বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় নিয়ে বণিক বার্তায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংক পরিচালনার ব্যয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যয়ের যে তফাত তুলে ধরা হয়েছে, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। দেখা যাচ্ছে, যেখানে অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলোর আয়ের বড় অংশ যাচ্ছে নিট মুনাফা হিসেবে, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর বড় ব্যয় পরিচালন খাতে। অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশে পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক নীতি ও মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত ব্যাংকিং। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত খাত। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি আর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারকে জনগণের করের টাকা দিতে হচ্ছে। এবারের বাজেটেও এজন্য বরাদ্দ রয়েছে। এসব মিলিয়ে দেশের মানুষের আস্থা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংকিং খাত। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাতের পরিচালন ব্যয় নিয়ে যে চিত্র সামনে এসেছে, তাতে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়িক উন্নতির দিকে কতটুকু মনোযোগী, সেটা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে।
এর আগেও ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। অথচ পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকেরই কাজের একটি অংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের মাসিক বেতন-ভাতা ব্যাংক বিশেষে মাসে ৮ থেকে ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া শাখা প্রতিষ্ঠা ও ব্যয় নির্বাহেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। দেশে ব্যাংকের তুলনায় দক্ষ এমডির সংখ্যা কম। এতে স্বাভাবিকভাবেই দক্ষদের চাহিদা থাকে, ফলে বেতন বাড়ে। এর প্রভাব পড়ে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয়ের ওপর। এমডিসহ কর্মীদের বেতন নির্ধারণে ব্যাংকের সম্পদ ও মূলধন বিবেচ্য হওয়া উচিত। আর গ্রাহকসেবার জন্য ব্যাংক শাখায় প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করা ব্যতীত অতিরিক্ত সাজসজ্জার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার পেছনে খেলাপি ঋণও বড় একটি কারণ। খেলাপি ঋণের হার বেশি হওয়ায় ব্যাংককে সঞ্চিতি সংরক্ষণের জন্য পরিচালন মুনাফার বড় একটি অংশ রেখে দিতে হচ্ছে। খেলাপি ঋণ সমস্যা সমাধানে ব্যাংক ও সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার জন্য করপোরেট ট্যাক্সের উচ্চহারকেও দায়ী করছেন ব্যাংকাররা। তবে এবারের বাজেটে ব্যাংকিং খাতে আড়াই শতাংশীয় পয়েন্ট করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। এতে পরিচালন ব্যয় কমে যাওয়ার কথা। আবার প্রযুক্তিগত উন্নতির জন্য ব্যয় বাড়লে অন্য খাতে কমানোর মাধ্যমে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ায় এর প্রভাব গ্রাহকদের ওপর পড়ছে। ব্যয়কৃত অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করতে গিয়ে ব্যাংক আমানতকারীদের সুদের হার কমিয়ে ঋণ গ্রহণকারীদের সুদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে গ্রাহকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক ফি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা দেখছি, সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিলেও অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয়ের কারণে সুদের হারও কমাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ১ জুলাই থেকে ঋণ বিতরণে সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও অধিকাংশ ব্যাংক এটি কার্যকর করতে পারেনি।
পরিচালন ব্যয় কমাতে হলে ব্যাংকগুলোকেই এ ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। যথাসম্ভব অপব্যয় কমাতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনতে পারলে ব্যাংকের মুনাফা বাড়বে। ব্যাংকগুলো স্বল্প সুদে গ্রাহকদের ঋণ ও আমানতকারীদের বেশি সুদ দিতে পারবে, এতে দেশের ব্যাংকিং খাতেরই কল্যাণ হবে।
- কার্টসিঃ বনিকবার্তা/ জুলাই ৩০,২০১৮
No comments:
Post a Comment