Search

Tuesday, June 26, 2018

চাঁদের অপর পিঠের চেহারা

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে, অন্যদিকে দেশজ ও জাতীয় সঞ্চয়ের হার কমেছে। ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরের বাজেটের অন্তত একটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণবিষয়ক লক্ষ্যমাত্রা শুধু বাস্তবায়িত হয়নি, ছাড়িয়েও গেছে। অর্থাৎ ঋণ বাড়ছে, কিন্তু সঞ্চয় বাড়ছে না। সঞ্চয় না বাড়লে বিনিয়োগ বাড়বে কীভাবে? নতুন কর্মসংস্থান কীভাবে তৈরি হবে? সঞ্চয়পত্র তো মানুষই কিনছে। কিন্তু দেশজ সঞ্চয় ও জাতীয় সঞ্চয় কমছে। অর্থাৎ কিছু মানুষের সঞ্চয় বেড়ে যাচ্ছে; অধিকাংশের সঞ্চয় কমছে বা করতেই পারছেন না, অথবা ঋণ করে চলতে হচ্ছে। এই মুষ্টিমেয় মানুষ রাষ্ট্রকে ঋণের জালে বাঁধতে পারছে। অন্যদিকে দিন দিন বৈষম্যও বাড়াচ্ছে। 

সঞ্চয় হার কমার সঙ্গে পুঁজি পাচারের বিষয়টিরও যোগসাজশ রয়েছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি বলছে, বাংলাদেশ থেকে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে এবং ক্রমাগত এর পরিমাণ বাড়ছে। অবৈধভাবে ব্যাপক হারে পুঁজি পাচার হওয়ায় বাণিজ্য-ঘাটতি বাড়ছে। ফলে জাতীয় সঞ্চয় কমছে ও বিনিয়োগ স্থবির থাকছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বড় সংকটের কারণ। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের ঘাটতি আছে; আছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আস্থার অভাব। বিগত কয়েক বছর যাবৎ মোট দেশজ উৎপাদনের অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও তা দিয়ে কতটা কর্মসংস্থান হবে?

সঞ্চয়ের সঙ্গে কর্মসংস্থানের সম্পর্ক নিবিড়। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। বেকার সমস্যার সবচেয়ে বড় শিকার ১৫-২৯ বছর বয়সী যুবকেরা। কথিত উন্নয়নের জোয়ার থেকে ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষিত যুবক বঞ্চিত। একটা প্রজন্মকে হারাতে যাচ্ছি। চাকরি না থাকলে আয় কোথা থেকে আসবে, সঞ্চয়ও বাড়বে না। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫-৬৫ বছরের কর্মক্ষম জনশক্তির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এই পরিমাণ কর্মক্ষম জনশক্তি যেকোনো দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এক বিরাট সম্পদ। ‘জনমিতিক লভ্যাংশ’ থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি। সঞ্চয়ও হারাচ্ছি।

আর যারা কোনোমতে কাজ পাচ্ছে, তারা অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। না আছে উপযুক্ত মজুরি, না আছে অধিকার। অতএব সঞ্চয়ের সুযোগ নেই। অগ্রযাত্রা নিয়ে কথা বলা হলেও অগ্রযাত্রার মৌল সূচক ‘শোভন কর্মসংস্থান’ নিয়ে কথা নেই। একদিকে মূল্যস্ফীতি ঘটছে, অন্যদিকে মজুরি কমছে। সঞ্চয় আসবে কোথা থেকে?

আয় না বাড়লে কীভাবে সঞ্চয় বাড়বে? অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হলেও তা মানুষের জীবনযাত্রার আয় ও মান বাড়াচ্ছে না। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে না বরং প্রকৃত বিচারে মানুষের আয় কমছে। ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ বিশ্লেষণে, আয় ২০১০ সালের চেয়ে ২০১৬ সালে ২ শতাংশ কম দেখাচ্ছে। অবধারিতভাবেই কমেছে প্রকৃত ব্যয় করার ক্ষমতা। সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ থাকছে না বরং রাষ্ট্রের যেমন ঋণ বেড়ে যাচ্ছে, একই কায়দায় মাথাপিছু ব্যক্তিগত ঋণ বেড়ে চলেছে। আর বাড়বেই না কেন-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, গ্যাস, বিদ্যুৎ লাগামহীন গতিতে দাম বাড়ছে। নিশ্বাস নেওয়াই দুরূহ হয়ে উঠছে! সরকারি জরিপ বলছে, ২০১০ সালে যেখানে মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ২৩১৮ কিলোগ্রাম ছিল, ২০১৬ সালে তা কমে ২২১০ কিলোগ্রামে দাঁড়িয়েছে। টাকার অঙ্কে পরিবারপ্রতি প্রকৃত খরচ করার ক্ষমতা বা ভোগ্য ব্যয় কমেছে ১১ শতাংশ। আর তাই দেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য কমার সেই হারও কমে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপমতে উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ অত্যন্ত কষ্টকর জীবন, কিংবা তাদের একটি অংশ দরিদ্র হওয়ার মতো ঝুঁকিতে বসবাস করছে।

বৈষম্য ও সঞ্চয় হ্রাসের মধ্যে এক নিবিড়তম চক্রাকার সম্পর্ক রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ধনী-গরিব বৈষম্য বাড়ছে। বাজেটের দলিল জানাচ্ছে, মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী সঞ্চয়পত্র কিনেই চলেছে। পরিকল্পনা কমিশনের ব্যাকগ্রাউন্ড পেপার লিখছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাঝামাঝি সময়ে পুঁজি থেকে প্রাপ্তি আর শ্রম থেকে প্রাপ্তির (মজুরি) মধ্যে অনেক বেশি ফারাক। এ পার্থক্য বেড়েই চলছে। অধিকাংশ মানুষই শ্রম বিক্রি করে আয় করে। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের শ্রম থেকে আয়ের হার কমায় সঞ্চয়ও কমছে। সঞ্চয় না থাকা বা কম থাকায় আয়বৈষম্যের দুষ্টচক্র চলমান হবে এবং ক্রমাগত বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। লুট থেকেও সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে।

সরকারি মহলের কেউ কেউ বলে থাকেন, উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বৈষম্য হতে পারে। এ তত্ত্ব অনেক আগেই অসার প্রমাণিত হয়েছে। সঞ্চয় কমছে, বিনিয়োগ স্থবির, আয় ও কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি চলছে, কৃষি খাত ধুঁকছে, শিল্প খাত এক পণ্যনির্ভর ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে, পুঁজিবাজার নিম্নগামী, তালিকাভুক্ত কোম্পানি কম লভ্যাংশ ঘোষণা করছে, অবকাঠামো খাতে উচ্চায়িত মূল্য-এখানে এসব বক্তব্য অসার। নির্মমও বটে।

আয় বাড়লে সঞ্চয় বাড়ে। আয় বাড়বে প্রকৃত খাত তথা কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত থেকে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রকৃত খাতগুলো ঝুঁকির সম্মুখীন। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ এবং বহুমুখী করতে না পারায় রপ্তানি খাতে আয়ের ক্রমহ্রাসমান প্রবৃদ্ধি লক্ষণীয়। বরাদ্দ বাড়লেও অবকাঠামোগত দুর্বলতা উৎপাদন খাত সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। কৃষি খাতে অগ্রগতি থমকে দাঁড়িয়েছে। শিল্প ও সেবা খাত দক্ষ জনশক্তি ঘাটতিতে ভুগছে। ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে বৈধ ও অবৈধভাবে এ দেশে নিয়োগ পাচ্ছে। অর্থাৎ সঞ্চয় বিদেশে চলে যাচ্ছে।

জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যদি জনমুখীন সর্বজনব্যাপী টেকসই প্রবৃদ্ধির ধারায় টেনে আনতে হয়, তাহলে আদিম পুঁজি সঞ্চয়ের পন্থা যেমন দুর্নীতি, অপকর্ম, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন প্রভৃতি অবলম্বনের পরিবর্তে উৎপাদন খাতকে গতিশীল করার সৃজনশীল কৌশল অনুসরণ জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বর্তমানে গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকারের অভাব, আইনের শাসন ও জবাবদিহির প্রতি অবজ্ঞা, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের দ্বারা অর্থনীতিকে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার মারাত্মক প্রবণতা দৃশ্যমান।

রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রচণ্ডভাবে সর্বজনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। রাষ্ট্র জনতার প্রতিষ্ঠান। দিন দিন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গোষ্ঠীতন্ত্রের কবলে চলে যাচ্ছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে অধিকাংশ জনতার ‘সামাজিক চুক্তি’ ঢিলে হয়ে পড়ছে। জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার কোনো বিকল্প নেই। এই মৌলিকে ফিরে যাওয়াই (back to basic) প্রধানতম কাজ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

  • ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ।
  • Courtesy: Prothom Alo /June 25, 2018

No comments:

Post a Comment