Search

Wednesday, June 27, 2018

বাইরে সুনসান ভেতরে গড়বড়

গাজীপুরে ভোটচিত্র

সোহরাব হাসান

সকাল ৮টা ২ মিনিট। টঙ্গী বাজারের কাছে মন্নু টেক্সটাইল মিল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দেখি, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে ভোটারদের লম্বা লাইন। বেশির ভাগ লোকের বুকে নৌকার ব্যাজ। দু-একজনের কাছে কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীকও আছে। কিন্তু কাউকে ধানের শীষের ব্যাজ নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে দেখলাম না। বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হলো। এত বড় লাইনেও একজন বিএনপি সমর্থক নেই! এরপর ব্যাজ পরেননি এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা জানান, নৌকার প্রতীক নিয়ে যাঁরা লাইনে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের সবাই নৌকার লোক নন। অনেকে নৌকা কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থীর ব্যাজ লাগিয়ে ধানের শীষে ভোট দিতে এসেছেন। তাঁর এ কথার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম আরেকটি কেন্দ্রে। সেখানে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী দাবি করলেন, অন্য প্রতীক নিয়ে ধানের শীষে কাজ করার জন্য তিনি একজনকে বের করে দিয়েছেন।

টঙ্গী ও গাজীপুরে যেসব কেন্দ্রে ‘ভোট উৎসব’ দেখেছি, চেহারা মোটামুটি অভিন্ন। কেন্দ্রের বাইরে নৌকার প্রতীক নিয়ে সবাই ঘোরাফেরা করছেন। ভেতরে সুনসান। কোনো হল্লাচিল্লা নেই। ভোটাররা ভোটও দিচ্ছেন। একজন তরুণ ভোটার বের হতে হতে বললেন, ‘দুইটা সিল মাইরা আইলাম।’ একজনের দুটো সিল মারা কিংবা এলাকার ভোটার না হওয়া সত্ত্বেও ভোট দেওয়া বন্ধ করতে পারেন যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট, তাঁরাই ছিলেন অনুপস্থিত।


রাস্তার পূর্ব পারে টঙ্গী শ্রম কল্যাণকেন্দ্রে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল ছয়টি বুথের মধ্যে দুটিতে বিএনপির এজেন্ট আছেন। এজেন্টের কার্ড নিয়েছিলেন চারজন। দুজন কার্ডই নেননি। পাশের রওশন এরশাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে একজন বয়স্ক ভোটারকে জিজ্ঞেস করি, কোনো গোলযোগ হয়েছে কি না। তিনি বললেন, গোলযোগ বলতে আপনি কী বোঝাতে চান? বললাম, মারামারি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ইত্যাদি। তিনি বললেন, সেসব হয়নি। তবে আসল গোলযোগ হয়েছে। ভোটটা অংশগ্রহণমূলক হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি।

রেনেসাঁ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখলাম টেলিফোনে আলাপ করছেন। অপর প্রান্তে কে ছিলেন জানি না। এ প্রান্ত থেকে তিনি বলছেন, ‘স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মতো ভোট হচ্ছে।’ আরেকবার বললেন, আধা স্বচ্ছ। তাঁর কথায় রহস্য আছে মনে হলো। এই কেন্দ্রেই নির্বাচন কমিশনের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হয়, যিনি পর্যবেক্ষণ করতে এসেছেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি জানতে চান, আপনারা কী দেখলেন। বললাম, অনেক কেন্দ্রে ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট নেই। তাঁর জবাব, কোনো প্রার্থী নির্বাচনী এজেন্ট না দিলে তো প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কিছু করার নেই। কিন্তু কী কারণে প্রার্থী এজেন্ট দেননি বা দিতে পারেননি, সেটি খুঁজে বের করার দায়িত্ব ইসিরই।


টঙ্গী ও গাজীপুরে যেসব কেন্দ্রে গিয়েছি, একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বলেছেন, ভালো ভোট হয়েছে। কিন্তু কেন ধানের শীষের এজেন্টরা নেই, সেই প্রশ্নের সদুত্তর তাঁরা দিতে পারেননি। বলেছেন, ছিলেন তো। হয়তো কোথাও গেছেন। একটু পরেই ফিরে আসবেন। কিন্তু বিকেল চারটা পর্যন্ত কেউ ফিরে আসেননি।

বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এক শ কেন্দ্র থেকে তাঁদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। গাজীপুরে কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২৫ টি। আমরা সরেজমিনে যা দেখেছি, তাতে বিএনপি এক শ কেন্দ্রেও ঠিকমতো এজেন্ট দিতে পারেনি। তাহলে বিএনপি কি আগেভাগেই মাঠ ছেড়ে দিয়েছিল?

বেলা আড়াইটায় রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মন্ডলের অফিসে তাঁর সঙ্গে ভোটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়। তিনি বেশ আস্থার সঙ্গে বললেন, ‘ভালো ভোট হয়েছে। দু-একটা কেন্দ্রে কিছুটা গোলযোগ হয়েছে। সেখানে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।’

বিএনপির প্রার্থীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে শুনেছেন এবং ব্যবস্থাও নিয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে আলাপ চলাকালেই সকালে ঘুরে আসা টঙ্গীর একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা টেলিফোন করে এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘আপনাদের কেউ কাছাকাছি থাকলে এখানে পাঠান। বেশ চাপে আছি।’ ততক্ষণে ব্যালটপেপারে জবরদস্তি সিল মারার কারণে কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করার খবর অনলাইন সংবাদপত্র ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয়েছে।

  • Courtesy: Prothom Alo/ June 27, 2018

No comments:

Post a Comment