Search

Sunday, July 22, 2018

সিন্ডিকেটের কব্জায় ১৩৫৩ কোটি টাকার প্রকল্প

নূর মোহাম্মদ 

সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভুক্ত ১৩৫৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, মডেম ও সাউন্ডবক্সসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করার কথা। ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা প্রচলন’ ২য় শীর্ষক প্রকল্পটি নিজেদের চাহিদামতো কাজ বাগিয়ে নিতে না পারায় পুরো প্রকল্পটি আটকে দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। এতে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ১৪৬ কোটি ৪২ লাখ টাকার প্রায় পুরোটাই অব্যয়িত অবস্থায় ফেরত গেছে। আর ২ মাস যাবত প্রকল্পটি কার্যত স্থবির হয়ে আছে, ১৮ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী কোনো কার্যক্রম ছাড়াই অলস সময় পার করছেন। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পে শুরু থেকেই একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ তৎপর ছিল।

তাদের কথামতো কাজ করতে না পারায় প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তারা। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করে। কমিটি প্রতিবেদন দেয়ার আগেই প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেয়া হয়। তদন্তে তার বিরুদ্ধে আর্থিক কোনো দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়ার পরও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। বিষয়টি এখন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের টেবিলে আছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, একটি তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে এটা জানি। তবে সেখানে কি আছে তা আমার জানা নেই। তবে প্রকল্পের গতি বাড়াতে দ্রত পিডির বিষয়টি সমাধান করা হচ্ছে। আগের পিডি থাকবেন না নতুন পিডি নিয়োগ দেয়া হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দ্রুত সময়ই পিডি দেয়া হবে সেটা বলতে পারবো। কাকে দেয়া হবে সেটি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত।  

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের তিন হাজার ৩৪০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪৬০০০ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং ২৫০০টি স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপনসহ ৫ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তাকে আইসিটি বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৩৫৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মডেম ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। 

এই প্রকল্পের কাজ পেতে সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করছিল। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘টেসিস’ ও বাংলাদেশ নৌ বাহিনী ‘ডকইয়ার্ড’ নামে প্রতিষ্ঠান কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরম্যান্ট মেথড) পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য চিঠি দেয়। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা জায়গা থেকে ডিপিএম পদ্ধতিতে দরপত্র দেয়া জন্য চাপ দিতে থাকে। কেনাকাটা কোন পদ্ধতিতে হবে তা জানতে প্রকল্প পরিচালক মন্ত্রণালয়ের মতামত চান। এরপর ১৬ই জানুয়ারি অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ও ১১ই এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনের নেতৃত্বে বৈঠকে ডিপিএম নয়, সরকারি ক্রয় নীতি (পিপিআর) অনুসরণ করে উন্মক্ত পদ্ধতি ই-জিপিতে দরপত্র করার সিদ্ধান্ত হয়।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় প্রথম কিস্তিতে গত এপ্রিলে প্রায় ১৪ হাজার মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর কেনার জন্য ই-জিপিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু প্রজেক্টরের উন্নতমানের স্পেসিফিকেশ এবং প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজসহ প্রতিষ্ঠানে ইনস্টলেশনের শর্ত দেয়া হয়। এটি সিন্ডিকেটের লুটপাটের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। স্মার্ট টেকনোলজিসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। দরপত্র খোলার আরো ১৭ দিন পর তারা প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির কাছে। অভিযোগে দরপত্রে ‘সিমিলার প্রডাক্ট’ শব্দ দুটির পরিবর্তে ‘মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এন্ড সিমিলার প্রডাক্ট’ শব্দ ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করেন মর্মে দাবি করেন তারা। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্ট এন্ড কম্পিউটার অনলি যোগ করে দরপত্র আহ্বান করেছেন। তাদের অভিযোগ, এ শর্তের ফলে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানই এ কাজ করতে পারবেন। ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১০ই জুন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

একই দিনে পিডিকে ওএসডি করে মাউশিতে পদায়ন করা হয়। কমিটি ১৯শে জুন ১৩টি পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে কোথাও পিডি অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন মর্মে মন্তব্য করেনি। তারপরও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মাউশি উদ্যোগী হয়েছেন। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির সদস্য ও মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে যতটুকু ভূমিকা রাখার দরকার তাই রেখেছি। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।  

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, একটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সরকারি একটি সংস্থার মাধ্যমে মাউশি অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে ডিপিএম পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে, যা সরকারি ক্রয় নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এ প্রকল্পেও এ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সরকারি একটি সংস্থার মাধ্যমে কম্পিউটার, ল্যাপটপ সরবরাহের প্রস্তাব করে। প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয় অনুমোদন না করায় তারা ভিন্ন পন্থায় তৎপরতা অব্যাহত রাখে এবং প্রজেক্টরের দরপত্র বাতিল করে ডিপিএম পদ্ধতিতে কম্পিউটার, ল্যাপটপ সরবরাহ করার জন্য প্রকল্প পরিচালককে চাপ দিতে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকেও ব্লাকমেইল করে দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। 

জানা গেছে, সাতটি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে প্রাথমিক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে থাকে। কিছুদিন আগে ২০০ কোটি টাকার একটি কাজ তারা সিন্ডিকেট করে বাগিয়ে নিয়েছে। এটি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলেও আমলে নেয়নি মাউশি বা মন্ত্রণালয়। 

মন্ত্রণালয় উন্নয়ন শাখার সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগে প্রতিটি প্রজেক্টরের মূল্য ৬০ হাজার টাকা করে কেনা সম্ভব। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, কোনো ধরনের অন্যায় আমি করেনি। শুধু সিন্ডিকেটে কথা শুনিনি। এটাই আমার কাল হয়েছে। তিনি বলেন, তারা ৬০ হাজার টাকায় মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্ট দেয়ার যে কথা বলেছে তা বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যই। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, বর্তমান দরপত্রের নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন ও অন্যান্য শর্ত বহাল রেখে কোনো প্রতিষ্ঠান ৬০ হাজার টাকা দরে ব্রান্ডেড প্রজেক্টর সরবরাহে সম্মত না হলে সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটকে ৬০ হাজার টাকা দরে প্রজেক্টর সরবরাহে বাধ্য করা অন্যথায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তার দাবি, প্রকল্পের আওতায় ইন্টারনেট মডেম ও সিম কেনার ৪ কোটি ৭ লাখ টাকার চারটি প্যাকেজের দরপত্রে ৫৮ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে এবং ৪ কোটি ৭ লাখ টাকার ডাটা প্যাকেজ বিনামূল্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। 

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/ জুলাই ২২,২০১৮ 

No comments:

Post a Comment