এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে
১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে গেছে বলে খবর প্রকাশের পরই দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেল। দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তৃতীয় ইউনিট বন্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পুরো উৎপাদনই বন্ধ হলো। এটা একটা বড় দুঃসংবাদ, কারণ এর ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে এবং জাতীয় গ্রিডেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত কয়লার মজুত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। অন্যথায় বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতে পারে না। কিন্তু বড়পুকুরিয়ার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে, অথচ সংকট দূর করার কার্যকর উদ্যোগ যথাসময়ে নেওয়া হয়নি। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে গত ১৪ জুন কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেছে; এরপর উত্তোলন শুরু হবে আগস্টের শেষে। এই সময়ের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে উদ্বৃত্ত কয়লা মজুত থাকার কথা, কিন্তু দেখা গেল তা নেই।
খনি কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০০৫ সালে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে কয়লা তোলা শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ১০ লাখ টন কয়লা তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের বরাতেই এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। তারা এ পরিমাণ কয়লার হিসাবের গরমিলকে বলছে ‘সিস্টেম লস’। এই খনির নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ পেট্রোবাংলা; তারা এত দিন এদিকে যথেষ্ট নজর রাখেনি। কয়লা গায়েব কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করা হয়েছে এবং মহাব্যবস্থাপককে বদলি করা হয়েছে।
খনি থেকে তোলা কয়লার হিসাব রাখা একটি নিয়মিত দায়িত্বের বিষয়। ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা রাতারাতি গায়েব হয়ে যায়নি, যেতে পারে না। প্রতিনিয়ত চুরি হয়েছে। নিয়মিত হিসাব রাখা হলে অনেক আগেই তা ধরা পড়ত। খনি কর্তৃপক্ষ যেমন এর দায়দায়িত্ব এড়াতে পারে না, তেমনি তার তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলারও দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। তদন্ত করে দেখা দরকার, কী প্রক্রিয়ায় কাদের দ্বারা এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে; এই চুরি সেখানকার একটা স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে কি না। ডিলারদের কাছে কয়লা বিক্রির প্রক্রিয়া কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, তা খতিয়ে দেখে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। শুধু দায়িত্ব থেকে অপসারণ ও বদলি যথাযথ প্রতিবিধান নয়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার মজুত নিশ্চিত করার পরই শুধু উদ্বৃত্ত কয়লা বিক্রি করা যায়। এদিকে কতটা দৃষ্টি রাখা হয়, তা আমাদের জানা নেই। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াতে হবে, দায়িত্বশীলতা ও সততা নিশ্চিত করতে হবে, সে জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়লা উত্তোলন যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সেই সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে, এই খনির প্রাথমিক কর্তব্য তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত পরিমাণ কয়লা উৎপাদন ও সরবরাহ করা। খনির সার্বিক তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীলতাও নিশ্চিত করা দরকার।
তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে, এটা মোটেই ভালো কথা নয়। আর কয়লাই যেহেতু এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একমাত্র জ্বালানি, সেহেতু পর্যাপ্ত কয়লার নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তাদেরও খনি কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দেওয়া উচিত।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সম্পাদকীয়/জুলাই ২৫,২০১৮
No comments:
Post a Comment