Search

Sunday, June 24, 2018

মানবাধিকার কি কখনও মতাদর্শভিত্তিক হতে পারে?

 ড. মাহবুব উল্লাহ্

মানবাধিকারের বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিকভাবে বহুল আলোচিত। মানবাধিকার বলতে কী বোঝায়? এ প্রশ্নের জবাব হল- বাক-স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, আইনের চোখে সবাই সমান এবং নিষ্ঠুর ও অসম্মানজনক দণ্ড থেকে নাগরিকের স্বাধীনতা- এগুলোর সম্মিলিত চর্চাই হল মানবাধিকার।

একদিকে এসব মানবাধিকারের বিষয়গুলো যেমন রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে, অন্যদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং বাণিজ্যিক প্রথা ও নিয়ম-কানুনের গুরুত্বও মানবাধিকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কখনও কখনও দেখা যায়, নিরাপত্তা বিবেচনা মানবাধিকার বিবেচনাকে গৌণ করে ফেলছে।


যেমনটি আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে। ১৯৮০-এর দশক থেকে মানবাধিকারের বিষয়টি নাটকীয়ভাবে পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে।

বস্তুত সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই মানবাধিকার নিয়ে চিন্তাভাবনার সূচনা। সেই সময় মনে করা হতো প্রতিটি রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হল তার নাগরিকদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। English Bill of Rights-এর সূচনা হয় রাজা দ্বিতীয় জেমসের বিরুদ্ধে অভিযোগের মাধ্যমে। তখন অভিযোগ করা হয়েছিল- রাজা দ্বিতীয় জেমস নাগরিকদের অধিকার হরণ করছেন। এর সমাধান হয় প্রিন্স অব অরেঞ্জ কর্তৃক এ দাবি মেনে নেয়ার মাধ্যমে।

১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার দলিলে রাজা তৃতীয় জর্জের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উত্থাপিত হয়। তখন বলা হয়েছিল একজন অত্যাচারী স্বাধীন জনগণের শাসক হওয়ার অযোগ্য। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের ডিক্লারেশন অব রাইটসে বলা হয়েছিল কারও অধিকার কেড়ে নেয়া যাবে না।

কিন্তু সেই অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল জাতি রাষ্ট্রের। জাতি রাষ্ট্রই হল সব সার্বভৌমত্বের উৎস। যে কালে এসব দলিল প্রণীত হয়েছিল, তখন ভাবা হয়নি যে বিশ্ব সম্প্রদায়ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের অধিকার ভোগ করতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধীরে ধীরে স্বীকৃত হতে শুরু করল যে, একটি দেশের ভেতরে সরকারের কার্যকলাপ কেমন চলছে এবং সেই সরকার তার নিজ নাগরিকদের প্রতি কেমন আচরণ করছে, এসব ব্যাপার ভিন্ন দেশগুলোও বিবেচনায় নিতে পারে। এ বিবেচনা জোরদার হতে পেরেছে নাজি জার্মানিতে বর্বর নির্যাতন ও নিপীড়নের ফলে।


১৯৪৫ সালের জাতিসংঘের চার্টারের ৫৫ ধারায় বলা হয়েছিল, The World Body shall promote universal respect for, and observance of human rights and fundamental freedom for all. একই চার্টারের ৫৬ ধারায় বলা হয়েছিল, জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র প্রতিজ্ঞা করছে যে, জাতিসংঘের সহযোগিতায় যৌথভাবে অথবা পৃথকভাবে ৫৫ ধারার বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের Universal Declaration of Human Rights-এ মানবাধিকার সংজ্ঞায়িত করা হয়। কোনো ধরনের বিরোধিতা ছাড়াই এটি গৃহীত হয়েছিল। তবে সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকভুক্ত দেশগুলো, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সৌদি আরব ভোটদানে বিরত থাকে।

পরবর্তী বছরগুলোয় বেশকিছু আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস (১৯৫০); দ্য ইন্টারন্যাশনাল কোভন্যান্ট অন হিউম্যান রাইটস (১৯৫০); দি ইন্টারন্যাশনাল কোভন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (১৯৬৬); দি আমেরিকান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস (১৯৬৯); দ্য হেলসিংকি অ্যাকর্ডস (১৯৭৫) এবং দি আফ্রিকান চার্টার অন পিপলস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (১৯৮১)।

এরপর থেকে বা তার আগেও এসব চুক্তির সঙ্গে সরকারগুলো যেন সঙ্গতি রেখে দায়িত্ব পালন করে সেই লক্ষ্যে অনেক এনজিও গঠিত হয়। এর ফলে যেসব দেশে ভয়াবহভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় সেসব দেশ আন্তর্জাতিক জনমত দ্বারা নিন্দিত হতে থাকে। এমনকি ১৯৮০-এর দশকের আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সরকারগুলো কদাচিৎ এ ধরনের চাপের সম্মুখীন হতো।

বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে অধ্যাপক আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, এনায়েত উল্লাহ খান ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠিত হয়েছিল। এরই পাশাপাশি সময়ে বাংলাদেশের হাইকোর্টের বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য দুটি ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সাহসী রায় ঘোষণা করেছিলেন।

আমরা পৃথিবীর অনেক দেশেই নিষ্ঠুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে পরিচিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চিলির পিনোশে সরকার, ফিলিপাইনের মার্কোস সরকার, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গবাদী সরকারগুলো, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলফেনসন পূর্ববর্তী সরকারগুলো।

এ ছাড়াও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ নজির আছে। হাল আমলে জিম্বাবুয়ের মুগাবে সরকারও কম যায়নি। ইরানে শাহ-এর আমলে তার সাভাখ বাহিনীর অত্যাচারও বহুল আলোচিত। ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিক এবং বোদ্ধা ব্যক্তিরা অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যে আমেরিকা মানবাধিকার নিয়ে এত গর্ব করে সেই আমেরিকায়ও যুগের পর যুগ ধরে কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার ভয়াবহভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।


মানবাধিকারের বিষয়টি প্রেসিডেন্ট কার্টারের সময় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। ল্যাটিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় একটি অত্যাচারী সামরিক সরকার ১৯৭৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর, সত্তরের দশকে গুয়াতেমালায় সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনের নামে চরম অত্যাচার ও ত্রাস দেখা যায় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে কার্টার প্রশাসন মানবাধিকারের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করে।

কিন্তু একই সময়ে মানবাধিকারের অবনতি সত্ত্বেও কার্টার প্রশাসন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দ্যাঁতাতের নীতি অব্যাহত রাখে। কার্টার প্রশাসন কেন এতটা মানবাধিকারের ধ্বজাধারী হয়ে উঠল সেটাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের পর মার্কিন প্রশাসন উপলব্ধি করে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কোনো দেশের ওপর দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব নয়।

এ জন্য কার্টারের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন মানবাধিকারের নামে নিজেদের মানবদরদি হিসেবে উপস্থাপন করে বিশ্ব রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু বুশের শাসনামলে নয়/এগারোর টুইন টাওয়ার হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারও স্ব-মূর্তিতে হাজির হয়। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও মিসরে যা ঘটেছে তা কোনোক্রমেই মানবাধিকারের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রদ্ধাবোধের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না।

মানবাধিকার একটি বিশ্বজনীন অঙ্গীকার হওয়া সত্ত্বেও আইডিওলজির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। তাই এখনও মনে হয় মানবাধিকার সার্বিকভাবে একটি বিশ্বজনীন মানবিক আদর্শরূপে দাঁড়াতে পারেনি। এ ছাড়া মানবাধিকারবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও রয়েছে বড় রকমের পার্থক্য।

বলা হয়ে থাকে, মানবাধিকারের প্রাচ্যদেশীয় দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্যের মতো নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট সারবত্তা থাকলেও কিছু মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিষ্ঠুর নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধার ব্যাপারে মতাদর্শ নির্বিশেষে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্র নিপীড়নের হাতিয়ার।

যখন যে শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকে সেই শ্রেণী বৈরী শ্রেণীর প্রতি নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইবে এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। মানবাধিকারের প্রকৃত স্বীকৃতি তখনই অর্জিত হবে যখন পৃথিবী থেকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। এমন সম্ভাবনা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না। আমাদের পরবর্তী কয়েক পুরুষ পর এমন একটি অবস্থার উদ্ভব হতে পারে।

আবার এরকম অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আগেই জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে এ গ্রহ থেকে মানবকুলই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সুতরাং মতাদর্শ নির্বিশেষে সবাই যদি মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তাহলে একদিকে যেমন সমাজ ও শাসনকে মানবিক করে তুলতে হবে, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার পক্ষেও কার্যকরভাবে দাঁড়াতে হবে।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিগ্যান প্রশাসনের সময় কার্টার প্রশাসনের মানবাধিকার নীতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এই প্রশাসন হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত কমিয়ে ফেলে। ১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে গিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে মানবাধিকারের সমার্থক হিসেবে উপস্থাপন করেন। এ গণতন্ত্রের অর্থ হল বেশি বা কম স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন।

এ সময় যেসব দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিল এবং এ ধরনের নির্বাচন হতে দেয়নি তারা আন্তর্জাতিক সমালোচনা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে শুধু এ কারণে যে, সেসব দেশে গুম এবং চরম শারীরিক নির্যাতন করা হয় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বার্থে মানবাধিকারের সংজ্ঞায় পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ থেকে জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, কাউন্সিলভুক্ত দেশগুলো ভণ্ড এবং মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরোধী। ঘোষণাটি এসেছে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিক্কি হ্যালির কাছ থেকে। ঘোষণাটি দেয়ার সময় তার পাশে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পাম্পও।

ঘোষণার সময় দু’জনই জোর দিয়ে বলেছেন মানবাধিকার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় এগিয়ে থাকবে। ইসরাইল প্যালেস্টাইন, বিশেষ করে গাজা এলাকায়, যেভাবে দিনের পর দিন হত্যাযজ্ঞ ও অবৈধ বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এমন একটি দেশের পক্ষে নগ্ন অবস্থান গ্রহণ কতটুকু মার্কিন নীতি-নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটায় তা একটি বিশাল প্রশ্ন। কার্যত দেখা যাচ্ছে স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ প্রাধান্য অর্জন করছে এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন অত্যন্ত গৌণ হয়ে যাচ্ছে।

এ কারণেই মনে হয় বাংলাদেশের পরিচিত মানবাধিকারের প্রবক্তারা কিছুটা হলেও নিশ্চুপ হয়ে পড়েছেন। আবারও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, মানুষের চেয়ে আইডিওলজি ও সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর কাছে অনেক বড়। যদি আইডিওলজি ও মানবতার মধ্যে সম্মিলন ঘটানো যায়, তাহলেই হয়তো ভালো কিছু আশা করা যায়। জানি না এমন প্রত্যাশা কীভাবে কখন বাস্তবায়িত হবে।

  • ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
  • কার্টসি — যুগান্তর/রোববার, জুন ২৪, ২০১৮। 

No comments:

Post a Comment