Search

Sunday, July 8, 2018

নিরাপত্তাহীনতায় আন্দোলনকারীরা

  • প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা 
  • নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আন্দোলনকারীরা
  • সপ্তাহজুড়েই হামলা চলেছে



কোটা সংস্কার নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মুক্তি চেয়েছেন হামলা-মামলা-নির্যাতন থেকে। গতকাল শনিবার সেগুনবাগিচায় ক্র্যাব মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের একজন নেতা তাঁদের দাবি-দফা উত্থাপনের পাশাপাশি কতটা নিরাপত্তাহীনতায় তাঁরা ভুগছেন সেই বর্ণনা দেন।

গত শনিবার কোটা সংস্কার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেছিল। ছাত্রলীগের হামলায় সেই সম্মেলনটি হতে পারেনি। পুরো সপ্তাহজুড়েই হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর গতকালই প্রথম সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করল।

ওই সংবাদ সম্মেলনে ৫৭ ধারায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানের বাবা-মা ও স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্র রাশেদের রাজমিস্ত্রি বাবা নবাই বিশ্বাস অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ফোনে রাশেদকে গুম করে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। তাঁকে গালমন্দ করেছেন ‘কুলাঙ্গার’ ছেলে জন্ম দেওয়ার জন্য।

কর্মসূচি আহ্বানের এত দিন পর সংবাদ সম্মেলনের কারণ জানতে চাইলে, ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র আতাউল্লাহ বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছি না। আমাদের নেতাদের প্রায় সবাই হয় কারাগারে, না হয় নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে। আমার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এখনো গায়ে জ্বর। আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ হলের আবাসিক ছাত্র। হলে ফিরতে পারছি না। জানি না সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি যে জায়গা থেকে আজ এসেছি, সেখানে ফিরতে পারব কি না।’

আতাউল্লাহ জানান, গত ৩০ জুন সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে ও পরদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হামলায় অনেকে আহত হয়েছেন। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে অনেককে। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কারও কারও। ঢাকা মেডিকেল কলেজ আহত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বের করে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওপরের নির্দেশে তাঁদের রাখা যাচ্ছে না। বেসরকারি একটি হাসপাতালও যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক ওরফে নুরুকে মাঝরাতে চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে বের করে দিয়েছে। 

মাহফুজ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নারীদের ওপর হামলা হয়েছে। থানায় ২৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর মুচলেকা দিয়ে একজন ছাত্রী বেরিয়ে এসেছেন। বেশির ভাগ নেতা কারাগারে, নয়তো নির্যাতন ও মামলার বিড়ম্বনা এড়াতে আত্মগোপনে আছেন। তাঁদের ফেসবুক পেজটি পর্যন্ত হ্যাক হয়ে গেছে। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা-কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

সরকারের উদ্দেশে আতাউল্লাহ বলেন, ‘আপনারা আমাদের ওপর যে নির্যাতন ও হামলা চালাচ্ছেন তা থেকে মুক্তি দিন।’ গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি, রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধ ও হামলায় আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার উদ্যোগ নিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

আতাউল্লাহর কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল আন্দোলনে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, অর্থায়ন ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। জবাবে তিনি বলেন, ‘১৭ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন শুরুর পর থেকে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পায়নি। কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেই আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করব। প্রজ্ঞাপন জারি না হলে আন্দোলন চলবে।’ অর্থায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিকাশ ও রকেটের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে এই আন্দোলনের জন্য অর্থ চাওয়া হয়েছিল। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীদের কেউ ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, কেউ সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঠিয়েছেন।

আতাউল্লাহ বলেন, তাঁরা কখনো কোটা বাতিল হোক তা চাননি। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্যসন্তান। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের কথা একবারও বলেননি। তাঁরা শুধু যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছেন। 

রাশেদের শর্তহীন মুক্তি ও নিরাপত্তা দাবি

গতকালকের সংবাদ সম্মেলনে রাশেদ খানের বাবা নবাই বিশ্বাস, মা সালেহা বেগম, স্ত্রী রাবেয়া আলো উপস্থিত ছিলেন। নবাই বিশ্বাস বলেন, রাশেদকে গ্রেপ্তারের আগের দিন ঝিনাইদহ ছাত্রলীগের সভাপতি রানা কয়েকজনকে তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে তাঁর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহের জন্য পাঠান। পরে তাঁকে ফোন করেন ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। সাইফুর তাঁকে বলেন, ‘আপনি কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছেন, সে তো একটা কুলাঙ্গার। ছেলেকে এসব থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন, না হলে গুম করে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, এখন তাঁকে বলা হচ্ছে তিনি রাজাকার, জামায়াত ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ছয় মাস। তিনি একজন সাধারণ মানুষ। দিনমজুরের কাজ করে যা রোজগার করেন, তা দিয়ে কোনোমতে চলেন।

রাশেদের মা সালেহা বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে আমার মণি কিছুই বলেনি। সে শুধু চাকরির জন্য দাবি করেছিল।’ রাশেদের স্ত্রী রাবেয়া বলেন, রাশেদ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আন্দোলনে যাননি। সবার জন্য গিয়েছিলেন। পরিস্থিতি এখন এমন যে আর সবাই সুবিধা পেলেও রাশেদ পাবেন না। তাঁকে শর্তহীনভাবে দ্রুত মুক্তি ও নিরাপত্তা দেওয়া হোক। রিমান্ডে নেওয়ার পর গতকাল পর্যন্ত তাঁরা রাশেদের কোনো খোঁজখবর পাননি বলে জানান তিনি।

এদিকে নবাই বিশ্বাসের এমন অভিযোগের পর সাইফুর রহমান সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন বাপ হয়ে কীভাবে মিথ্যা কথা বলে? তার সঙ্গে কোনো দিন আমার কথাই হয়নি। হুমকি দেওয়া তো দূরে থাক।’ 

কারাগারে তারেক আদনান, মাহফুজ কোথায়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র তারেক আদনান ২ জুলাই রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন। তারেকের বাবা শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিউমার্কেট, শাহবাগ ও রমনা থানা ঘুরেও তিনি ছেলেকে পাননি। পরে জানতে পারেন ছেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তারেক আদনান এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছেলে যুক্ত ছিল এ কথা তিনি জানতেন। এর বাইরে তাঁর ছেলের অন্য কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ৯ জুলাই থেকে তারেকের পরীক্ষা শুরু। যেকোনো মূল্যে ছেলের মুক্তি চান শফিকুল ইসলাম।

তারেকের খোঁজ পাওয়া গেলেও মাহফুজ এখন কোথায় সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি সাত দিন পরও। রোববার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয় দিয়ে একই মোটরসাইকেলে রাশেদ ও মাহফুজকে মিরপুরের ভাষানটেক থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাশেদ খানের স্ত্রী রাবেয়া আলো। তিনি গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রাশেদকে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয় সেদিন মাহফুজ তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। সকাল থেকেই একজন লোক তাঁদের বাসার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। এ কথা জানলে রাশেদ ভয় পেয়ে যান এবং কাছেই একটি বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে রাশেদ ও মাহফুজকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনেন কয়েকজন লোক। পরে একটি মোটরসাইকেলে করে দুজনকেই হাতকড়া দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঢাকা মহানগর পু‌লি‌শের উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান ব‌লেন, ডি‌বি রা‌শেদ খাঁন, ফাইজুর ও আতিক নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আর শাহবাগ থানা পু‌লিশ গ্রেপ্তার ক‌রে‌ছে নয়জনকে। মাহফুজ‌কে পু‌লিশ গ্রেপ্তার করে‌নি। 

ঢাকার বাইরে কর্মসূচি অব্যাহত

ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, হামলা এবং নারীদের লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রামে ঝটিকা মিছিল হয়েছে। ‘সকল সাধারণ শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম’-এর ব্যানারে হওয়া এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীরা অংশ নেন। হামলার আশঙ্কায় তাঁরা ১৫ মিনিটের মধ্যেই তাঁদের কর্মসূচি শেষ করেন।

এদিকে কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করেন। ছাত্রলীগের হামলার দ্রুত এবং সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করেন।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় জুবায়ের হোসেন (২২) নামে এক যুবককে পুলিশ কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দেওয়া ও নাশকতার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল সকালে রায়পুর উপজেলার মিতালী বাজার কামাল টেলিকম থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় বিকেলে রায়পুর থানার উপপরিদর্শক মোতাহের হোসেন বাদী হয়ে থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন।

  • কার্টসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ৮, ২০১৮ 

No comments:

Post a Comment