ঢাকার যানজট নিরসনে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার সাড়ে তিন বছর পার হলেও এতে অন্তর্ভুক্ত সাত পরিকল্পনার পাঁচটিই এখনো কাগজে-কলমে। যেসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের গতি ধীর হওয়ায় জনদুর্ভোগও বাড়ছে। ব্যস্ত সড়কগুলোয় মেট্রোরেল, বিআরটির মতো প্রকল্পের কাজ শুরু হলে মানুষ যেন বিকল্প হিসেবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারে, সেটিই ছিল উদ্দেশ্য। সাত বছরেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ করা যায়নি। এ কারণে মেট্রোরেল নির্মাণকে ঘিরে মিরপুর এলাকার মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। পরিবহন সংকট ও তীব্র যানজট রাজধানীবাসীর অন্যতম নাগরিক সমস্যা। এ সমস্যা মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ছাড়াও জন্ম দিচ্ছে আরো অনেক সমস্যার। এতে নাগরিকদের মূল্যবান শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যানজটের ক্ষতি এরই মধ্যে বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জ্বালানি অপচয় বাড়ছে। বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক, রাজধানী ঢাকা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সমন্বিত পদক্ষেপের বাস্তবায়ন ছাড়া এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের আর কোনো পথ নেই। প্রকৃতপক্ষে এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় এর মাশুল দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
আরএসটিপির কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। নগরবাসী স্বচক্ষেই তা দেখছে। রাজধানীতে কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ ও কয়েকটি প্রধান সড়ক রিকশামুক্ত করা ছাড়া আর কোনো অগ্রগতি নেই। বৃত্তাকার নৌপথ চালু হলেও তা স্থায়ী রূপ পায়নি। মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বটে, তবে এসব কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে, কে জানে। ফুটপাত দখলমুক্ত করার মতো সামান্য কাজটিও করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বস্তুত মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের বিষয়গুলো বরাবর উপেক্ষিত হয়েই এসেছে। রাজধানীতে গণপরিবহন সংকট তীব্র। অথচ এ থেকে উত্তরণে সরকারের উদ্যোগ অত্যন্ত সীমিত। বিদ্যমান গণপরিবহন খাতে নৈরাজ্যের কারণে নগরবাসীর ভোগান্তির শেষ নেই। এ খাতেও রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কর্তৃত্ব। ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ২০০৯ সালে এসটিপির আওতায় বিআরএফ অর্থাৎ একটি রুটে একটি কোম্পানির উন্নতমানের বাস ব্যবস্থা চালু করা হলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রাজধানীতে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ হলেও যানজট কমেনি। অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপেও এ অবস্থার তেমন পরিবর্তন হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা।
২০১৫-৩৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও বাস্তবায়নে নেই সরকারের কার্যকর উদ্যোগ। এসটিপি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, এ পরিকল্পনা শুধুই কাগজপত্রে। ফলে সরকারের এমন একটি সুন্দর সময়োপযোগী পরিকল্পনা যেন আঁতুড়ঘরেই মারা যাওয়ার পথে। কারণ এসটিপিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি যেসব কার্যক্রম বা প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের প্রস্তাব রাখা হয়, এর মধ্যে দুটি ব্যতীত আর কোনোটি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কাজই শুরু করা যায়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, কাজ শুরু করতে গেলে প্রাথমিক যেসব কাজ জরুরি, যেমন— প্রাক-সমীক্ষা, চূড়ান্ত সমীক্ষা; সেগুলো শুরু করা যায়নি। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে আরএসটিপি প্রণয়নকারী সংস্থায় দক্ষ, যোগ্য ও প্রয়োজনীয় জনবল নেই।
ঢাকার যানজট নিরসনে বহু অর্থ ও সময় ব্যয়ে একাধিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও বাস্তবায়নের অভাবে তা কোনো ফলই বয়ে আনেনি ঢাকাবাসীর জন্য। বরং সমন্বয়হীনতা ও এসটিপির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু প্রকল্প গ্রহণ করায় প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। আরএসটিপি বাস্তবায়নে অর্থায়নও কম বড় সমস্যা নয়। বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের অর্থছাড়ও পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে বৈকি। ২০২০ সালে শেষ হবে আরএসটিপির স্বল্পমেয়াদি সময়। এ সময়েও যদি অধিকাংশ প্রকল্প আলোর মুখ না দেখে, তাহলে সেটি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।
- কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ জুলাই ১৯,২০১৮
No comments:
Post a Comment