Search

Friday, June 8, 2018

ফ্যাসিবাদের বিস্তারে কংগ্রেসের মত বিজেপিও কি হামাগুড়ি দেবে?


শওকত মাহমুদ 


এ কি করল আনন্দবাজার পত্রিকা! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তাঁর একান্ত কথোপকথন নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকাটির রিপোর্ট রীতিমত অপমানজনক। পত্রিকাটি কিভাবে জানল একান্ত কথাবার্তা? শেখ হাসিনা নাকি নরেন্দ্র মোদীর কাছে প্রতিদান প্রার্থনা করেছেন। হোক না আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিনা ভোটের। তাতে কি? এভাবে নিচে নামিয়ে দেয়া কি ‘আনন্দবাজার’ এর ঠিক হল?

এই ঐতিহাসিক পত্রিকাটির দ্বাদশবর্ষে পদার্পনকালে ১৯৩৩ সালের ১২ মার্চ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক আশীর্বাণী দিয়েছিলেন। তাঁর উপদেশটা ছিল এমন — 

  
তোমার লেখনী যেন ন্যায়দণ্ড ধরে
শত্রু মিত্র নির্বিভেদে সকলের পরে
স্বজাতির সিংহাসন উচ্চ করি গড়ো
সেই সঙ্গে মনে রেখো সত্য আরো বড়ো।
স্বদেশের চাও যদি আরো উর্ধ্বে ওঠো
কোরো না দেশের কাছে মানুষের ছোটো।  

দেশকে তুলতে গিয়ে অন্যকে ছোটো” না করার পরামর্শ আনন্দবাজার মানে নি। না মানার ঢের উদাহরণও আছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের সংবিধানে, বোধ হয় আর কোন দেশের সংবিধানে নেই, সংবাদপত্র, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা প্রশ্নে কতকগুলো শর্ত আছে। এরমধ্যে একটি হল বৈদেশিক সম্পর্ক সম্বন্ধীয়। এমন কিছু লেখা বা প্রচার করা যাবে না যেন বৈদেশিক বা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আঁচড় লাগে। এটা সাংবাদিকেরা সহজে মানেন না, মানলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বলে কিছু থাকে না। যেমন মিয়ানমারের সঙ্গে সরকার গোপন পীরিত করলেও সাংবাদিকেরা তো অসভ্য মিয়ানমারকে ছেড়ে কথা কইবে না। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এদিক দিয়ে টনটনে। পারলে বিদেশ ভ্রমণরত সাংবাদিকদের নজরদারিতে রাখার জন্য নোটিশ জারি করে বসে। এমনকি প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যেও বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি ঢুকিয়ে রেখেছে। শুধুমাত্র ভারতকে মিডিয়া-প্রটেকশন দিতেই হয়তো এমন ব্যবস্থা। সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশী হত্যা করলে আমরা আগেভাগে বলা শুরু করে দেই - ওতো চোরাচালানি ছিল। ভারতে কোথাও দাঙ্গায় মুসলমান খুন হলে আমরা খবরটিকে আড়াল করে ফেলতে চেষ্টা করি। এখন অবশ্য বাংলাদেশে অনেক সাংবাদিক ভারত - প্রেমে এমনিতেই মশগূল।

যাকগে ‘আনন্দবাজার’ এর যে রিপোর্ট নিয়ে আজকের লেখা, এটি সংক্ষেপে পড়ে নিলে ভালো। পত্রিকাটির রিপোর্ট বলছে, “দিয়েছেন অনেক, প্রতিদানে এবার সহযোগিতা চান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধনের পর সেখানেই মোদীর সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, তাঁর সরকার উত্তর পূর্বের জঙ্গীদের দেশছাড়া করছে, ট্রানজিট দিয়েছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বরাবর দিল্লির পাশে থেকেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের বছরে এবারও তাই ভারতের সহযোগিতা চান। ‘আনন্দবাজার’ আরও বলেছে, মোদির সঙ্গে রুদ্ধদ্ধার বৈঠকে তিনি কি বলেছেন, উপদেষ্টাদের সঙ্গে আগেই আলোচনা সেরে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর দপ্তরের এক সূত্র জানায়, হাসিনার বার্তা, মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে সরাতে, বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত চলছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে পশ্চিমে আর পূর্বে দুই দিকেই পাকিস্তান নিয়ে ঘর করতে হবে ভারতকে। তাই ভারতের উচিত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারই যাতে ক্ষমতায় ফেরে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা।”

এই রিপোর্ট মোতাবেক শেখ হাসিনা তিস্তার পানি নিয়ে কথা বলেননি, রোহিঙ্গা সমস্যার কথা চেপে গেছেন। শুধুমাত্র তার প্রধানমন্ত্রীত্বে থেকে যাওয়ার জন্য ভারতের প্রতিদান কামনা করেছেন। ‘আনন্দবাজার’ সঠিক বলে নি বলেই বিশ্বাস করতে চাই। বাংলাদেশের এক সূত্রের উদ্বৃতিতে এমন খবর ছেপে দিয়েছে, তাও একান্ত বৈঠকের সংলাপ নিয়ে। সাধারণত দুই সরকার প্রধানের কথা বার্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন করে নোট লেখক থাকেন। কিন্তু একান্ত বৈঠকে থাকেন না। সেখানে কি কথা হয়েছে, দু’জন ছাড়া কারও জানার নয়। কিন্তু রিপোর্টটি অবিশ্বাস করার যুক্তিও পাই না। কারণ বাংলাদেশ সরকারের এর প্রতিবাদ করেনি। আর দেখলাম, শেখ হাসিনা তিস্তার ব্যাপারে নীরব, মোদী নির্বাক রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি কোন প্রতিদান চাননি। শুধু ভারতকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি ভারতকে কতটুকু দিয়েছেন। কিন্তু কোন আলাপের কারণে শেখ হাসিনাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হল? এমনি এমনি তো শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের অবদান বলতে যাননি। অবদান স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর মোদী নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করেছেন —  ‘এতনা বাত্ কিও বোলা’. আর আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টের প্রতিবাদও কিন্তু তিনি করেননি। 

এক রসিকজনের পর্যবেক্ষণ হল, শেখ হাসিনা তো বিএনপি’র বলা কথাই মোদীকে বলেছেন। বিএনপি হামেশাই অভিযোগ করছে, শেখ হাসিনা ভারতকে বহু কিছু দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ভারত সে তুলনায় বাংলাদেশকে কিছু দেয়নি। এর জবাব দিতে পারেনি আওয়ামী লীগ বিএনপি’র ওই অভিযোগকে স্বীকৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা নিজের মতো করে নরেন্দ্র মোদীকে বলেছে। প্রতিদানে হয়তো বাংলাদেশ নয়, তাঁকে ব্যক্তিগত প্রতিদান দিতে বলেছেন।

একটু পিছিয়ে যদি দেখি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কিছুদিন আগে দলীয় এক প্রতিনিধিদল নিয়ে দিল্লি ঘুরে এসেছিলেন। দেশে ফিরেই বললেন যে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারত অতীতেও নাক গলায়নি, ভবিষ্যতেও গলাবে না। ওই বক্তব্যে ঝড় উঠল —  আপনি বলার কে? ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না। অথচ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তার বইয়ে (দি কোয়ালিশন ইয়ার্স) বিস্তারিত বলেছেন, কিভাবে সাবেক সেনাপ্রধান কুখ্যাত মঈন উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জেতাতে তিনি কি কাণ্ড করিয়েছেন। ২০১৪ তে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে বিতর্কিত ভোটে অংশ নিতে দে দরবার করেছিলেন বাংলাদেশের বিরোধীদলগুলোকে। তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তার বইয়ে (দি আদার সাইড অব দ্য মাউন্টেইন) এ কথা উল্লেখ করেছেন। অতএব ভারতের সরকার নির্বাচনে নাক গলায়নি, এটা সত্য নয়। এবারে ভারত সফরের আগে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেই বসলেন, ভারত চাইলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ কেমন কথা। একটা স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন নিয়ে কেন কথা হবে। ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আমাদের ভোট নিয়ে ভারত কিছু করতে চায় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন, তার মর্মার্থ হল, ভারত চাইলে আমাদের স্বার্থে নাক গলাতে পারে। আনন্দবাজার এর খবর যদি সঠিক হয়, শেখ হাসিনা নিজে ও তাঁর মন্ত্রীরা ভারতকে বাংলাদেশের নির্বাচনে টেনে আনতে চাইছেন। ভারত ছাড়া আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করছেন? আবার অশান্তির আয়োজন? জনগণের ওপর আস্থা নেই। ভারত কি করবে এবার?

বাংলাদেশে চলমান ফ্যাসিবাদের আরেক প্রস্থ বিস্তারে কংগ্রেসের মত বিজেপি সরকারও কি হামাগুড়ি দেবে?

No comments:

Post a Comment