Search

Sunday, June 24, 2018

জেলগেটে গ্রেফতার — স্বেচ্ছাচারের বহিঃপ্রকাশ

তৈমূর আলম খন্দকার

যখন পৃথিবীতে সভ্যতা প্রকাশ পায়নি, প্রকাশিত হয়নি মানুষের জন্মগত অধিকার এবং প্রতিষ্ঠিত হয়নি মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার, তখন শাসকের বিরাগভাজন হওয়ার অর্থই ছিল নির্জন কারাবাস বা দীপান্তর, ফাঁসি বা শিরচ্ছেদ। ‘আইন’ যা-ই হোক না কেন, শাসক বা শাসকযন্ত্রের চক্ষুশূল হলেই ‘আইন’ প্রয়োগ হতো উল্টো পথে। তবে এখনো তা হচ্ছে। ঐতিহাসিকদের মতে, সে যুগ ছিল বর্বরতার যুগ। অর্থাৎ, রাজা যা মনে করতেন সেটাই আদেশ এবং আইন। 

এমনও দেখা গেছে, কোনো সাধারণ মানুষ বা উজির-নাজির তিনিই হোন, যে অপরাধের জন্য তাদের মৃত্যুদণ্ড হতো, রাজপরিবারের সদস্যের একই অপরাধের জন্য কিন্তু কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। এভাবেই একটি জনগোষ্ঠী ইতিহাসের পাতায় BLUE BLOOD নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এখন রাজপরিবার তারাই যারা ক্ষমতাসীন ও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট। বহু আন্দোলন সংগ্রামের পর গণমানুষ দাসপ্রথা থেকে আনুষ্ঠানিক মুক্তি লাভ করলেও দাসত্বের মুক্তি পায়নি।

দাসপ্রথা বাতিল হওয়া প্রসঙ্গে নানা বিদ্রোহ ও রক্ষক্ষয়ী ইতিহাস রয়েছে। আন্দোলনের ফলে ১৮৪৩ সালে Act Five আইনে দাস-দাসী আমদানি-রফতানি নিষিদ্ধ করা হলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়নি বরং নিছক পরিবর্তন করেছে। মানুষ যখন মানুষকে ক্রয় করে তখন ক্রেতা হয় মালিক, যে মানুষটি যে বিক্রয় করা হয় সে হয় ক্রীতদাস। Slavery মধ্যযুগীয় বর্বরতার সময় দাসপ্রথা হিসেবে অনুমোদিত আইনানুগ সামাজিক প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

কিন্তু বর্তমানে সভ্যসমাজেও মানুষ ক্রয়-বিক্রয় হয়, কোথাও সে দেহ বিক্রি করে, কোথাও বিক্রি করে বুদ্ধি, কোথাও শ্রম বিক্রি করে এবং কোথাও বিবেক বিক্রি করে দেয়। যে নারী তার দেহ বিক্রি করে, সে অর্থের বিনিময়ে নিজের দেহকে কারো পুরুষের কাছে উজাড় করে দেয়। আর যে বিবেক বিক্রি করে, তার দেহে কোনো চিহ্ন থাকে না, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনগণ, দেশ ও জাতি। এখন চলছে প্রমোশন, সুবিধামতো পোস্টিং কিংবা সুখ শান্তি ও অর্থের বিনিময়ে বিবেক বিক্রি করার যুগ। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিবেক বিক্রি হওয়ার প্রবণতায় ভিকটিম হচ্ছে দেশের নিরীহ শান্তিপ্রিয় অসহায় মানুষ।

কিন্তু যারা বিবেক বিক্রি করে তাদের সম্পর্কে সভ্যসমাজ কী ধারণা পোষণ করতে পারে? বুদ্ধি বিক্রি আর বিবেক বিক্রি করা এক নয়। যে ব্যক্তি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে না পারে সে বিবেক বিক্রেতা। এদের কাছে জাতি আজ অসহায়। বিবেকবিক্রেতাদের প্রধান অস্ত্র লোভ বা প্রলোভনের কারণে বিবেককে বিসর্জন দিয়ে মিথ্যাকে গ্রহণ করা। মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করাই ওদের প্রধান কাজ। নানাবিধ অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে যাওয়া অথবা ঘুষ খাওয়ার অবৈধ সুবিধা পাওয়ার জন্য সুবিধামতো পোস্টিং ও প্রমোশনের লোভে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এখন মিথ্যাকে সত্যে এবং সত্যকে মিথ্যায় রূপান্তরিত করছে। তা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটিশ থেকে এ দেশের আমলারা পেয়েছেন। বড় বড় আমলারা জেনেশুনে মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তর করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, এ জন্য যে, তাতে তাদের ওপরওয়ালারা খুশি থাকবেন। এতে কিন্তু নিগৃহীত হচ্ছে জনগণ। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণের পরও স্বার্থের জন্য অহরহ বিবেক বিক্রি করা হচ্ছে, এ অবস্থা এখন দৃশ্যমান।

পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, ছাত্রলীগ নেতা পুলিশকে পিটিয়েছে। তখন পুলিশ নির্বাক, কারণ যে পিটিয়েছে সে সরকারি দলের লোক, অর্থাৎ তার অভিভাবক সরকারি দলের কর্মকর্তা। অন্য দিকে, কোনো ঘটনাই ঘটেনি এমন কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অহরহ গ্রেফতার করা হচ্ছে। রিমান্ড দেয়া যুক্তিসঙ্গত নয়, তারপরও নিজ বিবেককে কবর দিয়ে দাঁড়িপাল্লা (ন্যায়বিচার) খচিত চেয়ারে বসে ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুর করে পুলিশকে রিমান্ড বাণিজ্য (পত্রিকার ভাষায়) করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। এমনকি কোর্ট এখন রাজনৈতিক মামলায় তেমন আচরণ করে। হাইকোর্টের দেয়া জামিনের আদেশে জেল থেকে বের হওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন তখন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের আদেশে এজাহারে নাম না থাকা মামলায় জেলগেট থেকে বারবার বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে, এ যেন এক মগের মুল্লুক। এ নতুন ইভেন্ট যোগ হয়েছে, রিমান্ডে থাকার সময়ে ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে পরিবারের নিকট থেকে চাহিদামতো টাকা আদায়। রিমান্ড ও ক্রসফায়ার বাণিজ্য থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য (যারা টার্গেট) অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছেন, অনেকে বিদেশেও পাড়ি দিয়েছেন।

হাইকোর্ট জামিন দেয়ার পর জেলগেট থেকে গ্রেফতারের প্রবণতা আগেও ছিল, যা কদাচিৎ দেখা যেত। ১/১১-এর অবৈধ সরকারের সময় এর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে, যা এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। আইন অপপ্রয়োগ করে কৌশলে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য জেলগেটে গ্রেফতার করা স্বেচ্ছাচারিতার একটি বহিঃপ্রকাশ। 

রকার নির্দেশিত এ বর্বরতাকে রোধ করার জন্য, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে জেলগেট থেকে বারবার গ্রেফতার করায় জেলগেটে গ্রেফতারে নিষেধ করে নিন্মেবর্ণিত দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এতে অ্যাপিলেট ডিভিশন বলেন যে, ‘We direct that the respondent Mahmudur Rahman should not be shown arrested in connection with any other case unless there is true complaisance of section 167 of the Code of Criminal Procedure. Even he should not be arrested at the Jail gate after he is released from the custody which is not permissible in law. [সূত্র: ৬৮ ডি.এল.আর (এ.ডি) (২০১৬)(৩৭৩)] 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১-এ বলা হয়েছে যে, ‘আপিল বিভাগকর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয় হবে।’ অর্থাৎ, সংবিধান মোতাবেক সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক আইন সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা দেশের সব আদালতের ওপর প্রযোজ্য। অ্যাপিলেট ডিভিশনের জেলগেটে গ্রেফতারসংক্রান্ত দিকনির্দেশনাকে অমান্য করে, জামিন হওয়ার পর পুলিশ জেলগেটে গ্রেফতার করছে ম্যাজিস্ট্রেটদের সহযোগিতায়। পুলিশ তো বটেই, বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেটদের অনেকে সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা মানছেন না। কারণ, তাদের চাকরির নিয়ন্ত্রণ এখন সরকার প্রধানের হাতে, সুপ্রিম কোর্টের হাতে নেই। 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখনো কার্যত অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ আইনে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণে থাকবে বিচার বিভাগ। বাস্তবতা এই যে, সংবিধানের ৪৮(গ) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সব প্রশাসনিক কার্যক্রমই প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীর লিখিত সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। 

‘বিবেকই’ মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মাঝে তফাতের প্রধান মাপকাঠি। পতিতা যখন দেহ বিক্রি করে, তখন কলঙ্কিত হয় সংশ্লিষ্ট নারী। অন্য দিকে, দায়িত্বশীলরা যখন ‘বিবেক’ বিক্রি করে তখন বিপর্যস্ত হয় গোটা জাতি, যার প্রধান শিকার সমাজের শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ। তোষামোদিতে কে কার চেয়ে এগিয়ে, তা নির্ধারণের জন্য ‘বিবেক’ বিক্রির প্রতিযোগিতা চলছে। তা এখন মাহামারী থেকে স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়েছে।

  • কার্টেসিঃ নয়াদিগন্ত/ জুন ২২,২০১৮

No comments:

Post a Comment