Search

Tuesday, June 5, 2018

চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা নয়

হাসান ফেরদৌস

জন্মাবধি শুনে আসছি চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। এই প্রবাদের সারকথা হলো, সুযোগ থাকলে চুরি করো, সমাজ এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করবে না। করেও না। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, মহা চোর হিসেবে পরিচিত লোকেরাই সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত। কেউ মন্ত্রী, কেউ এমপি, কেউ মস্ত ব্যবসায়ী। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যাঁরা সে টাকা ফেরত দেন না, তাঁরাও তো চোর বৈ অন্য কিছু নন। আর এসব লোকই আমাদের সমাজে লাঠি ঘোরান।

সমস্যা হলো, এখন না হলেও একসময় এঁরা ঠিকই ধরা পড়েন। কেউ যদি জীবদ্দশায় আইনের ফসকা গেরো দিয়ে পিছলে যানও, ইতিহাস কিন্তু তাঁদের ক্ষমা করে না।

ফিলিপাইনের মার্কোসের কথা ভাবুন, অথবা কঙ্গোর মবুতু। জনতার রোষ এড়াতে দেশ থেকে পালিয়ে জীবন নিয়ে বেঁচেছেন বটে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এখন তাঁদের পরিচয় বিশ শতকের দুই প্রধান চোর হিসেবে। তাঁরা নেই বটে, কিন্তু তাঁদের ছেলেমেয়েরা চুরির টাকায় কেনা ঘরে রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে তো?

আসলে চুরিবিদ্যা আদৌ কোনো মহাবিদ্যা নয়, এমনকি চুরি করে কেউ যদি ধরা না-ও পড়ে। যাঁরা ক্ষমতার কেদারায় বসেন, তাঁরা হয়তো এই সত্য টের পান না। কিন্তু ধর্মের কল একসময় ঠিকই বাতাসে নড়ে।

মালয়েশিয়ার নাজিব রাজাকের কথা ভাবুন। ক্ষমতা থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় টলে পড়বেন, এ কথা তিনি ভাবেননি, তাঁর দেশের মানুষেরাও নয়। প্রায় এক দশক ক্ষমতার কেন্দ্রে তিনি। রাজনৈতিক দল, পত্রপত্রিকা ও টিভি, নিরাপত্তা বাহিনী, এমনকি বিচারপতিরাও তাঁর পকেটে। ডাইনে-বাঁয়ে না তাকিয়ে চুরি করেছেন। তাঁর সময়ে সরকারি উন্নয়ন তহবিল থেকে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের মতো খোয়া গেছে, তার একটা বড় অংশ জমা পড়েছে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।

বিলাস-ব্যসনের ব্যাপারে তাঁর স্ত্রীর খ্যাতি ইমেলদা মার্কোসকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি একবার ২২ ক্যারেটের এক গোলাপি হিরার আংটি কিনেছিলেন, যার দাম সাড়ে ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। পুলিশ ইমেলদার ঘর থেকে হাজার হাজার জুতা উদ্ধার করেছিল। আর নাজিবের স্ত্রীর আলমারি থেকে পাওয়া গেছে হাজার হাজার ডিজাইনের হাতব্যাগ। কাঁচা টাকা ও গয়নাগাটিভরা ২৭৪ বাক্স পুলিশ উদ্ধার করেছে।

তাহলে কী লাভ হলো চুরিবিদ্যা শিখে? ধরা তো পড়েই গেলেন!

অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার কথা ভাবুন। নেলসন ম্যান্ডেলার উত্তরসূরি, আর সেই লোক দেশের মানুষের কথা না ভেবে শুধু নিজের পকেট ভরতেই সময় কাটালেন। নিজের গ্রামে সরকারি খরচে এমন এক আলিশান বাড়ি বানিয়েছেন, যার বাবদ বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ কোটি ডলার। দক্ষিণ আফ্রিকার পাবলিক প্রটেক্টর এই বাড়ি বানানোর সমালোচনা করে যে কড়া প্রতিবেদন তৈরি করেন, তাতে বলা হয় এই অর্থের বড় একটা অংশ জুমার পকেটে গেছে। সে তথ্য ব্যবহার করে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি পত্রিকা প্রথম পাতায় এক কার্টুন ছেপেছিল। তাতে নিজ বাড়ির সুইমিংপুলে থোকা থোকা টাকার মাঝখানে মহানন্দে শুয়ে জুমা।

দুই মাস আগে নিজ দলের লোকেরাই তাঁকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছেন। তাহলে কী লাভ হলো এত টাকার জন্য খাই খাই করে?

আফ্রিকার আরেক নেতা রবার্ট মুগাবেরও একই দশা। ভাবুন, তিনি দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা, সারা আফ্রিকা তাঁকে বীর হিসেবে সম্মান করে। অথচ দেখা গেল তিনি আসলে মস্ত চোর। দেশের রাজকোষকে তিনি নিজের ব্যক্তিগত বাজার খরচের পুঁটলি ভেবেছিলেন। তাঁর স্ত্রী গ্রেস, সে দেশের লোক পরিহাস করে যার নাম দিয়েছে ‘ডিসগ্রেস’, তিনি বিলাস বাহুল্যে ফ্রান্সের রানি মারি আন্তোনেতকেও হার মানাতেন।

একবার প্যারিসে বাজার-সদাই করতে গিয়ে এক দিনে তিনি খরচ করেছিলেন প্রায় এক লাখ ডলার। শোনা যায় সে যাত্রায় তিনি ৩০০ জোড়া জুতো কিনে ঘরে ফিরেছিলেন। এখন অবশ্য ঘর নয়, তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে শ্রীঘর।

যে উদাহরণগুলো দিলাম তা শুধু চুরির নয়, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারেরও। একেই আমরা অন্য কথায় দুর্নীতি বলে থাকি। সভ্যতার আদিকাল থেকে শক্তিধর মানুষ তাঁদের ওপর ন্যস্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। আড়াই হাজার বছর আগে কৌটিল্য বলে গেছেন মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে।

দুর্নীতির বেলায়ও তা-ই। রাজা যদি সচেতন না থাকেন, তাহলে সে রাজ্যের মন্ত্রী, কোটাল, চাই কি লেঠেল সর্দার পর্যন্ত সময়-সুযোগ বুঝে দু-দশ (কোটি) টাকা হাতিয়ে নেন। কেন নেন, তার এক ব্যাখ্যা কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে করেছেন। ‘রাজার কাজ পারিষদদের হাত থেকে চুরি ঠেকানো। তবে চুরি ঠেকানো সহজ নয়। জিবের ডগায় মধু রাখা হলে তা চেখে দেখা যেমন কঠিন, ঠিক সেই রকম সরকারি অর্থ হাতের নাগালে এলে তা না হাতিয়ে স্থির থাকা বড়ই কঠিন।’

কৌটিল্য, যার অন্য নাম চাণক্য, এই কথাগুলো বলেছিলেন রাজা চন্দ্রগুপ্তের উদ্দেশে। কৌটিল্য হয়তো আশা করেছিলেন রাজা রাজকোষ থেকে চুরি রোধের ব্যবস্থা নেবেন। তাঁর নিজের তো চুরির প্রয়োজন নেই, সারা রাজ্যটাই তো তাঁর, কৌটিল্যের চোখে সেটাই ছিল আশার কারণ। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টে গেছে।

রাজা-রাজড়ারা এখন আর তেমন নেই, আর যাঁরা আছেন তাঁদের হাত-পা বাঁধার নানা ব্যবস্থা রয়েছে। সমস্যা হলো, এখন এমন অনেক ক্ষমতাবান রয়েছেন, যাঁরা রাজা না হয়েও রাজার মতো ব্যবহার করেন। মুগাবে বা জুমার ব্যবহার থেকে সে কথাই স্পষ্ট।

আরও একটা জিনিস স্পষ্ট। এসব ক্ষমতাবান লোক ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারেন, কারণ আমরা, অর্থাৎ দেশের মানুষ, মুখ বুজে তাঁদের সে সুযোগ দিই। কখনো কখনো আমরাই যুক্তি দেখাই চুরি তো নেতা করেন না, তাঁর পারিষদেরা করেন। এ কথাও বলি এখন যারা ক্ষমতায় তারা তো রয়েসয়ে চুরি করে। অন্যরা ক্ষমতায় এলে পুকুর গিলে খাবে।

অথচ জনগণের অর্থ নিয়ে নয়ছয় হলে-তা সে যেভাবেই হোক-ক্ষতিটা কিন্তু আমাদের। একটা উদাহরণ দিই। কয়েক বছর আগে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি বহুতল ভবন ধসে পড়লে ২৫ জন মানুষ নিহত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ভবন নির্মাণেই গলদ ছিল।

সরকারি পরীক্ষকেরা সে কথা জানতেন, কিন্তু পিছ পকেটে উৎকোচ পেয়ে সে কথা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। এমন ঘটনা অবশ্য আমাদের দেশে হরহামেশাই ঘটছে। লোহার বদলে বাঁশ ঢুকিয়ে দিচ্ছি, ইন্সপেক্টররা সে খবর জানেন না, তা তো নয়। কিন্তু কৌটিল্য তো বলেই গেছেন, ঠোঁটের আগায় যদি মধু ঢেলে দেওয়া হয়, তাহলে ইন্সপেক্টর সাহেবের আর দোষ কী?

তাহলে কি এদের হাত থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নেই? আছে, গোড়াতে যেসব নেতার কথা বলেছিলাম, তাঁদের পরিণতির কথা একবার ভাবুন। এঁরা প্রত্যেকে গণরোষের শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। কেউ দেশ থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন, কেউ ঢুকেছেন জেলখানায়। জনগণই এঁদের ক্ষমতায় বসায়, আবার ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর ক্ষমতাও জনগণেরই রয়েছে।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
  • কার্টেসিঃপ্রথম আলো/ জুন ৫,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment