রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ড তাঁদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ কিংবা ন্যায্য মজুরি নির্ধারণে সফল হবে, সেই সম্ভাবনা এখনো উজ্জ্বল নয়। মালিকপক্ষ পাঁচ বছর পরে এবং আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিম্নতম মজুরি বিদ্যমান ৫ হাজার ৩০০ থেকে মাত্র ৬ হাজার ৩৬০ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দিচ্ছে। তাদের এ অবস্থান নির্দেশ করে শ্রমিকদের দর-কষাকষি করার ক্ষমতা কতটা ভঙ্গুর। কিন্তু তাঁদের কর্মশক্তি ও উৎপাদনশীলতায় কোনো ধস নেই। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের হিস্যা পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগতভাবে বেড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এই কৃতিত্বের গর্বিত অংশীদার তাঁরাও। ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা বলে তার কোনো নেতিবাচক প্রভাব পোশাক উৎপাদনে পড়েছে বলে মালিকপক্ষ কখনো অভিযোগ তুলতে পারেনি।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পকে সরাসরি চাপ মোকাবিলা করতে হয়, রানা প্লাজার বিয়োগান্ত অধ্যায়ের পর গঠিত অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্স দীর্ঘদিন বাংলাদেশে কাজ করলেও তারা বোধগম্য কারণেই শ্রমিকের মজুরির বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারেনি। ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন বা ইন্ডাস্ট্রিঅলের মতো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে সোচ্চার হলেও বাংলাদেশে সরাসরি তারা কোনো কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারছে না। সুতরাং বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের চাপ দিয়ে সুবিধা আদায়ের পর্যায়ে সব অর্থে সরকারই ভরসা।
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা করতে একটা ঐকমত্যে পৌঁছালেও তারা এই দাবি আদায়ে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার জায়গায় নেই। কেউ এটা আশা করবে না যে ন্যূনতম মজুরি বাড়াতে গিয়ে পোশাক খাত কোনোভাবে অসন্তোষ বা উদ্বেগের মধ্যে পড়ে। দীর্ঘদিন আমরা এই খাতকে একটি স্থিতিশীল অবস্থা পার করতে দেখছি। সবাই আশা করবেন, ন্যূনতম মজুরি এমনভাবে নির্দিষ্ট হওয়া উচিত, যাতে মালিকপক্ষ অহেতুক কোনো চাপের মধ্যে না পড়ে, আবার শ্রমিকেরা যাতে জীবনধারণের উপযোগী মজুরি ভোগ করতে পারেন। এই ভারসাম্য নিশ্চিত করতে উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সম্ভবত কোনো বিকল্প নেই।
শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধির কণ্ঠে ইতিমধ্যে আকস্মিকভাবে ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়ার কথা প্রকাশ পেয়েছে। যদিও সব শ্রমিক সংগঠনই হয়তো জানে যে এই ১২ হাজার টাকা হলেও তারা বর্তে যাবে। ২০১৩ সালে শ্রমিক প্রতিনিধি ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ১১৪ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। ১২টি শ্রমিক সংগঠনের জোট ছয় সদস্যের একটি শ্রমিক পরিবারের মাসিক খরচ ২৮ হাজার ৮২০ টাকা দেখিয়েছে। এর মধ্যে খাবার ব্যয়ই ১৯ হাজার টাকার বেশি। আবার আট ঘণ্টা কাজের জন্য ২ হাজার ৮৮০ ক্যালরি দরকার পড়লেও ওই টাকায় ক্যালরির সবটা পূরণ হয় না, ঘাটতি পড়ে। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি এবং অন্যান্য দিক বিবেচনায় আগামী পাঁচ বছরের জন্য ন্যূনতম মজুরি উপযুক্ত পরিমাণে না হলে তা শ্রমিকদের জীবনযাপনকে এক দুঃসহ অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।
এটা বিশ্বাস করার কারণ আছে যে সরকার পাশে না দাঁড়ালে মজুরি বোর্ডের শ্রমিক প্রতিনিধির পক্ষে কোনো কার্যকর দর-কষাকষিতে অংশ নিয়ে মালিকপক্ষকে কোনো কিছু মানাতে বাধ্য করা বাস্তবসম্মত কোনো পরিকল্পনা নয়। খোদ শ্রমিক প্রতিনিধি কার্যত স্বীকার করেছেন, শুধু শ্রমিকপক্ষ নয়, তিনি যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তার কথাও তাঁর শুনতে হবে। সুতরাং কিসে শ্রমিকেরা বাঁচবেন, তা সরকারকেই সবচেয়ে ভালো বুঝতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনায় নেবেন যে এবার শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করতে পারলে আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচনে তাঁরা সুফল আশা করতে পারেন।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ সম্পাদকীয়/ জুলাই ২১, ২০১৮
No comments:
Post a Comment