বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন
দেশে রেকর্ড আমদানির দায় পরিশোধ নিয়ে ব্যাংকারদের উদ্বেগ আর উত্কণ্ঠা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বাজারে ডলারের সংকট। চলতি বছরের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী মার্কিন মুদ্রাটির বিনিময় হার। এদিকে আমানত নিয়েও হাহাকার চলছে ব্যাংকগুলোতে। আর্থিক খাতে এ পরিস্থিতির মধ্যেই ক্রমে বাড়ছে সন্দেহজনক লেনদেন।
দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) বার্ষিক প্রতিবেদনে সন্দেহজনক বা অস্বাভাবিক লেনদেন ও তত্পরতা বৃদ্ধির তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আর্থিক খাতে সন্দেহজনক ২ হাজার ৩৫৭টি লেনদেন ও তত্পরতার তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এমন লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৮৭। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
কর্মকর্তারা বলছেন, আগেও দেশে সন্দেহজনক লেনদেন হতো। নানা কারণে সংশ্লিষ্টরা বিএফআইইউকে সে তথ্য দিতেন না। কিন্তু বিএফআইইউর তত্পরতায় ব্যাংকারসহ খাতসংশ্লিষ্টদের সচেতনতা বেড়েছে। ফলে আগের তুলনায় সংস্থাটির কাছে সন্দেহজনক লেনদেন ও কর্মকাণ্ডের তথ্য বেশি এসেছে।
আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিতকরণ, নগদ লেনদেনে নজরদারিসহ মুদ্রা পাচার রোধে কাজ করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের কর্মকাণ্ড নিয়ে গতকাল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ঘুষ-দুর্নীতি, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, মানব পাচার, চোরাচালান, মুদ্রা জাল, অর্থ পাচার ও সম্ভাব্য বেআইনি লেনদেন হলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানি বিএফআইইউতে রিপোর্ট করে। যাকে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) বলা হয়। আবার ১০ লাখ টাকা বা তার বেশি যেকোনো ধরনের নগদ লেনদেন হলে তার তথ্যও বিএফআইইউতে পাঠাতে হয়। তবে সন্দেহজনক লেনদেন বা কর্মকাণ্ড মানেই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এমনটা নয়।
এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউর প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন কোনো অপরাধ নয়। লেনদেনে অপরাধের উপাদান পাওয়া গেলে তবেই সেটি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিএফআইইউর কাছে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বেশি জমা পড়া প্রতিষ্ঠানটির সফলতারই নির্দেশক। আগে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য জমা দিতে ভয় পেত। কিন্তু আমাদের তত্পরতা ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির কারণে সংশ্লিষ্টদের মন থেকে ভয় দূর হয়েছে।
তিনি বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন আগেও ছিল। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলোর সচেতনতার কারণে বিএফআইইউর সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিং বেড়েছে। সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্যগুলো দিয়ে আমরা একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করছি। এ তথ্যভাণ্ডার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানেও কাজে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে কারো বিষয়ে অনুসন্ধান করার দরকার হলে, আমরা মানসম্মত প্রতিবেদন তৈরি করতে পারব। এছাড়া সন্দেহজনক লেনদেনগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আমরা খতিয়ে দেখছি। অনুসন্ধানে অপরাধের উপাদান পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য জমা পড়েছিল ৪১৬টি। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে এমন লেনদেনের সংখ্যা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬২১টি, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ১ হাজার ৯৪ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৮৭টি সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য জমা পড়ে বিএফআইইউতে। বিদায়ী অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন ও তত্পরতা ৩৯ দশমিক ৭২ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৩৫৭টিতে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে ১৯৬টি সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য জমা হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের অক্টোবর, নভেম্বর এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে শুধু বিদায়ী বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ৩২৯টি সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বিএফআইইউতে জমা পড়ে। ব্যাংক, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই), অর্থ প্রেরক (মানি রেমিটার) এবং পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে এসব অভিযোগ জমা পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির কাছে। বিএফআইইউর কাছে জমা পড়া সন্দেহজনক লেনদেনের মধ্যে ৭০ দশমিক ৫৬ শতাংশই ছিল ব্যাংকের। এছাড়া অর্থ প্রেরকের কাছ থেকে ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) কাছ থেকে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য এসেছে।
সন্দেহজনক লেনদেনের মধ্যে ১৮টি ছিল ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের। এছাড়া আড়াই কোটি থেকে ৫ কোটি টাকার ২৯টি, ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ২৩টি ও ৫০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকার ৯৪টি সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বিএফআইইউর কাছে আসে। সন্দেহজনক অন্য লেনদেনগুলো ছিল ৫০ লাখ টাকার কম মূল্যমানের। সন্দেহজনক লেনদেনের ৫৫ শতাংশই ছিল ঢাকায়।
শুধু সন্দেহজনক লেনদেন নয়, বিএফআইইউর কাছে আর্থিক অপরাধের অভিযোগের সংখ্যাও বিদায়ী অর্থবছরে ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে মোট ৩০১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১০৯টি অভিযোগ করে বাংলাদেশ পুলিশ। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছ থেকে ৭১টি, গণমাধ্যমের কাছ থেকে ১৪টি, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ১১টি এবং শুল্ক বিভাগসহ অন্যদের কাছ থেকে ৯৬টি আর্থিক অপরাধের অভিযোগ পেয়েছে বিএফআইইউ।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে গত অর্থবছর রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে দুর্নীতি, প্রতারণা, অপহরণ, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১২১টি অপরাধের তথ্য দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৯টি অভিযোগ ছিল দুর্নীতি ও জালিয়াতি সম্পর্কিত। এছাড়া প্রতারণা সম্পর্কিত ২৫টি, অপহরণ-সংক্রান্ত ১০টি, সন্ত্রাসে অর্থায়ন বিষয়ে ১০টি অপরাধের তথ্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে দেয়া হয়েছে। বিএফআইইউ থেকে সবচেয়ে বেশি ৭২টি অভিযোগ পাঠানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। ৩৮টি অভিযোগ সিআইডি, ৯টি অভিযোগ কাউন্টার টেরোরিজমে পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
- Courtesy: BanikBarta /June 27, 2018