আনু মুহাম্মদ
প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার আগে আগে সাংবাদিকরা অভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন— ‘এই বছরের বাজেট থেকে আপনার কী প্রত্যাশা?’ আমার বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছা করছে, ‘জনগণের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?’
বাজেট থেকে আলাদা করে আমাদের কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? অর্থনীতি যে সামগ্রিক পরিকল্পনা, নীতিকাঠামো এবং প্রভাববলয় দিয়ে পরিচালিত হয়, তা অব্যাহত রাখাই প্রতি বছরের বাজেটের কাজ। বাজেট নিজে নিজে কোনো নতুন মোড় নিতে পারে না। কর-শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে যে ওঠানামা হয়, তা এ পরিকল্পনারই অংশ। যেমন— অনেক ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি করে দেশে উৎপাদন করলে শুল্ক বেশি, চূড়ান্ত পণ্য দেশে আমদানি করলে শুল্ক কম। এটা হঠাৎ করে ঘটে না, ঘটে শিল্পোদ্যোক্তার চেয়ে আমদানিকারকমুখী অর্থনীতি পরিচালনার নীতির প্রকাশ হিসেবে।
যেমন— জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অপরাধীদের দায়মুক্তি আইন দিয়ে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, অনিয়ম এবং প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী প্রকল্প করা হচ্ছে একের পর এক। বাজেট কি এ আইন বাতিল করে পুরো খাতে স্বচ্ছতা আনবে? রামপাল, রূপপুরসহ এসব সর্বনাশা প্রকল্প ও চুক্তি বন্ধ করবে? সরকারের নীতিগত অবস্থানে পরিবর্তন ছাড়া বাজেট এগুলো কিছুই করবে না। বরং বাজেট এসব প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে তার বিধ্বংসী তত্পরতা নিশ্চিত করবে।
বাজেট ঘোষণার আগে অর্থমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে জানিয়েছেন, উন্নয়ন বাজেটে সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত প্রথমে যোগাযোগ ও পরিবহন এবং দ্বিতীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। কোনো সন্দেহ নেই, এ দুটো খাতেই সরকারের অর্থ বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি। এতে কি আমাদের আনন্দিত হওয়ার কথা? অর্থ বরাদ্দ বেশি মানেই যে বেশি উন্নয়ন নয়, তা কাণ্ডজ্ঞান থেকেই বোঝা সম্ভব। কারণ প্রথমত. যে কাজ ১০০ টাকায় করা সম্ভব, তা যদি করা হয় ৫০০ টাকায়, তাহলে বাজেটের আকার বড় হয়, জিডিপিরও বৃদ্ধি ঘটে কিন্তু তা চরম অদক্ষতা এবং/অথবা বড় আকারের দুর্নীতির কথা জানান দেয়। বাংলাদেশ এরই মধ্যে সড়ক-সেতু-বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছে। এসব ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তো বটেই ইউরোপ-আমেরিকার অনেক ব্যয়বহুল অর্থনীতির তুলনায়ও বাংলাদেশে সড়ক সেতু বানানোর খরচ অনেক বেশি। আবার গুণগত মানও যে খারাপ, তা মানুষের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। তাহলে এই যে বাড়তি বিপুল টাকা, তা যায় কোথায়? সহজেই বোঝা যায়, তা যায় ক্ষমতাবানদের পকেটে, তা দেশের চোরাই অর্থনীতির আকার বাড়ায় আর সম্পদ দেশের বাইরে পাচার হয়। তাহলে বাজেট কী করতে পারে? বাজেট এসব দুর্নীতি-অনিয়মকেই বৈধতা দিতে পারে, সেটাই যে দেবে, তা অর্থমন্ত্রীর কথা থেকে বোঝাই যাচ্ছে।
ব্যাংক খাত নিয়ে বহু অবিশ্বাস্য ঘটনার কিছু কিছু দেশের মানুষ সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের কোষাগার লুণ্ঠন, বহু হাজার কোটি টাকা লোপাটের খবর সবার জানা। এটাও জানা যে, এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। শুধু এসব ব্যাংকই নয়, যেকোনো অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষিত প্রতিষ্ঠান হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশে যার নাম বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানেই ফুটা করে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে। অন্য দেশের সংবাদপত্রের খবর থেকে আমরা জেনেছি এ বিষয়, আরো হয়েছে কিনা জানি না। দেশে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের নির্লিপ্ত ভাব বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। অর্থমন্ত্রী মাঝেমধ্যে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার জন্য উচ্চস্বরে কথা বলেন, কিন্তু এ দুর্গ লুণ্ঠনের কারণ অনুসন্ধান, অপরাধীদের পাকড়াও করার ব্যাপারে তার বা সরকারের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। বরং এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি আড়াল করাতেই তাদের সক্রিয়তা বেশি।
ব্যাংকিং খাতে এসব তত্পরতায় এসব প্রতিষ্ঠান যখন তহবিল সংকটে, তখন সরকার করের আওতা বাড়িয়ে মানুষের ওপর চাপ আরো বাড়িয়ে সেই টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে এসব ব্যাংকে। তলাবিহীন ঝুড়িতে ক্রমাগত যত টাকা যাবে, তার সবই ফাটা তলা দিয়ে চলে যাবে অন্য কারো পকেটে। সরকারের তাতে কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। বাজেট সেই বরাদ্দই দিতে যাচ্ছে, তাহলে বাজেট আর কী পরিবর্তন করবে?
এ বছরও বলা হবে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ। অংকের ফাঁকি অব্যাহত থাকবে। চিকিৎসা খাতেও অনেক সাফল্যের গল্প বলা হবে। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও সরকারের উচ্চপদের ব্যক্তিরা দেশের ভেতর চিকিৎসা করানোর মতো হাসপাতাল তৈরি করতে পারেননি। তারা জনগণের অর্থে মেডিক্যাল চেকআপ করতেও বিদেশে যান।
অর্থশাস্ত্রের গতানুগতিক প্রশিক্ষণে বড় হওয়া অর্থনীতিবিদরা শুধু সংখ্যা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। জিডিপি, বিনিয়োগ; তারা সংখ্যার বাইরে আর কিছু দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না। সব সরকারের জন্য সেটাই নিরাপদ। তার ফলে জিডিপি বৃদ্ধি কীভাবে হচ্ছে, বিনিয়োগ কোথায় হচ্ছে, তার ফলাফল বা প্রভাব কী, তা মনোযোগের বাইরে থাকে। বিভিন্ন প্রকল্পে যদি উচ্চহারে দুর্নীতি হয়, সেসব প্রকল্প যদি দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলেও বাজেটে বড় সংখ্যা দেখা যাবে, জিডিপি বৃদ্ধিতে সরকারি ব্যয় তাই উত্তরোত্তর বাড়ছে। এ বৃদ্ধি সামাল দিতে করের আওতা বাড়ছে। দুটোতেই বাজেটের চেহারা আরো ভালো দেখায়। জনগণ কর দিচ্ছে সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সার্ভিস পেতে। অর্থনীতিবিদরা জিডিপি-কর অনুপাত নিয়ে অনেক কথা বলেন, এবং এ অনুপাত বৃদ্ধি করতে অর্থাৎ আরো কর বাড়াতে সুপারিশও করেন। কিন্তু তাঁরা কর-সার্ভিস অনুপাত, অর্থাৎ কতটা কর দিচ্ছি, তার বিনিময়ে কতটা সার্ভিস পাচ্ছি সেই অনুপাত, কখনো পরীক্ষা করেন না। আমরাই ভ্যাটসহ নানা মাধ্যমে সরকারকে কর দিই, সরকারের টাকা বলে আলাদা কিছু নেই।
সরকার সেই টাকাতেই সরকার চালায়, সরকারের সব প্রতিষ্ঠান চলে তা দিয়েই। ঋণ দেয়ার কারণে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ নানা সংস্থা প্রতিনিয়ত ছড়ি চালায়, তাদের শর্ত মেনে নিয়ে কত কিছু করে সরকার, জনগণের ওপর কত বোঝা বসায়। অথচ যারা মূল অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত করে, সেই জনগণের মতামতের কোনো গুরুত্ব থাকে না। জনগণের টাকা, কিন্তু সরকারি শানশওকতে খরচ হয় সেই টাকা নির্দ্বিধায়, সর্বজনের অর্থে প্রতিপালিত পুলিশ শ্রমজীবী অনাহারী মানুষের ওপর নির্যাতন করে, ক্রসফায়ার, আটক বাণিজ্য নিয়ে তারা ব্যস্ত থাকলেও জনগণের দিক থেকে প্রতিকার পাওয়ার উপায় থাকে না। ভুল বা জনবিধ্বংসী প্রকল্প নিয়ে জনমত বিবেচনারও প্রয়োজন মনে করে না সরকার। জনমত নিয়ে সরকারের বিন্দুমাত্র দায়বোধ থাকলে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প অনেক আগেই বাতিল হতো।
এসব দেখে-শুনে আমার তাই প্রশ্ন, সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা করার যেখানে কোনো সুযোগই নেই, সেখানে জনগণের কাছে কী প্রত্যাশা নিয়ে সরকার তার যা খুশি তাই কাজ চালাচ্ছে? জনগণ সম্পর্কে সরকার কী মনে করে? কী ধারণা থাকলে সরকার এভাবে কাজ করতে পারে? একটা তালিকার কয়েকটি পয়েন্ট হতে পারে এ রকম:
প্রতিদিন শহরের ভেতর কিংবা মহাসড়কে ভয়াবহ ভোগান্তিতেও জনগণ মন খারাপ করবে না, রাগ করবে না। যতই হাত-পা ভাঙুক, কষ্ট হোক, স্কুলে শিশুদের, হাসপাতালে রোগীদের যেতে যতই সমস্যা হোক, মানুষ মুগ্ধ হয়ে বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকবে, টিভি পত্রিকার বিজ্ঞাপন ও বাণীর কথা মনে রাখবে। ভাবতে থাকবে, অসুবিধা কী? পদ্মা সেতু তো হচ্ছে।
একটু বৃষ্টিতে ঢাকা শহর অচল হয়ে গেলে, ড্রেন উপচে পড়লে, গ্যাস-পানি সংকট চলতে থাকলেও মানুষ বিরক্ত হবে না। তাঁরা বরং খুশি হয়ে দেখবে সরকার এবং দক্ষিণ মেয়রের সাফল্য নিয়ে শহরজুড়ে প্রচারণা।
সার্ভিস না থাকলেও কর যতই বাড়ানো হোক, মানুষ তা হাসিমুখে পরিশোধ করবে, কারণ দেশে উন্নয়ন চলছে।
ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কারসাজি, সম্পদ পাচার হলেও মানুষ খুশি থাকবে এটা ভেবে যে, এ লুণ্ঠনকারীরা নিশ্চয়ই দেশের উন্নয়ন করছে!
নিয়োগ বাণিজ্য আর আটক বাণিজ্যে বিপর্যস্ত হলেও মানুষ খুশি থাকবে, কারণ দেশে উন্নয়ন চলছে। সড়ক দুর্ঘটনা, ক্রসফায়ার, সরকারি দলের লোকজনদের দখল-সন্ত্রাস দেখেও মানুষ ভাববে, উন্নয়ন চাইলে কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে!
রামপাল প্রকল্পসহ দেশের রক্ষাপ্রাচীর সুন্দরবন বিনাশের সব আয়োজনে, নদী-পাহাড় দখলে মানুষ খুশি থাকবে। জনগণকে না জানিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে অচিন্তনীয় মাত্রার বিপজ্জনক, বিশাল ঋণনির্ভর বোঝা তৈরি করতে থাকলেও মানুষ খুশি থাকবে। কারণ দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। জনগণের প্রতি সরকারের এ প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হচ্ছে/হবে, সেটা চাইলে সরকার নিজেই জানতে পারবে।
- লেখক: অর্থনীতিবিদ/ অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- Courtesy: BanikBarta /May 31, 2018