ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮৭ টাকা পর্যন্ত
হাছান আদনান
দেশে ভোগ্যপণ্য আমদানির বড় প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপ। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ৬০ লাখ ডলারের এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলেছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এলসির দায় পরিশোধ করতে পারছিল না ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি বড় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েও প্রত্যাশিত ডলার না পেয়ে গত সপ্তাহে বিকল্প উপায় হিসেবে ওডির মাধ্যমে এলসির দায় পরিশোধ করতে হয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংককে।
ফান্ড সংকটের কারণে কোনো ব্যাংক আমদানি দায় পরিশোধ করতে না পারলে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নস্ট্রা অ্যাকাউন্ট ওডি করে দেয়া হয়। যেকোনো ব্যাংকের জন্যই এটি বিপজ্জনক ধাপ। এর মাধ্যমে ব্যাংক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মতোই অবস্থা দেশের অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের। আমদানি দায় পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রমতে, নতুন প্রজন্মের নয়টি ব্যাংক ছাড়াও এ তালিকায় আছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), বাংলাদেশ কমার্স, প্রিমিয়ার, ঢাকা, এক্সিম, আইএফআইসির মতো ব্যাংকও।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই খাদ্যশস্যসহ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির বিপুলসংখ্যক এলসি খুলতে হয়েছে। সে তুলনায় রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় না বাড়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে এলসির দায় পরিশোধে অন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে অনেক ব্যাংককে।
সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কামাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, কিছু ব্যাংক সক্ষমতার বেশি এলসি খুলেছে। ফলে এখন এলসির দায় পরিশোধ করতে পারছে না। আমরা বেশি মূল্য দিয়ে হলেও রেমিট্যান্স কিনে ডলারের ভিত মজবুত করেছি। এ কারণে অনেক ব্যাংকই আমাদের কাছে ডলার কিনতে আসছে।
সূত্রমতে, চাহিদা মেটাতে প্রতিদিনই ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ছেড়েছে ১৮০ কোটি ডলারের বেশি। এর পরও থামছে না টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৭৯ টাকা ৭০ পয়সা। চলতি বছরের একই দিন ৪ শতাংশ বেড়ে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮২ টাকা ৯৬ পয়সায়।
যদিও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তথ্যমতে, ডলার বিক্রি হচ্ছে আরো বেশি দামে। বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের ঘোষিত মূল্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং চ্যানেলে গতকাল ডলারপ্রতি ক্রয়মূল্য ছিল ৮২ টাকা ৫০ পয়সা ও বিক্রয়মূল্য ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা। এনসিসি ব্যাংকের মতোই গতকাল ডলারের মূল্য ঘোষণা করে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। যদিও অধিকাংশ ব্যাংকই ঘোষিত মূল্যের বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। গত সপ্তাহের শেষ দুই কর্মদিবসে প্রায় সব ব্যাংকই ৮৪ থেকে ৮৬ টাকায় ডলার বিক্রি করেছে। আর খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) ৮৭ টাকার বেশি দামেও ডলার বিক্রি হয়েছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে ভালো ব্যাংকগুলোকেও আমদানি দায় পরিশোধে সমস্যায় পড়তে হবে বলে জানান ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রেমিট্যান্স কম থাকলেও ঢাকা ব্যাংকের রফতানি আয় ভালো। ফলে এ মুহূর্তে আমদানি ব্যয় মেটাতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে না। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে আগামীতে ভালো ব্যাংকগুলোকেও আমদানি দায় পরিশোধে বিপত্তিতে পড়তে হতে পারে।
তবে কিছু ব্যাংক ঘোষিত মূল্য লঙ্ঘন করে ডলার কিনে বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেন এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে মাঝে মাঝে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনছি। তবে এ মুহূর্তে আমাদের হাতে চাহিদার অতিরিক্ত ডলার সংরক্ষিত আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দুই বছর ধরেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান মাধ্যম রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহে ভাটা পড়েছে। অন্যদিকে রেকর্ড পরিমাণ চালসহ খাদ্যশস্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হওয়ায় বেড়েছে আমদানি ব্যয় পরিশোধ। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশের চলতি হিসাবে ৫৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এ সাত মাসে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৮৯ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের চলতি হিসাবে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৫ হাজার ২০ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৬০ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি। একই সময়ে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে।
অথচ এ সময়ে রফতানি আয় বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক শূন্য ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আড়াই শতাংশ কমার পর গত অর্থবছর রেমিট্যান্স সাড়ে ১৪ শতাংশ কমেছে। সেই সঙ্গে গত অর্থবছর আমদানিতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে রফতানি আয় বাড়ে মাত্র ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। এমন অবস্থায় ডলার সংকটে পড়ে অনেকেই পূবালী ব্যাংকের কাছে আসছে বলে জানান ব্যাংকটির এমডি মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী। তিনি বলেন, রফতানি আয় কম থাকা ব্যাংকগুলো এলসির দায় পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে ওইসব ব্যাংকের বড় গ্রাহকরা আমাদের কাছে আসছে। এ কারণে আমরা যাচাই-বাছাই করে এলসি খোলার সুযোগ পাচ্ছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো নিজেদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা ধরে রাখতে পারে না। এজন্য নির্ধারিত সীমা বেঁধে দেয়া হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক দিন শেষে তার মোট মূলধনের ১৫ শতাংশ সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করতে পারে। নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ডলার থাকলে দিন শেষে বাজারে বিক্রি করতে হয়। বিক্রি করতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হয়। এর ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়।
ডলারের বাজারের বিদ্যমান সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণের এ হার কমিয়ে দেয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, বড় ব্যাংকগুলো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণের সুযোগ নিচ্ছে। এ কারণে বাজারে ডলার সংকট কাটছে না। সংরক্ষণের হার কিছুটা কমিয়ে দিলে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ডলার বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হবে।
ডলারের বাজারের বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজর রাখছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র দেবাশিস চক্রবর্ত্তী। তিনি বলেন, পরিস্থিতি সহনশীল রাখতে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছি। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়তে শুরু করেছে। ফলে পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আমরা আশাবাদী।
- Courtesy: Banikbarta Apr 09, 2018