- ২৫ মাদক ব্যবসায়ী জোগানদাতা
- ক্যাম্প ইনচার্জ বাচ্চু ও ক্যাশিয়ার শামীম বেপরোয়া
- হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে শঙ্কিত মানুষ
দেশের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ঢুকে পড়েছে ইয়াবার বিষ।
দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেও ঢামেক হাসপাতালের অন্তত ১৫টি স্পটে হরদম চলছে ইয়াবা সেবনের আসর। অভিযোগ, ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই (এবি) বাচ্চু মিয়ার সহযোগিতায় এসব মাদকের আসর বসে।
প্রতি আসর থেকে বাচ্চু নিজে নতুবা তার ক্যাশিয়ার আনসার শামীম টাকা নেয়। শুধু তাই নয় বাচ্চুর সহযোগিতায় চানখাঁরপুল ও চকবাজার এলাকার পেশাদার ইয়াবা ব্যবসায়ীরা হাসপাতালে ইয়াবা সাপ্লাই দেন।
শনিবার ঢামেক হাসপাতাল এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। মাদকের কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে চরম উদ্বেগের সৃষ্টি হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
এ কারণে তাদের অনেকে বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিকত-উৎকণ্ঠিত। জানা গেছে, হাসপাতালে মাদক সহজলভ্য হওয়ায় কতিপয় চিকিৎসক, শিক্ষানবিস চিকিৎসক, নার্স, ব্রাদার, ওয়ার্ডবয়, স্পেশালবয়সহ সেবার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের একটি অংশ ইয়াবা, গাঁজা ও হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকের নেশায় ঝুঁকে পড়ছেন।
অভিযোগ সম্পর্কে বাচ্চু মিয়া যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালে মাদক ব্যবসা হয়- বিষয়টি তার জানা নেই। তিনি বলেন, গত পরশুও শাহবাগ থানার ওসিকে নিয়ে অভিযান চালানো হয়েছে।
তবে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া, ইয়াবার আসর থেকে টাকা তোলার বিষয়ে প্রশ্ন করতেই বাচ্চু মিয়া ফোনলাইন কেটে দেন। এরপর তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। সরাসরি যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এ সংবাদ যাতে প্রকাশ করা না হয় সেজন্য একাধিক ব্যক্তিকে দিয়ে এ প্রতিবেদককে ফোন করিয়েছেন বাচ্চু মিয়া।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শাহ আলম তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, মাদকাসক্তি এক ধরনের অসুস্থতা। তাই কোনো মাদকাসক্তের হাতে রোগীর শতভাগ চিকিৎসা কিংবা সেবা আশা করা যায় না। তিনি বলেন, হাসপাতালের কোনো কর্মচারী মাদকে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া মাদকসহ যে কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দেয়া আছে।
ঢামেক হাসপাতালে মাদক সেবনের চিত্র : শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঢামেক হাসপাতালের সাবেক পিজি ডক্টর কিচেনের একটি রুমে ইয়াবা সেবন করছিল পাঁচ যুবক। তাদের মধ্যে কয়েকজন এ হাসপাতালের কর্মচারী। ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া ওই রুমে প্রবেশ করে ৫ মিনিটের মাথায় বেরিয়ে আসেন। এর কিছুক্ষণ পর ওই যুবকরা বেরিয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এখানে দিনে কমপক্ষে পাঁচ দফা ইয়াবা সেবনের আসর বসে। প্রতি আসর থেকে ১০০ টাকা করে নেন বাচ্চু। বিকাল ৫টায় হাসপাতাল-২ এর ছাদে বসে ইয়াবা সেবন করছিলেন ছয়জন।
এক রোগীর স্বজন বিল্লাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ছাদে গেলে দেখবেন, ডাক্তার-কর্মচারীরা গোল হয়ে বসে ইয়াবা টানছেন। দিন-দুপুরে যারা নেশা করেন তারা রোগীর সেবা কিংবা চিকিৎসা দেবেন কি করে?
বিকাল সাড়ে ৫টায় মিলন অডিটরিয়ামের পাশে বসে কয়েকজন যুবককে নেশা করতে দেখা যায়। ওই এলাকার ভ্রাম্যমাণ বাদাম বিক্রেতা আজিম যুগান্তরকে বলেন, মিলন অডিটরিয়াম, মর্গের পেছন ও কলেজ চত্বরের বিভিন্ন চিপা গলিতে বসে ইয়াবার আসর।
পুলিশ ও আনসার তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। ঢামেক হাসপাতাল এলাকার এ ধরনের অন্তত ১৫টি পয়েন্টে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে ইয়াবা সেবন। এসব পয়েন্টে হোম ডেলিভারি পদ্ধতিতে মাদকাসক্তদের চাহিদা অনুযায়ী মাদকদ্রব্য পৌঁছে যায়।
ঢামেক হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী যুগান্তরকে জানান, পুরাতন পিজি ডাক্তার হোস্টেলের কিচেন ও এর আশপাশ, ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগ, শহীদ মিনারের পেছনে মাজার সংলগ্ন এলাকা, নার্সিং হোস্টেলের পাশ, কলেজের শহীদ ডা. মিলন অডিটরিয়াম এলাকা, মর্গ এলাকা, জরুরি বিভাগ সংলগ্ন পানির ট্যাংকি এলাকা এবং বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আশপাশের ফাঁকা জায়গা, হাসপাতাল-২ এর ছাদ হল ইয়াবা সেবনের নিরাপদ আস্তানা। শুধু এসব স্পটই নয়, হাসপাতালের বিভিন্ন বাথরুমকে মাদকসেবীরা সেবনের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি পয়েন্ট থেকে এসআই বাচ্চু মিয়া ও তার ক্যাশিয়ার আনসার শামীম টাকা নেন। মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও বাচ্চু মিয়া মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা নিচ্ছেন। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে একটি বিশেষ বাহিনী দিয়ে সাইজ করানোর হুমকি দেন তিনি। এছাড়া পুলিশ সদর দফতরের একজন প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাকে নিজের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অপকর্ম করছেন বাচ্চু মিয়া।
ঢামেক হাসপাতালের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, চকবাজার, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচরসহ আশপাশের মাদক ব্যবসায়ীরা হোম ডেলিভারির মাধ্যমে এ হাসপাতাল এলাকায় ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সরবরাহ করেন। হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী যুগান্তরকে জানান, চকবাজার থানার হোসনি দালানের ইয়াবা জাফর, নেতা সুমন, আসিক, অনিক, পাপন, হাসান, জাহাঙ্গীরসহ বেশ কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ী ঢামেক হাসপাতালে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে তাদের ঘোরাফেরা করতেও দেখা যায়।
একজন স্পেশাল বয় যুগান্তরকে বলেন, বাচ্চু মিয়াকে মাদক ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে মাদক ব্যবসা করেন। হাসপাতাল এলাকায় শাহীন, চণ্ডি, আয়েশা ও আছিয়া, কলেজ ক্যাম্পাস ও ডা. মিলন অডিটরিয়াম এলাকায় লাবু, বুলবুলি মাদক সম্রাট বলে পরিচিত। বার্ন ইউনিটসংলগ্ন এলাকায় স্বপন ও রনি ইয়াবার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। নতুন ভবনের সামনে ব্যবসা চালান ইয়ার হোসেন ওরফে চিনচিন। র্যাবের হাতে তিনি ইয়াবাসহ আটকও হয়েছিলেন। তার সহযোগী বিল্লাল, হেদায়েত, মোমেন এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ঢামেক হাসপাতাল এলাকায় আজম বিল্লাল, লাক্কা লাভলু, আমীর, আয়েশা, বুলবুলিসহ বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঢামেক হাসপাতালের কিছু স্টাফ মাদক ব্যবসায় জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এছাড়া হাসপাতাল এলাকায় ভবঘুরে, বখাটে ও রিকশাওয়ালার ছদ্মবেশেও মাদক বিক্রি চলে। তাদের কাছ থেকে মাদক কিনে ঢামেক হাসপাতালের টয়লেট এবং বিভিন্ন রুম এবং দেয়ালঘেঁষা নির্জন স্থানে বসে মাদকাসক্তরা মাদক সেবন করছেন। আবার কেউ কিছু বললে মাদকসেবীরা তার ওপর হামলা চালায়। ফলে ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীর একটি অংশ মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। এ বিষয়টি নিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিয়মিত মাদক সেবন করা একজন চিকিৎসকের জন্য চরম গর্হিত কাজ। যা চিকিৎসা পেশার নৈতিকতার পরিপন্থী। এর ফলে রোগী ও সাধারণ মানুষ চিকিৎসকদের ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলবেন। বিষয়টি হাসপাতালের ভাবমূর্তির জন্যও ক্ষতিকর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, দু-একজন জুনিয়র চিকিৎসক মদ-গাঁজা খান। এটা নতুন কিছু নয়। তবে কিছুদিন ধরে এমন অবস্থা বিরাজ করছে- যেন পুরো হাসপাতালটাই মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
তারা জানান, বহিরাগত মাদকসেবীদের সঙ্গে কলেজ ও হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক মাদক সেবন করছেন। কর্মচারীদেরও কেউ কেউ মাদক সেবনে জড়িত। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবসার অভিযোগও আছে।
তারা বলেন, চিকিৎসক-কর্মচারীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় এ হাসপাতালের সুনাম ও ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলবে। সুনাম ও ভাবমূর্তি রক্ষা তথা রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা দেয়া নিশ্চিত করতে অনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধে সরকারের প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ খুবই জরুরি।
- কার্টেসিঃ যুগান্তর /মে ২৭,২০১৮