কোটা সংস্কার দাবিদারদের ওপর নিপীড়ন
কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমে শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়েছেন। এই আন্দোলন অন্যায়, অযৌক্তিক, সংবিধানবিরোধী কিংবা জনমতের বিপক্ষে এ ধরনের কথা কেউ বলেনি; বরং নাগরিক সমাজ ও সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে এর পক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ করা হয়েছে। সিভিল সার্ভিসের সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তারা এই আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি জুগিয়েছেন। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিয়ে কোটা প্রথা একেবারে বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করে সব কিছু যেন একেবারে উল্টে গেল। আন্দোলনকারীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন চড়াও হয়েছে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে মামলা। অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন, অনেকে পুলিশি রিমান্ডের পর কারাগারে গেছেন। কোনো একটি আন্দোলনের নৈতিক অবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়ার পর, সেটিকে এ ধরনের অন্যায় পদ্ধতিতে দমনের পথ বেছে নেয়া নজিরবিহীন। কেবল বাংলাদেশেই যেন এটা সম্ভব। এ ধরনের অনৈতিক অবস্থান থেকে সরকার পিছু হটলে তা মঙ্গলজনক নয়।
এ দিকে কারো কারো ওপর নেমে এসেছে নির্মম নির্যাতন। প্রথমে ছাত্রলীগের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়েছেন আন্দোলনকারীদের অনেকে। পরে পুলিশ তাদের আটক করে রিমান্ডে নিয়েছে। এরপর মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এখন জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে গ্রামের একেবারে দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাশেদসহ কয়েকজন নেতার অবস্থা করুণ।
এক গোলটেবিল আলোচনায় রাশেদের দরিদ্র মা তাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য করুণ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা প্রতিদিন ফোন করে জিজ্ঞেস করত, মা কেমন আছো? আজ কত দিন আমার বাবার মুখ থেকে এই মা ডাক শুনি না। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। আমার বাবা তো শুধু একটা চাকরি চেয়েছিল। কেন তাকে আজ এত দিন ধরে রিমান্ডে রাখা হয়েছে? প্রধানমন্ত্রীকে বলব, আমার ছেলেকে আপনারা ফিরিয়ে দিন।’ রাশেদের মা সালেহা বেগম এসব কথা বলে কাঁদলেন, কাঁদালেন অন্যদের।
সালেহা বেগম আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটাই আবেদন, আমার সন্তানকে আমি ভিক্ষা চাই। তারে পেলে আমি গ্রামে চলে যাবো। আমার মনির (রাশেদের) আর চাকরির দরকার নেই। আমার মনিরে যেন রিমান্ড থেকে মুক্তি করে দেয়। আমার সন্তানকে বাঁচান।’ রাশেদের মা জানান, তার স্বামী রাজমিস্ত্রি। তার কিডনি রোগ রয়েছে। তিনি বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার চালান। কী কারণে এমন একজনকে রাষ্ট্র নিপীড়ন করবে, তার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্য দিকে প্রবাসে অধ্যয়নরত বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
বিভিন্ন দেশে অধ্যয়নরত ৬২ শিক্ষার্থী এক বিবৃতিতে বলেন, কোটা সংস্কারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। তারা বলেন, এমন দমনপীড়নের ঘটনা দিয়ে আমরা বহির্বিশ্বে পরিচিত হতে চাই না। পূর্বঘোষিত আন্দোলনে দমনপীড়নের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। তাদের মতে, ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কোটা সংস্কার যৌক্তিক একটি দাবি। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনেককে পুলিশ গ্রেফতার ও হয়রানি করছে। এমনকি নেতাদের রিমান্ডে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিপীড়িত হয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রত্যেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের নিরাপদ আশ্রয়। শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে ক্যাম্পাসে দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা জরুরি। আমরা সরকারকে চলমান সঙ্কট দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানাই।
আন্দোলনকারীদের দুরবস্থার মধ্যে নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার কর্মী ও সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে যতটা প্রতিবাদ আসা দরকার ছিল, সেটি দেখা যায়নি। আমরা মনে করি, এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ দরকার। তার চেয়ে বড় বেশি প্রয়োজন সরকারের নৈতিক অবস্থান সমুন্নত করা। সরকার একটি আন্দোলনের ন্যায্যতা স্বীকার করে নিয়ে কিভাবে পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকারীদের ওপর খড়গহস্ত হতে পারে? এ অবস্থা দ্রুত শুধরানো দরকার।
- Courtesy: NayaDiganta /Editorial/ Jul 16, 2018
No comments:
Post a Comment