Search

Sunday, April 8, 2018

কী ভয়ঙ্কর আগ্রাসী ঋণ

হারুন-অর-রশিদ


বিধি ভঙ্গ করে ১৬ বাণিজ্যিক ব্যাংক ভয়ঙ্করভাবে আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে তিনটি হচ্ছে ইসলামি ব্যাংক ও বাকি ১৩টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক। আরও ১৯ ব্যাংক আগ্রাসী সীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। মাঝেমধ্যেই তারা সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। ফলে ওই ব্যাংকগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তদারকি জোরদার করেও আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধ করা যাচ্ছে না।

ব্যাংকগুলো হচ্ছে ফারমার্স ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এবি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। এর বাইরে যমুনা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর আগ্রাসী ব্যাংকিং করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা (এএলএম) নীতিমালা অনুসারে সাধারণত ব্যাংকগুলো সংগৃহীত আমানতের ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই সীমা ৮৫ শতাংশ। কিন্তু অন্যান্য আর্থিক সূচক ভালো থাকলে সাধারণ ব্যাংকগুলো সংগৃহীত আমানতের ৮৫ শতাংশ এবং ইসলামি ব্যাংকগুলো ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। গত জানুয়ারিতে এটি কমিয়ে সাধারণ ব্যাংকগুলোর জন্য সাড়ে ৮৩ শতাংশ এবং ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৯ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে, যা চলতি মাস থেকে কার্যকর করতে হবে। আমানতের কী পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে তা সাপ্তাহিক ভিত্তিকে পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংকগুলো পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

এই সীমার বেশি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। এর চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করলে একদিকে তারল্য সংকট প্রকট হয়। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাবে। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সীমার বেশি ঋণ বিতরণ করলে জরিমানা আরও করে। ইতোমধ্যে আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের দায়ে ওয়ান ব্যাংক প্রিমিয়ার ব্যাংককে জরিমানা করেছে। আরও কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের এডিআর প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১২টি ব্যাংক সীমার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক মোট আমানতের ১০৫ দশমিক ২৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক তাদের আমানতের ১০০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। অর্থাৎ তারা সংগৃহীত আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে তারা তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংক আমানতের ৯০.৮২ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ৯০.১৪, ন্যাশনাল ব্যাংক আমানতের ৮৮.০৭, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক আমানতের ৮৬.৩৭, এবি ব্যাংক ৮৬.২৪, মেঘনা ব্যাংক আমানতের ৮৬.১৪, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক আমানতের ৮৬, সিটি ব্যাংক আমানতের ৮৫.২৯, আইএফআইসি ব্যাংক আমানতের ৮৫.০৮, ট্রাস্ট ব্যাংক আমানতের ৮৫.০৩ শতাংশ এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক আমানতের ৯০.১৭ শতাংশ ঋণ হিসাবে বিতরণ করেছে।

এর বাইরে যমুনা ব্যাংকের ইসলামিক উইন্ডো থেকে সংগৃহীত আমানতের ১২৫.১৬ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামিক উইন্ডো থেকে সংগৃহীত আমানতের ১২৪.৮৪ শতাংশ ও অগ্রণী ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডো তাদের মোট আমানতের ১২১.০৫ শতাংশ ঋণ হিসাবে বিতরণ করেছে।

এসব ব্যাংক সীমার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করায় তারা ব্যাংলাদেশ ব্যাংকে বিধিবদ্ধ আমানত রাখতে পারছে না। আর রাখলেও তা কলমানি থেকে ধার করে রাখছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে গেছে।

সীমা অতিরিক্ত ঋণের বিষয়ে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুন ইসলাম মজুমদার বলেন, বিভিন্ন কারণে বিনিয়োগের চাহিদা বেড়েছে। দেশের অর্থনীতির সুবিধার্থে ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করেছে। এ জন্য সীমার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে।

প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, আরও প্রায় ১৯ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ আইনি সীমার কাছাকাছি রয়েছে। কোনো কোনো সপ্তাহে এই ব্যাংকগুলোর সীমা বিধির বাইরে চলে যায়। আমানত সংগ্রহ বাড়লে তা আবার নির্দেশিত সীমার মধ্যে নেমে আসে। বিপজ্জনক সীমার কাছাকাছি থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে আছে ওয়ান ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক. ব্র্যাক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক মধুমতি ব্যাংক সাউথ-ইস্ট ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক ও মিডল্যান্ড ব্যাংক। এ ছাড়া ইসলামি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক ঝুঁকির কাছাকাছি রয়েছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশে বিভিন্ন প্রয়োজনে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। 

যে কারণে অভ্যন্তরীণভাবে ঋণের চাহিদা বেড়েছে। একদিকে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে, সেই তুলনায় আমানত বাড়েনি। অন্যদিকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কারণে সরকারি সংস্থাগুলো আমানত তুলে নিয়েছে। এ জন্য কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণ বিতরণ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনের বছরে আরও ঋণের চাহিদা বাড়বে। এ জন্য ঋণ বিতরণের সীমা আরও বাড়ানোর দাবি করেছিলাম।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ, যাচাই-বাছাই ছাড়া বেপরোয়া ঋণ এবং বিচারহীনতা ইত্যাদি কারণে ব্যাংকিং খাতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এসব জায়গায় হাত দেওয়া হচ্ছে না।

  • আমাদের সময়/এপ্রিল ৭,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment