দেশের এক গুদাম থেকে আরেক গুদামে খাদ্যপণ্য পৌঁছাতে বড়জোর দুই সপ্তাহ লাগে। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সরকারি গুদামের হাজার হাজার টন ধান, চাল ও গম এক গুদাম থেকে আরেক গুদামে পাঠানোর পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ২৭ বছরেও গন্তব্যে পৌঁছেনি।
তাহলে রাস্তা থেকে এসব খাদ্যপণ্য যায় কোথায়? জানা গেছে, গত ২৭ বছরে পরিবহনের সময় ৪০-৫০ হাজার টন খাদ্যপণ্য উধাও হয়ে গেছে। দীর্ঘদিনেও এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে পৌঁছেনি ওইসব খাদ্যপণ্যের চালান। বছরের পর বছর সংশ্নিষ্ট গুদামের নথিপত্রে সেগুলো চলাচলরত (পথ খাতে) দেখানো হলেও বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।
সূত্র জানায়, দেশের খাদ্যগুদামগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যোগসাজশ করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে খাদ্যপণ্য আত্মসাৎ করছেন। আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণও রয়েছে সরকারের হাতে। খাদ্য বিভাগের অবহেলা ও উদাসীনতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকট মোকাবেলায় মজুদ করা খাদ্যসামগ্রী লোপাট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে খাদ্যপণ্য আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এরপরও মজুদ, পরিবহন ও সংরক্ষণে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, হিসাব রক্ষায় ডিজিটাইজড পদ্ধতি চালু ও নিরাপত্তায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
সচিবালয় সংলগ্ন খাদ্য অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে মহাপরিচালক মো. আরিফুর রহমান অপুর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি বিভিন্ন সময়ে গুদাম থেকে ও পরিবহনের সময় খাদ্যপণ্য উধাও হওয়ার ঘটনা স্বীকার করেন। তিনি সমকালকে বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ৪০-৫০ হাজার টন খাদ্যপণ্যের হিসাব কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই। সেগুলো কোথায়, কার কাছে গেছে তা খুঁজে বের করার কাজ চলছে। যাদের বিরুদ্ধে সরকারি খাদ্যপণ্য আত্মসাতের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এতে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুদাম থেকে ধান, চাল ও গমের চালান বের হওয়ার নথিপত্র রয়েছে। তবে চালানগুলো অন্য গুদামে গ্রহণ করার প্রমাণ নেই। খাদ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী কিছু চালান ২৭ বছর, কিছু চালান ২০ বছর, কিছু চালান ১৫ কিংবা ১০ বছর ধরে চলাচলের মধ্যে রয়েছে। অধিদপ্তরের এই হিসাব অবিশ্বাস্য, অস্বাভাবিক। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, চলাচলে আটকে থাকার কথা বলা হলেও ওইসব খাদ্যপণ্য বাস্তবে নেই। ১৯৯১ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ২৭ বছরে ৪০-৫০ হাজার টন খাদ্য রাস্তা থেকে উধাও হয়েছে। ওই খাদ্যসামগ্রী কখন, কোথায়, কার কাছে গেছে তার কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে।
রাস্তা থেকে ওইসব খাদ্যপণ্য কোথায়, কার কাছে গেল- তা খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক পরিচালক ফরিদুর রহমানের নেতৃত্বে বিশেষ একটি টিম ২০০৭ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ১১ বছরের চলাচলের হিসাব অনুসন্ধান করছে।
এ বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, দুদক চাইলে তারও আগের ১০ বা ১৬ বছরের হিসাব অনুসন্ধান করতে পারে। দুদকের অনুসন্ধানে অধিদপ্তর থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। এ-সংক্রান্ত যা যা নথিপত্র চাওয়া হবে তা সরবরাহ করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক পদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এক গুদাম থেকে আরেক গুদামে খাদ্যপণ্য না পৌঁছিয়ে সেগুলো আত্মসাৎ করা হয়েছে। রেকর্ডপত্র অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট ঠিকাদারদের খুঁজে বের করা হবে। উধাও হওয়া ওইসব পণ্যের চালান পাঠানোর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও অভিযোগের আওতায় আনা হবে। সংশ্নিষ্ট ঠিকাদার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যাদের বিরুদ্ধে খাদ্যপণ্য আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, খাদ্যপণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত কতিপয় ঠিকাদার, খাদ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন গুদামের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী আঁতাত করে এসব খাদ্যপণ্য আত্মসাৎ করেছেন। ঠিকাদাররা গুদাম থেকে খাদ্যের চালান নিয়ে তা খোলাবাজারে বিক্রি করেছেন। ফলে ওইসব খাদ্যপণ্য যেসব গুদামে পৌঁছানোর কথা ছিল সেখানে পৌঁছায়নি।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মূলত সড়ক, রেল ও নৌপথে দেশের এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে ধান, চাল ও গম পরিবহন করা হয়। পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী পরিবহন করা হয়। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একটি চালান পৌঁছাতে এক সপ্তাহ বা বড়জোর দুই সপ্তাহ সময় লাগে। ফলে ২৭, ২০, ১৫ কিংবা ১০ বছরেও তা গন্তব্যে না পৌঁছানো অস্বাভাবিক।
দুদক সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ায় সংশ্নিষ্ট শাখা বা বিভাগ থেকে কোনো কোনো কর্মকর্তা অবসরেও গেছেন। তবে উধাও হওয়া ওইসব চালানের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
খাদ্য অধিদপ্তরের চলাচল সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগের পরিচালক চিত্তরঞ্জন বেপারি সমকালকে বলেন, চলাচলে আটকে থাকা খাদ্যপণ্যের হিসাব বের করা, গুদাম ও খাদ্য পরিবহনের সব ধরনের কার্যক্রম ডিজিটাইজড করতে ২০১৪ সালে টেকনো হেভেন কনসোর্টিয়াম নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। গত ৩০ জুনের মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল। কাজটি শেষ করতে না পারায় তারা সময় বাড়িয়ে নিয়েছে।
জানা গেছে, টেকনো হেভেন খাদ্য পরিবহনের সব ধরনের কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় আনার বিশেষ সফটওয়্যার জমা দেবে। এরপর থেকে পরিবহন, সংরক্ষণের কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় চলবে। তখন খুব সহজেই মজুদ, চালান প্রদান, চলাচল, গ্রহণের আপডেট তথ্য পাওয়া যাবে।
অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, গুদামে খাদ্য মজুদ ও চলাচলের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কিছু ঘাটতির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত এক আদেশে বলা হয়, চাল, গম গুদামে ছয় মাস মজুদ রাখার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ, একই সময় পর্যন্ত ধান মজুদের ক্ষেত্রে দশমিক ৭৫ শতাংশ ঘাটতির হিসাব স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হবে। একই সঙ্গে খাদ্যপণ্য চলাচলের ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ১২৫ শতাংশ ঘাটতি মেনে নেওয়া হয়।
অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত মে মাস পর্যন্ত ১২১ টন ধান ও ৮৭ হাজার ৬৪০ টন গম চলাচল অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ ৩০ মে পর্যন্ত ওই পরিমাণ মালামালের চালান সংশ্নিষ্ট গুদামে পৌঁছায়নি। এ সময় বেশ আগের চালানের ২০ হাজার ১৯ টন অতিরিক্ত চাল পৌঁছেছে বিভিন্ন গুদামে। তবে বছরের পর বছর ধরে 'চলাচলে আটকে থাকা' ৪০-৫০ হাজার টন খাদ্যপণ্য রাস্তা থেকে কখনও গুদামে পৌঁছবে কি-না- সংশ্নিষ্ট কেউ তা স্পষ্টভাবে বলতে পারছেন না।
খাদ্য গুদামে সাম্প্রতিক লুটপাটের চিত্র
বস্তায় কম চাল : ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল রাজধানীর তেজগাঁওয়ের খাদ্য গুদামে অভিযান চালিয়ে ট্রাকভর্তি বস্তার চাল মেপে পরিমাণ কম পায়। ৩০ কেজির বস্তায় ছিল ১২, ১৪ ও ১৬ কেজি। ঢাকা-৪ আসনের সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপির পানিবন্দি মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৩০ টন চাল গুদাম থেকে সরবরাহ করা হচ্ছিল। পুরো চাল মেপে সাড়ে ২০ টন পাওয়া গিয়েছিল।
একই সময়ে গুদামের নথিপত্র যাচাই করে ঢাকা জেলা আনসারকে ২৫৮ টন চাল সরবরাহের তথ্য পাওয়া যায়। ম্যাজিস্ট্রেট ওই সময় আনসার কমান্ডার মো. আমিন উদ্দিনকে ফোন করে তিনি কী পরিমাণ চাল পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি ৭৫ টন চাল পাওয়ার কথা জানান।
চট্টগ্রামের গুদাম থেকে ২ হাজার টন চাল-গম উধাও : ২০১৭ সালের ২০ জুলাই চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাটের গুদাম থেকে ২ হাজার টনেরও বেশি চাল-গম উধাও হয়েছিল। সরকারি ডিও (ডিমান্ড অর্ডার) ছাড়া ভুয়া কাগজপত্রে ছাড় করিয়ে ওই পরিমাণ চাল খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় সহকারী ম্যানেজার ফখরুল আলম মানিকসহ চারজনকে আসামি করে হালিশহর থানায় একটি মামলা হয়।
চালের বদলে বস্তাভর্তি তুষ, মাটি, বালি, কয়লা : ২০১৩ সালের ২১ অক্টোবর খাদ্য বিভাগের এক তদন্তে দেশের পাঁচ জেলার গুদামে বস্তাভর্তি তুষ, মাটি, বালি ও কয়লা পাওয়া যায়। অথচ গুদামের কাগজপত্রে সেগুলোতে চাল দেখানো হয়। এভাবে আত্মসাৎ করা হয় ৭৬০ টন চাল। ওই সময় এই চালের বাজার মূল্য ছিল প্রায় চার কোটি টাকা। সে সময় তদন্তকালে বেশ কয়েকটি জেলার গুদামে কাগজপত্রের হিসাবে ও প্রকৃত মজুদে গরমিল পাওয়া যায়।
নারায়ণগঞ্জের গুদাম থেকে চাল আত্মসাৎ : গত জুনে নারায়ণগঞ্জ বন্দর সংলগ্ন গুদাম থেকে প্রায় ১০০ (৯৯.৮৮) টন চাল আত্মসাৎ করা হয়। এ ঘটনায় দুদক উপপরিচালক একরামুর রেজা বাদী হয়ে ৫ জুন গুদামের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করে বন্দর থানায় মামলা করেন।
কিশোরগঞ্জে চাল আত্মসাতের : সরকারি চাল আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সাবেক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুল জলিল ও গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী হাসিবুল হাসানকে গ্রেফতার করে দুদক। ২০১২ সালে গুদামের ৬০ টন চাল আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তখন ওই চালের বাজারমূল্য ছিল ২০ লাখ ২২ হাজার টাকা।
কুমিল্লায় ৭ কোটি টাকার চাল আত্মসাৎ : গত বছরের জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত তিন বছরে কয়েকটি ধাপে কুমিল্লার দৌলতগঞ্জ খাদ্য গুদাম থেকে ১ হাজার ৮০০ টন চাল আত্মসাৎ করা হয়। তখন ওই চালের বাজারমূল্য ছিল প্রায় সাত কোটি টাকা। এই অপরাধের তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও 'শাস্তি' হিসেবে তৎকালীন কুমিল্লা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মামুনুর রশীদকে কিশোরগঞ্জে বদলি করা হয়েছিল। লাকসাম থানা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সালমা বেগমকে বদলি করা হয়েছিল চাঁদপুর গুদামে।
- কার্টসিঃ সমকাল/জুলাই ১৭,২০১৮
No comments:
Post a Comment