দেড় মাস ধরে অপেক্ষায় কমিশনিং কার্গো
ইয়ামিন সাজিদ
দেশের প্রথম ভাসমান এলএনজি টার্মিনালে নোঙর করে আছে কমিশনিং কার্গো। কিন্তু সঞ্চালন লাইনে ত্রুটির কারণে দেড় মাসেও প্রথম কিস্তির এলএনজি সরবরাহ হয়নি। এতে প্রতিদিনই অপচয় হচ্ছে গ্যাসের। অপচয়ের পাশাপাশি পরিচালন বাবদও আর্থিক ক্ষতি গুনতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে।
অন্যান্য তরল পদার্থের মতো এলএনজিও উদ্বায়ী। ক্রায়োজেনিক লিকুইড ট্যাংকে এ গ্যাস মজুদ করা হয়। তবে ক্রায়োজেনিক ট্যাংকে তাপের কারণে এলএনজির একটি অংশ উড়ে যায়। মজুদকালীন ও লোড-আনলোডের সময় তাপজনিত কারণে এ অপচয় হয়ে থাকে। এতে হ্রাস পায় গ্যাসের পরিমাণ। মহেশখালীতে আমদানিকৃত এলএনজির ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ইভাপোরেটিংয়ের কারণে তো গ্যাসের পরিমাণ হ্রাস পায়। এতে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। এলএনজি পাইপলাইন সঠিকভাবে নির্মাণ করতে না পারায় এটা হচ্ছে।
তবে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কমিশনিং কার্গো বসিয়ে রাখার কারণে বয়েল-অফ গ্যাস ও পরিচালন ব্যয় বাবদ সংস্থাটির প্রায় অর্ধকোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া কমিশনিং কার্গোর পর ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী যেসব জাহাজ আসার কথা, সেগুলো না আসার কারণেও গ্যাস ব্যবহার ছাড়াই ব্যয় বহন করতে হবে। এতে করে পেট্রোবাংলার আর্থিক ক্ষতি আরো বাড়বে।
এলএনজির প্রথম কিস্তি নিয়ে গত ২৪ এপ্রিল কক্সবাজারের মহেশখালীতে পৌঁছায় কমিশনিং কার্গো। গত ১২ মে পাইপলাইনের মাধ্যমে এ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু এফএসআরইউ থেকে জিরো পয়েন্ট তথা জাতীয় গ্রিডের আগ পর্যন্ত সাড়ে সাত কিলোমিটার পাইপলাইনের বিভিন্ন অংশে ছিদ্র দেখা দেয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এরপর পুনরায় সরবরাহের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৬ মে।
এ সময়ের মধ্যেও ত্রুটি মেরামত না হওয়ায় ৪৭ দিন ধরে সাগরে নোঙররত অবস্থায় বসে আছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ ঘনমিটার (৬০ হাজার ৪৭ টন) এলএনজিবাহী জাহাজটি। বিশাল এ জাহাজের পরিচালন ব্যয় (ফিক্সড অপারেটিং কস্ট) ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ দৈনিক ডেমারেজ বা লোকসান গুনতে হচ্ছে ৫০ হাজার ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এক্সিলারেট এনার্জি টার্মিনাল নির্মাণ ব্যয় বহন করলেও অপচয়ের ব্যয় বহন করতে বাধ্য নয়।
নির্মাণ ও ব্যবহার চুক্তি অনুযায়ী ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) ও টার্মিনাল থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের ব্যয় মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির। কিন্তু গ্যাসের অপচয় ও নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করতে না পারার কারণে যে ক্ষতি, তা আমদানিকারক হিসেবে পেট্রোবাংলাকেই বহন করতে হবে।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, কার্গো অপেক্ষায় রাখার জন্য আমাদের কোনো আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ দায়িত্ব আমাদের নয়। এটা এক্সিলারেট এনার্জিই বহন করছে। পাইপলাইনের যে জটিলতা ছিল, তা সমাধান হয়েছে। ১৪ জুন এ বিষয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। আপাতত কোনো সমস্যা নেই। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি আছে। ওগুলো শেষে ঈদের পর গ্যাস সংযোগ দেয়া যাবে।
জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ, শিল্প ও আবাসিকসহ বিভিন্ন খাতে দেশে গ্যাসের চাহিদা বর্তমানে দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৭০ কোটি ঘনফুট। ফলে ঘাটতি থাকছে ১৩০ কোটি ঘনফুট। এ সংকট সামাল দিতে এলএনজি আমদানির এ উদ্যোগ। এ লক্ষ্যে একটি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ ও ব্যবহার বিষয়ে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে পেট্রোবাংলা ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জির মধ্যে চুক্তি হয়। এরই মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) নির্মাণ শেষ করেছে এক্সিলারেট এনার্জি। ওই টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এলএনজির প্রথম কিস্তিও এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে।
গ্যাস সরবরাহের জন্য মহেশখালী থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। আনোয়ারা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করবে। আনোয়ারায় একটি সাব-স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা হয়ে আরো একটি গ্যাস পাইপলাইনে ফৌজদারহাট পর্যন্ত যাবে এলএনজি গ্যাস। ফৌজদারহাট থেকে চট্টগ্রামের উদ্বৃত্ত গ্যাস নেয়া হবে জাতীয় গ্রিডে।
কেজিডিসিএল সূত্রে জানা গেছে, এলএনজি সরবরাহের লক্ষ্যে এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনাল জাহাজ ভাড়া করা হয়েছে। জাহাজের ভাড়া, সেবা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে সরকার প্রতি বছর এক্সিলারেট এনার্জিকে ৭২০ কোটি টাকা প্রদান করবে। অর্থাৎ আমদানিকৃত এলএনজি তরলীকৃত অবস্থা থেকে গ্যাসে রূপান্তরসহ দৈনিক আনুষঙ্গিক ব্যয় প্রায় ২ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়েজ আহমেদ মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, এলএনজি সরবরাহ করবে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) । আমরা বিতরণ কোম্পানি হিসেবে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করব। শুরুতে মে মাসের শেষদিকে গ্যাস সরবরাহ করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ২৩ জুন সরবরাহ করা হবে বলে নিশ্চিত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরবরাহ না হওয়ায় দৈনিক ভিত্তিতে জাহাজ ভাড়া বাবদ ও গ্যাসের অপচয়জনিত কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, সে বিষয়ে আমি অবগত নই।
- Courtesy: Banikbarta /June 11, 2018
No comments:
Post a Comment