কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন অভিভাবক ও উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। পাশাপাশি হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মুক্তি চেয়েছেন তারা।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে শুক্রবার ৬ জুলাই আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে এ দাবি জানানো হয়েছে।
প্রতিবাদ সমাজে পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ইনামুল হক বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্রসমাজের ন্যায্য আন্দোলন। এই আন্দোলনে কারা হামলা করেছে তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সরকারের এত এত গোয়েন্দা সংস্থা, এ ঘটনার ছবি, ভিডিও ফুটেজ আছে। সরকারের উচিৎ এদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী এগুলো চোখে দেখছেন না।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের পেটোয়া বাহিনী ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। আজ কোদাল দিয়ে কোপানো হচ্ছে, লাঠি দিয়ে মারা হচ্ছে, হাতুড়ি পেটা করা হচ্ছে। যারাই প্রতিবাদ করতে যাচ্ছেন, যুক্তিসঙ্গত আন্দোলন করছেন তারাই পেটোয়া বাহিনীর রোষানলে পড়ছেন ‘
প্রতিবাদ সমাবেশে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুরুর বাবা।
নুরুর পিতা ইদ্রিস হাওলাদার আটক হওয়া ছাত্রদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আপনি দেশের মা। দেশের নাগরিকরা আপনার সন্তানের মতো। সন্তানরা আপনার কাছে আবদার করতেই পারে। আপনি দেবেন কী দেবেন না, সেটা আপনার বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু আপনি নির্যাতন করতে পারেন না। আহত ছেলে-মেয়েদের রাষ্ট্রীয়ভাবে চিকিৎসা করানো হোক এবং গ্রেপ্তার ছেলে-মেয়েদেরকে তাদের বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিন। এই সমাবেশে ইদ্রিস হাওলাদার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘কষ্টে আমি কথা বলতে পারছি না। আমার হৃদয় ফেটে যাচ্ছে। সারাদেশের মানুষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে ছিল। আমার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্স করা একজন মানুষ। তার জ্ঞান আছে, যা আমার নাও থাকতে পারে। তাই সে সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে কোটা সংস্কার আন্দোলন করে। আমার ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে নির্যাতন নিপীড়ন করেছে। সে এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। আমি গ্রামে কৃষি কাজ করি। তার চিকিৎসায় আমি টাকা দিয়েছি। নুরুকে মারধরের পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেও তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ছেলের লেখাপড়া করাচ্ছি জমিজমা বিক্রি করে। হামলায় আমার ছেলে গুরুতর আহত হয়েছে। এখন জমিজমা বিক্রি করে তার চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছি।’
প্রতিবাদ সমাবেশে তেল-গ্যাস বিদ্যুৎ, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সরকারের ভাষায় সরকার উন্নয়ন করছে। জনগণের জন্য যদি উন্নয়ন হয় তাহলে সরকারের এত ভয় কেন? কেন তাদের পেটোয়া বাহিনীর দরকার হচ্ছে? কেন আন্দোলনকারীদের ওপর এমন হামলা চালানো হলো?’
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির অসঙ্গতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা প্রকৃতভাবে সুবিধাবঞ্চিত সেই অসহায় নারী, সুবিধাবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধারা এর সুফল পায় না। সরকারি আমলা, কর্মকর্তা ও তাদের লোকজন এই কোটার সুযোগ নিচ্ছে। কোটা যত থাকবে, নিয়োগ বাণিজ্যে তত লাভ। এই কারণে তারা এই কোটার সংস্কার চায় না।’
সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিলেন। কিন্তু সেটির বাস্তবায়ন হলো না। এটি সংসদে প্রধানমন্ত্রীর কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না, এটি ছিল তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ কারণে পরবর্তীতে আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে।’
প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমেদ কামাল।
তিনি বলেন, ‘এই সরকার রাষ্ট্রবিদ্রোহী সরকার। রাষ্ট্রবিদ্রোহ কেবল নাগরিক করে না, সরকারও করে সেটি আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে।’
দেশের রাজা যদি ঠিকমতো দেশ শাসন না করেন তবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আন্দোলনকারীদের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবস্থানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রশাসনের মতো অর্থব ও তেলবাজ প্রশাসন আমি দেখিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন তা আর কোনো শিক্ষক দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।’
আহমেদ কামাল আরও বলেন, ‘৭৫ এ বাকশাল ঘোষণা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যেন বাকশালে যোগ দেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষক বাকশালে যোগ দেননি। আজকেও দেখি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ শিক্ষক দাঁড়িয়েছেন। এখনও আলো নিভে যায়নি, একদিন আলো দপ করে ঠিকই জ্বলে উঠবে।’
তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের ফলে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু তারপরও দেখলাম প্রশাসন আন্দোলনকারীদের তথ্য নিয়েছে, নাম-ঠিকানা নিয়েছে তাদের পরিবারকে হয়রানি করেছে। ভয়-ভীতি দেখিয়েছে। অগ্নিকন্যা বললেন এরা সব রাজাকারের বাচ্চা। প্রথম দিকেই এদের রাজাকার, জামায়াত, দেশদ্রোহী বানানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। এই ছাত্র সমাজ সকলের ইন্টাররেস্ট দেখছে। সে কারণে কাজ হয়নি। সকলের জন্য সমান সুযোগ দেওয়া এটা একটি ডেমোক্রেটিক ডিমান্ড।’
- কার্টসিঃ সারাবাংলা / জুলাই ৭,২০১৮