Search

Wednesday, June 27, 2018

গাজীপুরে ভোটারের হাত থেকে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে সিল


গাজীপুরের পুবাইল আদর্শ কলেজ কেন্দ্রে সবার সামনেই জালভোট দিচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। ভোটারের কাছে থাকা তিনটি ব্যালট পেপারের মধ্যে শুধু মেয়র পদের ব্যালট নিয়ে সিল দিয়ে বাক্সে ফেলছিলেন। ওই ব্যক্তি নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী ছিলেন।

মঙ্গলবার সকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পুবাইল আদর্শ কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটারের হাত থেকে মেয়র পদের ব্যালট পেপার টেনে নিয়ে কেন্দ্রের ভেতর এক বহিরাগত ব্যক্তি নিজ উদ্যোগেই নৌকা প্রতীকে সিল মারছিলেন।

‘আপনি কেন সিল মেরে দিচ্ছেন’—এমন প্রশ্নে বুথ থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান ওই ব্যক্তি।

এ ঘটনায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন ওই কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। ওই কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টরা নৌকা প্রতীকের এজেন্টদের কাছ থেকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তাঁদের প্রায় সবাইকে গলায় ঝুলিয়ে রাখা কার্ড প্রদর্শন না করে শার্টের নিচে, পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে দেখা গেছে। ভোটকেন্দ্রের কাছে ধানের শীষের নির্বাচনী ক্যাম্পেও নৌকা প্রতীকের এজেন্টদের বসে থাকতে দেখা গেছে। সেখানে ধানের শীষের এজেন্টদের দেখা যায়নি।

আজ সকাল থেকে পুবাইলের বসুগাঁও এলাকায় পুবাইল আদর্শ কলেজ কেন্দ্রে নারী ও পুরুষ ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি চোখে পড়ে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দেখা যায়, মোট আটটি বুথে পুরুষ (১-৪) ও নারী (৫-৮) ভোটাররা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে অপেক্ষা করছেন। নারীদের জন্য চারটি ও পুরুষদের জন্য চারটি বুথে ভোট নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৭ নম্বর বুথে বিএনপির কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি। বাকি বুথগুলোয় দায়িত্ব পালন করা বিএনপির এজেন্টরা অভিযোগ করেন, সকাল থেকে নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী লোকজন তাঁদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন, হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।

সকাল ১০টা ২০ মিনিটের দিকে ১ নম্বর বুথে (পুরুষ) গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সব দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্ট রয়েছেন। এর বাইরে ব্যালট বাক্সের সামনে সাদা টি-শার্ট পরা এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। ভোটারের হাতে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর পদের জন্য তিনটি ব্যালট পেপার তুলে দেওয়ামাত্র সাদা টি-শার্ট পরা ব্যক্তি ব্যস্ততার সঙ্গে ভোটারের হাত থেকে শুধু মেয়র পদের ব্যালট পেপার টেনে নিচ্ছেন এবং সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ভরে দিচ্ছেন। বাকি দুটো ব্যালট পেপারে ভোটার নিজেই ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

এই প্রতিবেদকের সামনেই ঘটনাটি ঘটছিল। এই প্রতিবেদক ওই ব্যক্তিকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ‘আপনি কে? আপনি কেন ভোট দিচ্ছেন’—জিজ্ঞেস করা মাত্র কোনো জবাব না দিয়ে তিনি দ্রুত ওই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।

এ নিয়ে ওই বুথে দায়িত্বরত সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি তাঁর অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বারবার মানা করার পরও তিনি এ কাজ করছেন।’

সাদা টি-শার্ট পরা ব্যক্তিকে এরপরও কেন্দ্রে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়।

ওই সময় পর্যন্ত ওই বুথে ১০৩টি ভোট পড়েছিল।

এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর ওই কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম। তাঁকে এই ঘটনা জানানো হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো অনিয়ম পাননি। কোনো বুথে বহিরাগত কেউ থাকতে পারবেন না। ওই সময় তিনি নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের বুথ থেকে বহিরাগত লোক থাকলে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

বুথের ভেতরে নৌকা প্রতীকের এজেন্টদের ফোন ব্যবহারের অভিযোগ করা হলে তিনি সবার ফোন ফেরত নেওয়ারও নির্দেশ দেন।

বেলা ১১টার দিকে ম্যাজিস্ট্রেট কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন।

তবে ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা পরিদর্শন শেষে কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বহিরাগত লোকজন প্রায় সব কটি বুথে ঢুকে পড়ে প্রকাশ্যে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ফেলতে থাকেন।

আটটি বুথের বেশির ভাগের নৌকা প্রতীকের এজেন্ট না হয়েও নৌকার ব্যাজধারী বহিরাগত ব্যক্তিদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। এবার তাঁরা ভোটারের হাত থেকে নয়, সরাসরি সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মারতে থাকেন। তবে তাঁরা শুধু মেয়র পদের সাদা রঙের ব্যালট পেপারই নিচ্ছিলেন। ভোটারের নাম জিজ্ঞেস করে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ভরতে দেখা যায় তাঁদের। প্রতিটি বুথে এমন একাধিক ব্যক্তি এই সিল মারার কাজ করেছেন।

৮ নম্বর বুথে গিয়ে দেখা যায়, সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন নৌকা প্রতীকে সিল মারছেন। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই জানালেন. নাম মো. আশরাফুল আলম। গাজীপুর মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। বাসা পুবাইলে। বললেন, ‘নৌকার জন্য এটুকু কাজ করতে হয়।’

ওই বুথেই ধানের শীষ প্রতীকের কার্ড ঝুলিয়ে এক ব্যক্তিকে জালভোট দিতে থাকা আশরাফুল আলমের সঙ্গে গল্প করতে দেখা গেছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, নাম সাকিব হোসেন। এই কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্ট মোবারক মোল্লার কাছ থেকে ধানের শীষের এই কার্ডটি পেয়েছেন বলে জানালেন।

৬ নম্বর বুথে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। বেগুনি রঙের পাঞ্জাবি পরা একজন নৌকা প্রতীকে ব্যালট পেপারে সিল মারছিলেন। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই বললেন, নাম মো. রাসেল। পুবাইল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। এবার ওই ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী।

ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ আতাউল্লাহকে ওই সময় বুথ থেকে বুথে ছুটোছুটি করতে দেখা গেছে। তিনি বহিরাগত ব্যক্তিদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি এক বুথ থেকে বের করে অন্য বুথে যাওয়া মাত্র বহিরাগত ব্যক্তিরা ফের ঢুকে জালভোট দেওয়া শুরু করেন।

ধানের শীষের নির্বাচনী ক্যাম্পেও নৌকার এজেন্ট

পুবাইল আদর্শ কলেজ কেন্দ্রের উল্টো দিকে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে। কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে করাত ও ঠেলাগাড়ি মার্কা আর মেয়র পদে ধানের শীষ ও নৌকা প্রতীকের আলাদা ক্যাম্প রয়েছে সেখানে। সেসব ক্যাম্প থেকে ভোটারদের হাতে যাঁর যাঁর প্রতীকের ছাপ দেওয়া ভোটার নম্বরের চিরকুট দেওয়া হচ্ছিল। ধানের শীষের প্রতীকের ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের ব্যানার ও পোস্টার থাকলেও তাঁর কোনো এজেন্ট নেই। ধানের শীষের এজেন্টদের বদলে সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের ছবিসহ নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী চারজন ভোটার চিরকুট বিতরণ করছেন। তাঁদের একজনের কাছে বিএনপির ক্যাম্পে বসে কাজ করার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘বিএনপির কোনো এজেন্ট এখানে বসেননি। ফাঁকা পেয়ে আমরা বসেছি।’

  • Courtesy: Prothom Alo/ June 27, 2018

No comments:

Post a Comment