ইয়ামিন সাজিদ
ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তা সরবরাহ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। এরই মধ্যে পাঁচ দফা দিনক্ষণ নির্ধারণ হয়েছে। তবে প্রতিবারই পিছিয়েছে। ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে কবে নাগাদ গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে, সুনির্দিষ্ট করে তা বলতে পারছে না কেউই।
নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান উদ্যোগও বাস্তবায়ন করতে পারছে না সংস্থাটি। গভীর সমুদ্রে মাত্র একটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। যদিও থ্রিডি সিসমিক সার্ভে ও ড্রিলিং এখনো শুরু হয়নি।
উপরন্তু বিদ্যমান গ্যাসকূপ ও খনিজ সম্পদ ক্ষেত্র পরিচালনায়ও ব্যর্থ হচ্ছে পেট্রোবাংলা। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উত্তোলিত প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা গায়েব হয়ে গেছে। বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলনে প্রস্তুত হচ্ছে না নতুন কূপও। ফলে কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়ায় দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
পেট্রোবাংলার অদক্ষতাকেই এ দুরবস্থার জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সংস্থাটিতে যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে; সেই সঙ্গে রয়েছে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাবও। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে অগ্রগতি হলেও তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না পেট্রোবাংলা।
তিন মাসেও শুরু হয়নি এলএনজি সরবরাহ
বিদ্যুৎ, শিল্প, সার ও বাণিজ্যিক খাতসহ দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪১২ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে দেশীয় কূপগুলো থেকে উৎপাদন ও সরবরাহ হচ্ছে ২৮০ কোটি ঘনফুট। ফলে ১৩২ কোটি ঘনফুটের ঘাটতি থাকছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে ২০১০ সালে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি ও আরেকটির জন্য দেশীয় কোম্পানি সামিট পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালে তিন মাস আগে কাতার থেকে এলএনজি আমদানিও হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ার কথা ছিল। যদিও ভাসমান টার্মিনাল থেকে উপকূল পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণই এখনো শেষ হয়নি। সমুদ্রের তলদেশে পাইপলাইনে প্রথমে একবার ত্রুটি দেখা দেয়। সেটি মেরামত করার আগেই নতুন করে আবারো ছিদ্র ধরা পড়েছে। ফলে পঞ্চম দফায় নির্ধারিত ১৫ জুলাইও এলএনজি সরবরাহ সম্ভব হয়নি।
শুধু সমুদ্রের তলদেশের পাইপলাইন নয়, এলএনজি পরিবহনের জন্য স্থলভাগের পাইপলাইন প্রকল্পেরও একই অবস্থা। আনোয়ারা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ৪২ সেন্টিমিটার ব্যাসের ৩০ কিলোমিটার লাইনের কাজও এখনো শেষ হয়নি।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন ও মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, এলএনজি আমাদের দেশে একেবারেই নতুন একটি প্রকল্প। এছাড়া সমুদ্রের তলদেশের যে পাইপলাইন, তা নির্মাণও সহজ নয়। জোয়ার-ভাটার সময় সমুদ্রে প্রচণ্ড স্রোত থাকে। যে কারণে এক্সিলারেট এনার্জির প্রকৌশলীরা কাজের জন্য পর্যাপ্ত সময় পান না। জোয়ার-ভাটার মধ্যে স্বাভাবিক যে সময়টুকু আছে, সেই সময়ে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। সেটিও খুবই কম। এ কারণে যত দ্রুত সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত, তত দ্রুত সম্ভব হচ্ছে না।
কাতার গ্যাসের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ১৮ কোটি টন হারে এলএনজি আমদানি করবে পেট্রোবাংলা। নিজেদের সক্ষমতার অভাবে এ পরিমাণ এলএনজি ব্যবহার করতে না পারলেও চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করতে হবে পেট্রোবাংলাকে। গত ২৩ এপ্রিল কমিশনিং কার্গো বাংলাদেশে পৌঁছার মধ্যদিয়ে এলএনজি আমদানি চুক্তি কার্যকর শুরু হয়েছে। ফলে এক্সিলারেট এনার্জির সাব-সি পাইপলাইনের ত্রুটির কারণে গত তিন মাসের অব্যবহূত এলএনজির দামও পরিশোধ করতে হবে পেট্রোবাংলাকে।
পেট্রোবাংলার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতাই এ দুরবস্থার জন্য দায়ী বলে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নেতৃত্ব ও দক্ষ জনবলের অভাবেই এ অব্যবস্থাপনা। দুই বছর আগে এক্সিলারেট এনার্জিকে টেন্ডার ছাড়া কাজ দেয়া হয়। দুই বছর পরও যদি তারা কাজ শেষ করতে না পারে, তাহলে বিশেষ আইনে তাদের এ প্রকল্প দিয়ে লাভ কী হলো? এখন পর্যন্ত কয়েক দফা তারিখ পিছিয়েছে, তার পরও এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়নি। এ ব্যর্থতার জন্য সংস্থাটিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।
সমুদ্রে তেল-গ্যাস আহরণ
দেশের জ্বালানি সম্পদের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র সমুদ্রবক্ষ। ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ মীমাংসার পর পাঁচ বছর চলে গেছে। এ সময় মিয়ানমার তাদের সমুদ্র এলাকায় একাধিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ-সংলগ্ন মিয়ানমারের এডি-৭ নামের ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। কোরিয়ার কোম্পানি দাইয়ু পিএসসির অধীনে ক্ষেত্রটি থেকে গ্যাস তুলছে তারা। ওই ক্ষেত্রসংলগ্ন বাংলাদেশের একটি গ্যাস ব্লক ডিএস-১২। ক্ষেত্রটি উন্নয়নের জন্য দাইয়ুর সঙ্গে পেট্রোবাংলা উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) করেছে মাত্র। কিন্তু উন্নয়নকাজ এখনো শুরু হয়নি। মিয়ানমারের গ্যাস তোলার কাজেই বেশি ব্যস্ত তারা। এক্ষেত্রেও পেট্রোবাংলার কোনো তদারকি নেই।
এছাড়া অগভীর সমুদ্র (এসএস) ব্লক ৪, ৯ ও ১১ এবং গভীর সমুদ্র (ডিএস) ব্লক-১২-তে অনুসন্ধান চালানোর জন্য তিনটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এসব ব্লকে টুডি সিসমিক সার্ভে শেষে হলেও এখন পর্যন্ত থ্রিডি সিসমিক সার্ভে ও ড্রিলিং শুরু হয়নি। কবে নাগাদ শুরু হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান অত্যন্ত জটিল কাজ। ধাপে ধাপে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে একেকটি কূপ খনন করতে হয়। একটি কূপ খনন করতে যে অর্থ ব্যয় হয়, গ্যাস পাওয়া না গেলে সে অর্থ ফেরত আনার সুযোগ নেই। শুধু আমরা নই, শেভরনের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানেরও একই অভিজ্ঞতা। তাই জ্বালানি খাতের অর্জন বিদ্যুৎ খাতের মতো দৃশ্যমান নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র যত সহজে নির্মাণ করা হয়, একটি গ্যাসক্ষেত্র তত সহজে আবিষ্কার করা যায় না।
কয়লা জোগানে ব্যর্থ
পেট্রোবাংলা অদক্ষতার নজির সৃষ্টি করেছে কয়লা খাতেও। সংস্থাটির অব্যবস্থাপনার কারণে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উত্তোলন করে ইয়ার্ডে রাখা ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে গেছে। পাশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য মজুদ রাখা হয়েছিল ওই কয়লা। কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার পর জ্বালানি সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে ৫২৫ মেগাওয়াটক্ষমতার বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বর্তমানে দেশে কয়লা খনি রয়েছে পাঁচটি। পেট্রোবাংলা এসব খনির মালিক। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী পাশের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ওই কয়লা সরবরাহ করে পেট্রোবাংলা।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জ্বালানির জন্য বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কেন্দ্রটির তিনটি ইউনিট পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার টন কয়লার প্রয়োজন। চুক্তি অনুযায়ী, জ্বালানি নিশ্চয়তার জন্য পেট্রোবাংলাকে সবসময় এক মাসের কয়লা মজুদ রাখতে হয়।
গত ২০ জুন ঢাকায় পেট্রোবাংলা ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে কয়লা খনির এক কর্মকর্তা জানান, ১ লাখ ৮০ হাজার টন কয়লা ইয়ার্ডে মজুদ রয়েছে। বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গত সোম ও মঙ্গলবার খনি পরিদর্শন করে ৩০ হাজার টনের মতো কয়লার মজুদ পান। প্রায় দেড় লাখ টন কয়লার হদিস পাননি তারা।
- কার্টসিঃ বনিকবার্তা/ জুলাই ২৩,২০১৮
No comments:
Post a Comment