আসিফুর রহমান
দিনের আন্দোলন শেষে ঘরে ফিরে গেলেও গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতে আবারও হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের তিন ছাত্রীকে নির্যাতনের প্রতিবাদে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহানকে বহিষ্কারের দাবিতে মধ্যরাতে হলের ভেতরে-বাইরে অবস্থান নেন।
শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইফফাতকে বহিষ্কার করা হয়। ভোররাত সোয়া চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা হলে ফিরে যান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল দিবাগত রাত ১২টার দিকে ইফফাত হলের তিন ছাত্রীকে একটি কক্ষে ডেকে নির্যাতন করেন। নির্যাতনের শিকার ছাত্রীদের চিৎকার শুনে সেখানে যান উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী মোর্শেদা খানম। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে মোর্শেদা কক্ষের জানালার কাচে লাথি মারেন। এতে তাঁর পা কেটে যায়।
খবর পেয়ে অন্য ছাত্রীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ইফফাতকে মারধর করে তাঁকে আটকে রাখেন। ছাত্রী নির্যাতন করায় তাঁর বহিষ্কারের দাবিতে বাইরে বিক্ষোভ করতে থাকেন অনেকে। ‘নির্যাতনকারীর কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মরতে নয়, পড়তে চাই’, ‘বোনের ওপর হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’—এসব স্লোগান দিতে থাকেন তাঁরা।
কেউ কেউ মোর্শেদার কেটে যাওয়া পায়ের ছবি তুলে ও ছাত্রী নির্যাতনের কথা লিখে ফেসবুকে শেয়ার করেন। মোর্শেদার সঙ্গে কথোপকথনের ভিডিও ধারণ করে তা–ও শেয়ার করেন। মুহূর্তেই খবরটি ছড়িয়ে যায়।
ভিডিওতে মোর্শেদাকে বলতে শোনা যায়, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা এ ধরনের নির্যাতন সহ্য করছেন। প্রশাসন তাঁদের আবাসনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না করায় তাঁরা হলের নেত্রীদের কথামতো চলতে বাধ্য হন। সবশেষ গত রোববারের আন্দোলনে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ছাত্রীরা রাত্রিবেলা হল থেকে বের হয়ে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন। ওই দিন ও পরের দিন সোমবার আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় বেশ কয়েকজনকে চড়-থাপ্পড় দেন ইফফাত। আজ (মঙ্গলবার) গিয়ে দেখেন, তিনজনকে মারধর করা হচ্ছে। তিনি আর নিজের ক্ষোভ সংবরণ করতে পারেননি। জানালায় লাথি দিয়ে তিনি প্রতিবাদ করেন।
মোর্শেদা ছাত্রলীগের সুফিয়া কামাল হল শাখার সহসভাপতি। তবে তিনি শুরু থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে। তাঁকে প্রথমে সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ও পরে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ সময় তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে তাঁকে মগবাজারে এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
ছাত্রী নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে বিক্ষোভ করে কবি সুফিয়া কামাল হলের সামনে জড়ো হতে থাকেন। তাঁরা ফটকের বাইরে অবস্থান নিয়ে ইফফাতের বহিষ্কারের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
রোকেয়া হল ও শামসুন নাহার হলের ছাত্রীরাও রাতে তাঁদের হলের ভেতরে প্রতিবাদ মিছিল করেন।
ছাত্রদের হলগুলোর কলাপসিবল গেট আটকে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতারা অবস্থান নেন। বিজয় একাত্তর হলের ফটক ভেঙে হাজারো শিক্ষার্থী বেরিয়ে যান।
কবি সুফিয়া কামাল হলের ভেতরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা ইফফাতের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেন।
হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমানের মুঠোফোনটি এ সময় বন্ধ পাওয়া যায়।
আন্দোলন থামাতে একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী হলে প্রবেশ করেন। ইফফাতকে হল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করে পেছন দিয়ে বের করে দেন। পরে তিনি বের হওয়ার পথে ছাত্রদের তোপের মুখে পড়েন।
ঘটনার পরপরই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইফফাতকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
তারপরও বিক্ষোভ না থামায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ইফফাতকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আজ বুধবার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে।
বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের অভিযোগ ছিল, ছাত্রলীগের হল শাখা সভাপতি আগেও সাধারণ ছাত্রীদের নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে মারধর করতেন। তবে এত দিন ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি।
ছাত্রী নির্যাতনের বিষয়ে জানতে ইফফাতের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আবিদ আল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী কাউকে বকা দিয়েছিলেন ইফফাত। ওই ছাত্রী নিজেই কাচে লাথি মেরে পা কেটে ফেলেন। এটাকে ইস্যু করে অনেকে গুজব ছড়িয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ইফফাতকে বহিষ্কারের খবর পেয়ে ভোররাত সোয়া চারটার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আজ বুধবার সকাল ১০টায় আন্দোলনকারীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হওয়ার কথা।
- Courtesy: Prothom Alo/Apr 11, 2018
No comments:
Post a Comment