Search

Monday, July 9, 2018

তরিকুলের ওপর হামলাকারী কারা


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তরিকুলের ওপর হামলার যেসব ভিডিও ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের লাঠি, রাম দা ও হাতুড়ি নিয়ে আঘাত করতে দেখা গেছে। গত ২ জুলাইয়ের ওই হামলায় তরিকুলের ডান পায়ের দুটি হাড় ভেঙে যায়।

তরিকুলের ওপর হামলাকারীদের মধ্যে ১১ জনকে চিহ্নিত করেছে দ্য ডেইলি স্টার। এদের মধ্যে ১০ জনই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

হামলার পর থেকে চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের সবাইকেই ক্যাম্পাসে দেখা গেছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে তারা এখন প্রচারণা চালাচ্ছেন।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুল ইসলামের ওপর হামলা চালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন। তরিকুলের পায়ে ও কোমরে লোহার হাতুড়ি দিয়ে সে আঘাত করে। তার বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান এলাকায়। সে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসম্পাদক।

হামলা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে গতকাল বলেন, ‘ওই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।’

তরিকুল যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল, মামুনের সঙ্গে রমিজুল ইসলাম রিমু ও লতিফুল কবির মানিক তার ঘাড়ে ও পিঠে লাথি মারছিল। রমিজুল ইসলাম রিমু ছাত্রলীগের রাবি শাখার সহসভাপতি। আর লতিফুল কবির মানিক মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের কর্মী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে ফেলে পেটানোর সময় তরিকুল হাত দিয়ে তার মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। এসময় ছাত্রলীগের কর্মী জন স্মিথ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু ও রিমু এগিয়ে গিয়ে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করেন। মানিক ব্যাডমিন্টন কভার থেকে একটি রামদা বের করে রাম দা’টির ভোঁতা দিক দিয়ে তরিকুলকে আঘাত করেন। তখনও হাতুড়ি ও বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত অব্যাহত ছিল।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, তরিকুলকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলেন রাবি শাখা ছাত্রলীগের অনুষ্ঠান ও পরিকল্পনা বিষয়ক সহসম্পাদক সৌমিত্র কুমার রানা। অন্যান্য ছবিতে সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান লাবন ও চার জন সহসভাপতি—আহমেদ সজীব, গুফরান গাজী, শোভন কায়সার ও মিজানুর রহমান সিনহাকে লাঠি নিয়ে পেটাতে দেখা যায়।

এ ব্যাপারে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে সহিংসতার চেষ্টা করছিল কিছু ছাত্র। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির লোকজন ছাত্রদের উষ্কানি দিচ্ছিল। ‘তাদেরকে প্রতিহত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা সেটাই করেছি।’

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাতুড়ি নিয়ে হামলাকারী মামুন দাবি করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরাই তাদের ওপর হামলা চালাতে গিয়েছিল। ‘ওরা হামলা করতে এলে আমরা তাদের ধাওয়া করি। তাদের মধ্যে একজন পড়ে গেলে আমরা সবাই মিলে মারধর করি… ঘটনা এটাই।’ হাতুড়িসহ হামলার অস্ত্র তাদের কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছিল বলে তার দাবি।

নিজের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ভালো আছি।

হাসিমুখে গর্বভরে বলেন, ‘অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছে, আমি ক্যাম্পাস থেকে পালিয়েছি কিনা। আমি পালাইনি। আমি ক্যাম্পাসেই আছি এবং আমার ওপর কোনো মানসিক চাপ নেই।’

হামলায় তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশান বা ছাত্রলীগের কেউ যোগাযোগ করেছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, না…না কেউ আমাকে কিছু বলেনি।’

যোগাযোগ করা হলে রাবি প্রক্টর লুতফর রহমান বলেন, ঘটনাটি ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটায় তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি দেখবে।

হামলাকারী ও হামকার শিকার সবাই রাবির ছাত্র ছিল জানানোর পর তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সেখানে ছিলেন। তারাই আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ বিষয়টি দেখবে।

ছবি ও ভিডিওতে যাদেরকে হামলা চালাতে দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তারা বিষয়টি দেখবেন।

  • The Daily Star/ jul 9, 2018 

চলে যা ভাই…


ইসরাফিল খসরু


গত বেশ কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেদম প্রহার, নিষ্ঠুর নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচেছ আমাদের তরুণ ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’ এর নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। এদের অধিকাংশই দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থী ছেলেমেয়ে। বলা হচ্ছে, এঁদের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। যদি ধরেও নিই এতে ছাত্রলীগের কোন ভূমিকা নেই, তাহলে প্রকাশ্য দিবালোকে জনস্মুখে সংবাদকর্মীদের সামনে এমন সন্ত্রাসী কাজ করার সাহস কোথা থেকে পেল তারা? সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এই ঘটনাগুলোতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর দৃশ্যমান অনুপস্থিতি। 

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে।    এক — তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি, আইনশৃংখলার দায়িত্ব পুলিশ কতিপয় যুবকদের হাতে তুলে দিয়েছে? যদি তা হয় তাহলে জনগণের কাছে কি বার্তা পৌঁছায়? দুই —  সরকার কি আন্দোলনটিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে না ন্যায্য অধিকারের অবস্থান থেকে দেখছে। তিন — দেশের সাধারণ জনগণের ভাবনা কি? তারা কি এটিকে শুধুমাত্র ছাত্রদের আন্দোলন হিসেবে দেখছে? 

এই প্রশ্নমালার উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের কাছে কিছু জিনিস পরিস্কার হয়। 

প্রথমে —   আইনশৃংখলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা যা একটি অশনি বার্তাই দেয়। বার্তাটি হচ্ছে একটি যৌক্তিক আন্দোলনেও জনগণের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। এই ছাত্ররা বাংলাদেশেরই জনগণ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাওয়া তাদের অধিকার। প্রথমে মানুষ বুঝে নিচ্ছে সরকারের নির্দেশেই তারা নিস্ক্রিয় থাকছে। কাজেই, ধরে নেয়া যায়, এই আইন-শৃংখলা বাহিনী সরকারের সেবার জন্য, জনগণের নয়।

সরকারের আচরণ থেকে এটি পরিস্কার, সরকার এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। এটি যে অধিকারের আন্দোলন সেটিকে সরকার মেনে নিচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার এই আন্দোলনে  জামাত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা ও পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। অথচ সরকার যদি এই আন্দোলনকে অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখত, তাহলে এর সমাধান দেখতে পেতাম। 

যেখানে এপ্রিল ১১, ২০১৮, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন সাধারন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা-সংস্কার’ দাবি তিনি মেনে নিয়েছেন এবং আন্দোলনকারীরা সেই আশ্বাসের বিশ্বাসের নিরিখে আন্দোলন স্থগিত রাখে, সেইখানে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিলম্বিত হচ্ছে এর বাস্তবায়ন। ইতোমধ্যে কোটা পদ্ধতিতে ৩৭তম বিসিএসের ফলাফলও দিয়ে দেয়া হয়েছে, যদিও ৩৭তম থেকেই কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবি ছিল।  তার উপর আন্দোলনকে বিতর্কিত করে ভিন্নাখাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। এসবকে সরকারের সদিচ্ছার অভাবের আলামত হিসেবেই দেখা স্বাভাবিক। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, এই বিষয়ে তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করা। 

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের ভূমিকা কি হতে পারে? তারা যদি এই আন্দোলনকে শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হিসেবে দেখে, তাহলে এই আন্দোলন খুব বেশি গতি পাবে না। এইক্ষেত্রে এই বার্তাটিও সর্বমহলে পৌঁছাবে যে দেশে কোন যৌক্তিক আন্দোলন হলে তাতে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে না, সেইখানে শুধু যে শ্রেণির আন্দোলন তারাই শুধু অংশ নেবে। অথচ চলমান  ‘কোটা-সংস্কার-আন্দোলন’  যা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মেধাভিত্তিক উজ্জ্বল এক বাংলাদেশ গড়ার, সেই আন্দোলনে যদি জনগণ সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে আন্দোলনকারীদের আমরা এখনি বলে দিতে পারি —    "চলে যা ভাই, এই দেশে তোদের কোন ভবিষ্যত নাই।" মেধার মূল্যায়ন ও বিকাশের জন্য আমাদের ছেলেরা রাস্তায় মার খাবে কিন্তু আমরা তাদের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে একটি উজ্জ্বল বাংলাদেশের আশা করব, সেই ধারণাটিই ভুল। সেইক্ষেত্রে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। 

  • লেখক বাংলাদেশের একজন হতভাগা নাগরিক। 

রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে এগিয়েছে চীন

সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রক্রিয়া শেষ মুহূর্তে আটকে যায়। এর পর থেকে ফাইলবন্দি প্রকল্পটি। সোনাদিয়ায় না হলেও মিয়ানমারের রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পথে অনেকটাই এগিয়েছে চীন। সোনাদিয়া থেকে ২৮৯ কিলোমিটার দূরে রাখাইনের কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত। শিগগিরই এ বিষয়ে চুক্তি হবে বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম সিনহুয়া।

কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের (সিআইটিআইসি) নেতৃত্বে চীনের ছয়টি গ্রুপ অব কোম্পানির কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা করছে মিয়ানমার। কিয়াকপিউয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে আহ্বান করা দরপত্র প্রক্রিয়ায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে যোগ্য বিবেচিত হয় সিআইটিআইসির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম। প্রকল্প দুটির মধ্যে রয়েছে একটি শিল্পপার্ক। অন্যটি গভীর সমুদ্রবন্দর। মূলত কিয়াকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ হিসেবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সিআইটিআইসি এ বিষয়ে শিগগিরই চুক্তিতে পৌঁছবে বলে আশা করছে উভয়পক্ষ।

মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী থান মিয়েন্ট সিনহুয়াকে বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হিসেবে কিয়াকপিউয়ের গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। দুই দেশের জন্যই এটি সমান লাভজনক হবে। এছাড়া সমুদ্রবন্দরটির কল্যাণে উন্নয়ন হবে রাখাইন রাজ্যেরও। স্থানীয়দের জন্য বিপুল কাজের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখবে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।

গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের আওতায় রয়েছে মাদেই আইল্যান্ড টার্মিনাল ও ইয়ানবাই আইল্যান্ড টার্মিনাল। এতে জাহাজ নোঙরের সুবিধাসম্পন্ন মোট ১০টি বার্থ থাকবে। শিল্পপার্ক ও গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে রাস্তা ও সেতু নির্মাণের কাজও রয়েছে প্রকল্পটির আওতায়। ২০ বছরে মোট চারটি ধাপে গভীর সমুদ্রবন্দরটির নির্মাণকাজ শেষ হবে। নির্মাণ সম্পন্ন হলে বার্ষিক ৭৮ লাখ টন বাল্ক কার্গো ও ৪৯ লাখ টিইইউএস কনটেইনার ধারণ সক্ষমতা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করবে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।

কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বাংলাদেশও অনেকটা এগিয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠনের পর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। জাপানের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সে সময় এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও পরিচালনা করে। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১১-এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এরপর প্রকল্পটিকে ফাস্টট্র্যাক মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়। প্রকল্পটির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় একটি কমিটিও।

গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা হয়নি। এর পর থেকে এক প্রকার ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে প্রকল্পটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজে গতি আসেনি। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ভূ-রাজনৈতিক কোনো প্রভাব আমাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে। এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে সামনে এগোতে হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সবাইকে নিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাই আমরা। বিষয়টি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে ধরার দরকার ছিল। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেটি তুলে ধরতে পারিনি আমরা।

মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ বরাবরই ছিল বলে জানান সাবেক এ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়, সে সময়ও মিয়ানমারের কাছে চীনের প্রস্তাবটি ছিল। অল্প দূরত্বে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকলে তার অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই হয়তো সোনাদিয়া গুরুত্ব পাচ্ছে না।

রাখাইনের কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী সিআইটিআইসির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামের অন্য অংশীদারগুলো হলো— চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, চায়না মার্চেন্টস হোল্ডিংস (ইন্টারন্যাশনাল), টিইডিএ ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিং, ইউনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ও থাইল্যান্ডের চারোয়েন পোকফান্ড গ্রুপ অব কোম্পানিজ। মিয়ানমারের স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকল্প দুটি নির্মাণ ও পরিচালনাকাজ সম্পন্ন করবে সিআইটিআইসি কনসোর্টিয়াম। ২০১৪ সালে মিয়ানমার সরকারের ঘোষিত মিয়ানমার স্পেশাল ইকোনমিক জোন ল’ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। 

বিশ্লেষকদের মতে, চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মূলেও আছে রাখাইনের কিয়াকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর এ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরেই নির্মাণ করা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দরটি। 

ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির বলেন, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে যে অস্থিরতা তার অন্তর্নিহিত কারণ এ অঞ্চলের সম্পদ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও এর শিকার।

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর নাফ নদী পাড়ি দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে থাকে। সেই সময় থেকে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা।

  • Courtesy: BanikBarta /Jul 09, 2o18

আগামী সপ্তাহে মজুরি প্রস্তাব দেবে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের দ্বিতীয় সভা রোববার বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে মালিক ও শ্রমিক কোনো পক্ষই মজুরি প্রস্তাব দেয়নি। উভয় পক্ষই ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে প্রস্তাব জমা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

রাজধানীর তোপখানা রোডে রোববার বিকেলে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের দ্বিতীয় সভা শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। সভায় মালিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি কাজী সাইফুদ্দিন আহমদ, শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি ফজলুল হক, পোশাকশিল্পের মালিক প্রতিনিধি তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, পোশাকশিল্পের শ্রমিক প্রতিনিধি জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বেগম শামছুন্নাহার ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। তবে বোর্ডের নিরপেক্ষ সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. কামাল উদ্দীন উপস্থিত ছিলেন না।

বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মজুরি নির্ধারণে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেসব বিষয়ে নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। তবে গত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মজুরি প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা ছিল। উভয় পক্ষই জানিয়েছে, তাদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তারা আমাদের কাছে কিছু সময় চেয়েছে। সে জন্য আমরা সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছে। মজুরি বোর্ডের তৃতীয় সভা ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যেই মালিক ও শ্রমিকপক্ষ প্রস্তাব দেবে।’ 

মালিকপক্ষের প্রতিনিধি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পোশাক খাত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন ইন। যাতে কোনো রকম আঘাত না আসে এবং শ্রমিকেরা যাতে ভালোভাবে চলতে পারেন এবং পোশাক খাত যাতে ভালো থাকে, সে জন্য মালিকের সক্ষমতা ও শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে আমরা একটি হিসাব দাঁড় করতে চাই। সেটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। সে জন্য আমরা ১০ দিন সময় চেয়েছিলাম। তবে আট দিন পেয়েছি।’ আগামী সভার আগেই মজুরি প্রস্তাব জমা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। 

মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করা হচ্ছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, আগস্ট মাসে মজুরি বোর্ডের ছয় মাস শেষ হবে। তারপর আরও তিন মাস নেওয়ার সুযোগ আছে। আশা করছি, এর মধ্যেই কাজ শেষ হবে। আর সময় নিতে হবে না। 

শ্রমিক প্রতিনিধি জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বেগম শামছুন্নাহার ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের মজুরি প্রস্তাব মোটামুটি তৈরি। তবে গ্রেডের সংখ্যা সাতটি থেকে কমিয়ে পাঁচটি করায় মজুরি হার নির্ধারণে একটু ঝামেলা হয়েছে। মালিকপক্ষ যেহেতু দেয়নি, তাই আমরাও কিছুটা সময় পেলাম। কারণ এক পক্ষের প্রস্তাবে তো আলোচনা হবে না।’ 

অপর প্রশ্নের জবাবে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, উভয় পক্ষ মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানা পরিদর্শন করবে মজুরি বোর্ডের সদস্যরা। এরপরই আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ এবং মজুরি বোর্ডের কার্যক্রম নিয়ে সরকার ও মালিকপক্ষের ‘টালবাহানা’ বন্ধের দাবিতে মজুরি বোর্ডের সামনে প্রতীকী অনশন করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। 

এ ছাড়া নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ের সামনে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা-কর্মীরা পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা এবং গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীরা নিম্নতম মজুরি ১৮ হাজার নির্ধারণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।


উল্লেখ্য, গত ১৯ মার্চ মজুরি বোর্ডের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ এপ্রিল দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এসে সেটি স্থগিত করা হয়। 

পোশাকশিল্পের জন্য ১৯৮৪ সালে প্রথম নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। তখন পোশাকশ্রমিকদের জন্য ৬২৭ টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে বোর্ড। পরে ১৯৯৪ সালে ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা এবং ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ৫ হাজার ৩০০ টাকা মজুরির মধ্যে মূল মজুরি ৩ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা এবং চিকিৎসা, যাতায়াত ও খাদ্যভাতা ১ হাজার ১০০ টাকা। একেকটি মজুরি কাঠামো পাঁচ বছরের জন্য গঠন করা হয়।
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৯, ২০১৮ 

পরিকল্পিত পরিবার মানবাধিকারের অংশ

পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি আরও সফলভাবে কার্যকর করতে হলে সেবাগ্রহীতাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিত পরিবার মানবাধিকারের অংশ। দম্পতিদের কাছে মানসম্পন্ন সেবা সহজলভ্য করে তুলতে হবে। সেবার ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।

গত শনিবার রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিবার পরিকল্পনা: সুরক্ষিত মানবাধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা এসব মতামত দেন। প্রথম আলোএই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও আরটিএম ইন্টারন্যাশনাল এই আয়োজনে সহায়তা করে।

১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিনটি সামনে রেখে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, একাধিক সাংসদ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি, অভিনেত্রীসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহারের হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়েছে। ১৯৭২ সালে দম্পতিপ্রতি সন্তান ছিল ৬ দশমিক ২ জন। এখন তা কমে হয়েছে ২ দশমিক ৩ জন। এসব উপাত্ত উল্লেখ করে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঋণাত্মক পর্যায়ে নিতে চাই না। এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত আছে। চীন তাদের জনসংখ্যা নীতি থেকে সরে এসে এখন দুই সন্তানের ওপর জোর দিচ্ছে।’

সাংসদ ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি বলেন, কোনো দম্পতি কত সন্তান কখন নেবেন, এ ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন ধরনের পদ্ধতি তাঁরা বেছে নেবেন, সেই স্বাধীনতা দম্পতির থাকতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুত যেন শেষ না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।

সাংসদ বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার জন্য সঠিক তথ্য-উপাত্তের বিকল্প নেই। বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত আলাদা করে থাকা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকা পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এসব অঞ্চলের জন্য পৃথক কর্মসূচি নিতে হবে।

মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় ইউএনএফপিএর টেকনিক্যাল কর্মকর্তা আবু সাইদ হাসান বলেন, বাংলাদেশের জনঘনত্ব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে ১২ লাখ মানুষের। বছরে ৫৮ লাখ নারী গর্ভধারণ করেন। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। এতে গর্ভপাত যেমন বাড়ছে, আবার গর্ভপাতজনিত কারণে মাতৃমৃত্যুও বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সবার জন্য সহজলভ্য হলে ৪০ শতাংশ গর্ভপাত এড়ানো সম্ভব হবে। জোর করা যাবে না, তবে যাঁর সেবা প্রয়োজন তিনি যেন প্রয়োজনের সময় তা পান।

ইউএনএফপিএর ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সাথিয়া দোরাইস্বামী বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিকার’ বা ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এসব স্লোগানের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা সেবা এখন যুক্ত হয়েছে। এই সেবাকেও এখন অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ যেভাবে সেবা চায়, যে পদ্ধতি গ্রহণ করতে চায়, তাকে তা-ই দিতে হবে। চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আগের মাঠকর্মী দিয়ে ২০১৮ সালের মাঠের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

সরকারের কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার। তিনি বলেন, দেশে খাবার বড়ি ও কনডমের ব্যবহার বেশি। জন্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর মজুতে কোনো সংকট নেই। মাঠে জনবলের সংকট দূর করতে আট হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

অভিনেত্রী মৌসুমী বলেন, বুঝে না-বুঝে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা নানা অঘটনের শিকার হয়। কম বয়সী মেয়ে যখন দুই-তিন সন্তানের মা হয়ে যায়, তখন সে অসহায় হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক বড়। কোটি কোটি মানুষের সামনে পরিবার পরিকল্পনা ও মানবাধিকারের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে।

অধিকারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল হক বলেন, ‘আমি আমার পরিবার নিয়ে যে পরিকল্পনা করি—কখন সন্তান নেব, কীভাবে তাকে বড় করে তুলব, কোথায় তার শিক্ষা হবে—নিজের এই পরিকল্পনা যদি দেশের সব মানুষের জন্য করি, তাহলেই কর্মসূচি সফল হবে।’ তিনি বলেন, অনেক মানুষ এখন সচেতন। পিছিয়ে পড়া বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ১০০ ভাগ দম্পতির কাছে এই সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

তিন ঘণ্টার এই গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর উপদেষ্টা গওহার নঈম ওয়ারা।

গোলটেবিলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) আশরাফুন্নেসা বলেন, জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। দেশের কিশোরী মায়েদের সংখ্যা যেমন কমানো দরকার, পাশাপাশি এদের জন্য পরিকল্পনা থাকা দরকার।

দেশে আইইউডি ও ইমপ্লান্ট সরবরাহে কিছু সমস্যা আছে উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এফপি ২০২০-এর ফোকাল পারসন আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এই দুটি সামগ্রী বিদেশ থেকে আনতে হয়। এর সরবরাহের ব্যাপারে সরকারের আরও মনোযোগী হতে হবে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা নার্সিং কলেজের দুজন ছাত্রী অংশ নেন। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আসমা আকতার বলেন, পরিবার পরিকল্পনা মানে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ নয়। মানুষকে বোঝাতে বা পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে মিডওয়াইফরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেরাকের সহযোগী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তাসনিয়া আহমেদ বলেন, কর্মসূচি সফল করতে হলে পুরুষদের অংশগ্রহণ সমানভাবে জরুরি। 

অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মাসুমা বিল্লাহ বলেন, আর্থসামাজিক কারণে এখনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বেশি বয়সে বিয়ে হলে যৌতুকও বেশি দিতে হয়। বিয়ে হওয়া কিশোরীরা প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবাও কম পায়।

  • Courtesy: Prothom Alo /Jul 08, 2018

Sunday, July 8, 2018

‘হাতুড়ির নিচে জীবন’

গোলাম মোর্তোজা




কবি বা কবিতা নিয়ে কথা বলার সময় নয় এটা। আবার কবির কবিতাই তো সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ। এরশাদের সামরিক নিপীড়নের কালে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’। মাত্র তিন শব্দের বাক্য দিয়ে কবি যা বুঝিয়েছেন, লক্ষ শব্দ লিখেও তা বোঝানো কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা কবিতার প্রাসঙ্গিকতা। যখনই লেখা হোক, বহু বছর বা যুগ পরেও তা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বারবার।

চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গেও পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’।

কোটা সংস্কার বিষয়ে বহুদিন ধরে কিছু তর্ক চলছে। কিছু প্রশ্ন সামনে আনা হচ্ছে। আজকের লেখায় সেই সব সাধারণ কিছু প্রসঙ্গ- প্রশ্ন বিষয়ে দু’একটি কথা দিয়ে শুরু করি।

১. ‘কোটা বাতিল করা যাবে না। আমি কোটার পক্ষে। কোটা থাকতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যে কোটা থাকতে হবে’- একথা বলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমালোচনা করছেন কেউ কেউ।

প্রথমত, সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। কোটা সংস্কারের দাবিকে যৌক্তিক মনে করার অধিকার যেমন আছে, অযৌক্তিক মনে করারও অধিকার আছে।

দ্বিতীয়ত, কোটা থাকবে না, বাতিল করতে হবে- এ কথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতরা কখনো বলেননি। যৌক্তিক শতাংশে কোটা থাকার কথাই তারা সব সময় বলে এসেছেন। কোটা বাতিলের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী কোটা থাকার কথাও তিনি বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সংসদে এবং সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য যদি কার্যকর হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা, জেলা কোটা থাকবে না।

সুতরাং যারা বলছেন ‘কোটা থাকতে হবে, বাতিল করা যাবে না’- তাদের দাবি করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আন্দোলনকারীদের অবস্থান আর আপনাদের অবস্থানে কোনো পার্থক্য নেই, নেই সমালোচনারও কিছু।

২. ‘ যারা আন্দোলন করছেন, তারাই শুধু মেধাবী? যারা কোটায় চাকরি পাচ্ছেন, তারা কি মেধাবী নয়? তারাও তো বিসিএসে প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই চাকরি পাচ্ছেন। সুতরাং তারাও মেধাবী।’

প্রথমত, বিতর্কটা কে মেধাবী, কে মেধাবী নয়- তা নিয়ে নয়। যিনি কোটায় চাকরি পাচ্ছেন তিনি মেধাবী নন, সে কথাও কেউ বলছেন না। মেধার ভিত্তিতে চাকরি আর মেধাবী, এই দুটি বিষয় সচেতন বা অসচেতনভাবে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হবেন, তাদের ভেতর থেকে মেধার ভিত্তিতে চাকরি নিশ্চিত করা হোক। একথা সত্যি যে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন সবাই (কোটা সুবিধা প্রাপ্তরাও) । পাশাপাশি আরও বড় সত্যি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একজন হয়তো ৩০০তম হয়ে চাকরি পাচ্ছেন না। আর কোটা প্রাপ্তজন হয়তো ৭০০তম হয়ে চাকরি পাচ্ছেন। শুধু বিসিএস পরীক্ষায় ৫৬ শতাংশ চাকরি হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়। এখানেই ‘মেধার ভিত্তিতে’ প্রসঙ্গ আসছে। কোটা প্রাপ্তজন মেধাবী নন, সেটা বলা হচ্ছে না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ৩০০তম জন অবশ্যই ৭০০তম জনের তুলনায় মেধাবী এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে তারই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। যেহেতু সেটা ঘটছে না, সেহেতু দাবি তোলা হয়েছে ৫৬ শতাংশ নয়, কোটা ১০ বা ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। এতে বৈষম্য কমে আসবে। আরও একটি তথ্য সবার জানা থাকা দরকার, ৫৬ শতাংশ কোটা শুধু বিসিএসের ক্ষেত্রে। অন্যান্য ক্ষেত্রে কোটা অনেক বেশি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন ক্যাডার চাকরিতে কোটা ৬১ শতাংশ। ৭০ শতাংশ কোটা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে। রেলওয়েতে কোটা ৮২ শতাংশ। ৯৬ শতাংশ কোটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে।

৩. ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন তারা বিএনপি-জামায়াত। তারা সরকারবিরোধী। তারা শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চায়।’- এই অভিযোগ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতা এবং মন্ত্রীদের।

প্রথমত, গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা গত তিন মাস অনুসন্ধান করে কোটা  আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতৃবৃন্দের কারও বিএনপি বা জামায়াত সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি। সুতরাং আন্দোলনকারীরা সবাই বিএনপি বা জামায়াত এই বক্তব্যের কোনো ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, যে কোনো দাবি সরকারের কাছেই করতে হয়। সরকারের কাছে দাবি তোলা মানে সরকার বিরোধিতা নয়।

তৃতীয়ত, সরকারের বা সরকারের কাজের বিরোধিতা করার অধিকার দেশের সব নাগরিকের আছে। একইভাবে সমর্থন করার অধিকারও আছে। সরকারের কাজের বিরোধিতা করা মানে দেশের বিরোধিতা করা নয়, সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাও নয়। সরকার আর দেশ বা রাষ্ট্র সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।

চতুর্থত, অস্থিতিশীল যে পরিবেশ তৈরি করা হলো, তার দায় কার? কোটা সংস্কারের দাবি প্রধানমন্ত্রী মেনে নেওয়ার তিন মাস পরও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। কবে হবে সে বিষয়েও কোনো ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, প্রজ্ঞাপন জারির কোনো অগ্রগতি নেই।

আন্দোলনকারীরা একটি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অবস্থান জানান দিতে চেয়েছিলেন। তারা রাস্তায় নেমে আসেননি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ডাকেননি, গাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করেননি। মনে রাখা দরকার, গাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা ছাড়া অন্যগুলো করার অধিকার তাদের আছে। সংবাদ সম্মেলনকারীদের উপর আক্রমণ করার অধিকার ছাত্রলীগের নেই। যে অধিকার নেই, সেই অধিকার প্রয়োগ করে ছাত্রলীগ নুরুলদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। এখানে ‘মারামারি’ হয়নি। শুধু ‘মারা’ হয়েছে। ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নির্দয়ভাবে পিটিয়ে আহত করেছে। লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পায়ের হাড় ভেঙে দিয়েছে। ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করেছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে। একজন শিক্ষার্থী এখনও নিখোঁজ।

আন্দোলনকারীরা পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল’ করেছে তার পক্ষে একটিও তথ্য বা প্রমাণ নেই। ছাত্রলীগ পিটিয়ে-নিপীড়ন করে পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল’ করেছে, তার পক্ষে ভিডিও চিত্রসহ যাবতীয় প্রমাণ আছে।

প্রথমত, যে কোনো দাবি বা আন্দোলনের সঠিক প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা না করলে, বিরোধী দল সুযোগ নিতে চাইবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এই সুযোগ নিতে চাওয়ার দায় আন্দোলনকারীদের নয়। এই দায় সরকারের। যদি বিরোধী দল কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেটা নিয়েছে সরকারের ভুল দমননীতির কারণে।

৪. শিক্ষার্থীদের জীবন চলে গেল হাতুড়ির নিচে, দেখার কেউ থাকল না। ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোটা আন্দোলনের নেতা তরিকুলের জীবন বিপন্ন করে দিয়েছে। ভিডিও চিত্রে মামুনের দানবীয়তা ধারণ করা আছে, এক্সরে রিপোর্টে আছে তরিকুলের টুকরো হয়ে যাওয়া পায়ের ছবি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মেরুদণ্ড।


‘হাতুড়ির নিচে জীবন’র কিছু খণ্ড চিত্র-

ক. তরিকুলকে রাজশাহী সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়নি। তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগ করেছেন তরিকুলের ভাই-বোন- বন্ধুরা।

খ. নুরুলকে ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা করা হয়নি। আনোয়ার খান মেডিকেলে আনা হয়েছে। পুলিশের ভয়ে মাঝরাতে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নুরুল নিজেই গণমাধ্যমকে সেকথা বলেছেন।

গাজীপুরের কোনো একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। দরিদ্র বাবা জমি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ছেলের চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় এসেছেন।

গ. সবাই গাজীপুর থেকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় আসেন। নুরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। কোনো অপরাধ ছাড়া তাকে পিটিয়ে আহত করেছে ছাত্রলীগ। তার চিকিৎসার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিলো না। ঢাকা মেডিকেল বা বেসরকারি মেডিকেলে করতেও দিল না। তাকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে গাজীপুরে।

ঘ. ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের হুমকি দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

ঙ. কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ফারুককে শহীদ মিনারে লাথি- ঘুষি- পিটিয়ে অজ্ঞান করে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। ভিডিও চিত্রে তা দেখা গেছে। একদিন পর জানা গেল ডিবি তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তুলে নিলো ছাত্রলীগ, পাওয়া গেল ডিবির কাছে!

চ. ‘আপনি কুলাঙ্গার ছেলের জন্ম দিয়েছেন। আপনার ছেলেকে গুম করে ফেলা হবে’- রাশেদের বাবাকে ফোন করে একথা বলেছেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেছেন রাশেদের বাবা। সোহাগ বলেছেন, রাশেদের বাবা অসত্য বলছেন।

জ. সাপ মারার মতো একজনকে দশ বারোজন মিলে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত এবং লোহার হাতুড়ি দিয়ে রড সোজা করার মতো আঘাত করে পায়ের হাড়-কোমর ভেঙে দেওয়া নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা প্রশাসন একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সহস্রাধিক শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১৪ জন তরিকুলদের নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছেন। ভিসি এই ১৪ জনকে বলেছেন ‘সরকারবিরোধী’। তিনি বলেছেন, সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে শিক্ষকরা সরকারের বিরোধিতা করছেন।

শিক্ষকরা যে মুক্তচিন্তা, মুক্ত কথা বলার অধিকার রাখেন, ৭৩’র অধ্যাদেশ তাদের সেই অধিকার দিয়েছে, ভিসি মহোদয় তা ভুলে গেছেন।

ঝ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নিপীড়ন বা ছাত্রলীগের হামলা বিষয়ে প্রথম তিন দিনে কিছু জানেনইনি। ভিসি বলেছেন, গ্রেপ্তার ছাত্রদের দায় বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না। ‘শিক্ষক সমিতির কাজ শিক্ষকদের স্বার্থ দেখা’- বলেছেন শিক্ষক নেতা। বলেননি যে, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখা বা তারা নিপীড়িত হলে তাদের দেখা শিক্ষকদের দায়িত্ব নয়। এমন বাক্য না বলেও তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দুই হাজারের অধিক শিক্ষকের মধ্যে নিপীড়নের প্রতিবাদ করছেন অল্প কয়েকজন শিক্ষক। উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের পক্ষে শিক্ষক- আইনজীবী- সমাজকর্মীরা প্রতিবাদ করছেন। পুলিশ তাদেরও অপমান- অসম্মান করছেন।

৫. বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম মানুষের সাংখ্য প্রায় ১১ কোটি। এর মধ্যে কাজ নেই প্রায় সাড়ে ৪ কোটি কর্মক্ষম মানুষের। অর্থনীতির অবস্থা ভালো, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’-এই চিত্রের মাঝেও সাড়ে ৪ কোটি মানুষ বেকার।

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, এই একটি পরিসংখ্যান তার প্রমাণ বহন করছে। যারা কোটা সংস্কারের আন্দোলন করছেন, তারা এই  কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীরই অংশ। আন্দোলনকারীদের উপর হামলা যারা করছে, তারাও এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ। মূল সমস্যা কাজের নিশ্চয়তার অভাব। বিনিয়োগ বা কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, কোটা বৈষম্য দূর না করে, হাতুড়ি পেটা করে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দমন করা যাবে বলে মনে হয় না। আরও বড় হানাহানির আশঙ্কা তৈরির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
  • The Daily Star/ jul 8,2018 

দায় কার?

আসিফ নজরুল

হাতুড়ি দিয়ে নির্বিচারে পেটানো হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তরিকুলকে। তরিকুলের অপরাধ, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এই প্রতিবাদ সমাবেশকে দাঁড়াতেই দেয়নি ছাত্রলীগ। এঁদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রামদা, হাতুড়ি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে চড়াও হন। নির্বিচার মারধরের একপর্যায়ে তরিকুলের পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়।

হাতুড়িওয়ালা আবদুল্লাহ আল মামুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা। হাতুড়ি হাতে তাঁর ছবি, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলকে আঘাত করার ছবি এবং তরিকুলের ভাঙা হাড়ের এক্স-রের ছবিতে এখন সামাজিক গণমাধ্যম সয়লাব হয়ে গেছে। মামুনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন অনেকে। কিন্তু দোষটা কি আসলে শুধু হাতুড়িওয়ালা মামুন ও তাঁর মতো আক্রমণকারীদের?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা অস্বীকারও করেননি যে তাঁরা পিটিয়েছেন তরিকুলকে। তাঁরা নাকি ধারণা করেছিলেন যে তরিকুলদের সমাবেশে জামায়াত-শিবিরের লোক থাকতে পারে, এবং এই সমাবেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণকারী কিছু ছাত্রলীগ নেতাও এমন বক্তব্য দিয়েছেন। এর সোজাসাপ্টা মানে হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতারা মনে করছেন কেউ অস্থিতিশীলতা বা নাশকতার চেষ্টা করছে, শুধু এমন ধারণা হলেই তাঁরা তাকে হাতুড়ি, রামদা, লাঠি দিয়ে পেটাতে পারেন।

প্রশ্ন হচ্ছে এটা দেশের কোন আইনে লেখা আছে? বাংলাদেশে কোনো আইন বা সংবিধানে কি লেখা আছে যে কোনো সমাবেশে গোলযোগ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে সেখানে নির্বিচার হামলা করে কারও হাড়গোড় ভেঙে দেওয়ার অধিকার সরকারি ছাত্রসংগঠনের রয়েছে? নেই। এ ধরনের আশঙ্কা সত্যি থাকলে কেবল পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, উপযুক্ত প্রমাণ থাকলে কাউকে গ্রেপ্তার করবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এমন কোনো আশঙ্কাও ছিল না। এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন প্রথম হামলা চালিয়ে আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হককে গুরুতরভাবে আহত করা হয়, সেদিন তাঁরা মাত্র একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে গিয়েছিলেন। অল্পসংখ্যক মানুষ সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে সেখানে গোলযোগের আশঙ্কা কীভাবে থাকে? বা শহীদ মিনারে পরবর্তী সময়ে নীরব মানববন্ধনে কীভাবে নাশকতার আশঙ্কা থাকে? দশ-পনেরোজন মিলে একজনকে পেটানোর সময় মরিয়াম নামের ছাত্রীটি তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলে কোন আশঙ্কায় তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়?

আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের লোক থাকতে পারে, তারা ইন্ধন দিতে পারে এই যুক্তিও হামলার পক্ষে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের কোনো আইনে কি লেখা আছে যে বিএনপি-জামায়াত করলে সে কোনো সমাবেশে বা আন্দোলনে যোগ দিতে পারবে না? বাংলাদেশের কোনো আইন বা কোথাও এটি লেখা নেই।

কোনো সমাবেশে কারও হাতে অস্ত্র বা বিস্ফোরক থাকলে তাকে নাশকতার ইন্ধন বলা যেতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা বরাবর সমাবেশ করেছেন বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রীর ছবি আর জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে। এসব কি নাশকতার ইন্ধন?

গোটা আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওপর যে হামলাগুলো ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ একতরফা এবং বেআইনি। সশস্ত্র হামলায় গুরুতর আঘাতের ঘটনা ঘটেছে, যা সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।

কিন্তু তারপরও এই হামলার দায় ছাত্রলীগের একার নয়। আমাদের এটিও বিবেচনা করতে হবে, তাদের এসব গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ ক্যামেরার সামনে নির্দ্বিধায় করার সাহস কে বা কারা দিয়েছে। তাদের নির্বিচার হামলার ঠিক আগে আগে হয় পুলিশ আক্রমণের স্থান ত্যাগ করেছে অথবা নিষ্ক্রিয় থেকেছে। পুলিশ এই আক্রমণে কোনো বাধা দেবে না এটি না জানলে কীভাবে তাঁরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে হামলা করেন? এটা তাঁদের কারা জানাতে পারে নিশ্চিতভাবে? এসব অপরাধ করার পরও ছাত্রলীগের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, তঁাদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করার সাহস পায়নি, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেননি। রাষ্ট্রের পুলিশ, গোয়েন্দা, আদালত এমন নিষ্ক্রিয় হয়ে যান কোন শক্তির দাপট বা হস্তক্ষেপে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছে ছাত্রলীগ। এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনকে ওই শক্তিই পেটোয়া বাহিনীতে রূপান্তর করছে। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক বর্বরতার ঘটনাগুলোর মূল দায়দায়িত্ব তাদেরই। 

দায়দায়িত্ব আমাদেরও আছে। আমাদের কেউ কেউ অতীতে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। অথচ এত বড় বর্বর আক্রমণের ঘটনাগুলোর পর আমাদের সেসব প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও আইনজীবীর অনেকে নিশ্চুপ রয়েছেন। দায় আমাদের এসব মৌসুমি বিবেকবানদেরও।

দায় রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতিগুলোরও। এঁদের অনেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ঢল দেখে একে ন্যায়সংগত আখ্যায়িত করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। আজ সেই আন্দোলনের নেতাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা ও হয়রানিমূলক মামলার পর তাঁরা নিশ্চুপ থেকেছেন, কেউ কেউ এমনকি শোচনীয় ও দায় এড়ানো বক্তব্য প্রদান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেই দিয়েছেন আঠারো বছরের ওপরের কারও দায়দায়িত্ব তাঁর নিজের। অথচ তাঁর মনে রাখা উচিত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অভিভাবক হওয়ার কথা তাঁরই। আর আঠারো বছরের ওপরের ছাত্রদের পাশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজের দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছে এ দেশের বহু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

আশার কথা, বাম ছাত্রসংগঠনসহ কিছু মানুষ এই নৈরাজ্যকর সময়ে তবু প্রতিবাদ করেছেন, রাস্তায় নেমেছেন। একটি ন্যায়সংগত আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, তাঁদের চিকিৎসা দিতে বাধাদান ও হয়রানিমূলক মামলার প্রতিবাদ করা মৌলিক একটি মানবাধিকার। এই প্রতিবাদ না থাকার মানে হাতুড়ি আর রামদাকে মেনে নেওয়া, পুলিশ আর সরকারি ছাত্রসংগঠনের অনাচারকে মেনে নেওয়া, নিজেকে বিবেকবর্জিত বা পলায়নপর মানুষ হিসেবে ঘোষণা করা।

আমরা বেশির ভাগ সুবিধাভোগী মানুষ যদি এমন হয়ে যাই, তাহলে এই সমাজে শক্তিতন্ত্র আরও জেঁকে বসবে। এক অশুভ শক্তির প্রতিবাদ না করতে পারলে অন্য অশুভ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক শক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলব। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতিবান্ধব একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন। সরকার এটি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারলেই তা সবার জন্য মঙ্গলকর হতো। দেরিতে হলেও কোটা সংস্কারের জন্য সরকার কমিটি ঘোষণা করেছে। এই কমিটি গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই।

কমিটির কাজ দ্রুত শেষ করে ন্যায়সংগতভাবে কোটা সংস্কারের পদক্ষেপ নিলে এই আন্দোলনের পেছনে অশুভ শক্তি আছে কি না, এ নিয়ে সরকারকে দুর্ভাবনায় থাকতে হবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলে ছাত্রসমাজের ক্ষোভ ও মনোবেদনাও বহুলাংশে হ্রাস হওয়ার কথা। আর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এটিও প্রমাণিত হবে যে এসব হামলার পেছনে সরকারের কারও কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।


  • আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৮, ২০১৮ 

আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শিক্ষকদের পদযাত্রা


কোটা নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক ও অবিশ্বাস্য। এটা পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলে ঘটেনি।

রোববার বেলা ১১টায় ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দের’ ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে পদযাত্রা বের করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে সাম্প্রতিক নিপীড়ন, গ্রেপ্তার, সহিংসতা ও হয়রানির প্রতিবাদে এই পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। পদযাত্রাটি শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খানের সঞ্চালনায় শিক্ষকদের একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ কথা বলেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘কোটা আন্দোলন যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। এ জন্য ছেলে, মেয়ে, অভিভাবক, শিক্ষক সবাই এতে সমর্থন দিয়েছে। ৫৬ ভাগ কোটা অত্যন্ত অযৌক্তিক। আন্দোলন করেছে বলে সরকার কমিটি করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের ওপর নৃশংস বর্বর হামলা চালানো হয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে এভাবে নৃশংস হামলা আগে দেখিনি। যে অবস্থা চলছে, তাতে মানুষের নিরাপত্তা নেই। যারা আন্দোলন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। এটি যৌক্তিক নয়। কোটা সংস্কারের দাবি যেন বাস্তবায়ন করা হয়, এই প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তার দাবি জানাচ্ছি।’

সমাবেশে আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আন্দোলন করার কারণে শিক্ষার্থীকে হাতুড়িপেটা করা হয়েছে। মেয়েদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। মিথ্যা হয়রানির মামলা করা হয়েছে। নানা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করার অধিকার বন্ধ করা গণতন্ত্রবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। সকল ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার চাই এবং হাতুড়িপেটাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চাই।’

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চেয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক তাসনিম সিরাজ মাহবুব বলেন, ‘ভিন্নমতের বিরুদ্ধে গলা চেপে ধরার যে প্রবণতা তার নিন্দা জানাচ্ছি। হাসপাতাল থেকে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা না করে বের করে দেওয়ারও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’

এ সময় সংবিধানে প্রতিবাদ করার অধিকার আছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। সেটি সমুন্নত রাখার সুযোগ দিতে হবে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক আকমল হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। জামাত–শিবির ও বিএনপির সংশ্লিষ্টতা দেখানো হয়েছে। এখন যেকোনো দাবি তুললেই এ রকম করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্রদের দাবি প্রত্যাখ্যান করার ভাষা নিন্দনীয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে শিক্ষার্থীদের যেভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে, তাতে বোঝা যায় গণতন্ত্র কোন অবস্থায় আছে।’

বক্তব্য শেষে পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন। তিনি বলেন, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকল হামলাকারীর বিচার চাই, আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের নামে করা মিথ্যা মামলার প্রত্যাহার চাই, আক্রান্তদের চিকিৎসাব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে, নারী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের বিচার চাই এবং দ্রুত কোটা সংস্কারের প্রতিশ্রুত প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দিতে হবে।’
  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৮, ২০১৮ 

নিরাপত্তাহীনতায় আন্দোলনকারীরা

  • প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা 
  • নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আন্দোলনকারীরা
  • সপ্তাহজুড়েই হামলা চলেছে



কোটা সংস্কার নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মুক্তি চেয়েছেন হামলা-মামলা-নির্যাতন থেকে। গতকাল শনিবার সেগুনবাগিচায় ক্র্যাব মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের একজন নেতা তাঁদের দাবি-দফা উত্থাপনের পাশাপাশি কতটা নিরাপত্তাহীনতায় তাঁরা ভুগছেন সেই বর্ণনা দেন।

গত শনিবার কোটা সংস্কার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেছিল। ছাত্রলীগের হামলায় সেই সম্মেলনটি হতে পারেনি। পুরো সপ্তাহজুড়েই হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর গতকালই প্রথম সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করল।

ওই সংবাদ সম্মেলনে ৫৭ ধারায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানের বাবা-মা ও স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্র রাশেদের রাজমিস্ত্রি বাবা নবাই বিশ্বাস অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ফোনে রাশেদকে গুম করে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। তাঁকে গালমন্দ করেছেন ‘কুলাঙ্গার’ ছেলে জন্ম দেওয়ার জন্য।

কর্মসূচি আহ্বানের এত দিন পর সংবাদ সম্মেলনের কারণ জানতে চাইলে, ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র আতাউল্লাহ বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছি না। আমাদের নেতাদের প্রায় সবাই হয় কারাগারে, না হয় নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে। আমার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এখনো গায়ে জ্বর। আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ হলের আবাসিক ছাত্র। হলে ফিরতে পারছি না। জানি না সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি যে জায়গা থেকে আজ এসেছি, সেখানে ফিরতে পারব কি না।’

আতাউল্লাহ জানান, গত ৩০ জুন সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে ও পরদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হামলায় অনেকে আহত হয়েছেন। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে অনেককে। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কারও কারও। ঢাকা মেডিকেল কলেজ আহত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বের করে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওপরের নির্দেশে তাঁদের রাখা যাচ্ছে না। বেসরকারি একটি হাসপাতালও যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক ওরফে নুরুকে মাঝরাতে চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে বের করে দিয়েছে। 

মাহফুজ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নারীদের ওপর হামলা হয়েছে। থানায় ২৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর মুচলেকা দিয়ে একজন ছাত্রী বেরিয়ে এসেছেন। বেশির ভাগ নেতা কারাগারে, নয়তো নির্যাতন ও মামলার বিড়ম্বনা এড়াতে আত্মগোপনে আছেন। তাঁদের ফেসবুক পেজটি পর্যন্ত হ্যাক হয়ে গেছে। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা-কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

সরকারের উদ্দেশে আতাউল্লাহ বলেন, ‘আপনারা আমাদের ওপর যে নির্যাতন ও হামলা চালাচ্ছেন তা থেকে মুক্তি দিন।’ গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি, রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধ ও হামলায় আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার উদ্যোগ নিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

আতাউল্লাহর কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল আন্দোলনে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, অর্থায়ন ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। জবাবে তিনি বলেন, ‘১৭ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন শুরুর পর থেকে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পায়নি। কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেই আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করব। প্রজ্ঞাপন জারি না হলে আন্দোলন চলবে।’ অর্থায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিকাশ ও রকেটের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে এই আন্দোলনের জন্য অর্থ চাওয়া হয়েছিল। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীদের কেউ ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, কেউ সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঠিয়েছেন।

আতাউল্লাহ বলেন, তাঁরা কখনো কোটা বাতিল হোক তা চাননি। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্যসন্তান। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের কথা একবারও বলেননি। তাঁরা শুধু যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছেন। 

রাশেদের শর্তহীন মুক্তি ও নিরাপত্তা দাবি

গতকালকের সংবাদ সম্মেলনে রাশেদ খানের বাবা নবাই বিশ্বাস, মা সালেহা বেগম, স্ত্রী রাবেয়া আলো উপস্থিত ছিলেন। নবাই বিশ্বাস বলেন, রাশেদকে গ্রেপ্তারের আগের দিন ঝিনাইদহ ছাত্রলীগের সভাপতি রানা কয়েকজনকে তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে তাঁর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহের জন্য পাঠান। পরে তাঁকে ফোন করেন ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। সাইফুর তাঁকে বলেন, ‘আপনি কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছেন, সে তো একটা কুলাঙ্গার। ছেলেকে এসব থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন, না হলে গুম করে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, এখন তাঁকে বলা হচ্ছে তিনি রাজাকার, জামায়াত ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ছয় মাস। তিনি একজন সাধারণ মানুষ। দিনমজুরের কাজ করে যা রোজগার করেন, তা দিয়ে কোনোমতে চলেন।

রাশেদের মা সালেহা বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে আমার মণি কিছুই বলেনি। সে শুধু চাকরির জন্য দাবি করেছিল।’ রাশেদের স্ত্রী রাবেয়া বলেন, রাশেদ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আন্দোলনে যাননি। সবার জন্য গিয়েছিলেন। পরিস্থিতি এখন এমন যে আর সবাই সুবিধা পেলেও রাশেদ পাবেন না। তাঁকে শর্তহীনভাবে দ্রুত মুক্তি ও নিরাপত্তা দেওয়া হোক। রিমান্ডে নেওয়ার পর গতকাল পর্যন্ত তাঁরা রাশেদের কোনো খোঁজখবর পাননি বলে জানান তিনি।

এদিকে নবাই বিশ্বাসের এমন অভিযোগের পর সাইফুর রহমান সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন বাপ হয়ে কীভাবে মিথ্যা কথা বলে? তার সঙ্গে কোনো দিন আমার কথাই হয়নি। হুমকি দেওয়া তো দূরে থাক।’ 

কারাগারে তারেক আদনান, মাহফুজ কোথায়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র তারেক আদনান ২ জুলাই রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন। তারেকের বাবা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিউমার্কেট, শাহবাগ ও রমনা থানা ঘুরেও তিনি ছেলেকে পাননি। পরে জানতে পারেন ছেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তারেক আদনান এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছেলে যুক্ত ছিল এ কথা তিনি জানতেন। এর বাইরে তাঁর ছেলের অন্য কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ৯ জুলাই থেকে তারেকের পরীক্ষা শুরু। যেকোনো মূল্যে ছেলের মুক্তি চান শফিকুল ইসলাম।

তারেকের খোঁজ পাওয়া গেলেও মাহফুজ এখন কোথায় সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি সাত দিন পরও। রোববার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয় দিয়ে একই মোটরসাইকেলে রাশেদ ও মাহফুজকে মিরপুরের ভাষানটেক থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাশেদ খানের স্ত্রী রাবেয়া আলো। তিনি গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রাশেদকে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয় সেদিন মাহফুজ তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। সকাল থেকেই একজন লোক তাঁদের বাসার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। এ কথা জানলে রাশেদ ভয় পেয়ে যান এবং কাছেই একটি বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে রাশেদ ও মাহফুজকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনেন কয়েকজন লোক। পরে একটি মোটরসাইকেলে করে দুজনকেই হাতকড়া দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঢাকা মহানগর পু‌লি‌শের উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান ব‌লেন, ডি‌বি রা‌শেদ খাঁন, ফাইজুর ও আতিক নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আর শাহবাগ থানা পু‌লিশ গ্রেপ্তার ক‌রে‌ছে নয়জনকে। মাহফুজ‌কে পু‌লিশ গ্রেপ্তার করে‌নি। 

ঢাকার বাইরে কর্মসূচি অব্যাহত

ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, হামলা এবং নারীদের লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রামে ঝটিকা মিছিল হয়েছে। ‘সকল সাধারণ শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম’-এর ব্যানারে হওয়া এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীরা অংশ নেন। হামলার আশঙ্কায় তাঁরা ১৫ মিনিটের মধ্যেই তাঁদের কর্মসূচি শেষ করেন।

এদিকে কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করেন। ছাত্রলীগের হামলার দ্রুত এবং সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করেন।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় জুবায়ের হোসেন (২২) নামে এক যুবককে পুলিশ কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দেওয়া ও নাশকতার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল সকালে রায়পুর উপজেলার মিতালী বাজার কামাল টেলিকম থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় বিকেলে রায়পুর থানার উপপরিদর্শক মোতাহের হোসেন বাদী হয়ে থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৮, ২০১৮ 

একদল অবিবেচকের কাহিনী

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

গত কয়েক দিনে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একদল অবিবেচকের অমানবিক কর্মকাণ্ড দেখলাম। তারা নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের ওপর যে মধ্যযুগীয় বর্বরতা নিয়ে হামলা চালাল, তার নজির শুধু তারাই। এর আগে গত এপ্রিলে এই ছাত্রদের ওপর তারা হামলা চালিয়েছিল। শুধু তারাই নয়, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল পুলিশ বাহিনী। খুব কাছে থেকে পুলিশের টিয়ার শেলে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিক। 

সে আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নয়টি কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্রুত পরীক্ষা নেয়া। এর সাথে রাজনীতি ছিল না। অন্য কারো সাথে তাদের বিরোধও ছিল না। এটা তো খুব স্বাভাবিক যে, একজন শিক্ষার্থী যথাসময়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে চাইবে, প্রবেশ করতে চাইবে কর্মজীবনে। কিন্তু ছাত্রলীগ ও পুলিশ তাদের যেভাবে মারধর করল সেটা কল্পনার অতীত ছিল। কিন্তু আমরা কল্পনা করতে পারি বা না পারি, বাংলাদেশ এখন এমনি মগের মুল্লুক।

গত প্রায় তিন মাস ধরে শিক্ষার্থীরা একটি নতুন আন্দোলন করছে। সে আন্দোলন হলো কোটা সংস্কার। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ চাকরি দেয়া হয় কোটার ভিত্তিতে। ফলে মেধাবীরা ক্রমেই চাকরি জীবন থেকে পিছিয়ে পড়ছে। 


কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল এই ৫৬ শতাংশ কমিয়ে এনে তাকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হোক। সে দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং সমাজের সচেতন লোক। কিন্তু তাতে কোনো ফায়দা হয়নি। সরকার কোটা সংস্কারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জারিই রেখেছিল। কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি। শত নির্যাতন সত্ত্বেও আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে গেছে। সে আন্দোলন শুধু ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছিল না, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ছাত্রদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলছিল। তাতে তারা মোটেও দমে যায়নি। কোটা সংস্কারের দাবি অব্যাহত থাকে। এরই একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দেন যে, কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। যদিও সেটা আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজের দাবি ছিল না। তাদের দাবি ছিল সংস্কার। কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই পদ্ধতি বাতিল করাই ভালো।

কারণ কোটা থাকলে তা বাড়ানো বা কমানোর জন্য আবার আন্দোলন শুরু হবে। সুতরাং কোটা বাদ। এতে ছাত্রসমাজের মধ্যে একধরনের স্বস্তি নেমে এসেছিল; কিন্তু তাদের বক্তব্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা আইন নয়। আইনের জন্য অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। সঙ্কটের শুরু হয় সেখান থেকেই। প্রধানমন্ত্রী তো ঘোষণা দিলেন। 


কিন্তু নৌ-পরিবহনমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জোর গলায় চেঁচিয়ে বলতে থাকলেন- কোটা বাতিল করা চলবে না। প্রধানমন্ত্রীর কোনো ঘোষণার বিরুদ্ধে এর আগে আমরা কারো মুখে কোনো কথা শুনিনি। কিন্তু এবারই প্রথম সে ধরনের কথা শুনতে পেলাম। এ নিয়ে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নিজেও আর কোনো বক্তব্য দেননি। পরে তিনি নিজের কথা ঘুরিয়ে বললেন যে, এর জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা বসে সিদ্ধান্ত নেবেন, কিভাবে কি করা যায়। অথচ এ রকম তো কথা ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোটা পদ্ধতি না থাকারই কথা ছিল। তাহলে প্রতিবন্ধী বা সমাজের সুযোগবঞ্চিতদের চাকরি-বাকরির কী হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। যেহেতু বিশেষ ব্যবস্থার অপশনটি রইল, তাহলে কথা তো সেখানে শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেননি। তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটার কথা তুললেন।

ইতোমধ্যে ছাত্রসমাজ আবার সমাবেশের ডাক দিলো। এর মধ্যে গত ৩০ জুন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সে সম্মেলন শুরু হওয়ার প্রায় সাথে সাথে ছাত্রলীগের কয়েক শ’ কর্মী কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর তাদের বেধড়ক মারধর করে। এমনকি পরে তারা খুঁজে খুঁজে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে বহু সংখ্যক ছাত্রের ওপর চড়াও হয়। এ রকম পৈশাচিক কাণ্ড ছাত্রলীগ নানা কারণে আগেও ঘটিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং সংবাদমাধ্যমে সেসব হামলার বিস্তারিত সচিত্র বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। 

একজন আন্দোলনকারীর ওপর ১০-২০ জন ছাত্রলীগ কর্মী কিল-ঘুসি লাথি দিয়ে আহত করেছে। আর আহত শিক্ষার্থীদের পরে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। কোটা আন্দোলনের নেতা রাশেদ খানকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। তাকে আটক করার আগ মুহূর্তে এক ফেসবুক ভিডিও বার্তায় ভীত রাশেদ আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমাকে বাঁচান, আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে ধাওয়া দিয়েছে ডিবি পুলিশ। ভিডিওটি শেয়ার করুন।’ কিন্তু পুলিশ তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে আটক করে। কিন্তু যারা এই বর্বর হামলা চালাল, সেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

৩ জুলাই ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগ যে পৈশাচিক বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কোটা আন্দোলনকারীরা সমবেত হওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের একজনকে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা মাথা থেঁতলে দিয়েছে। হাতপায়ে কিল ঘুসি লাথি মেরেছে, যেন তাদের ধুলায় মিশিয়ে দিতে চায়। রক্তাক্ত ওই আন্দোলনকারীর অবস্থা করুণ। তার উঠে দাঁড়ানোর কোনো অবস্থা ছিল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে আরো মারাত্মক ঘটনা। একজন ছাত্রকে ১০-১২ জন ছাত্রলীগ লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করেছে। একজন ছাত্রলীগ সদস্য তার মাথা হাত পিঠে অবিরাম হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছে। তার পুরো ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ শুধু ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে তা নয়, তারা ছাত্রীদের ওপরও হামলা চালিয়ে নির্লজ্জ বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে এবং আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, যারা এ রকম পৈশাচিক বর্বরতার ঘটনা ঘটাল, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ঢাকার শহীদ মিনারে সে দিন যখন আন্দোলনকারীদের ওইভাবে পিষে মারার চেষ্টা করছিল, তখন পুলিশ তাদের বাধা তো দেয়ইনি, বরং নীরবে সে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ এসেছে পরে। এসে আহত মৃত্যুপথযাত্রী ছাত্রটিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগের মামলা দেয়া হয়েছে।


এ দেশে এ ঘটনা নতুন নয়। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে আমরা আইয়ুব খানের ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনের (এনএসএফ) কীর্তিকলাপ দেখেছি। তারাও ছাত্র সমাজের ওপর এভাবে চড়াও হয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগ যে নির্যাতন করল তাতে এনএসএফের নির্যাতন ম্লান হয়ে গেছে। এটা কাক্সিক্ষত ছিল না। তবে ছাত্রলীগের এই পৈশাচিকতার ঘটনা নতুন নয়। তারা বহু আগেই এনএসএফকে হার মানিয়ে দিয়েছে। এনএসএফ যত না পিষে মারতে চেয়েছে, তার চেয়ে বেশি চেয়েছে ভয় দেখাতে। ছাত্রলীগ ভিন্ন মতাবলম্বীদের পিষে মেরে ফেলারই চেষ্টা করেছে। 

অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তারা এনএসএফকেও হার মানিয়েছে। পেছনে সরকার আছে, পুলিশ বাহিনী আছে- সেই জোরে তারা এসব কর্মকাণ্ড করছে। কিন্তু এসব জোর শেষ পর্যন্ত থাকে না। আমরা এনএসএফের ষণ্ডাদের রাস্তাঘাটে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানকালে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটা সময় আসবে যখন হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজেও কোনো ছাত্রলীগ পাওয়া যাবে না। এ রকম অবস্থা আমরা ১৯৭৫ সালেও একবার দেখেছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের পতনের পর গাঁঠরি বোঁচকা নিয়ে ছাত্রলীগারদের হলগুলো থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে দেখেছি। তার আগের দিনও যারা ছাত্রলীগের প্রতাপশালী মাস্তান ছিল পরদিন আর তাদের হলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইতিহাসের সাক্ষ্য এমনই। সরকার বা ছাত্রলীগ ক্ষমতার দম্ভে এখন কেউই অনুমান করতে পারছে না যে, তাদের পরিণতি কী হতে পারে। ক্ষমতা অনন্তকালের নয়। একসময় ক্ষমতা চলে যায়। তখন গাঁঠরি বোঁচকা নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে হয়। তখন যদি এই সাধারণ ছাত্ররা তাদের ধাওয়া করে এবং তাদের পরিণতি যদি আজকের নির্যাতিত ছাত্রদের মতো হয় তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না।


সামান্য একটু উদাহরণ দিচ্ছি। ২ তারিখেই আমরা দেখেছি, ছাত্রলীগের এই পৈশাচিকতা সত্ত্বেও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাশে মানববন্ধন করেছে। সিলেটেও সাধারণ ছাত্ররা ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে। রাজশাহীতেও বের করা হয়েছে মশাল মিছিল। আর তিন তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। সুতরাং হলফ করেই বলা যায়, সামনে ছাত্রলীগের জন্য বড় দুর্দিন অপেক্ষা করছে।

এবার খানিকটা আত্মসমালোচনা করা যাক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কিংবা তারও আগে থেকেই এ দেশের সংবাদপত্রগুলো সব সময় নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পক্ষে দাঁড়িয়েছে নায্যতার, তার জন্য সংবাদপত্রগুলোর ওপর দলনপীড়ন কম হয়নি। কিন্তু সত্য প্রকাশের নীতিতে সংবাদপত্রের সম্পাদক-প্রকাশকেরা অবিচল ছিলেন। তখন টেলিভিশন ছিল না। এত সব স্যাটেলাইট চ্যানেলও ছিল না। এখন সংবাদপত্র আছে, বহুসংখ্যক টেলিভিশন চ্যানেল আছে। কিন্তু সরকারের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য কোনো মিডিয়াই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে, তারা যথাযথভাবে আন্দোলনকারীদের সপক্ষে দাঁড়িয়েছে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলোর বিপদ অনেক বেশি। তাদের ওপর হুমকির খড়গ সব সময় জারি রয়েছে। সরাসরি সম্প্রচার কিংবা সরকারের পছন্দ নয় এমন খবর প্রচারের বিরুদ্ধে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অধিকাংশ চ্যানেলের অনুমতি দিয়েছি আমি। যে দেয় সে নিতেও পারে’। এর চেয়ে স্পষ্ট হুমকি আর কিছুই হতে পারে না। ফলে আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে তাদের ওপর নির্যাতনের খবর অতি সামান্যই প্রকাশ হয়েছে।

কেননা ইতোপূর্বে সরকার চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ গড়ে ওঠেনি। ফলে এ যাত্রায় টিভি চ্যানেলগুলোতে আমরা ছাত্রলীগের বর্বরতার চিত্র দেখতে পাইনি। কিন্তু সত্য চাপা থাকে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে বর্বরতার ভিডিওচিত্র প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশ হয়েছে স্থিরচিত্রও। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ দেখেছে, নব্য স্বৈরাচারী কায়দায় সরকার বাংলাদেশে কী কাণ্ড করছে।

সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদপত্র ছাড়া বেশির ভাগ সংবাদপত্রই যেন এত বড় ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সংবাদপত্রের মালিকদের বেশির ভাগ সরকার সমর্থক। ফলে তারা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকে, আর অনেকেই বিরত থাকে ভয়ে। তাই দেখা যায়, দু-চারটি সংবাদপত্র ছাত্রলীগের পৈশাচিক বর্বরতার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১৯৭২-১৯৭৫ সালেও সংবাদপত্রের ওপর এমন দলনপীড়ন চলেছিল, কিন্তু তখন প্রতিবাদ ছিল। সাংবাদিকদের সংগঠন ডিইউজে-বিএফইউজে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। পত্রিকায় লিখেও তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দাবি করেছে। কিন্তু সরকার একের পর এক কালাকানুন জারি করে গেছে। আজ সবাই নিশ্চুপ। বিভক্ত সমাজের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ কোনো পদক্ষেপ নেই। কিন্তু আজ আমরা যে দাসত্ব মেনে নিচ্ছি রুখে না দাঁড়ালে আগামীতেও একই রকম দাসত্ব করে যেতে হবে।

জার্মান নৌবাহিনীর দুর্র্ধর্ষ সাবমেরিন অধিনায়ক ছিলেন নায়মোলার। পরে চিন্তাবিদ ও লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং হিটলারের নাৎসিদের হাতে কারারুদ্ধ হন। জার্মান জাতি নিষ্ক্রিয় ছিল বলেই হিটলার তাদের স্তব্ধ করে দিতে এবং নাৎসি শাসন চালু করতে পেরেছিলেন। 

ব্যাপারটাকে নায়মোলার বর্ণনা করেছেন এভাবে :
‘প্রথমে ওরা এলো কমিউনিস্টদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি/কেননা আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না।/এরপর এরা সোস্যালিস্টদের ধরতে এসেছিল, আমি প্রতিবাদ করিনি/কারণ আমি সোস্যালিস্ট ছিলাম না।/এরপর এরা এলো ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি,/কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নপন্থী ছিলাম না।/এরপর এরা এলো ইহুদিদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি,/কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না।/সবশেষ ওরা আমাকে ধরতে এলো/তখন আর আমার হয়ে প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না।’ তেমন পরিস্থিতি কাম্যকারো কাছে কাম্য হতে পারে না।


  • কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ জুলাই ৮,২০১৮