আরাফাতুল ইসলাম/ডয়চে ভেলে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি দেশ আবার বিশ্বের বুকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ দেশটির আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন রাজনীতবিদরা৷ বলছি জার্মানির কথা৷
একথা সত্য, জার্মানির এক ভয়াবহ অতীত রয়েছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য অনেকটাই দায়ী এই দেশ৷ সে সময় ইহুদি ধর্মের মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন জার্মানির তৎকালীন শাসক এডল্ফ হিটলার, যিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে আগে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে আত্মহত্যা করেছিলেন৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার অপরাধের কথা অস্বীকার করে না জার্মানি৷ বরং অকপটে সেই অন্ধকার অতীতকে স্বীকার করে, প্রয়োজনের জায়গায় ক্ষতিপূরণ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে দেশটি৷ ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মূলত দুইভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া জার্মানি আবারো নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, একত্রিত হয়েছে৷ ধ্বংসস্তুপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে বড় ভুমিকা রেখেছেন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশটির দায়িত্ব নেয়া জার্মান রাজনীতিবিদরা৷
জার্মানিতে আসার পর গত এক দশকে তিনটি জাতীয় নির্বাচন দেখার সুযোগ হয়েছে আমার৷ বাংলাদেশ থেকে আসা একজন সাংবাদিক হিসেবে জার্মান রাজনীতির যে তিনটি দিক আমার ভালো লেগেছে, সেগুলো তুলে ধরছি এখানে৷
ব্যক্তি নয়, দেশ আগে
জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে পরিবারতন্ত্র কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের ছায়া দেখেনি আমি৷ বরং দেশের প্রয়োজনে, দলের প্রয়োজনে দলগুলোর শীর্ষ পদে পরিবর্তন আসতে দেখেছি৷ জার্মানির সবচেয়ে পুরাতন দল এসপিডি’র কথাই ধরুন৷ জার্মানির গত তিন সরকারের দু’টিতে মহাজোট সরকারের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে রয়েছে দলটি৷ ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে এসপিডি’র চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী হন পেয়ার স্টাইনব্রুক৷
দক্ষ এই রাজনীতিবিদ নির্বাচনের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ভবিষ্যতে ম্যার্কেলের অধীনে মন্ত্রিসভায় আর কাজ করবেন না তিনি৷ অর্থাৎ চ্যান্সেলর হবেন, অথবা থাকবেন না মন্ত্রিসভায়৷ কিন্তু সেবছর নির্বাচনের ভোটাভুটির পর দেখা গেলো, এককভাবে বা সিনিয়র পার্টনার হিসেবে সরকার গঠনের মতো ভোট পায়নি এসপিডি৷ বরং সিডিইউ’র সঙ্গে সরকার গঠনই দল ও দেশের স্বার্থে মঙ্গলজনক৷
স্টাইনব্রুক তাঁর কথা রেখেছেন৷ তিনি জোট সরকার গঠনের পথে এসপিডিকে সহায়তা করেছেন বটে, তবে যোগ দেননি ম্যার্কেলের মন্ত্রিসভায়৷
২০১৭ সালের নির্বাচনের আগে এসপিডি’র চ্যান্সেলর প্রার্থী হলেন মার্টিন শ্যুলৎস৷ এই নির্বাচনে এসপিডি আগেরে চেয়েও কম ভোট পেলো৷ অন্যদিকে আশাতীতভাবে তৃতীয় অবস্থানে চলে গেলো অভিবাসী ও মুসলমনাবিরোধী উগ্র ডানপন্থি দল এএফডি৷ সেই নির্বাচনের পরপরই এসপিডি ঘোষণা দেয় যে, সিডিইউ’র সঙ্গে জোট গড়বে না তারা৷ বরং সংসদের বিরোধী দল হিসেবে থাকবে দলটি, যাতে এএফডি প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানে যেতে না পারে৷
সেই ঘোষণার পর ম্যার্কেলও চেষ্টা করেছিলেন এসপিডিকে ছাড়া সবুজ দল এবং এফডিপিকে নিয়ে জোট গড়তে৷ কিন্তু কয়েকমাস চেষ্টার পরও সেটা সম্ভব হয়নি৷ ফলে, সরকার গঠন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়৷ আলোচনা তখন নতুন আরেকটি নির্বাচনের দিকে যেতে থাকে৷ এমনকি কেউ কেউ ম্যার্কেলের পদত্যাগের সময় ঘনিয়ে এসেছে বলেও মনে করতে থাকেন৷ কিন্তু শেষমেষ এসপিডিকেই এগিয়ে আসতো হলো সিডিইউ’কে রক্ষায়৷ আবারো তৈরি হলো জার্মানির বড় দুই দলের মিলনে জোট সরকার৷
সেসময় দেশের, দলের স্বার্থে নিজের স্বার্থত্যাগ করেছেন মার্টিন শ্যুলৎস৷ জোট সরকারের মন্ত্রিসভাতে বড় পদ পেতে পারতেন, কিন্তু নেননি৷ এমনকি এসপিডি দলের শীর্ষপদটিও ছেড়ে দিয়েছেন তিনি৷ জার্মান রাজনীতিবিদদের কাছে দেশ, দলই যে সবসময় প্রাধান্য পায়, শ্যুলৎস তা আবারো প্রমাণ করেছেন শুধু৷
জনগণই শেষ কথা
জার্মানির বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে রাজনীতির যে ফাঁকফোকড় গলিয়ে হিটলার দেশটির শাসক হয়েছিলেন, সেসব ফাঁকফোকড় এখন আর নেই৷ বরং রাজ্য এবং জাতীয় নির্বাচন থেকে চ্যান্সেলর পদে নির্বাচন অবধি পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল করা হয়েছে, যেখানে জনগণের আকাঙ্খার বাস্তবায়ন কয়েক ধাপে করা হয়৷ আর বলাই বাহুল্য, এদেশের নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাধীন৷ সেগুলোর উপর সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই৷
এই দেশে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগের কথা আমি কখনো শুনিনি৷ বরং নির্বাচনের ফলাফল যা হয় তাই মেনে নিয়েই পরবর্তী পরিকল্পনা সাজায় দলগুলো৷ সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতি জার্মান সমাজের একাংশকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল৷ প্রায় দশলাখের মতো শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়াকে মেনে নিতে পারেননি তারা৷ নির্বাচনের ফলাফলে সেটার প্রতিফলন ঘটে৷ এএফডি নামের দলটি আশাতীত ভালো ফলাফল করে৷
নির্বাচনের পর নড়েচড়ে বসেন ম্যার্কেল৷ নতুন সরকার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি শরণার্থীদের প্রতি থাকা তাঁর উদার মানসিকতা থেকে কিছুটা সরে আসেন তিনি৷ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হওয়া শরণার্থীদের ধরে ধরে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়৷ নতুন করে শরণার্থী নেয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াও জটিল করা হয়েছে৷ এমনকি, ম্যার্কেল এমন একজনকে নতুন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি শরণার্থী এবং মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর মানসিকতার রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত৷ সর্বোপরি ম্যার্কেল এই ঘোষণাও দিয়েছেন যে, যেসব মধ্য ডানপন্থি ভোটার গত নির্বাচনে তাঁর দলকে ভোট দেয়নি আগামী চার বছর তাদের মন জয়ের চেষ্টা করবেন তিনি৷
এখানে জার্মানির সংসদের আরেকটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ না করলেই নয়৷ সেটা হচ্ছে, সাংসদদের ‘ফ্লোর ক্রসিংয়ের’ সুযোগ৷ অর্থাৎ সংসদে কোন বিষয়ে ভোটাভুটি হলে সেক্ষেত্রে দলীয় অবস্থানের বাইরে গিয়েও একজন সংসদ নিজের পছন্দমত ভোট দিতে পারেন৷ ফলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটি চাইলেই যে কোনো কিছু সংসদে অনুমোদন করিয়ে নিতে বা যে কোনো কিছু বাতিল করতে পারে না৷ এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেই৷
অনেক পশ্চিমা দেশে সমকামীদের মধ্যে বিয়ে বৈধ হলেও জার্মানিতে সেটা বৈধ ছিল না৷ গত বছর নির্বাচনের আগে এই নিয়ে ম্যার্কেলের উপরে চাপ সৃষ্টি করা হয়৷ ম্যার্কেল তখন এক পর্যায়ে ঘোষণা দেন যে, সংসদে এই বিষয়ে ভোটাভুটি হবে৷ সেই ভোটাভুটিতে সমকামীদের বিয়ে বৈধ করার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ম্যার্কেল৷ কিন্তু তাঁর দলের অনেক সংসদ পক্ষে ভোট দিয়েছেন৷ অর্থাৎ চ্যান্সেলর হয়েও সমকামীদের বিয়ে সংক্রান্ত প্রস্তাব ঠেকাতে পারলেন না ম্যার্কেল৷
জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেয়ায় জার্মান রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রতিহিংসার রাজনীতি চর্চাও দেখা যায়না৷ যুক্তিহীনভাবে শুধুমাত্র খামখেয়ালিপনা থেকে আগের সরকারের কোন সিদ্ধান্ত পরের সরকার পরিবর্তন করেছে এমনটা আমি দেখিনি৷ বরং সরকার পরিবর্তনের প্রভাব উন্নয়নের ধারায় যাতে না পরে সেটার দিকে খেয়াল রাখেন রাজনীতিবিদরা৷
দেশবান্ধব পররাষ্ট্রনীতি
বাঙালি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর চাচাকাহিনীতে লিখেছিলেন এক জার্মান সেনা কর্মকর্তার কথা যিনি নিজের মেয়েকে ত্যাজ্য করেছিলেন শুধুমাত্র সে এক ফরাসি যুবককে বিয়ে করেছিল বলে৷ ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির অনেক পুরনো শত্রুতা ছিল৷ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই শত্রুতাকে ঝেড়ে ফেলে দুই দেশ বরং বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে৷ এক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রেখেছেন দুই দেশের রাজনীতিবিদরা৷ আর সেই বন্ধুত্বের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক শক্তিশালী ইউনিয়নে পরিনত হয়েছে৷
জার্মানি এমন একটি দেশ যার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এমনকি ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে৷ অথচ এই দেশগুলোর একে অপরের মধ্যে কিন্তু বিরোধ চরমে৷ বিদেশি বিভিন্ন দেশ বা শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে জার্মান রাজনীতিবিদরা, কূটনীতিকরা নিজের দেশের স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন৷ আর দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশি নির্দিষ্ট কোন দেশ বা শক্তির দ্বারস্থ হয় না৷ ফলে দেশটির রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই৷
আবার এমনও নয় যে, জার্মানির সব রাজনীতিবিদ ধোয়া তুলশি পাতা৷ তবে, জনগণের প্রতি তাদের জবাবদিহিতা তুঙ্গে৷ তাই, কোন রাজনীতিবিদ যদি বড় ধরনের অপকর্মে জড়ান, তাহলে তার রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না৷ গত দশবছরে একাধিক রাজনীতিবিদকে আমি দেখেছি, যাদের অনেক বড় কিছু করার সুযোগ থাকলেও অপকর্মের দায় নিয়ে সরে যেতে হয়েছে৷
No comments:
Post a Comment