[সম্পাদকীয় নোটঃ মার্চ ২৮, ২০১৮ হংকংভিত্তিক এশীয় মানবাধিকার কমিশন ১১টি মানবাবাধিকার সংস্থা প্রদত্ত একটি যৌথবিবৃতি তাদের পক্ষ থেকে প্রকাশ করেছে। এই সংস্থাগুলি হলো — এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এসোসিয়েশন প্যারালা রিকু্পােররেশন দে লা মেমোরিয়া হিস্টোরিকা, এএফএডি, এডভোকেসি ফোরাম, ইন্টরন্যাশনাল কোয়ালিশন এগেনস্ট এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্সেস, ম্যাডরেজ দ্য প্লাজা দ্য মেয়ো, ফাইন্ড-ফ্যামিলিজ অব ভিক্টিমস অব ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস, ফেদেফ্যাম, কাতারি পানিতুরি ,উই রিমেম্বার, লেলস পি. দেমে টায়ারডেস ল অফেন্স]
ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ সরকার। দেশটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক এবং খুবই উদ্বেগজনক। তার ওপর ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিক্ষোভে প্রায়ই সহিংস আচরণকরছে দেশের আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এক ‘যৌথ বিবৃতিতে’ এসব কথা লিখেছে। এর শিরোনাম ‘বাংলাদেশ: ক্র্যাকডাউন অন অপজিশন প্রায়র টু ইলেকশনস ডেটেরিওরেটস দ্য হিউম্যান রাইটস সিটুয়েশন’ (BANGLADESH: Crackdown on opposition prior to elections deteriorates the Human Rights situation)।
দীর্ঘ এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার ব্যাপক আকারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। সব নাগরিকের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার এরই মধ্যে ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে জবরদস্তি গুম করা হযেছে ৪২২ জনকে। জড়িত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি পার্লামেন্টে এক বক্তব্যে এর পক্ষে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গুমকে যৌক্তিকতা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। বলেছেন, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও তো বিপুলসংখ্যক মানুষ নিখোঁজ হন। জোরপূর্বক গুমকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে গুমের ঘটনা ঘটে আসছে। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এ বিষয়ে দ্বিমত জানিযে বলেছে,প্রকৃত সত্য হলো, প্রধানমন্ত্রী যেসব দেশে গুমের কথা বলেছেন সেখানে কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে বলপ্রয়োগে গুমের ঘটনা ঘটেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ও ১৯৯৬ সালের জুন মাস বাদে অন্য কোনো দশকে কিন্তু বাংলাদেশে গুম হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এরপর থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১৪৮০টি। এই মারা্ত্মক ধারা বন্ধ হয়নি। নিরাপত্তা হেফাজতে পর্যায়ক্রমিক নির্যাতনে প্রাণ গেছে আরো ১২০ জনের।
অন্যদিকে পুলিশি নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় কয়েক ডজন ভিক্টিমের পায়ের মালাচাকিতে গুলি করার কারণে তারা স্থায়ীভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছেন। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ওই বিবৃতিতে আরো লিখেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলাকে কেন্দ্র করে ও ওই মামলায় পাঁচ বছরের জেল দেয়ার আগে পরে বিভিন্ন বাহিনী তাদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গণহারে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পোশাক পরা বা সাদা পোশাকের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন। এ বছর ৩০শে জানুয়ারি থেকে বিরোধী দলের কমপক্ষে ৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, আটক বা নির্যাতন করা হয়েছে। সম্প্রতি গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে। যাদের আটক করা হয়েছে তাদের পরিণতি এখনও অজ্ঞাত। পুলিশ এখনও এসব আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রকাশ করেনি তারা কোথায় আছে। আটক ব্যক্তিদের পরিবারগুলো অভিযোগ করছে, তাদের প্রিয়জনকে আটক রাখা হয়েছে কোনো গোপন বন্দিশিবিরে। সেখান থেকে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। তাদের অব্যাহতভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। নিখোঁজ করে দেয়া হচ্ছে। যেমনটা ঘটেছিল ২০১৩ সালের শেষের দিকে ও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনের সময়কালে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন তার প্রকাশিত যুক্ত বিবৃতিতে আরো লিখেছে, এরই মধ্যে এক ভয়াবহ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় অ্যাক্টর - রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা যেমন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সহায়তা করছে। নজরদারিও করছে। এক্ষেত্রে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
বিরোধী দলের ছাত্রবিষয়ক একজন নেতা জাকির হোসেনকে আটক করে পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হয়। এর তিন দিন পরে ১২ মার্চ তিনি মারা যান নির্যাতনে। তার সারা শরীরে ছিল ক্ষতচিহ্ন। তার হাত ও পায়ের আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ওই বিবৃতিতে আরো লিখেছে, সর্বশেষ ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যে দমনপীড়ন চলছে তা যুক্ত হয়েছে সরকারের অব্যাহতভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ বা জনসভার অধিকার প্রত্যাখ্যানের রীতির সঙ্গে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য জনসভায় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম হোক সেটা ইলেক্ট্রনিক বা ছাপার সংস্করণ, তার বেশির ভাগেরই মালিক অথবা নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারপন্থি ব্যবসায়ী বা সাংবাদিক। নির্বাসনে থাকা একজন বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশ করার কারণে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে মর্জিমাফিক গ্রেপ্তার করা হয়। ওই আটকের পর তিনিসহ আরো দুজন সাংবাদিক মাহাথির ফারুকী খান ও কনক সারোয়ার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন আরো লিখেছে, ওই টেলিভিশনের মালিকানা এর চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সরকারপন্থি একজন ব্যবসায়ীকে দেয়ার চেষ্টা করছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে অব্যাহতভাবে সরকারের নজরদারিতে, পর্যবেক্ষণে, হুকমিতে, নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিশোধপরায়ণতার মুখে রয়েছে- এটা হলো তার অন্যতম উদাহরণ।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন লিখেছে, গত নয় বছর ধরে অব্যাহতভাবে যেভাবে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে তা এটা নিশ্চিত করে যে, নির্যাতিতদের ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো জায়গা নেই অথবা তাদের সেই সক্ষমতা নেই। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে সরিয়ে তাকে জোর করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। এহলো বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উদাহরণ।
বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম করে দিতে বা ব্যাপকহারে বিচার বহির্ভূত হত্যা করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যস্ত রেখেছে সরকার। এসব ঘটানো হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারিরর নির্বাচনকে সামনে রেখে। সব বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। ফলে ক্ষমতাসীন দল ও তার মিত্ররা ১৫৩টি আসন নিয়ে নেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। নির্বাচনে কোনো ভোট পড়ার আগে এ ঘটনাটি ঘটেছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আসন রয়েছে মোট ৩০০। এখন সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা সেই একই ধারায় অগ্রসর হচ্ছে। একই রকমভাবে দমনপীড়ন চালাবে। যাকেই তারা শাসকগোষ্ঠীর জন্য হুমকি মনে করবে তার বিরুদ্ধেই এমন ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, এখানে জাতীয় প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭ ভাগের ওপরে। যুদ্ধকবলিত দেশগুলো থেকে ২০১৭ সালে ইউরোপে যেসব উদ্বাস্তু বা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন তার মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক হলো বাংলাদেশি। বিশ্বে শতকরা ৭ ভাগের বেশি জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এমন কোনো দেশের এমন সংখ্যক শরণার্থী নেই।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন লিখেছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার বিপর্যয়ের এত সব বাস্তবতা সত্ত্বেও অপ্রত্যাশিতভাবে নীরব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সরকার আন্তর্জাতিক দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ইস্যুতে। দেশের অভ্যন্তরে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য শক্ত বর্ম হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার জন্য বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য একটি নির্বাচনের পরিবেশ জরুরি ভিত্তিতে সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তে একটি বিশ্বাসযোগ্য গণতন্ত্রের জন্য মানবাধিকার পরিস্থিতিতে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।
- সূত্র — Asian Human Rights Commission, Hong Kong। ওয়েবসাইট - humanrights.asia