছি। যদি ২ লাখও ফেরত নেয়, বাংলাদেশকে বলতে হবে ৯ লাখকে ফেরত নেয়নি।অর্ধেক গ্লাস ভরা তত্ত্ব এক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ পরিপন্থী।
৩. দেশের তরুণদের বহু দিনের দাবি প্রচলিত কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। শুধু তরুণদের নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে যে তিনটি কমিটি করা হয়েছিল তারা সবাই সবাই পদ্ধতি বাতিল বা সংস্কারের পক্ষে রিপোর্ট দিয়েছিল। পাবলিক সার্ভিস কমিশনও বর্তমান পদ্ধতির কোটার পক্ষে না। তরুণরা কোটা বাতিল নয়, সংস্কারের দাবি সামনে আনল। প্রথমে গুরুত্বই দিলেন না। তারা সংগঠিত হতে থাকলো। তাদের পক্ষে বাড়তে থাকল জনমত। তখন থেকেই বলা শুরু হলো, আন্দোলনকারীরা জামায়াত- শিবির- রাজাকার। জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত কেউ কেউ লিখে ফেললেন ‘রাস্তা কেন আটকালো’?’ রাস্তা আটকে মানুষের দুর্ভোগ তৈরি করা খুব খারাপ কাজ, যা করা একদম ঠিক হয়নি।
এক্ষেত্রেও অর্ধেক দেখা না দেখার বিষয় চলে আসে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী- চাকুরিপ্রার্থীদের আন্দোলন গত ৮ এপ্রিল শাহাবাগে রাস্তা আটকে শুরু হয়নি। তারা নিয়মাতান্ত্রিক উপায়ে রাস্তা না আটকে মানববন্ধন করেছে।গলায় সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে রাস্তা ঝাডু দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। স্বারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করেছে। সরকার তাদের দিকে ফিরেও তাকায় নি। আন্দোলনটি অনেক দিন ধরে চলছে।
যিনি বা যারা বলছেন ‘রাস্তা কেন আটকালো’ তিনি বা তারা দীর্ঘদিন ধরে চলা এই আন্দোলন বা নায্য- যৌক্তিক দাবি বিষয়ে একটি কথা বলেননি, একটি অক্ষরও লেখেননি।
একজন পুলিশ অফিসার আন্দোলনকারীদের বললেন ‘খায়া ফালামু’। কোনো উস্কানি ছাড়া নির্দয়ভাবে লাঠিপেটা করলেন।কয়েক’শ টিয়ারসেল, রাবার বুলেট ছোঁড়া হলো। জলকামানের ব্যবহার চলল। শিক্ষার্থীরা আহত রক্তাক্ত হলেন। এই নিপীডন নির্যাতন চলল সারা রাত ধরে। চলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে। ‘রাস্তা কেন আটকালো’ বলাওয়ালারা এই নিপীড়ন- নির্যাতনের বিষয়ে নিরব থাকলেন, কোনো কথা বললেন না- লিখলেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি হঠাৎ করে জেগে উঠলেন সকালবেলা। ’ভিসির বাড়ি কেন ভাঙ্গচুর হলো’- মানববন্ধন করে ফেললেন। খুব ভালো উদ্যোগ, ভিসির বাড়ি ভাঙ্গার প্রতিবাদে মানববন্ধন অবশ্যই করবেন। ভিসির বাড়ি কারা ভাঙ্গলেন, তদন্ত- শাস্তি খুব জরুরি। ভিসির বাড়ি ভাঙ্গচুরের ঘটনা ঘটেছে রাত একটা বা দেরটার দিকে। অদ্ভূত বিষয়, শিক্ষক সমিতি তার ‘আগে- পরে’র কোনো ঘটনা দেখার দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত- রক্তাক্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল গেছে, সেখান থেকেও তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে অনেককে। শিক্ষক সমিতি বা ভিসি বা প্রক্টোরিয়াল বডির নজরেই আসল না বিষয়টি। এই আংশিক দেখাটাই আমাদের সমাজের একটা সাধারণ চিত্র হয়ে গেছে।
৪. দাবি ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কার করে কমিয়ে আনার। শিক্ষকসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের একটা অংশ দেখানোর চেষ্টা করতে থাকলো যে, মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হচ্ছে। এবং আন্দোলনকারীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি।মুক্তিযোদ্ধারা যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্য নয়, তা বুঝেও না বোঝার ভান করলেন। আন্দোলনকারীদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান।এই তথ্য জানা থাকলেও, বলতে চাইলেন না।
অসত্য প্রচারণাও চালালেন। গোলাম আযমরা অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ ছাড়া বাংলাদেশের সব মানুষের অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সঠিক তালিকা করতে পারেনি বাংলাদেশের কোনো সরকার। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে তালিকায় নেই। যে তালিকা আছে সেই তালিকা অনুযায়ী এখন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংখ্যা ২ লাখ। ৩০ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অধিকাংশই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত নয়। ২ লাখ নিপীড়িত নারীদের অল্প কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই তালিকার বাইরে। যে তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে, সেই তালিকাটি বড় রকমের ত্রুটিপুর্ণ। তালিকায় রয়ে গেছে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজাকারও।
বর্তমান সরকারে সময়ে উদ্যোগ নেয়া তালিকাতেও ঢুকে গেছে জামায়াত- রাজাকার। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে সুবিধা নেয়া পুলিশ ধরা পড়ছে, ধরা পড়ছে প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা সচিবরা। মূলত বাণিজ্য চলছে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে।অর্থের বিনিময়ে সনদ বিক্রির কিছু সংবাদ বের হয়ে আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এমন একটি তালিকার ভিত্তিতে সরকারি চাকরির ৩০ শতাংশ কোটা যে কোনোভাবেই থাকা উচিত নয়, যে কোনো বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের তা বোঝার কথা। অথচ এখানে ঘটছে উল্টো ঘটনা। সত্য চাপা দিয়ে অসত্য সামনে এনে, অসততার পক্ষে অবস্থান নেয়া হচ্ছে। অসম্মানিত করা হচ্ছে জাতির শ্রেষ্ঠ্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের। নায্য দাবির বিপক্ষে যুক্তি দিতে না পেরে, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের। যে কাউকে বলে দেয়া হচ্ছে রাজাকার। ছাত্রলীগ করা আন্দোলনের নেতাকেও বলে দেয়া হচ্ছে জামায়াত - শিবির। সরকারের একটি অন্যায় বা দুর্নীতির সমালোচনাকে আখ্যা দেয়া হচ্ছে, দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে। প্রচারণা যেন প্রপাগান্ডায় পরিণত হচ্ছে।
৫. শুরুতে বলেছিলাম দৃষ্টিভঙ্গির কথা। অর্ধেক গ্লাস খালি দেখবো, না অর্ধেক ভরা দেখবো। অর্ধেক গ্লাস ভরা দেখতে চাওয়া মানে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অপরাধকে সমর্থন করা। এর সঙ্গে আশাবাদের সম্পর্ক নেই, বিষয়টি এত সরল নয়। আপনার দুটি ভালো চোখের একটি আঘাত করে নষ্ট করে দেওয়া হলো। নিশ্চয় একটি অক্ষত রাখার জন্যে আঘাতকারীকে ধন্যবাদ বা অভিনন্দন জানাবেন না। দুই সন্তানের একজনকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করল, আরেকজনকে করলো না। নিশ্চয় অভিনন্দন জানাবেন না, একজনকে হত্যা করেনি বলে। রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ডলার চুরি হয়ে যাওয়ার পর, ৩২ বিলিয়নের বাকিটা চুরি হয় নাই বলে গভর্নরকে ধন্যবাদ বা অভিনন্দন জানাবেন না।
গ্লাসের পুরোটা ভর্তি থাকার কথা, অর্ধেক ভর্তি থাকার কথা নয়। বাকি অর্ধেক অন্যায়ভাবে খালি করা হয়েছে, হচ্ছে। এখানে গ্লাসের পানি মানে শুধু পানি নয়, মানুষের জীবন। বহু আগে, হয়তো বর্বর যুগে বলা যেত ‘যাক তাও তো কিছু একটা হয়েছে’। তখন অর্ধেক গ্লাস ভরা বা আংশিক প্রাপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার ব্যাপার কাজ করে থাকতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে এসব পুরনো তত্ত্ব অচল। অচল তত্ত্ব নিয়ে পড়ে থাকলে সমাজবিরোধীরা উৎসাহ পায়। এখন সময় হিসেব নেওয়ার, অর্ধেকের নয়, পুরোটার।
- Courtesy: Daily Star Bangla/Apr 2018
No comments:
Post a Comment