ড. মইনুল ইসলাম
গত ১৬ মার্চ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ যেহেতু স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উত্তরণের জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে নির্ধারিত তিন বিবিধ শর্ত পূরণ করেছে, তাই ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশের এ উত্তরণ পর্ব শুরু হয়ে গেল। এ তিন ধরনের শর্ত মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিসংক্রান্ত। বাংলাদেশ সব শর্তই পূরণ করে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এ উত্তরণ পর্ব আগামী ছয় বছর ধরে ওই কমিটি মনিটর করার পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। তারও তিন বছর পর ২০২৭ সাল থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রযোজ্য যাবতীয় শর্ত মেনে চলবে এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সব নিয়ম-কানুনের আওতায় আসবে।
জাতিসংঘ এ স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের ক্যাটাগরির প্রচলন করেছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বহু সাধ্য-সাধনা করে বাংলাদেশকে এ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রত্যাশায়, যদিও সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার কোনো দেশকে সাধারণত এ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম ছিল না। বলা বাহুল্য, ওই সময়ের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সুবিধাগুলো পাওয়া বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য বিবেচিত হয়েছিল। এটাও অবশ্য বলা প্রয়োজন, বিশ্বের ‘মিসকিনদের ক্লাব’ কিংবা ‘ভিক্ষুকদের ক্লাব’ হিসেবে পরিচিত এ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতে অনেক দেশ কখনই রাজি হয়নি তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় থাকা সত্ত্বেও। ঘানা, ভিয়েতনাম ও জিম্বাবুয়ের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্তির পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত আশা ছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী চরম সংকটজনক অর্থনৈতিক অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পর এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ এই অবমাননাকর স্বল্পোন্নত দেশের পরিচয় ঝেড়ে ফেলে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উত্তরণে সক্ষম হবে। কিন্তু এ উত্তরণ পর্বে পৌঁছতে বাংলাদেশের ৪৩ বছর লেগে গেছে।
এ পর্যায়ে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে জিএনআইয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে বলে সরকার দাবি করছে এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে ১ এপ্রিল মাননীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৭ সালের জুনে ১ হাজার ৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে বলে সরকার দাবি করলেও জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফের হিসাবে তা এখনো অনেক কম দেখানো হচ্ছে। জিএনআই প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু জিএনআই বেশি দেখানোর প্রবণতা বাংলাদেশের সব সরকারের আমলেই ছিল, এটাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কারণ এর রাজনৈতিক ফায়দা ক্ষমতাসীন সরকারের ভাগেই যাবে। সরকারের দাবি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবস্থানের ফারাক থাকলেও এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি উচ্চ জিএনআই প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্তরে প্রবেশ করেছে, যেটাকে টেকসই করাটাই এখন জাতির প্রধান চ্যালেঞ্জ।
আজকের নিবন্ধে আমি দৃষ্টি দিতে চাই দেশে আয়বৈষম্য নিরসনের বিষয়টায়। গত ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তাদের পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০১৬ বা খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬-এর মূল তথ্য-উপাত্তগুলো একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিল, যা ১৮ অক্টোবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিচালিত এবারের জরিপে ৪৬ হাজার হাউজহোল্ড বা খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বলা হচ্ছে, যেখানে ২০১০ সালের জরিপে ১২ হাজার খানাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জরিপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নিম্নরূপ—
১. বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০১৬ সালে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল, যে হার ২০১০ সালে ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। অতএব, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল— এ ছয় বছরে দারিদ্র্য কমেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। মানে ওই ছয় বছরে প্রতি বছর গড়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। এর আগের পাঁচ বছর মানে ২০০৫-১০ মেয়াদে দারিদ্র্য হ্রাসের হার ছিল প্রতি বছর ১ দশমিক ৭ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এ দেশের দারিদ্র্য হ্রাসের হার ক্রমেই শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা দুঃসংবাদ। কিন্তু এর প্রধান কারণটাও জরিপের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে ধরা পড়েছে, সেটা হলো— বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বেড়ে মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
২. অর্থশাস্ত্রে আয়বৈষম্য পরিমাপের সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত পরিমাপক হলো জিনি সহগ, যার মান এবারের জরিপে ২০১০ সালের শূন্য দশমিক ৪৬৫-এর চেয়ে বেড়ে ২০১৬ সালে শূন্য দশমিক ৪৮৩-এ দাঁড়িয়েছে। জিনি সহগের মান বাড়লে সেটা একটা মহাবিপদ সংকেত হিসেবে বিবেচিত হয় যে, দেশে আয়বৈষম্য বেড়েই যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ অদূরভবিষ্যতে একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। যেসব দেশের জিনি সহগ শূন্য দশমিক ৫ পেরিয়ে যায়, সেসব দেশকে উন্নয়ন তত্ত্বে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশ এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
৩. আরো একটা উপাত্ত একই সাক্ষ্য বহন করছে: ছয় বছর আগে দেশের ১০ শতাংশ উচ্চবিত্ত ধনাঢ্য ব্যক্তির দখলে দেশের মোট জিডিপির ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ছিল, ২০১৬ সালে ওই ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ আয় জমা হয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে দেশের ১০ শতাংশ দরিদ্রতম মানুষ ২০১৬ সালে মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশের মালিক হতে পারছে, যেখানে ২০১০ সালে তারা মোট আয়ের ২ শতাংশের মালিক ছিল। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে যে জিডিপি পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে, এটা তার অকাট্য প্রমাণ। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরলে এটাই তো হবে, নয় কি?
৪. দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ২০১৬ সালে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে গেছে, এ হার ২০১০ সালে ছিল ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এটা সুসংবাদ। কিন্তু আয়বৈষম্য না বাড়লে এ হার আরো দ্রুত কমে যেত।
৫. দেশের দরিদ্রতম ৫ শতাংশ মানুষের কাছে ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ আয় কিন্তু ২০১৬ সালে তাদের কাছে মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ আয় পৌঁছতে পেরেছে। এর অর্থ দেশের হতদরিদ্ররা ওই ছয় বছরে আরো দরিদ্র হয়ে গেছে।
১৯৭৫ সাল থেকে এ দেশের সরকারগুলো ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরিক হয়ে ব্যক্তিখাত ও বাজারীকরণকে আঁকড়ে ধরার ফলে এ দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। ১৯৭২ সালে বিআইডিএসের গবেষণায় নির্ণীত হয়েছিল, বাংলাদেশের আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ শূন্য দশমিক ৩২। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা থাকার কথা নয় যে, হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে বা খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক এ দেশের জিনি সহগ ২০০৫ সালে শূন্য দশমিক ৪৬৭ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল এবং ২০১০ সালের একই জরিপে ওই সহগ শূন্য দশমিক ৪৬৫-এ রয়ে গেছে। তার মানে ওই পাঁচ বছরে আয়বৈষম্য আর না বাড়লেও কমানো যায়নি। আর ২০১৬ সালে এসে জিনি সহগ শূন্য দশমিক ৪৮৩-এ পৌঁছে গেছে।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ওই ২২ পরিবারের মধ্যে দুটি পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, তা-ও একটি ছিল অবাঙালি। ওই বাংলাদেশেই ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক ২৩ হাজার ২১২ জন কোটিপতি ছিলেন। ২০১৪ সালে ওই সংখ্যা ৫০ হাজার অতিক্রম করেছে বলে তারা দাবি করেছে। ২০১৭ সালে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ অ্যাকাউন্টে থাকা ব্যাংকের আমানতকারীদের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার অতিক্রম করেছে বলে খোদ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, বাংলাদেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা প্রতি বছর নাকি এ দেশ থেকে ৯০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিশ্বের নানা দেশে পাচার করে দিচ্ছে।
এসব তথ্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যে এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে পুঞ্জীভূত কিংবা তাদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বিপদসংকেত পাওয়া যাচ্ছে, সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারের কি কোনো করণীয় নেই? সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় এ বিপদটার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো— ১. দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মা-বাবার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে ২. দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে ৩. ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে ৪. দেশের জায়গাজমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে ৫. বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে ৬. ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৫ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৭০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী ৭. দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে ৯. বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে ১০. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে ১১. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে ১২. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে ১৩. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে ১৪. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে ১৫. দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মহোৎসব চলছে এবং ১৬. প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের যানজট নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নয়ন দর্শন ঘোষিত হয়েছিল— ‘দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি কৌশল’ অবলম্বন করা হবে। ওই পরিকল্পনা প্রণয়নে দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য গঠিত ‘প্যানেল অব ইকোনমিস্টস’-এর অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি। আমার অবস্থান ছিল, ওই কৌশল একটা ফাঁকিবাজির নামান্তর।
আমাদের দেশের জন্য সরাসরি বৈষম্য নিরসনকে উন্নয়নের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ এবং ২০১০ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে এ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে আবার সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব, ২০১০-১৫ মেয়াদের জন্য প্রণীত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৈষম্য নিরসনকে উন্নয়ন কৌশলের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়েছিলাম। প্যানেল অব ইকোনমিস্টসের চেয়ারম্যান প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদসহ প্রায় সব সদস্য আমাকে সমর্থন দিলেন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, প্যানেলের আর কোনো সভা না ডেকেই পরিকল্পনার খসড়া মন্ত্রিসভায় পেশ করে পাস করে ফেলা হলো। সেখানে ‘দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি’ কৌশল ঠিকই বহাল রয়ে গেল।
২০১৬ সালের জরিপের ফল জানার পর এখন তো স্বীকার করতেই হবে, বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধিকেই এ দেশের উন্নয়নের মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় ও বাজেটে সুস্পষ্ট নীতি ও কর্মকৌশল ঘোষণা করতে হবে যে, প্রতি বছর জিনি সহগ কতখানি কমিয়ে আনা হবে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া ও চিলি এখন এ পথেই এগোচ্ছে। সরকারকে ওইসব দেশে আয় পুনর্বণ্টনের মূল এজেন্টের ভূমিকা পালনে এখন বাধ্য করা হচ্ছে।
বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য খাতের বাজারীকরণ হলো আয়বৈষম্য বৃদ্ধির সবচেয়ে ক্ষতিকর ব্যবস্থা। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর এ দুটো ব্যবস্থাকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে সরকারগুলো। তৃতীয় ডাইমেনশনটি হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং চতুর্থটি হলো সরকারি রাজস্ব ও ব্যয় ব্যবস্থা। বাজেটে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়কে এখনো জিডিপির আড়াই শতাংশেরও নিচে নামিয়ে রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। স্বাস্থ্য খাতের সরকারি ব্যয়ও জিডিপির শতাংশ হিসেবে মোটেও বাড়ানো যাচ্ছে না বাজেটে। আর এ দেশের দারিদ্র্য সৃষ্টির সবচেয়ে বড় যে কারখানা, সে কৃষি খাতেও সরকারি ব্যয় বরাদ্দ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির বেস্ট সেলার ক্যাপিটাল ইন দ্য টুয়েনটি ফার্স্ট সেঞ্চুুরি বইয়ে যে হাইপোথিসিসটি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা হলো, রাষ্ট্র যদি অত্যন্ত কঠোরভাবে আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টনকারীর ভূমিকা পালন না করে, তাহলে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সব দেশে আয় ও সম্পদ বৈষম্য বাড়তে বাড়তে অতিদ্রুত বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাবেই। সাইমন কুজনেৎস যে একপর্যায়ে উন্নত দেশগুলোয় বৈষম্য আর বাড়বে না বলে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, সেটাকে পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে পিকেটির বইয়ে।
তিনি মনে করেন, অত্যন্ত প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থা, সম্পত্তি কর ব্যবস্থা ও বিশ্বব্যাপী পুঁজির ওপর ‘গ্লোবাল ট্যাক্স’ বসানোর মাধ্যমে এ আসন্ন মহাবিপদ ঠেকাতে হবে। পিকেটি অবশ্য ইউরোপীয় কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোকে এ ব্যাপারে তার আদর্শ মনে করেন। টমাস পিকেটি তার বইয়ে কার্ল মার্ক্সকে কঠোর সমালোচনা করেছেন কিন্তু তা সত্ত্বেও বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল অবলম্বনের জন্য তার আকুতি ফুটে উঠেছে বইয়ের উপসংহারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল’কে কেন আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করছি না? আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণকে টেকসই করতে হলে বাংলাদেশের প্রথম অগ্রাধিকার হতেই হবে ‘বৈষম্য নিরসন’।
- লেখক: ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
- Courtesy: Banikbarta/Apr 21, 2018
No comments:
Post a Comment