- আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে
- দুষ্টচক্রের ভেতরে ঢুকেছে বৈদেশিক বাণিজ্য
- দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অর্থনীতির চিত্র হবে বিকৃত
সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে দেশের আমদানি ব্যয়, যা বিনিয়োগ ও অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর বড় কারণ হল, নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বাইরে অর্থ পাচার হচ্ছে।
আমদানির নামে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে দেশের বাইরে টাকা নিচ্ছে একটি চক্র। অর্থাৎ দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের খাত একটি দুষ্টচক্রের ভেতরে ঢুকে গেছে। আর বিষয়টি এখনই নিয়ন্ত্রণ না করলে আগামী দিনে অর্থনীতির বিকৃত চিত্র দেখা যাবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সামষ্টিক অর্থনীতির বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠেছে। রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সিপিডি মনে করছে, দেশের ব্যাংকিং খাত নষ্ট রাজনীতির শিকার। এক্ষেত্রে যাদের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব, সেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় আমানতদারিদের পরিবর্তে নষ্ট ও ভ্রষ্ট লোকের স্বার্থ রক্ষা করছে। ফলে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়ন করে সমস্যা সমাধানের সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, এ মুহূর্তে দেশের আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে যতটুকু সমস্যা, তার চেয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনে অনেক বেশি সমস্যা রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের আয় ও ব্যয় এখনও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এরপরও বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে। কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সামগ্রিক ঘাটতি যেমন বেড়েছে, একইভাবে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়ছে। বর্তমানে এটি আশঙ্কাজনক অবস্থায় চলে গেছে। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় রফতানি, রেমিটেন্স ও বৈদেশিক সাহায্য তিনটিই বেড়েছে। এরপরও চলতি হিসাবে ঘাটতি বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। এর বড় কারণ হল দেশের আমদানি ব্যয় অনেক বেশি বেড়েছে।
দেবপ্রিয় বলেন, গত বছরের তুলনায় রফতানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭ এবং রেমিটেন্স বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। তিনি বলেন, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, আমদানির আড়ালে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমদানির নামে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিদেশে টাকা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সিপিডির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, যে কোনো নির্বাচনী বছরে এ টাকা পাচারের প্রবণতা বাড়ে। এর মানে হল, একটি দুষ্টচক্রের ভেতরে বৈদেশিক খাত ঢুকে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এ আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ না করলে অর্থনীতি সম্পর্কে বিকৃত চিত্র দাঁড়াবে, চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়তে থাকবে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমতে থাকবে। সাময়িকভাবে এতে রফতানিকারকরা একটু খুশি হলেও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে, যা শ্রমের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও চাপ সৃষ্টি করবে। অবধারিতভাবে বাড়বে ব্যাংক ঋণের সুদের হার, যা শিল্পায়নে প্রভাব ফেলবে।
সিপিডির ফেলো বলেন, এর সঙ্গে আরেকটি দুশ্চিন্তার কারণ হল অবকাঠামো খাতে যে হারে ঋণ নেয়া হচ্ছে, বর্তমানে তা নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে তা থাকবে না। এর আগে বিষয়টি সিপিডি গবেষণা করেছে।
সেখানে শ্রীলংকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে, ঋণ নিয়ে বড় বড় অবকাঠামো করার পর কীভাবে দায় দেনা পরিশোধের কারণে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। ফলে কেউ অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে এককথায় এভাবে উত্তর দিই, দেশের আর্থিক খাত নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত আমদানির কারণে বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্ক আছে। ফলে দেশের আমদানি পরিস্থিতি তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ জরুরি।
প্রয়োজনে বাজেটকে সামনে রেখে সাময়িকভাবে বিলাসবহুল পণ্য থেকে শুরু করে যেসব পণ্যে টাকা পাচারের আশঙ্কা বেশি, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে শূন্য শুল্কে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, সেগুলো বিশেষ নজরদারি করা দরকার।
তিনি বলেন, অর্থনীতিতে আরেকটি সমস্যা হল ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব। এ সমস্যায় হাত না দিয়ে তারল্য সংকটের পেছনে ছুটছেন নীতিনির্ধারকরা। অর্থাৎ রোগের চিকিৎসা না করে উপসর্গের পেছনে দৌড়ানো হচ্ছে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, পুরো ব্যাংকিং খাতের ভেতরে সুশাসনের অভাব রয়েছে। মূল সমস্যা হল, লক্ষ্যভ্রষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতির শিকার ব্যাংক। এর মানে হল, অর্থনীতিটিই ঠিক নেই। যার (আমানতকারী) স্বার্থ রক্ষা করার কথা, তার ওপরই অত্যাচার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় যারা ব্যাংকিং খাতের স্বার্থে কাজ করার কথা ছিল, তারা নষ্ট এবং ভ্রষ্ট লোকজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওইসব লোকের স্বার্থ রক্ষা করছে। ফলে রাজনৈতিক অর্থনীতি যতক্ষণ ঠিক না হবে, ততদিন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করেও তেমন কোনো কাজ হবে না। প্রশ্ন হল, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক অর্থনীতি আরও বেশি জটিল হচ্ছে কি না। তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে অবশ্যই লাখ লাখ আমানতকারীর স্বার্থ বিবেচনায় নিতে হবে।
এক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছা পরিচয় দিতে হবে। আর বাজেটের মধ্যে বিষয়টি দেখার জন্য মানুষের একটি আকাক্সক্ষা রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আর্থিক খাতে দুর্নীতি, দুরাচার, আইন লংঘনসহ বিভিন্ন অপরাধ হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও দৃশ্যমান বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকা উচিত। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এটি আরও বড় সমস্যা। ফলে দুদকের পদক্ষেপগুলো যেন লোক দেখানো না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, গত কয়েক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি মোটামুটি শোভন অবস্থায় থাকার পরও সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় অল্প অল্প করে চির ধরছে। যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, তাতে মানুষের কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যবিমোচনে আশানুরূপ ইতিবাচক ফল দেখছি না। ফলে আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রবৃদ্ধির গুণগতমান বৃদ্ধি এবং সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বিদ্যমান চাপ মোকাবেলা করা।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, চলতি বছরে ৭ দশমিক ৬৫ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ হার এত উচ্চ হওয়া সত্ত্বেও কেন কর্মসংস্থান বা আয়ের ক্ষেত্রে তাৎপর্য পরিবর্তন আসছে না। অপরদিকে বৈষম্য বাড়ছে। ক্রমেই ভোগবৈষম্য, আয়বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে। শিক্ষিত যুবকরা কর্মসংস্থান থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত।
ফলে আগামী বাজাটে বড় একটি চ্যালেঞ্জ থাকবে, প্রবৃদ্ধির গুণগতমান পরিবর্তন করে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ানোর কৌশল প্রণয়ন করা। কম প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য ভালো কি না, তা বিবেচনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে যেসব চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তা মোকাবেলা করা জরুরি।
সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে গুণগতমান আরও বাড়ানো জরুরি বলে মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, একদিকে প্রকল্পগুলোয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে অতিমূল্যায়নের একটি সমস্যা রয়েছে। পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ছে। এক কিলোমিটার রাস্তা বানাতে বাংলাদেশে যে ব্যয়, তা ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে বেশি।
এভাবে আরও বড় কয়েকটি প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অন্যদিকে বাংলাদেশে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে। বিশেষ করে খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুরসহ পিছিয়ে পড়া কিছু অঞ্চল রয়েছে। ওই অঞ্চলে দারিদ্র্যবিমোচনের হারও শ্লথ হয়ে আছে। এসব অঞ্চলের এ ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত।
তিনি বলেন, বাজার অর্থনীতির দুরাচার ও হস্তক্ষেপের কারণে কৃষক ফসল উৎপাদনের পরও ন্যায্যমূল্য পান না। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছিল ১ দশমিক ৩ লাখ টন। চলতি বছরের একই সময়ে ৩৯ লাখ টন আমদানি করা হয়েছে।
অর্থাৎ যখন আমদানি দরকার ছিল, তখন করা হয়নি। আর যখন দরকার নেই, তখন আমদানি করে মজুদ করা হয়েছে। তার মানে হল, বাজার ব্যবস্থাপনায় কেউ কোনো না, কোনোভাবে অপনিয়ন্ত্রণ করছে। এক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী সুযোগ নিয়েছে। এটি হল অপরাজনৈতিক অর্থনীতির আরেকটি বহির্প্রকাশ।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের ওপর সরকারকে অধিক হারে নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা করা উচিত। এক্ষেত্রে ন্যূনতম কর হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা যেতে পারে। এছাড়াও মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং দেশের মানুষের মধ্যে বৈষম্য রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করেন তিনি।
- Courtesy: Daily Jugantor/ June 04, 2018
No comments:
Post a Comment