Search

Wednesday, April 4, 2018

গণতন্ত্রীদের বিচারবহির্ভূত হত্যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নিয়োগ করে‌ছে হাসিনা — এশিয়ান হিউম্যান রাইটস

[সম্পাদকীয় নোটঃ মার্চ ২৮, ২০১৮ হংকংভিত্তিক এশীয় মানবাধিকার কমিশন  ১১টি মানবাবাধিকার সংস্থা প্রদত্ত একটি যৌথবিবৃতি তাদের পক্ষ থেকে প্রকাশ করেছে। এই সংস্থাগুলি হলো — এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এসোসিয়েশন প্যারালা রিকু্পা‌েররেশন দে লা মেমোরিয়া হিস্টোরিকা, এএফএডি, এডভোকেসি ফোরাম, ইন্টরন্যাশনাল কোয়ালিশন এগেনস্ট এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্সেস, ম্যাডরেজ দ্য প্লাজা দ্য মেয়ো, ফাইন্ড-ফ্যামিলিজ অব ভিক্টিমস অব ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস, ‌ফেদেফ্যাম, কাতারি পানিতুরি ,উই রিমেম্বার, লেলস পি. দেমে টায়ারডেস ল অফেন্স]



ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ সরকার। দেশটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক এবং খুবই উদ্বেগজনক। তার ওপর ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিক্ষোভে প্রায়ই সহিংস আচরণকরছে দেশের আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো।

মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এক ‘যৌথ বিবৃতিতে’ এসব কথা লিখেছে। এর শিরোনাম ‘বাংলাদেশ: ক্র্যাকডাউন অন অপজিশন প্রায়র টু ইলেকশনস ডেটেরিওরেটস দ্য হিউম্যান রাইটস সিটুয়েশন’ (BANGLADESH: Crackdown on opposition prior to elections deteriorates the Human Rights situation)।


দীর্ঘ এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার ব্যাপক আকারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। সব নাগরিকের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার এরই মধ্যে ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে জবরদস্তি গুম করা হ‌যে‌ছে ৪২২ জনকে। জড়িত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি পার্লামেন্টে এক বক্তব্যে এর পক্ষে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গুমকে ‌যৌক্তিকতা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। বলেছেন, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও তো বিপুলসংখ্যক মানুষ নিখোঁজ হন। জোরপূর্বক গুমকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে গুমের ঘটনা ঘটে আসছে। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এ বিষয়ে দ্বিমত জানিযে বলেছে,প্রকৃত সত্য হলো, প্রধানমন্ত্রী যেসব দেশে গুমের কথা বলেছেন সেখানে কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে বলপ্রয়োগে গুমের ঘটনা ঘটেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ও ১৯৯৬ সালের জুন মাস বাদে অন্য কোনো দশকে কিন্তু বাংলাদেশে গুম হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এরপর থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১৪৮০টি। এই মারা্ত্মক ধারা বন্ধ হয়নি। নিরাপত্তা হেফাজতে পর্যায়ক্রমিক নির্যাতনে প্রাণ গেছে আরো ১২০ জনের। 

অন্যদিকে পুলিশি নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় কয়েক ডজন ভিক্টিমের পায়ের মালাচাকিতে গুলি করার কারণে তারা স্থায়ীভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছেন। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ওই বিবৃতিতে আরো লিখেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলাকে কেন্দ্র করে ও ওই মামলায় পাঁচ বছরের জেল দেয়ার আগে পরে বিভিন্ন বাহিনী তাদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গণহারে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পোশাক পরা বা সাদা পোশাকের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন। এ বছর ৩০শে জানুয়ারি থেকে বিরোধী দলের কমপক্ষে ৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, আটক বা নির্যাতন করা হয়েছে। সম্প্রতি গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে। যাদের আটক করা হয়েছে তাদের পরিণতি এখনও অজ্ঞাত। পুলিশ এখনও এসব আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রকাশ করেনি তারা কোথায় আছে। আটক ব্যক্তিদের পরিবারগুলো অভিযোগ করছে, তাদের প্রিয়জনকে আটক রাখা হয়েছে কোনো গোপন বন্দিশিবিরে। সেখান থেকে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। তাদের অব্যাহতভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। নিখোঁজ করে দেয়া হচ্ছে। যেমনটা ঘটেছিল ২০১৩ সালের শেষের দিকে ও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনের সময়কালে।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন তার প্রকাশিত যুক্ত বিবৃতিতে আরো লিখেছে, এরই মধ্যে এক ভয়াবহ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় অ্যাক্টর - রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা  যেমন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সহায়তা করছে। নজরদারিও করছে। এক্ষেত্রে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।

বিরোধী দলের ছাত্রবিষয়ক একজন নেতা জাকির হোসেনকে আটক করে পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হয়। এর তিন দিন পরে ১২ মার্চ তিনি মারা যান নির্যাতনে। তার সারা শরীরে ছিল ক্ষতচিহ্ন। তার হাত ও পায়ের আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ওই বিবৃতিতে আরো লিখেছে, সর্বশেষ ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যে দমনপীড়ন চলছে তা যুক্ত হয়েছে সরকারের অব্যাহতভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ বা জনসভার অধিকার প্রত্যাখ্যানের রীতির সঙ্গে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য জনসভায় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম হোক সেটা ইলেক্ট্রনিক বা ছাপার সংস্করণ, তার বেশির ভাগেরই মালিক অথবা নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারপন্থি ব্যবসায়ী বা সাংবাদিক। নির্বাসনে থাকা একজন বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশ করার কারণে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে মর্জিমাফিক গ্রেপ্তার করা হয়। ওই আটকের পর তিনিসহ আরো দুজন সাংবাদিক মাহাথির ফারুকী খান ও কনক সারোয়ার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন আরো লিখেছে, ওই টেলিভিশনের মালিকানা এর চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সরকারপন্থি একজন ব্যবসায়ীকে দেয়ার চেষ্টা করছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে অব্যাহতভাবে সরকারের নজরদারিতে, পর্যবেক্ষণে, হুকমিতে, নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিশোধপরায়ণতার মুখে রয়েছে- এটা হলো তার অন্যতম উদাহরণ।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন লিখেছে, গত নয় বছর ধরে অব্যাহতভাবে যেভাবে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে তা এটা নিশ্চিত করে যে, নির্যাতিতদের ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো জায়গা নেই অথবা তাদের সেই সক্ষমতা নেই। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে সরিয়ে তাকে জোর করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।  এহলো বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উদাহরণ।

বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম করে দিতে বা ব্যাপকহারে বিচার বহির্ভূত হত্যা করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যস্ত রেখেছে সরকার। এসব ঘটানো হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারিরর নির্বাচনকে সামনে রেখে। সব বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। ফলে ক্ষমতাসীন দল ও তার মিত্ররা ১৫৩টি আসন নিয়ে নেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। নির্বাচনে কোনো ভোট পড়ার আগে এ ঘটনাটি ঘটেছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আসন রয়েছে মোট ৩০০। এখন সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা সেই একই ধারায় অগ্রসর হচ্ছে। একই রকমভাবে দমনপীড়ন চালাবে। যাকেই তারা শাসকগোষ্ঠীর জন্য হুমকি মনে করবে তার বিরুদ্ধেই এমন ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, এখানে জাতীয় প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭ ভাগের ওপরে। যুদ্ধকবলিত দেশগুলো থেকে ২০১৭ সালে ইউরোপে যেসব উদ্বাস্তু বা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন তার মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক হলো বাংলাদেশি। বিশ্বে শতকরা ৭ ভাগের বেশি জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এমন কোনো দেশের এমন সংখ্যক শরণার্থী নেই।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন লিখেছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার বিপর্যয়ের এত সব বাস্তবতা সত্ত্বেও অপ্রত্যাশিতভাবে নীরব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সরকার আন্তর্জাতিক দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ইস্যুতে। দেশের অভ্যন্তরে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য শক্ত বর্ম হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার জন্য বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য একটি নির্বাচনের পরিবেশ জরুরি ভিত্তিতে সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তে একটি বিশ্বাসযোগ্য গণতন্ত্রের জন্য মানবাধিকার পরিস্থিতিতে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।

  • সূত্র   — Asian Human Rights Commission, Hong Kong। ওয়েবসাইট - humanrights.asia 



অনিয়ম, টাকা পাচারের উৎসব!

গোলাম মোর্তোজা


ব্যাংক বা আর্থিকখাতের অনিয়ম-জালিয়াতি-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে একই কথা বারবার বলতে হয়। পুনরাবৃত্তি পাঠক হয়তো বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু যুক্তিকে যখন কূ-যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করার অপচেষ্টা করা হয়, তখন আরও কিছু কথা বলতেই হয়।

১. 
একটি দেশের আর্থিক কাঠামো বা সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার নিয়ম। নিয়মের ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একের পর এক বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। অনুমোদন দেয়ার আগে অর্থমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ ব্যাংকের অনুমোদন দিতে হচ্ছে।

‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ মানে দলীয় লোকদের সুযোগ দেয়া। সুযোগ দেয়া মানে দলীয় লোকদের টাকা বানানোর বা বড়লোক বানানোর ব্যবস্থা করা। গত কয়েক বছরে সেই কাজটি দৃশ্যমানভাবে হয়েছে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছে, ঋণের নামে জাল-জালিয়াতি করে জনগণের টাকা ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন নিয়ে গেছে।

২. 
ব্যাংকের মালিক বা পরিচালকদের বড়লোক বানানোর সুবিধার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে দিয়েছে সরকার। একজন পরিচালক তিন বছর করে মোট ছয় বছর পরিচালক থাকতে পারতেন। এখন একজন টানা নয় বছর পরিচালক থাকতে পারবেন। আগে এক পরিবারের দুইজন সদস্য পরিচালক থাকতে পারতেন। এখন এক পরিবারের চারজন পরিচালক থাকতে পারবেন। শুধু দলীয় লোকদের নয়, পারিবারিকীকরণও সম্পন্ন করা হয়েছে । যদি একটি ব্যাংকের নয় জন পরিচালক থাকেন, তাহলে পরিবারের সদস্যরাই সংখ্যগরিষ্ঠ। চেয়ারম্যান তাদেরই লোক হয়, অর্থাৎ চেয়ারম্যানসহ পাঁচ জন এক হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন। নামে বেনামে ঋণ দিতে বা নিতে পরিচালকদের এখন আর কোনো সমস্যা নেই।

৩. 
আগে সরকারি আমানতের ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যেত। এখন নিয়ম করে দেয়া হচ্ছে ৫০ শতাংশ রাখা যাবে। কারণ ব্যাংকে টাকা নেই। তারল্য সংকট প্রকোট হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের বছরে ব্যাংকগুলো সংকটে পড়লে সরকারের বিপদ বাড়বে। ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটানোর জন্যে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার নিয়ম করা হলো। ব্যাংকগুলো চাপ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার পরিমান এক শতাংশ কমিয়ে নিল। উল্টো যাত্রা বা নজীরবিহীন বললেও কম বলা হয়। এগুলো এখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের স্বাভাবিক চিত্র। সব জোরাতালি বা টোটকা সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা। সামগ্রিক কোনো পরিকল্পনা নেই।

৪. 
প্রশ্ন হলো, ব্যাংকের টাকা গেল কোথায়, তারল্য সংকট কেন দেখা দিল? রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা কোনো সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে বড়লোক হয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। নামে বেনামে ঋণ দিয়েছেন। একটু ঘুরিয়ে বলা যায় নিজেরা নিয়ে নিয়েছেন। শুধু নতুন ব্যাংক নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুরনো ব্যাংকে বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে চেয়ারম্যান, এমডি, পরিচালক নিয়োগ পাওয়াওয়ালারা ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার করে, ঋণের নামে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

৫. 
সরকারের খরচ বেড়েছে, অপব্যয় বেড়েছে, দুর্নীতি বেড়েছে। আয় বাড়েনি। সঞ্চয় পত্রের বিনিময়ে বিপুল পরিমান টাকা সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। অন্য দিকে ঋণ জালিয়াতি, খেলাপি ঋণ বেড়েছে।দুর্নীতি- জালিয়াতির মাধ্যমে বেহাত হয়ে যাওয়া টাকা পাচার হয়ে গেছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক ‘গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি(জিএফআই)’র গবেষণার তথ্য ২০০৫-২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি। দেশের অর্থনীতির গতি- প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ২০১৫-২০১৮’র বর্তমান সময় পর্যন্ত টাকা পাচার অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এই তিন বছরে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে।

৬. 
সরকার ও সরকার সংশ্লিষ্ঠরা বলেন, জিএফআই’র রিপোটে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা ধারণা থেকে বলা হয়েছে, ফলে এই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য নয়।

জিএফআই’র রিপোর্টে দুর্নীতির তথ্য সুনির্দিষ্ট নয়, তা সত্য। টাকা পাচার তো আর রিসিট দিয়ে হয় না, ফলে সুনির্দিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায় না।তবে জিএফআই’র রিপোর্ট অনুমানভিত্তিকও নয়। একটি দেশের আমদানি- রপ্তানির কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে, টাকা পাচারের পরিমান নির্ধারণ করে জিএফআই।তারা অনেক কিছু বাদ দিয়ে পরিমান নির্ধারণ করে। বাস্তবে তাদের উল্লেখিত পরিমানের চেয়ে টাকার পাচার আরও বেশি হয়ে থাকে।

টাকা পাচারের তথ্য যে একেবারে সুনির্দিষ্ট করে পাওয়া যায় না, তাও নয়।২০১৭ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৬০০ জন মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে টাকা নিয়ে গেছেন।এই তথ্য মালয়েশিয়ান সরকারের দেয়া।

ধারণা করা হয়,নিয়ে যাওয়া মোট টাকার পরিমান কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি।

২০১৫-১৭ সাল, এই দুই বছরে দের থেকে দুই হাজার জন বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে টাকা নিয়ে গেছেন।

মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি যারা সেকেন্ড হোমে নাম লিখিয়েছেন, যারা এ সংক্রান্ত খোঁজ রাখেন, তাদের ধারণা ২০১৭ সালের জুনের মাঝামাঝি থেকে ২০১৮ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কমপক্ষে দের হাজার বাংলাদেশি সেকেন্ড হোমে টাকা নিয়ে গেছেন।প্রক্রিয়াধীন আছেন আরও হাজারখানেক।

কত হাজার বা লক্ষ কোটি টাকা শুধু মালয়েশিয়ায় পাচার হয়ে যাচ্ছে,আমরা অংক ছাড়া আর কিছু করতে পারি না।

৭.
আর্থিকখাতের অনিয়ম বা জালিয়াতি একটা প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যাচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করছে।

ফলে অনিয়ম দুর্নীতি আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। তা যদি বাড়ে, পাল্লা দিয়ে বাড়বে টাকা পাচারও। সরকার টাকা পাচারের কোনো তথ্যই স্বীকার করতে চায় না । প্রকাশিত কোনো তথ্য, তদন্ত করেও দেখে না। সমস্যা স্বীকার না করে, অস্বীকার করার নীতিতে যে পরিত্রাণ মেলে না, তা সরকার বুঝতে চায় না। নির্বাচনের বছরে আর্থিকখাতের আরও কত ভয়ঙ্কর সংবাদ যে শুনতে হবে!

  • গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

খাদের কিনারে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক

হাছান আদনান



গত সাত বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। ঋণের নামে লুটপাটের কারণেই এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বড় অংকের মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হয়েছে এসব ব্যাংককে। ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নতুন করে ১২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। নিজেরা মূলধন ঘাটতিতে থাকলেও তাদেরই আবার মূলধন জোগান দিতে হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত বেসরকারি ব্যাংককে। সরকারি আমানতের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্তের ফলে এখন তহবিল প্রত্যাহারও শুরু হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে, যা তাদের আরো প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগান দেয়ার বিষয়টি এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আজ জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগানের বিষয়টি অনুমোদনের কথা রয়েছে।

আরও বেপরোয়া হবে প্রাইভেট ব্যাংক

এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে দুর্বল হয়ে পড়া অন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে যদি ফারমার্স ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তাহলে এটি সিদ্ধান্ত হিসেবে খারাপ নয়। তবে এর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতি একটি ভুল বার্তা যাবে। সংকটে থাকা অন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এ সুযোগ নিয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। তারা ভাবতে পারে, সংকটে পড়লে সরকার এগিয়ে এসে বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করবে। এটি যেন না হয়, এজন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে আছে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি। ঋণের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে হলমার্ক গ্রুপ। হরিলুট হয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন একসময়ের আদর্শ ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বেসিক ব্যাংকেও। একইভাবে লুটপাটের শিকার হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও। ফলে গত সাত বছরেই এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। ২০১০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) খেলাপি ঋণ ছিল ১১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৩২২ কোটি টাকায়। এর বাইরে অবলোপন করা হয়েছে এ ব্যাংকগুলো প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।

বেপরোয়া লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলো ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে। মূলধন ঘাটতি পূরণে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় অর্থ ঢালছে সরকার। গত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এর পরও সরকারের কাছে আরো ২০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত আট ব্যাংক। এর মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংক। সোনালী ব্যাংক একাই চেয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। জনতা ও বেসিক ব্যাংক চায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করে। এক্ষেত্রে রূপালী ব্যাংকের প্রত্যাশা ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।

মূলধন ঘাটতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল শেষে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকই ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। রূপালী ব্যাংক ৬৩৭ কোটি ও জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬১ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক ৬০০ কোটি টাকার বন্ড ছেড়ে বিদায়ী বছরে মূলধন ঘাটতি পূরণ করেছে। এছাড়া বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।

বড় কেলেঙ্কারির ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক। ঋণ বিতরণে সতর্কতার কারণে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ব্যাংকগুলোর হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকার আমানতের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত আটটি ব্যাংকের কাছেই আমানত রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণ করার মতো নগদ টাকা ছিল ৮৬ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। এর সিংহভাগই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের হাতে।

তারল্য সংকট

কিন্তু সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার নতুন নিয়মে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও তারল্য সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাত ঘিরে যে বলয় গড়ে উঠেছে, তাদের প্রভাবে এ তহবিল যাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোয়। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি পুরোপুরি ব্যাংকিং খাতেই যা নতুন সংকট তৈরি করবে।

তবে বাধ্য না করলে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকে রাখার ঝুঁকি নেবে না বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি ভালো নয়। সরকারি কোনো প্রকল্পের টাকা বেসরকারি ব্যাংকে রেখে আটকে গেলে নির্বাচনী বছরে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

তহবিল প্রত্যাহারের শঙ্কা ও নিজেরাই মূলধন ঘাটতিতে থাকলেও বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগানের চাপে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। গত বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক ও আইসিবির জন্য টাকার অংক নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়। পরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বৈঠকে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে ১৬৫ কোটি টাকা করে দেয়ার জন্য বলেছে। এর বাইরে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) দিতে বলা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ফারমার্স ব্যাংকে ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয়ার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগানের জন্য রাষ্ট্রীয় এ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পর্ষদ সভায় বিষয়টি উত্থাপন করতে বলে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিষয়টি জানিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ও আইসিবিকে চিঠি ইস্যু করা হয়। তার ভিত্তিতে এরই মধ্যে সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও আইসিবি পর্ষদ সভা ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগান দেয়ার বিষয়টি এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।

মালিকানার শর্তেই ফারমার্স ব্যাংকে ১৬৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল মাসুদ বলেন, আমাদের পরিচালনা পর্ষদ মূলধন দেয়ার বিষয়টি নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। বিষয়টি জানিয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি। এখন ফারমার্স ব্যাংক থেকে চিঠি পেলে, চিঠির শর্তগুলো পর্ষদে পর্যালোচনা করে টাকা ছাড়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। এক্ষেত্রে ফারমার্স ব্যাংকের দেয়া শর্তগুলো অবশ্যই আমাদের মনঃপূত হতে হবে। জোগান দেয়া মূলধনের অনুপাতে আমরা ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক দিতে চাই।

ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগান দেয়ার বিষয়টি আজ জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে অনুমোদন পাবে বলে জানা গেছে। সরকারের নির্দেশ হওয়ায় টাকা দেয়া ছাড়া ব্যাংকের কিছু করার নেই বলে জানান ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রত্যাশিত মূলধন পেয়ে যাবে বলে আশাবাদী ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ৬৬০ কোটি এবং আইসিবি ৫৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেবে। বর্তমানে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন রয়েছে ৪০১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এর বাইরে ৫০০ কোটি টাকা করে দুটি বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে আরো ১ হাজার কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করা হবে। পুরো টাকা হাতে এলে ফারমার্স ব্যাংক দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

  • Courtesy: Banikbarta /Apr 04, 2018 


Economists sceptical as govt. says 7.65pc GDP growth

BBS data shows per capita income $1,752


Sakhawat Hossain


The government on Tuesday announced that gross domestic product in the current fiscal grew by 7.65 per cent while economists said that the claim was not ‘acceptable’ with the present rate of employment and investment.

Planning minister AHM Mustafa Kamal at a briefing made the announcement that the country’s GDP growth rate reached a new height surpassing previous best 7.28 per cent in 2016-17 because of ‘good performance of the industrial sector, exports and inflow of remittance backed by higher investment.’

The new per capita income became $1,752 in the current financial year from $1,610 in 2016-17 on the basis of provisional calculation by the Bangladesh Bureau of Statistics, he said, hoping that the GDP growth rate would increase in the final calculation.

Economists expressed scepticism about manufacturing growth of 13.11 per cent and industrial growth of 11.99 per cent shown by the bureau of statistics as those were not supported adequately by data on investment and job creation.

Former interim government adviser Mirza Azizul Islam said that the country could not obtain higher economic growth with the present rate of investment hovering around 30 per cent of the GDP. ‘We need 34 per cent investment of the GDP to achieve 1 per cent higher growth since 2011-12,’ he said. 

Mirza Azizul Islam contested the planning minister’s claim on good growth in exports and in-flow remittance. He said that both the vital macro-economic components were having growth in the current fiscal but those came against paltry and negative growth in past year.

The country’s export earnings in July-February period of 2017-18 grew by 7.38 per cent to $24.39 billion from $22.71 billion in the same period of 2016-17 and the remittance inflow grew to $13.54 billion in 2017 from $12.46 billion in the previous year.

WB, ADB, IMF suggest below 7%

Experts said that the projected GDP growth in the outgoing fiscal was higher from the initial projection of 7.4 per cent by finance minister AMA Muhith in the presentation of national budget in parliament in June 2017 and also higher from the projection by the World Bank, Asian Development Bank and International Monetary Fund which forecasted growth rate below 7 per cent.

World Bank in Dhaka lead economist Zahid Hossain said that the growth calculation by the bureau of statistics was highly questionable providing the fact of employment data of 2.3 per cent by the same agency released in February.
The big jump in growth in manufacturing and industrial sector should have empowered more youths than the bureau estimation, he noted.

The government has been facing sever criticisms since the past year for projecting 7 per cent plus growth, which, according to the policymakers, could be made possible because of production enhancement of the manufacturing sectors backed mainly by apparel exports.

The bureau of statistics provisional data showed 13.18 per cent growth in the manufacturing sector which was 10.31 per cent in 2014-15, 11.69 per cent in 2015-16 and 10.97 in 2016-17.

Zahid pointed out that the double-digit growth for successive years just on the back of production enhancement and without major breakthrough in employment and private sector investment was something ridiculous.

The economists were also sceptical about the projection of 1.10 per cent growth in production of natural gas in the current fiscal against 0.28 per cent growth in the past year and 10.11 per cent growth in the construction sector in the current fiscal against 8.77 per cent growth in the past year.

Former Bangladesh Bank governor Salehuddin Ahmed said that the bureau of statistics should come with ‘objective’ data on the highly critical issue like GDP.

The country’s agricultural sector, according to the bureau, grew by 3.06 per cent in the current fiscal against the 2.97 per cent growth in the past year. The growth of service sector slowed down to 6.33 per cent in the current fiscal from 6.69 per cent one year back. 

The bureau said that the growths of the education and financial service providers like banks and insurance also slowed down.

  • Courtesy: New Age Apr 04, 2018 

Deception in the name of power sector development

Moudud Rahman


IF POLICY is meant to guide any sector into the right direction then Bangladesh’s power sector master plan is surely not fit to serve its intended purpose. The latest power sector policy guideline commonly known as Power Sector Master Plan-2016 clothed in rhetorical claims and unclear goals failed to protect the national interest.

The plan insists on importing fuel leaving our natural gas potential unexplored. The emphasis on import, without a doubt, will create a power sector that is dependent on the foreign company. Therefore, it is not a surprise that state owned company such as, Bangladesh Petroleum Exploration and Production company is struggling to secure its existence. 
Deceptive strategy

Power sector development does not mean that the government takes initiatives to prevent the frequent load shedding for few mega cities or take the grid line to the remote areas. It is also meant to ensure uninterrupted quality power supply for all at an affordable price. It isn’t necessary to be an expert to name and shame the celebration of 15 thousand megawatt (MW) capacity milestone achievement by fireworks and laser show at Hatirjheel (2016) while the generation units are still struggling to support 10 thousand MW peak demand. Such celebrations are part of government’s deceptive strategy. So far, all the major commitments are proved rhetorical. 

In the name of price adjustment, electricity tariff was increased for more than 7 times in last 7 years. Profit mongering rental and quick rental power plants are still on the scene, which was supposed to be in the system for not more than 5 years when it was introduced. It is a profit making mechanism for business-politics evil nexus that they sell in the name of tackling power sector crisis. Even more disturbing is that their actions are protected under an indemnity act. It costed Tk 5000 crore mainly due to purchasing costly power from poorly maintained but excessively charged rental power plant during first 10 month of 2016-17 fiscal year and thus BPDB ranked first in making loss among 48 state owned statutory body (Prothom Alo, 5 June, 2017). Subsidy is necessary to nurture and support a service sector such as power sector, but in Bangladesh, a sheer looting is going on especially in the last decade. There is no dearth of government interest in spending as much as Tk 20 to purchase per unit electricity from private companies, but it is reluctant to invest even lump sum amount to renovate state owned gas fired power plant to increase its efficiency which can produce per unit electricity at lower than Tk. 3.

Coal is obsolete fuel 
THE share of coal in power generation is still insignificant in Bangladesh, but its future target is horrendous. When rest of the world is in competition to declare their fossil-fuel divestment, coal phase out plans, Bangladesh is looking for the fastest ever coal plant expansion project in the history. According to PSMP– 2016, coal fleet capacity will reach up to 19 thousand MW in total by 2041 which is now only 500 MW. This plan defies the global trend. France, UK, Canada, and Germany have already declared its plan to phase out from coal by 2023, 2025, 2030 and 2050 respectively. China has cancelled 103 coal fired power plants of 120 thousand MW capacities all together which were at various stage of construction in 2017. Chinese government have allocated $275 billion budget to invest in 5 years to curb air pollution which is more than double of their defense expenditure. And, to maintain the growing electricity demand, they have decided to invest $ 361 by 2020 in renewable energy sector which in return will not only give electricity but also will create 13 million new jobs.

Nuclear is outdated technology 
IN PSMP-2016, 10 per cent of total power generation target has been set to achieve by 2041 from nuclear. To meet that goal Bangladesh needs to construct 7,200 MW capacity of nuclear power plant while Germany have already decided to demolish all of its nuclear power plant by 2022. Nuclear technology is not only unsafe for environment and risky to operate but also puts immense pressure on state exchequer for its costly power generation and radioactive waste disposal. Cost escalation is nothing new for nuclear power. The construction of 75 nuclear reactors was started in the US between 1966 and 1976. In each of these cases, the actual construction cost was found to be 300 percent higher on average than the estimated cost at the beginning (Ramana M V, 2009). Similarly, the construction of the 1,600 MW Flamanville nuclear power plant has already required three times the predicted cost till date and is yet to be completed (Reuters, December 4, 2012).

Bangladesh’s Rooppur nuclear power plant is no exception. Even before construction started, the project cost increased from $4 billion to $12.65 billion within just three years of the time frame (WNISR 2017). As the contract with Russia is not a fixed price contract, but a cost plus one, the vendor retains every right to present a revised budget at any point in future. In case of nuclear power, technology cannot guarantee the safety and it has been proved in Three Mile Island, Chernobyl and Fukushima. Instead of revisiting its plan, the government has passed an indemnity bill to get legal shield for any ‘unintended’ tragic occurrences. 

Instead of giving preference to our own natural gas reserve exploration, PSMP-2016 prescribed for importing 4000 million cubic feet of expensive LNG per day by 2041. No wonder that such expensive energy mix will increase the gas and electricity usage cost in manifold. Along with the suggestion for the usage of coal, nuclear and LNG in the energy mix, PSMP-2016 suggested for gradual increase of the gas price by 19 to 29 percent per year. Similar, increase of the electricity price is suggested as well.

Alternatives are cheap
ALL around the globe renewable energy becomes a crisis solver but in Bangladesh this alternative itself in crisis. Non-hydro renewable energy based power generation capacity is only 1.5 per cent in Bangladesh whereas in neighboring India it is more than 15 per cent. Germany is producing 30 per cent of its total generated electricity from renewables now. It has set a goal to produce at least 55 per cent of its total electricity from renewables by 2035 (Independent, May 5, 2017). Solar and wind power is producing at lower than Tk. 3.5 in India and Indian government is aiming to install 1 lakh 75 thousand MW of solar, wind, biomass and small hydro all together within next 4 years. On the other hand, Bangladesh’s recently formulated PSMP-2016 surprisingly couldn’t find any reason to set more than 15 per cent renewable energy based generation target to achieve by 2041. Moreover, imported power has been presented as substitute of renewable energy. Therefore, if the targeted 9,000 MW of imported electricity is possible to achieve, as mentioned in PSMP-2016, then 15 per cent renewable energy based generation quota is going to be fulfilled without any solar or wind.

In various research a huge wind power potential have already been identified in Bangladesh. However, concern authorities are yet to come up with a detail wind map. The government is unaware and somewhat unwilling to adopt the efficient technology and innovative idea available for energy sector globally. It is still stuck with the land based off-grid solar model while other countries are doing mini-grid, micro-grid and floating solar, as well as building smart grid system. While in other countries solar energy is empowering people with cheap electricity, in Bangladesh it has already fallen into the trap of profiteering business. In between 2010 and 2015 per unit solar electricity cost have been decreased by 58 per cent and by 2025 this cost is projected to be decreased by another 59 percent (IRENA, 2017). However, in Bangladesh government is awarding solar projects to private companies at fixed price of Tk. 12 for per unit electricity for next 20 years (Daily Star, 28 August, 2017). 

According to this master plan, once Bangladesh will achieve 100 per cent grid connectivity presumably by 2031, millions of installed solar home system would be disposed. But a recent study of Stanford University shows that 100 percent electricity from renewables would not only be possible for Bangladesh by 2050 but this will also be economical comparing with coal, nuclear and LNG (Jacobson et al. 2017). Therefore, it will not be mistaken to suggest that PSMP-2016 has largely considered research and policies approved by the coal and nuclear power industry than the interest of the people, environment and national economy of Bangladesh. 

It is of course not too late. There is still scope for the government abandon its deceptive strategy and design a people and environment friendly power sector plan. Power sector still can be self-reliant and serve the people’s interest. To achieve that goal revising the current policy trend is a must. We need adequate investment in building national capacity and nationally contextualised effective research. To produce cheap and clean electricity we need to focus on utilising our own natural gas reserve and immense potential of renewable energy instead of costly coal, nuclear and LNG. At the same time, policy makers and their collaborators who are misleading the energy sector for profiteering interest must be brought to justice for deceiving the people and misusing the public money in the name of power sector development.

Mowdud Rahman is an engineer and researcher.
  • Courtesy: New Age/ Apr 04, 2018

Tuesday, April 3, 2018

সত্যে হতাশা, অসত্যে আশাবাদ!

গোলাম মোর্তোজা 


বাংলাদেশ প্রায় সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ, ২ লাখ নারীর সম্মানহানি, স্বাধীনতা অর্জন। একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কত মূল্যই না দিতে হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনও দেশকে এত মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়নি।

বর্তমানে ‘উন্নয়ন’ এই শব্দটি নিয়ে বাংলাদেশে যত কথা, তর্ক-বিতর্ক দুনিয়ার আর কোথাও এমন নজির নেই। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ। বিশাল উদযাপন উৎসব পালিত হয়েছে শুধুমাত্র বাংলাদেশে। তাও আবার প্রকৃত তথ্য সামনে না এনে। প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে, আগামী অর্ধযুগ সেই ধারায় চলতে সক্ষম হলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ এখনও নিম্ন-মধ্যম আয়ের স্বল্পোন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ নয়। আগামী ৬ বছরের বাংলাদেশের পরিচিতিও এটাই থাকবে।

তার পরের তিন বছর অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত একটি কর্মকৌশল প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তারপর বাংলাদেশের প্রকৃত পরিচয় হবে ‘উন্নয়নশীল’। উৎসবের জন্যে ৬ বা ৯ বছর অপেক্ষা করার সময় আমাদের নেই। উৎসব আগেই করে রাখতে হবে। উন্নয়ন উৎসবের ডামাডোলের মাঝে নতুন-পুরনো কিছু পরিসংখ্যান সামনে আসছে, যা ‘উন্নয়ন’ গল্পের সঙ্গে ঠিক মানানসই নয়। একদিকে সরকারের এত ‘উন্নয়ন’ বিষয়ক কথামালা, আরেক দিকে দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ আর্থিক খাতের বিপরীতমুখী তথ্য। জনমনে নানা সন্দেহ-কৌতূহল-প্রশ্ন। সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।

১. বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৬-২০১৭ বছরের শ্রম জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। বিবিএস’র জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমান কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১১ কোটি মানুষ কর্মক্ষম। গত কয়েক বছর দেশে-বিদেশে আলোচনা হচ্ছে, জনসংখ্যাগত সুবিধার বিবেচনায় বাংলাদেশ বর্তমানে সুবর্ণ সময় অতিক্রম করছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম। ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ যারা কাজ করছেন বা কাজ করতে সক্ষম, তারাই কর্মক্ষম মানুষ।

এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যাবে। যদি এই জনসংখ্যাকে কাজে লাগানো না যায়, ২০ থেকে ৩০ বছর পরে জনসংখ্যার এই অংশ কর্মক্ষম থাকবে না। আজকের সম্পদ, ভবিষ্যতের বোঝায় পরিণত হতে পারে। বিবিএসের পরিসংখ্যানে কর্মক্ষম জনসংখ্যার চিত্রের পাশাপাশি, উদ্বেগের চিত্রও উঠে এসেছে। যদিও তা সাহসের সঙ্গে প্রকাশ না করে এক ধরনের চতুরতার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে।

২. বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী ১০ কোটি ৯১ লাখ কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ কর্মে নিযুক্ত আছে। ৪ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ কর্মে নিযুক্ত নেই। অর্থাৎ এদের কাজ নেই বা কাজ করছে না। আইএলও’র সংজ্ঞা সামনে এনে বলা হচ্ছে, এরা শ্রমশক্তির বাইরে,এদের যে কাজ নেই,কাজ নেই মানে এরা যে বেকার, তা স্বীকার করা হচ্ছে না। আইএলও’র সংজ্ঞায় ফেলে বেকারের সংখ্যা দেখানো হচ্ছে মাত্র ২৬ লাখ। এই চিত্র দেখিয়ে কাগজে কলমে কর্মসংস্থান এবং বেকারের একটা ভারসাম্যমূলক বা স্বস্তিদায়ক অবস্থা হয়তো দেখানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেশের কী উপকার হবে?

৩. উন্নয়ন হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। সবই বোঝা গেলো। কিন্তু আর্থিক খাতের চিত্র এত ভয়ঙ্কর কেন? ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। ৩ মাস পরে ডিসেম্বর মাসে এসে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। মাত্র ৩ মাসে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যা ছিল ১৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা।

ঘাটতির পরিমাণ শুধু বাড়ছেই। এই ঘাটতি মোকাবিলার জন্যে নানা নামে ইতিমধ্যে ৬টি ব্যাংককে ১৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন আরও ২ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

বহুল আলোচিত ফার্মার্স ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৮৩ কোটি টাকা। ৪০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে শুরু হওয়া ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭২৩ কোটি টাকা।

৪. ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির প্রকৃত কারণ চুরি-ঋণ জালিয়াতি এবং ঋণখেলাপি। আরও সরাসরি বললে, কিছু মানুষ জনগণের টাকা নানা উপায়ে জালিয়াতি করে নিয়ে যাচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে ভর্তুকি দিয়ে ব্যাংকগুলো বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে, সেই অর্থও লোপাট হয়ে মূলধন ঘাটতিতে পরিণত হচ্ছে।

৫. কাগজের হিসাব বলছে, গত ১০ বছরে,খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ২ বছরে বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত এক বছরে বেড়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের অধিকাংশই ফেরত পাওয়া যাবে না। একপর্যায়ে গিয়ে মূল টাকা ও সুদসহ ‘আর পাওয়া যাবে না’ দেখিয়ে মাফ করে দেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে মাফ করে দেওয়া হয়েছে। জনগণের টাকা ব্যাংক থেকে, ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষ ঋণের নামে এভাবে নিয়ে নিচ্ছে। গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা দিয়ে ১১টি পদ্মা সেতু বানানো যেত অথবা ঢাকা শহরের প্রতিটি রুটে মেট্রোরেল নির্মাণ করা যেত।

মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয়েও বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। চেন্নাইয়ের ৪৪ কিলোমিটার মেট্রোরেলের ২৪ কিলোমিটার নির্মিত হয়েছে মাটির নিচে দিয়ে। ৩৪টি স্টেশনের ২০টি মাটির নিচে। মাটির উপরের চেয়ে নিচে দিয়ে নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। মাটির উপরে-নিচে মিলিয়ে ৪৪ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে চেন্নাইয়ের ব্যয় হয়েছে ২৪৫ কোটি ডলার, কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ মাটির উপর দিয়ে ২০.১ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় করছে ২৭০ কোটি ডলার, কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ১৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। জাপানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ করছে বাংলাদেশ। চেন্নাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ ব্যয়ে হলেও, পাচার হওয়া টাকা দিয়ে বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ৪৫০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করতে পারত!

৬. দেশে কর্মক্ষম মানুষ আছে, কাজ নেই। আবার কাজ আছে, দেশে দক্ষ মানুষ নেই। দেশে আবার মেধার মূল্যায়নও নেই। ১০০টি পদের মধ্যে ৫৬টি পদে চাকরি হয় কোটায়। বাকি ৪৪টি পদের জন্যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকে।

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নেই। আর্থিক খাতে চরম নৈরাজ্য। বেসরকারি সেক্টরে চাকরির ক্ষেত্র বাড়ছে না।

বাংলাদেশে ৫ লক্ষের ওপরে ভারতীয়, কয়েক হাজার শ্রীলঙ্কান,চাইনিজ কাজ করছেন উচ্চ বেতনে, উচ্চ পদে। প্রতি বছর শুধু ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যায় কমপক্ষে ৩২ হাজার কোটি টাকা। ‘সিলিকন ইন্ডিয়া নিউজ’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আয় করেছে ৪ বিলিয়ন ডলার।

এই চিত্র দেখে ভারতের ওপর রাগ করে লাভ নেই। যে মানের ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কানরা বাংলাদেশে কাজ করছেন, সেই মানের কর্মী বাংলাদেশের নিজের নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের তৈরি করতে পারেনি। আগে তাও মোটামুটি একটা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। গত আট দশ বছরে তা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আগামীতে বেকারের সংখ্যা বাড়বে, দক্ষ লোকের সংখ্যা শুধু কমবে। বিদেশ থেকে দক্ষ লোক এনে কাজ করাতে হবে। চিন্তা করে দেখেন, আমাদের প্রবাসী কর্মীরা রক্ত পানি করে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। সেই অর্থ আবার বিদেশি কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছেন। ভারত সারা পৃথিবী থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে,বাংলাদেশ তার মধ্যে পঞ্চম।

৭. বাংলাদেশে সংখ্যায় কম,সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত দুটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে। একটি শ্রেণি রাজনীতি-ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। লুটপাটের অংশীজন হয়ে বিত্তবান হয়ে উঠছে, উঠেছে। আরেকটি করপোরেট জগতে কর্মরত শ্রেণি। এই দুটি শ্রেণির বক্তব্য প্রায় একরকম। ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’ জাতীয় গানে তাদের সঙ্গে মুখ মেলাতে হবে। জনগণের টাকা লুট- জালিয়াতি- পাচার হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলা যাবে না। তাদের ভাষায় এগুলো হতাশার কথা। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখে, হইচই করাটাও তারা পছন্দ করেন না। তারা এর দ্বারা ক্ষতির মুখে পড়ছেন না। নিজেদের সন্তানদের পড়াচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যমে। সেখানে প্রশ্ন ফাঁস বা মান নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। একটি ফ্লাইওভার বা ব্রিজ দেখিয়ে দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে ‘এই দেখো উন্নয়ন’! তাদের বক্তব্য, ‘এত ভর্তুকি দিয়েও ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সামর্থ্য দেখাতে পারছে বাংলাদেশ’।

৩ বছরের কাজ ৯ বছরে কেন? ৩০০ কোটি টাকার কাজে ১২০০ কোটি টাকা খরচ করা হলো কেন? এসব প্রশ্নে তাদের ভেতরে ক্ষিপ্ততা তৈরি হয়। ‘তবুও ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে তো—এত খুঁত ধরলে দেশকে তো এগিয়ে নেওয়া যাবে না। অন্য সরকার এলে দেশ কি এর চেয়ে ভালো চলবে?’– পাল্টা প্রশ্ন করেন।

না, ভালো চলার সম্ভাবনা খুই কম। এ কারণে সব অন্যায়-অনিয়ম-লুটপাট মেনে নিতে হবে?

‘বিকল্প তো কিছু নেই। অপেক্ষা করতে হবে। দেখছেন না, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে,দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’

শিক্ষাব্যবস্থা অকেজো করে দিয়ে,আর্থিক খাতে এমন নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি করে,দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে, কোনও দেশের সমৃদ্ধ হওয়ার নজির নেই। ব্যতিক্রমী বাংলাদেশ সেই নজিরও তৈরি করবে?

  • Bangla Tribune/ March 29, 2018 

ইসির বিশ্বাসযোগ্যতা নিম্নমুখী?

দুই সিটিতে নির্বাচন


বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনপর্বে দলীয় সরকারের অধীনে কীভাবে একটি স্বাধীন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে, সেই প্রশ্নটি জ্বলন্ত ছিল। সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে তারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো কীভাবে কতটা ভালোভাবে করতে পারছে, সেটা ছিল তাদের জন্য একটি পরীক্ষা। সার্বিক বিচারে এই পরীক্ষায় তারা এখন পর্যন্ত সফল হওয়া থেকে অনেক দূরে রয়েছে। গত ২৯ মার্চ স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে যেভাবে পেশিশক্তির নির্ভরতা দেখা গেল, সেই ধারার বাইরে আগামী ১৫ মে অনুষ্ঠেয় গাজীপুর ও খুলনার সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমরা ইসির কার্যকর ভূমিকা আশা করি।

গত সাধারণ নির্বাচনের আগে ওই দুটি সিটিতে নির্বাচন হয়েছিল। আবার রমজান মাসের পর বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি নির্বাচন হবে। আর এসব নির্বাচনে সন্দেহাতীতভাবে দুই প্রধান দলের শক্তি পরীক্ষার লড়াই বিশেষ উপজীব্য হয়ে উঠবে। আগামী সাত মাসের মধ্যে অনুষ্ঠেয় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি নির্বাচনের ফলাফল সরকারি দল নিজেদের অনুকূলে দেখতে চাইবে। তাই এ দিকটিও ইসির জন্য একটি বড় চাপ।

গত ২৯ মার্চ স্থানীয় সরকারের ১৩৩টি নির্বাচনে উদ্বেগজনক সহিংসতা ফিরে এসেছে এবং তা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান একটা বড় চ্যালেঞ্জ এবং সরকারি দল তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে যেকোনোভাবে ফল নিজের পক্ষে নেওয়ার জন্য মরিয়া। একটি সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে স্থানীয় নির্বাচনে এত বেশি সহিংসতা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। কারণ, এই সামাজিক শক্তিই সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন দলের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং এখনই সাবধান হওয়ার সময়।

২৯ মার্চ সংঘর্ষ-গুলি, ব্যালট পেপার ছিনতাই, এমনকি ভোটের আগেই ব্যালট ছিনতাইয়ের চেষ্টার ঘটনায় টাঙ্গাইলে যুবদলের একজন নেতা নিহত হয়েছেন। কিন্তু এসব যে ঘটতে পারে, সে জন্য তা প্রতিরোধে আগাম কোনো পদক্ষেপই ইসি নেয়নি। সহিংসতা বা অনিয়ম রোধে কোনো ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। বরং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার একটি মন্তব্য আমাদের হতাশ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচন সাধারণত বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়, সে জন্য সব সময় তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।’ এই উক্তি থেকে আমরা কি ধরে নিতে পারি যে যত বেশি প্রতিযোগিতা, তত বেশি সহিংসতার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া? এবং নির্বাচন কমিশন প্রতিযোগিতামূলক কোনো নির্বাচন পরিচালনায় প্রস্তুত নয়!

এর আগে আমরা বিএনপির বয়কট করা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১১৬ ব্যক্তির নিহত হওয়ার নজির সৃষ্টি হতে দেখেছি, যেখানে নিহত ব্যক্তিদের ৭২ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। নির্বাচন মানেই কি তবে কিছু না কিছু সহিংসতা? পুরোপুরি সহিংসতাহীন কোনো নির্বাচনই করতে পারব না? নাকি আমাদের সবার চোখের সামনে কিংবা অলক্ষ্যে পেশিশক্তিরই জয়জয়কার ঘটে গেছে।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, রংপুরের মেয়র নির্বাচনের মতো কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিলেও সাধারণভাবে ইসির প্রতি জনমনে বিরাট কোনো আস্থার জায়গা তৈরি হচ্ছে না। বরং তার মলিন ভূমিকা দিনে দিনে আরও মলিন হচ্ছে। সব থেকে পরিতাপের বিষয় হলো, ইসি নির্বিকার। তারা মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের মন জুগিয়ে চলাকেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জনগণের আস্থা বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণে তাদের সামান্য বিচলিত হতেও দেখা যাচ্ছে না। তাদের নিজেদের আরও প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া উচিত নয়।

  • Courtesy: Prothom Alo /Apr 03, 2018 /সম্পাদকীয়

উন্নয়ন, দুর্নীতি ও জিডিপি একসঙ্গে বাড়ার রহস্য

মাহা মির্জা


এ বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আফগানিস্তান আর মিয়ানমারও ‘উন্নয়নশীল’ দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে সবগুলো পরীক্ষায় পাস হলেই কেবল ২০২৪ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া সম্ভব। দুঃখজনক এই যে ভয়াবহ দুর্নীতি, দারিদ্র্য আরভেঙে পড়া আইনের শাসনের এই সব দেশের সঙ্গেই আজকাল আমাদের একচেটিয়া প্রতিযোগিতা। আরেকটু ওপরের দিকে তাকানোর মতো মনোবলও আমাদের আর অবশিষ্ট নেই। 

‘তাঁরা’ প্রায়ই জানতে চান, ‘এতই যদি দুর্নীতি, তাহলে জিডিপি বাড়ে কেন?’ যেন দুর্নীতি হলে জিডিপি বাড়ার সুযোগ নেই! অথচ অর্থনীতিতে লেনদেন বাড়লেই জিডিপি বাড়ে। সেই অর্থে রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ বা ফ্লাইওভার নির্মাণে যতই লুটপাট হোক; এমপি, নেতা,ঠিকাদার মিলে যতই ভাগ-বাঁটোয়ারা করুক, যতই লাফিয়ে প্রকল্প ব্যয় বাড়ুক, টাকার লেনদেন তো বাড়ছে, জিডিপিও বাড়বে। যেমন, এক রাস্তা অনর্থক দশবার কাটাকাটি, ভাঙাভাঙি করলেও জিডিপি বাড়ে, দেশের অর্ধেক মানুষ পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, বা সিসা দূষণের কারণে ভয়াবহ সব অসুখ–বিসুখে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও জিডিপি বাড়ে, ঢাকার ‘লাইফলাইন’ খাল এবং নালাগুলো দখল করে প্রভাবশালীদের বহুতল মার্কেট তৈরি হলেও জিডিপি বাড়ে। বাচ্চাদের খেলার সবুজ মাঠগুলো দখল করে বিল্ডিং উঠলেও জিডিপি বাড়ে।

অর্থনীতির অাদর্শ পাঠ্পুস্তক এবং দাভোসের মতো উঁচু মাপের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্মেলনগুলোতেও তাই পরিবর্তন আসছে। পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য বা আইনের শাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে শুধু জিডিপি বা মাথাপিছু আয়ের হিসাব দিয়ে যে উন্নয়ন হয় না, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

যেমন গ্লোবাল কম্প‌িটিটিভ ইনডেক্স বলছে, এশিয়ার মধ্যে নেপালের পরেই সবচেয়ে খারাপ রাস্তা বাংলাদেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্বিগুণ তিনগুণ অর্থ ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলেও কয়েক বছরের মাথায় ভয়াবহ দুর্গতি হচ্ছে রাস্তাগুলোর। দ্রুত নতুন করে তৈরি করার প্রয়োজন পড়ছে। অর্থাৎ আবারও নতুন বাজেট, নতুন লেনদেন, নতুন ভাগ-বাঁটোয়ারা, নতুন চুরি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রকল্প ব্যয় বা চুরির পরিমাণ বাড়লে জিডিপি বাড়াই স্বাভাবিক। কারণ, জিডিপি কেবল ‘ফাইনাল প্রোডাক্টে’র মূল্যমান বোঝে। কে পেল টাকার ভাগ: নেতা, জনগণ না ঠিকাদার, সেই হিসাবের দায় জিডিপির নেই।

তবে দুর্নীতির টাকা যতক্ষণ দেশে আছে এবং দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে, ততক্ষণই দুর্নীতি বা লুটপাটের সঙ্গে জিডিপির কোনো বিরোধ নেই। যেমন, জেনারেল সুহার্তোর সময়ে ইন্দোনেশিয়া ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশ। আবার একই শাসনামলে ইন্দোনেশিয়ার জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থাৎ দুর্নীতির টাকা দেশের ভেতরেই ছিল এবং তা উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছিল। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি এত সরল নয়। এখানে মহাদুর্নীতি হচ্ছে, ক্ষমতাবানদের যোগসাজশে অবাধে ব্যাংক ‘ডাকাতি’ হচ্ছে, সরকারের কাছের লোকজন বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লুটের টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আমরা জানি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা খুইয়েছিলেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। 

এর একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ‘গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্ট‌িগ্রিটি’র রিপোর্ট বলছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা অর্থাৎ এটা আমাদের জাতীয় বাজেটেরও দ্বিগুণ! এখানে দুটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেলেও সামগ্রিক অর্থনীতিতে তার সরাসরি প্রভাব কতটা? দ্বিতীয় প্রশ্ন, লুটপাট ও দুর্নীতির টাকার একটি বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তারপরও জাতীয় মাথাপিছু আয়ে তার প্রভাব পড়ছে না কেন? প্রথমত, আন্তর্জাতিক ঝুঁকি যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে (এরপরও একের পর এক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন পাচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা!)। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রই বলছে, ব্যাংকিং খাতের ‘অব্যবস্থাপনা’ (পড়ুন লুটপাট) কাটিয়ে উঠতে গত নয় বছরে তাদের প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে।

সবচেয়ে খারাপ সংবাদটি হচ্ছে, একে একে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সব অন্যায় আবদার মেনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক! সরকারি ব্যাংকের হেফাজতে থাকা জনগণের রক্ত পানি করা আমানতের ৫০ ভাগই এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তহবিলে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে! আর এ বছরের শুরুতেই লুটপাট সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে ছয় রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। এই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির টাকা আসবে কোত্থেকে ? জনগণের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে বাড়তি ট্যাক্স, ভ্যাট আদায় করা ছাড়া আর উপায় কী?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, এত সব দুর্নীতির পরেও মাথাপিছু আয় বাড়ছে কেমন করে? উত্তরটি করুণ ও বুকভাঙা। একদিকে প্রতিবছরই গড়ে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে৭, আরেক দিকে খেয়ে না খেয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিক। টাকা পাচার, ব্যাংক লুট, হরিলুট, এত কিছুর পরও তাই মাথাপিছু আয় বাড়ছেই। খেয়াল করুন, শ্রমে–ঘামে বিবর্ণ আধপেটা প্রবাসী শ্রমিকের দিনের পর দিন ‘কম খাওয়া’ মেনুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতেরপ্রাণভোমরা। রক্ত পানি করা এই বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্সের দাপটেই আজ ‘তাঁরা’ বলতে পারেন, ‘চার হাজার কোটি টাকা কিচ্ছু না’! রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা ‘কে’ বা ‘কারা’ স্রেফ লুটেপুটে খেয়ে ফেললেও আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ব্যাংক।

তাহলে উন্নয়নের দেশে কেমন আছেন অর্থনীতির চাকা ঘোরানো সেই মানুষগুলো? সত্য এটাই যে তাঁরা ভালো নেই। উন্নয়নের দেশে কৃষক বছরের পর বছর ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। উন্নয়নের দেশে এশিয়ার সবচেয়ে কম মজুরিতে এবং সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করেন গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকেরা। উন্নয়নের দেশে টিকতে না পেরে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে গিয়ে ১৩ বছরে লাশ হয়ে ফেরেন ৩৩ হাজার শ্রমিক। জনগণের নিরাপত্তা, পরিবেশ, অর্থনীতি, বা আইনের শাসন—এসব ক্ষেত্রেই প্রতিটি দেশিবিদেশি জরিপ দেখাচ্ছে সব কিছু ভেঙে পড়ার এক ভয়াবহ চিত্র।
কানাডীয় গবেষক নাওমি ক্লাইন তাঁর ‘নো-লোগো’ বইতে দেখিয়েছিলেন, পণ্যের ব্র্যান্ডিং আর বিজ্ঞাপনের পেছনে বিরামহীন অর্থ ব্যয় করে কোম্পানিগুলো, পাশাপাশি ভয়াবহ কাটছাঁট চলে শ্রমিকের মজুরিতে। বাংলাদেশের উন্নয়নটা ঠিক এমনই। অভাব, অন্যায় আর ভয়াবহ বিচারহীনতার দেশে বিপুল টাকাপয়সা খরচ করে উন্নয়ন নামক পণ্যের ঢাকঢোল পিটানোই এখন সরকারের একমাত্র ‘এস্কেপ রুট’। জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখার একমাত্র পন্থা। কিন্তু ক্রমাগত ঘা খাওয়া, লাথি খাওয়া মানুষ জানে, এই চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের ব্র্যান্ডিং আসলে কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর 'উন্নয়ন'কে আপামর মানুষের উন্নয়ন বলে চালিয়ে দেয়ার একটি 'গোয়েবলসীয়' ধারার প্রচারণা। যে উন্নয়নে মানুষ ভালো থাকে না, সেই 'উন্নয়ন'কে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ রাখা তাই জরুরি। 

তথ্যসূত্র:

১. গ্লোবাল কম্প‌িটিটিভ ইনডেক্স ২০১৭-১০১৮।২. প্রথম আলো, সাত বছরে আত্মসাৎ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মার্চ ২৮, ২০১৬।৩. গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি ২০১৭, ইলিসিট ফিনান্সিয়াল ফ্লোওস টু এন্ড ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিস: ২০০৫-২০১৪৪. দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৮।৫. বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৭-১৮, প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা। সিপিডি।৬. দৈনিক ইত্তেফাক, মূলধনঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকগুলো চেয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮।৭. প্রথম আলো, এক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার, মে ৩, ২০১৭।৮. বাংলাদেশ ব্যাংক, মান্থলি ডেটা অব রেমিটেন্স ২০১৬-২০১৭।৯. বণিক বার্তা, এশিয়ার সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশ, জুলাই ১৫, ২০১৭।১০. ২০১৭ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্ক স্টাডি, ইউনাইটেড স্টেইটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন।১১. বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন ২০১৭।


মাহা মির্জা: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ের গবেষক।

  • Courtesy:Prothom Alo Online/Apr 03, 2018

বিশ্লেষণ - তাহলে বন্ধই হোক বাংলাদেশ ব্যাংক

শওকত হোসেন


মালিকদের চাপে সরকার এই যে নানা সুবিধা দিল, তাতে ব্যাংক খাতে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার সরবরাহ বাড়বে। তবে সুদহার আপাতত কমছে না। নির্বাচনী বছরে উদ্যোক্তারা নানা অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগেও খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাতে বাড়তি অর্থ মূল্যস্ফীতি ঘটাবে বলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা। পাশাপাশি অর্থ পাচারেরও সুযোগ বাড়বে। নির্বাচনের বছরে এমনিতেই অর্থ পাচার বাড়ে। সুতরাং, এত সব উদ্যোগের পেছনে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক।

ব্যাংক খাতে এ ধরনের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব দেশই ব্যাপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও আলাপ-আলোচনা করে থাকে। তা ছাড়া এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের। ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে মুদ্রানীতি নিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনাও ব্যতিক্রমী।

গতকাল অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকারদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনায় তাঁরা বিস্মিত। তাঁরা মনে করছেন, এর পেছনের কারণ অর্থনীতি নয়, বরং রাজনৈতিক। মূল কারণ ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়া। ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়াই বড় উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ
বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কয়েকটি কাজ আছে। যেমন মুদ্রা সরবরাহ ঠিক রাখতে সহায়ক মুদ্রানীতি প্রণয়ন, ব্যাংক পরিদর্শন, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ইত্যাদি। এই কাজগুলো কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে না পারলে এ প্রতিষ্ঠান রাখা বা না রাখা তো সমান কথা। দেখা যাক, বাংলাদেশ ব্যাংক এসব কাজের কতটা করতে পারছে।

দেশে যা হলো
বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত নয়টি নতুন ব্যাংক দিয়েছে। নতুন আরও দু-তিনটি ব্যাংক দেওয়ার কথাও আলোচনা হচ্ছে। এর পেছনে অর্থনীতি নেই, আছে রাজনীতি। অর্থমন্ত্রী নিজেই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক দেওয়ার কথা বলেছেন। এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ভূমিকাই নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজটি কেবল সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে ব্যাংক অনুমোদনের চিঠি দেওয়া। নতুন ব্যাংক না দেওয়ার জন্য অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মত ছিল। তারপরও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অনুমোদনের চিঠি দিতে বাধ্য হয়েছে। কেবল একটি চিঠি লেখার জন্য তো বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন যে খুবই বেহাল, তার প্রমাণ একের পর এক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। ২০০৯ সাল থেকে এর শুরু। হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি—একের পর এক কেলেঙ্কারি ঘটছেই। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের কেলেঙ্কারি তো আছেই, বাদ নেই বেসরকারি ব্যাংকও। যে অল্প কিছু বেসরকারি ব্যাংক ভালো করছে, তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃতিত্ব কতখানি, সে প্রশ্ন তোলাই যায়। যেসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভালো, ব্যাংকটিকে যারা ভালো রাখতে চায়, তারাই ভালো করেছে। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন-ব্যবস্থা না থাকলেও তো চলে।

ব্যাংক পরিদর্শন বা তদারকির কাজটা তখন কে করবে? অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেই এ দায়িত্ব দেওয়া যায়। বর্তমান সরকার বন্ধ করে দেওয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নতুন করে তৈরি করেছে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য। অনেকে হয়তো বলবেন, তাদের তো যোগ্য লোক নেই। পাল্টা প্রশ্ন করে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ্য লোক থেকেই-বা লাভটা কী? কাজটা তো তারা করছে না বা করতে পারছে না।

বাকি রইল মুদ্রানীতি প্রণয়ন। এটিও তো আর হাতে রইল না। গত শুক্রবার ও রোববার অনুষ্ঠিত দু-দুটি বৈঠক থেকে এ কথা বলাই যায়। বিষয়টি অন্যভাবেও দেখা যায়। আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে পারি, মুদ্রানীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ নতুন একটি মডেল তৈরি করেছে। পাঁচতারা হোটেলে বসে, ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে মুদ্রানীতি তৈরি করা সম্ভব। মুদ্রানীতির বিভিন্ন উপকরণ এভাবে ঠিক করার ইতিহাস বিশ্বে সম্ভবত কোথাও নেই। বলা যায়, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস রচনা করল।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় কাজ মূল্যস্ফীতিকে মাথায় রেখে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে কয়েকটি অস্ত্র দেওয়া থাকে। এর অন্যতম হলো নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) আর বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণ (এসএলআর)। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোকে নিয়ম মেনে আমানতের একটি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। বর্তমানে সিআরআর হার হচ্ছে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং এসএলআর ১৩ শতাংশ। মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই দুই হার কমায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে বাড়ায়। এ সিদ্ধান্ত কারা কীভাবে নেয়? বিশ্বে এর একটি মান্য নীতি আছে। তা হলো সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এটিই ঘোষিত নীতি। আর এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়।

বাংলাদেশে এবার কী হলো? সিআরআর ১ শতাংশ কমানো হলো ব্যাংক মালিকদের চাপে, তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করে। বাধ্য করা হলো বাংলাদেশ ব্যাংককে। আরও অদ্ভুত কথা হলো, সিআরআর কমানোর এ সিদ্ধান্তের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হবে আগামী জুনে। অর্থাৎ আগে বাস্তবায়ন, তারপরে প্রভাব বিশ্লেষণ। আরও অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার হলো, প্রভাব বিশ্লেষণ করার এই প্রস্তাবও ব্যাংক মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস বা বিএবির অন্যতম সদস্য সালমান এফ রহমানের, বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। সুতরাং, এভাবেই যদি মুদ্রানীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক রেখে কী লাভ? শুধু শুধু খরচ।

আমানতকারীদের কী হবে
ব্যাংকের মোট মূলধনের ৯০ শতাংশই আসে আমানতকারীদের কাছ থেকে। ১০ শতাংশের মালিকানা বিএবির সদস্যদের। কিন্তু তাঁদের হাতে আছে আলাদিনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ, যার নাম রাজনৈতিক প্রভাব। চাওয়ামাত্রই সব মেলে। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার কেউ এখানে নেই। অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সিআরআর-এসএলআর রাখার অর্থ হলো আমানতকারীদের এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত আছে। আমানতকারীদের স্বার্থেই তা করা হয়। অথচ নির্বাচনের বছরে এসে সরকার গুরুত্ব দিল ১০ শতাংশ মালিকদের স্বার্থ। ভোটার হিসেবেও আমানতকারীদের যেন কোনো মূল্য নেই।

তাদের আবদার
দেশে খেলাপি ঋণ বহু আগেই এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন সংকট প্রকট। বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয় হয় অবস্থা। এর জন্য দায়ী মূলত সরকারের কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতি, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের অব্যাহত সুবিধা দেওয়া এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া। ফলে সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাত বড় সংকটে পড়ে আছে। দুই দফায় এই সরকারের ১০ বছর মেয়াদ ব্যাংক কেলেঙ্কারির দশক হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

অবশ্য ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি আবদার করেছে, ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না’র মতো কেলেঙ্কারির ইতিহাসও লেখা যাবে না। অর্থমন্ত্রীকে তারা এ নিয়ে লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছে। ব্যাংক খাত নিয়ে নেতিবাচক লেখালেখি বন্ধ করার জন্য আলাদা একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। তার তদারকি করবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। যাক, বিএবি অন্তত একটা কাজের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে উপযুক্ত ভেবেছে। ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের এ আবদারও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। অবশ্য বৈঠকে অর্থমন্ত্রীর দুই পাশে বসে থাকা বিএবির নেতৃত্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এ প্রস্তাব তাঁদের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। জমি দখল, অস্ত্র হাতে মিছিল, ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে অঘটন ঘটিয়ে চলা, প্রায় চার দশকজুড়ে খেলাপির শীর্ষস্থান ধরে রাখা, একের পর এক সুবিধা পাওয়া, অনিয়মের ঢল। এ এক অশেষ তালিকা। তারা সবই করবে, কিন্তু লিখলেই আপত্তি।

কিন্তু লেখালেখিতে নয়, বিপদ অন্য জায়গায়। সরকার, মালিক আর নিয়ন্ত্রক—সব এক হয়ে গেলে এর চেয়ে বড় বিপদ দেশের অর্থনীতিতে আর হতে পারে না। সে বিপদনাট্যের প্রথম অঙ্কের প্রদর্শনী হলো গত রোববার, ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠকটিতে। এখান থেকে ব্যাংক খাতের উদ্ধার কোথায়, সে পথটি বের করাই এখন বেশি জরুরি। নইলে সামনে মহাবিপদ।

  • Courtesy: Prothom Alo Apr 03, 2018

Banking Sector: TIB worried at proposal for reporting law


Transparency International Bangladesh yesterday termed the Bangladesh Association of Banks' proposal of formulating the Bank Reporting Act as illegal and expressed deep concern over it.
In a statement, TIB Executive Director Iftekharuzzaman termed the move as dreadful saying the anti-public proposal will encourage irregularities and corruption in the banking sector.

TIB said the proposal goes against public interest and called upon the government as well as Bangladesh Bank to reject it, the statement added.

"A Bank Reporting Act is needed, but not to create obstacles on the way to disclosing information on corruption, irregularities and frauds, rather to create an environment so that such information can be disclosed freely," he added.

Claiming that the people have the right to get all sorts of information of corruption as well as positive ones about private banks, TIB said, the banking sector has no right to confuse people and spread corruption by creating obstacles to disclosing information.

TIB also stressed the need for forming an unbiased advisory committee to take effective measures and to identify short term, mid-term and long term strategy ensuring participation of all stakeholders to solve the ongoing crisis in the private banking sector.

Though these banks are run privately, the sector is truly dependent on public money. People have a right to know about negative information like corruption and irregularities alongside reporting on positive issues, Iftekharuzzaman said.

On Friday, Bangladesh Association of Banks, a platform of private banks, in a meeting with Finance Minister AMA Muhith submitted a nine-point proposal including protection from the government against what they say is negative reporting in the banking sector.

The country's banking sector is passing through a setback due to some hasty decisions made by a vested quarter, he said. "I urge the government not to push the banking sector towards the verge of an absolute collapse after being influenced by that vested quarter."

He also underscored the need for formation of a neutral advisory committee comprised of relevant experts to undertake effective steps towards eliminating the crisis in the banking sector.

  • Courtesy: The Daiy Star Apr 03, 2018